এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ১৫

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৫
‘ তো বলুন! এআরকে’র কাছে আপানর কি দরকার মি.অপূর্ব হাসান?’

আনভীরের আগ্রাসী কন্ঠে দৃষ্টি প্রগাঢ় হলো অপূর্বের। বিক্ষিপ্ত চোখজোড়া আনমনেই বিচরণ করে চললো সামনে বসা এই রহস্যময় মানুষটির দিকে। অপূর্ব হাসলো কিঞ্চিত। ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,

‘ কেন আপনি জানেন না?’

আনভীর যেন বাকিয়ে কথা বলার আরও সুযোগ পেয়ে গেলো এতে। অবুঝ হওয়ার ভান করে বলে উঠলো,

‘ উমমম, যতটুকু আমার মনে পড়ে আপনি এ পর্যন্ত একবারও বলেননি যে আপনি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। তো আমি জানবো কিভাবে বলুন তো!’

অপ্রতিভ হয়ে পড়লো অপূর্ব। চোখের নজর এখনও সরায়নি আনভীরের কাছ থেকে।আনভীরের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতে কালো সানগ্লাসটি নিয়ে আনমনে খেলা করে চললো সে। কপালের সিল্কি চুলগুলো এই মানুষটিকে আরও যেন সুদর্শন করে তুলেছে। অপূর্ব এবার বলে ওঠলো,

‘ আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি এআরকে। তাই সরাসরিই কথা বলছি, কেন আমার পিছে পড়েছেন?’

আনভীর হাসলো। যেন অপূর্ব কোনো মজার কথা বলেছে। বলে উঠলো,

‘ ওএমজি! আমি কি ‘গে’ নাকি যে ছেলে হয়ে আপনার পিছে ঘুরবো? মানছি আপনি কোনো সাধারন টাইপ মানুষ না। অফটার অল এত বড় বিজনেস আছে আপনাদের। তাই বলে এভাবে আমি আপনার পিছে ঘুরবো?’

অপূর্বের ক্রুব্ধতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে সামনে বসা মানুষটার বেসামাল কথাতে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,

‘ ঠাট্টা করা আমি অপছন্দ করি।’

‘ হা হা হা! সেম টু ইউ। এন্ড আই এম সিরিসয়াস। আমি মেয়ে হলে আপনার পিছে ঘুরতাম সত্যি। তাই বলে ছেলে হওয়া সত্বেও এভাবে বলতে পারলেন?’

অপূর্ব নিঃশ্বাস ফেললো। বলে উঠলো,

‘ আপনার সেক্রেটারি নাহিদ রেজওয়ান আমার সব খবর কালেক্ট করা চেষ্টা করছে। এন্ড সেটা কেনো, আমি জানিনা। তাই ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম রকস্টার! আমার রাস্তা থেকে যতটা দূরে থাকবেন ততই আপনার মঙ্গল। আপনি সিঙ্গার, গান করবেন, ফ্যানদের ভালোবাসা নিয়ে মেতে থাকবেন, লাইফ ইন্জয় করবেন। আমার সঙ্গে শত্রুতা করতে আসছেন কেনো?’

আনভীর আলতো হেসে বলে উঠলো,

‘ আমার খুব কাছের একটা জিনিস আপনার সাথে রিলেটেড তাই।’

আনভীরের এই কথাতে একটা রহস্যময়তা আছে। ক্রমেই সেটা আন্দাজ করতে পারলো অপূর্ব। ভ্রু জোড়া কুচকে এসেছে ওর। আনভীরকে যতটা সহজভাবে ও নেওয়ার চেষ্টা করছে ততটা সহজ আনভীর না। অপূর্ব দৃষ্টি আরও গভীর করলো এবার৷ ঠোঁটজোড়া চেপে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মৌনতা কাটিয়ে বলে উঠলো,

‘ ক্লিয়ারলি বলেন তো এআরকে, কি চান আপনি?’

আনভীর প্রসন্ন হলেন। বললেন,

‘ আহিকে ছেড়ে দাও।’

অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে অপূর্ব। ও ভাবতেও পারেনি যে এভাবে একজন রকস্টারের মুখে আহির কথা ও শুনতে পারবে। অপূর্ব থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ কোথায় আহি?’

‘ যেখানেই থাকুক, ইউ ডোন্ট হ্যাভ রাইট টু নো অ্যাবাউট দ্যাট।’

আনভীরের স্থির কন্ঠ। অপূর্ব যেন না হেসে পারলো না। বলে উঠলো,

‘ আহি ধুরন্দর আমি জানতাম বাট এতটাই ধুরন্দর সেটা তো আমি ভাবতেও পারিনি। শেষমেষ রূপের আগুনে একজন রকস্টারকে পটিয়ে ফেললো?’

আনভীর এতক্ষণ মজার ছলে থাকলেও অপূর্বের শেষ কথাগুলো শুনে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। বলে উঠলো,

‘ নেক্সট টাইম এ কথাগুলো বলার সময় দশবার ভাববেন অপূর্ব। আহি আর আগের মতো একা নেই যে আপনি আর ওর সো কলড বাবা কাঠপুতুলের মতো যা করতে বলবে তাই করবে। আপনার ব্যবস্থা তো করবোই, সেই সাথে রাহিরও করবো৷ আর হ্যাঁ….’

এই বলে অপূর্বের দিকে শরীরটা এগিয়ে দিলো আনভীর। ঠোঁটে একচিলতে রহস্যময় হাসি। বলে উঠলো,

‘ আহির সাথে যেই আচরণগুলো করেছেন, সেগুলোর প্রত্যকেটার হিসাব আমি খাতায় তুলে রেখেছি৷ একটা মা হারা মেয়ের প্রতি আপনি যেই জেদ প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর প্রত্যেকটার শাস্তি আপনি পাবেন।’

অপূর্বের শরীরে এবার এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যেতে থাকলো এমন ঠান্ডা থ্রেড শুনে। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ সত্যি করে বলেনতো, আপনি কে হন আহির?’

আনভীর বাকা হেসে বললেন,

‘ সেটা নাহয় সময় পেলেই টের পাবেন!’

বলেই আনভীর হাতের ঘড়িতে টাইম দেখে চলে গেলো এখান থেকে। মুখে বরাবরের মতো পড়ে নিলো কালো রঙের মাস্ক। যাওয়ার আগে একপলক গহীন চোখে দেখে নিলো অপূর্বকে। এই প্রথম অপূর্বের চেহারায় পড়লো দুশ্চিন্তার ছায়া। এই ছেলেটার কথাবার্তা এত সহজ নয়। অন্য চারপাঁচ জন পলিটিশিয়ান বা সেলিব্রেটিদের মতো একে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে হাতিয়ে নেয়া অসম্ভব। অপূর্বের মাথাটি হাজারো অজানা প্রশ্নের তাড়নায় ভো ভো করছে। যতদ্রুত সম্ভব এগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। খোঁজ নিতে হবে যে একজন রকস্টার ছাড়াও আনভীর মানুষটার কি সম্পর্ক আহির সাথে।

_______________

বাড়িতে আজকে বড্ড বোর হচ্ছি আমি। কথা নাই-কাজ নাই হুট করে আনভীর বললো, আজ হসপিটাল যেতে হবে না। কেনো বলেছে কে জানে?
এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে প্রায়৷ জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যাবে ব্যস্ত নগরীর মাঝে নীরব-নিভৃত একটি দৃশ্য। ঢাকার শহরে এমন স্থানে থাকার সৌভাগ্য হয়তো সবার নেই বললেই চলে। তবে আনভীর যেহেতু একটু গম্ভীর ধরনের, তাই একা থাকতেই খুব বেশি পছন্দ করেন। বিষয়টা একটু খারাপ লাগে আমার৷ উনার মা-বাবা, ভাই-ভাবি সবাই আছে। তবুও পুরোনো ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে যদি এভাবে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রাখে তবে এটা বোকামি ছাড়া কিছুই না। আমি জানি একটি পরিবারের মূল্য কি, কারন আমি এসব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে আমার চারপাশের সবকিছুকে কেমন যেন বিষাক্ত লাগে। মনে হয় আমার সঙ্গে সবকিছু হচ্ছে এক প্রহেলিকাময় স্বপ্নের মতো। আচ্ছা, আমি যেই রাহি আপুকে এতদিন চিনে এসেছি সে কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য না? আনভীরই কি সত্য বলছিলেন যে আপু আসলে আমায় ব্যবহার করে কিছু একটা হাসিল করতে চেয়েছে?

আমার এসব ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে প্রবেশ করলেন কেউ। রুমটা অন্ধকার ছিলো। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম বারান্দায়। কারও উপস্থিতি টের পেয়ে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। যদিও আমি জানি মানুষটি কে।

আনভীর আমায় খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় এসে পড়েছেন এবার। চোখে হালকা সন্দেহের ছাপ। আমি মলিন কন্ঠে বললাম,

‘ টেনশন করবেন না। পালিয়ে যাইনি আমি।’

কথাটি আমি একটু অভিমান করেই বলেছিলাম। কেননা আমি অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম এভাবে বন্দীজীবন কাটিয়ে। আগে অপূর্ব ভাইয়ার, আর এখন আনভীরের। বিগত এতগুলো জীবন সবার কথার উঠবস করতে করতে অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছি আমি। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে কেমন যেন। আনভীর আমার পাশে দাঁড়ালেন। আলতো ভাবে হাত স্পর্শ করতেই তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে ফেললাম আমি। চিৎকার করে বলে উঠলাম,

‘ ডোন্ট টাচ মি। আপনার কোনো রাইট নেই আমায় টাচ করার।’

আমার কথায় নির্বিকার রইলেন আনভীর। যেন জানতেন আমি এমন ব্যবহারই করবো। তাই শান্ত নয়নে পরখ করে চলছেন আমাকে। তারপর বলে উঠলেন,

‘ শান্ত হও আহি, আমি এমন কোনো ভুল করিনি যে এভাবে ক্ষেপে যাচ্ছো।’

‘ ও তাই নাকি?’

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম আমি। বললাম,

‘ তাহলে কি করেছেন আপনি? আমায় কিছু লেইম এক্সকিউজ দেখিয়ে জোরপূর্বক আমায় নিয়ে আসলেন, আমি চুপ থাকলাম। আমায় আপনার ফ্যামিলির চাপে পড়ে বিয়ে করলেন তখনও আমি চুপ থাকলাম। কেন জানেন? আমার ধারনা হয়েছিলো, রাহি আপুর কারনেই হোক! আপনি ভালোবাসেন আমাকে। আমার জন্য কিছু একটা ফিল করেন। সেদিন রাতে আমার জন্য আপনার করা পাগলামিটা আরও গভীরভাবে আমি দেখতে পেয়েছিলাম আনভীর।
কিন্ত এখন আমার মনে হচ্ছে যে আমি ভুল।।কেননা আপনি এখনও প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক যে আমি আপনার ওয়াইফ। আমায় দিনের তিনভাগের একভাগ ঘরবন্দী করে রাখা, এখানে না যাওয়া-ওখানে না যাওয়া এগুলো দ্বারা কি বুঝবো আমি? জানেন! অপূর্ব ভাইয়াও আমায় এভাবে ঘরবন্দী বানিয়ে রাখতো। পার্থক্য শুধু একটাই, আপনি কখনোই আমার গায়ে হাত তুলেননি। কিন্ত যেটা অপূর্ব…. ‘

এতগুলো বলেই থামলাম আমি নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলাম ঘনঘন৷ আনভীর এখনও চুপ করে শুনছে আমার কথা। আমি এবার কাতর কন্ঠে বলে বললাম,

‘ আমি বাঁচতে চাই আনভীর। একটা হ্যাপি লাইফ লিড করতে চাই। আমি অপূর্ব ভাইয়ের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে চাই না। চাইনা আপনার পাগলামিগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতে। যদি অপূর্ব ভাইয়ার মতো আপনিও আমায় নিজের পাগলামি মনে করেন তাহলে আমি নিজে থেকে আপনার কাছ থেকে দূর….’

আমায় আর বলতে দিলেন না আনভীর। হঠাৎ আমার কোমড় চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ আনভীর একটা তপ্তশ্বাস ছেড়ে মৃদুভাবে নিজের ঠোঁটজোড়া দ্বারা স্পর্শ করলেন আমার ঠোঁটে। কিয়ৎপ্রহরের জন্য আমি পাথর হয়ে রইলাম। কি করা উচিত আমি যেন ভুলে গিয়েছি। আনভীর এবার প্রলুব্ধকর চাহিনী নিক্ষেপ করলেন আমাতে। বলে ওঠলেন,

‘ আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা নেক্সট টাইম মাথায়ও আনবে না তুমি? তুমি কি বোকা? বাচ্চা মেয়ে যে বুঝোনা কেনো আমার মতো একজন মানুষ তোমার পিছে পড়েছে? তোমায় তোমার অতীত থেকে নিয়ে আসছে? শুনতে চাও তো যে আমি এমন করছি কেনো? তাহলে শুনো৷ আই এম ম্যাডলি লাভ উইথ ইউ আহি। আজ থেকে না। তবে কবে থেকে আমি জানি না। রাহি শুধুমাত্র একটি বাহানা। আমি তোমায় ভালোবাসি আর এটাই সব কিছুর মূল। যা করছি সব কিছু করছি তোমায় পাওয়ার জন্য। এবং তোমায় নিজের কাছে রাখার জন্য অপূর্ব থেকেও আমি ভয়ঙ্কর হতে পারি। ‘

বলেই উনি আমার গলায় মুখ গুঁজে ফেললেন এবার। এতক্ষণ আমার জমে থাকা চোখের অশ্রু পাগলের মতো মুছে ফেললেন। অস্থির লাগছে উনাকে। যেন আমার কথায় প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ আমার ঠোঁটকোলে তখনও একটা হাসি ফুটে উঠলো উনার বাচ্চাসুলভ কর্মকান্ড দেখে।
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

আজকে সবাই বিশাল করে মন্তব্য করবেন কিন্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here