#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৬
ফুরফুরে বাতাসের ফিসফিসানো শব্দ সম্মোহিত করে ফেলেছে আমায়৷ আশপাশের পরিবেশ জানান দেয় এখন দিনের প্রথমভাগ। আজ প্রভাতটা সুন্দর। অন্যান্য দিনের মতো সাধারন হলেও আমার কাছে কেনো যেনো ছোট থেকেও ছোট জিনিস অসাধারন লাগছে। আমি বারান্দায় বসে আনভীরের ছোটোবেলার ছবির অ্যালবাম দেখছি মনোযোগ দিয়ে।
ছোটোবেলার বললে ভুল হবে, এখানে সব উনার কিশোরকালের ছবিগুলো সংরক্ষিত যখন উনি লন্ডনে পাড়ি জমান। আমি প্রত্যেকটা ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখছি৷ এখনকার মতো ছোটবেলাতেও চুপচাপ ছিলেন খুব, তবে ঠোঁটে বিদ্যমান ছিলো এক অকৃত্রিম সুন্দর হাসি।
আমি পাতা উল্টালাম। সেখানে দেখা যাচ্ছে উনার গিটার বাজানোর একটা ছবি। নিচে কার্সিভ লেটারে লিখা ‘ব্যাকিংহাম রোড’। ফল সিজন থাকার কারনে উনার ছবিগুলো আরও প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিলো। এভাবেই একে একে দেখলাম উনার ডর্মে থাকাকালীন ছবি, ইডেনবার্গের ট্যুরের ছবি, হাই স্কুল গ্রাজুয়েশন তারপর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তোলা কিছু ছবি; নিঃসন্দেহে বলা যাবে যে অভিজ্ঞতা প্রতিটা ক্ষেত্রে অর্জন করেছেন উনি।
কিন্ত আমি অ্যালবাম ঘাটছিলাম অন্য কোনো কারনে। জানতে চেয়েছিলাম উনার অতীত। কিন্ত এখানে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাইনি আমি। পরক্ষণেই ভাবলাম, কি দরকার উনার অতীত নিয়ে ঘাটার? উনি তো আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত সব। বিগত কিছুদিনে ছোট থেকে ছোট বিষয় দ্বারা উনি প্রকাশ করেছেন যে আনভীরের জীবনে আমার প্রভাব ঠিক কতটুকু।
শীতল হাওয়া আবিষ্ট করে ফেলেছে আমায়। পাশেই পড়ে আছে আনভীরের একটা ভায়োলিন৷ গতকাল হুট করে উনার ভায়োলিন বাজানোর ইচ্ছে হয়েছিলো। আমিও কৌতুহলের সাথে শুনেছিলাম সেটার প্রতিটি সুর। আনভীর বলেছিলেন,
এই ভায়োলিন উনার ইউনিভার্সিটি লাইফের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রায়ই উনি রাতে ডর্ম থেকে ফাঁকি দিয়ে টপকে চলে যেতেন কাছাকাছি একটা পার্কে। ক্যামব্রিজ যেহেতু বিশাল এলাকা ছিলো তাই সেকিউরিটি ফাঁকি দেওয়াটা কষ্টকর হলেও অসাধ্য কিছু ছিলো না।
এভাবেই গতকাল কতক্ষণ কথাবার্তা চলছিলো জানিনা। সকালে চোখ খুলতেই আমি নিজেকে পেয়েছিলাম বিছনায়। এই কাজ যে কে করেছেন সেটা নিয়ে আর সন্দেহ ছিলো না আমার৷ বারান্দা থেকে রুমের ভেতরে গিয়ে অ্যালবামটা আমি সন্তর্পণে রেখে দিলাম কাচের শেলফটিতে৷ ঘুম থেকে ফ্রেস হয়েছি অনেকক্ষণ হলো কিন্ত এখনও কিছু না খাওয়াতে ক্ষুধায় পেট চো চো করছিলো।
আমি নিচে গিয়েই দেখলাম নাহিদ ভাইয়া ব্রেকফাস্ট করছে টেবিলে। আমি চমকে গেলাম। টাইম অনুয়ায়ী আজ আনভীরের একটা সেমিনার ছিলো বেস্ট্রো অডিটোরিয়ামে। তাহলে উনি এখানে কেনো? আমায় এভাবে উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলেন নাহিদ ভাইয়া। কোনোমতে ব্রেডটা মুখে নিয়ে বলে ওঠলেন,
‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো ভাবি? পেট খারাপ হবে তো আমার।’
নাহিদ ভাইয়ার অপ্রাসঙ্গিক কথার পরোয়া করলাম না আমি। সন্দিহান চোখে বললাম,
‘ এভাবে ষাড়ের মতো আজগুবি কথা না বলে বলুন এখানে কি করছেন?’
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নাহিদ ভাইয়া। হয়তে নিজেকেই প্রশ্ন করছে যে এটাই তো তার আপাতত বাসস্থান। তবে আমি কিসের কথা বলছি? নাহিদ ভাইয়া এবার বললেন,
‘ দেখছেন না খাচ্ছি?’
‘ তা তো আমিও দেখছি। কিন্ত এখানে কেনো? আপনার না আনভীরের সাথে যাওয়ার কথা?’
‘ হ্যাঁ কিন্ত!’
‘ কিন্ত কি? আপনি আবার উনাকে একা ছেড়েছেন? আপনাকে না বলেছি উনাকে একা কোথাও না যেতে দিতে? একে তো এতসব ঝামলা আবার অপূর্ব ভাইয়া যদি উনার….’
দুশ্চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আমার। কেননা আনভীর অনিচ্ছা সত্বেও বলে আমায় ফেলেছিলো অপূর্ব ভাইয়ার সাথে উনার সাক্ষাতের কথা। বলেছিলেন ভাইয়াকে যে আমি এখন আনভীরের কাছেই আছি। এটা যেদিনই আমি জেনেছিলাম সেদিন থেকেই ভয় জেঁকে বসলো মনে। কেননা আমি জানি কতটা ভয়ঙ্কর মানুষ উনারা। যারা স্মাগলিং এর মতো কাজে জড়িয়ে যেতে পারে ব্যবসার অগোচরে, তারা যেকোনো কিছু করতে পারে। যদি আনভীরের কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তো?
আমায় এত অস্থির হতে দেখে নাহিদ ভাইয়া রীতিমতো চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার কাছে এলেন। বলতে থাকলেন,
‘ আরে হাইপার হচ্ছেন কেনো? আমাকে তো বলতে দিন। এআরকে কোথাও যায়নি বুঝেছেন? সে আজ সেমিনারে যাবে একটু দেরি করে। তাই আমিও যাইনি৷ কি ডেন্জেরাস আপনি আল্লাহ! এখন আমার জন্য আপনার কিছু হয়ে গেলে এআরকে আমার কপালে শনি আনতো। এত হাইপার হতে লাগে?’
আমার মনে এতক্ষণ অজস্র দুশ্চিন্তা থাকলেও নাহিদ ভাইয়ার কথায় আড় চোখে তাকালাম আমি উনার দিকে। নাহিদ ভাইয়া মিহি হেসে বললেন,
‘ আপনার বরসাহেব একটু আগে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে দেখলাম। এখন গার্ডেনে কি করছে আল্লাহ মালুম। যান দেখে আসেন।’
উনার দুষ্টুমি ভঙ্গিমার কথাগুলো ধরতেই আমি লজ্জায় মিলিয়ে গেলাম। নাহিদ ভাইয়া অ্যাপেলে একটা বাইট দিয়ে বললেন,
‘ কে যেনো বলেছিলো জীবনেও এআরকে কে ভালোবাসবে না। এখন তো দেখছি চোখে হারায়। দেখলেন! শেষমেষ নাহিদ রেজওয়ানের কথাই ঠিক বের হলো৷’
‘ আপনি…আপনি ব্রেকফাস্ট শেষ করেন।’
বলেই কোনোমতে উনাকে এড়িয়ে গার্ডেনের দিকে পা বাড়ালাম আমি। উদ্দেশ্য আনভীরকে একঝলক দেখা। সেই সাথে নাহিদ ভাইয়াকেও সন্তর্পণে এড়িয়ে চলা। আনভীর কি, এই ছেলের কাজকর্ম তার থেকেও ভয়ঙ্কর। আমি শুধু ভেবে পাইনা মানুষ এতটা বেফাঁস কাজকর্ম কিভাবে করে বেড়াতে পারে।
গার্ডেনে গিয়ে দেখলাম জিমি দৌড়াচ্ছে প্রাণবন্তভাবে। ছোট ছোট ফুলের গাছগুলো তরতাজা লাগছে। নানা বাহারের বিদেশি জাতের ফুলগুলোর যত্ন নিতে হয় অনেক। আর এগুলো নুড়ী আপার দায়িত্বে পড়লেও সকালে কাজটা আনভীরই করেন। আজ নুড়ী আপা বাসায় নেই। কোনো এক কারনে আনভীর নুড়ী আপাকে আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। কারনটি আমি জানতে চাইলেও উনি কিছু বলেননি। আমিও তাই পরন্তু আর আগ্রহ দেখালাম না।
আনভীর সুইমিংপুলের সামনে বসে আছেন ক্লান্তির সাথে। পরনে একটা কালো হাফ হাতা টিশার্ট আর কালো একটা হাফ প্যান্ট। উনাকে এভাবে দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। চোখের দৃষ্টি করে ফেললাম হালকা। পা ঘুরিয়ে উল্টোপথে ঘুরতেই পেছন থেকে আনভীর চেঁচিয়ে বললেন,
‘ কাম হেয়ার বেবিগার্ল! ‘
গালে ক্রমশ লালাভ আভা ফুটে ওঠলো আমার। উদ্ভ্রান্তের মতো দ্রুত এবার পা চালিয়ে উনার কাচে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
‘ পাগল নাকি আপনি? এভাবে এসব চেঁচিয়ে বলার কি আছে? নাহিদ ভাইয়া শুনলে কি ভাববে?’
‘ এমন কি সব চেঁচিয়ে বললাম আমি?’
আমি দম নিলাম। উনি এই প্রশ্নটা করেছেন শুধুমাত্র আমার মুখে ‘বেবিগার্ল’ শব্দটি শোনার জন্য। উনার চোখে-মুখে এমন একটা ভাব যেন উনি আমায় এভাবে বিভ্রান্ত হয়ে থাকতে দেখে মজা পাচ্ছেন বেশ।
আমি আড়নজরে চোখ বুলিয়ে নিলাম উনার ওপর। ঘেমে জুবুথুবু হয়ে আছে উনার মুখ। কালো চুলগুলো মিশে আছে ভিজে থাকা কপালের ওপর। চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ, সেটাও মুগ্ধভাবে দেখছে সুইমিংপুলের পানিকে। রৌদ্দুরের আবির্ভাবে যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে উনার চোখজোড়া। আনভীর আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন,
‘ এতক্ষণ ওয়ার্কআউট করাতে শরীরটা ক্লান্ত লাগছিলো। কিন্তু তোমার এই চাহিনী আমায় কিন্তু বেসামাল করে দিচ্ছে আহি। কন্ট্রোল ইট।’
তৎক্ষনাৎ আমি নিজেকে সংযত করলাম। উনার কথাগুলো হাসফাস করে তুলছে অন্তরে। আনভীর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘ ব্রেকফাস্ট করেছো?’
‘ না।’
‘ তাহলে করে আসো।’
‘ আপনি করেছেন?’
‘ না। করবো একটু পর। আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নেই। তারপর করবো।’
এই কথাটি উনি বললেন আমার দিকে তাকিয়ে। ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলছে। এ হাসিটি কেন যেন আমার খুব একটি সুবিধার মনে হলোনা৷ তবুও নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কি কাজ?’
আমার এই প্রশ্ন শুনে আনভীর একটা বাকা হাসি দিয়ে নিজের কালো হাফ হাতা টিশার্ট খুলে ফেললেন আমার সামনে। এহেন কান্ডে অবাক হলাম আমি৷ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। ও মাই গড! ও মাই গড! পাগল নাকি উনি? হুট করে আমার সামনে টিশার্ট খুলে ফেলাতে মুখমণ্ডল আমার লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
‘ ও হ্যালো মিস্টার! এসব কি ক…করছেন আপনি?’
‘ কি করছি?’
উনি নির্বিকারভাবে টিশার্টি রাখলেন পাশের কাউচে। ভ্রু কপালে উচিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি চোখে সরিয়ে নিলাম উনার কাছে থেকে৷ ভাবতেও পারিনি যে এই রূপে উনাকে হুট করে দেখবো। আনভীর চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো করে বললেন,
‘ আজকে ওয়েদারটা অনেক ওয়ার্ম মিসেস আহি। সুইমিং করবো তাই৷’
বলেই উনি আমায় অবাক করে দিয়ে হুট করে ঝাপ দিলেন সুইমিংপুলে। পানির শব্দে অবাক হলাম আমি৷ হতবুদ্ধি হারিয়ে তাকিয়ে রইলাম সে পানে। আনভীর আপন মনে সুইমিং করতে ব্যস্ত৷ উনাকে এভাবে নামতে দেখে জিমিও ঘেউ ঘেউ করে চলছে৷ চোখের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে, সেও নামবে। আনভীর জিমির দিকে পানির ছিটা দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘ ঠান্ডা লাগবে তোমার বেবি। আজ না। অন্য একদিন!’
ছোট কুকুরছানাটি কি বুঝলো কে জানে, সে এবার চুপচাপ আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। ব্যাটা আস্ত একটা বেশরম, লজ্জা করলোনা এভাবে আমার সামনে একটা হাফপ্যান্ট পড়ে সুইমিং করতে? আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ এমনিতে ওয়েদার চেন্জ হচ্ছে, তার পক্ষে এই ঠান্ডা পানিতে লাফ দেওয়ার কি দরকার ছিলো?’
‘ অভ্যাস আছে আমার। ডোন্ট ওয়ারি। তুমি নাস্তা করে আসো।’
আমি কিছু না বলে চলে গেলাম ভেতরে। নাহিদ ভাইয়া নিজের রুমে যাচ্ছিলো। আমায় দেখে বলে উঠলো,
‘ কোথায় আনভীর ভাই?’
‘ সুইমিং করে অসভ্যটা!’
আমার বিড়বিড়িয়ে কথা বলার জন্য কিছু বুঝলেন না ভাইয়া। আনমনেই সে রুমে চলে গেলো। আমি ব্রেকফাস্ট সেরে আবার গেলাম উনার কাছে। দেখলাম মহাশয় ক্ষান্ত হননি৷ এখনও সুইমিংপুলে দিব্যি বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। আমি এবার বললাম,
‘ এবার তো উঠুন! আপনার না যাওয়ার কথা একটা ইভেন্টে?’
উনি পরোয়া করলেন না। আমি বিরক্তি নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আনভীর বললেন,
‘ হাত দাও তোমার। আমি উঠবো।’
আমার সন্দেহ হলো উনার কথা শুনে। তবুও কিছু না বলে নিঃশব্দে ঝুঁকলাম পুলের দিকে। হাত বাড়িয়ে অস্বস্তি কাটিয়ে বললাম,
‘ উঠুন!’
কিন্ত আমার ধারনাকে পাল্টে দিলেন আনভীর৷ হুট করে উনি আমার হাত টান দিতেই আমি তৎক্ষনাৎ পুলে পড়ে গেলাম৷ ভড়কে গেলাম আমি। সেই সাথে কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলো স্নায়ু। কেননা সাঁতার জানতাম না আমি। পুলের গভীর পানিতে ঠাই না পাওয়াতে কই মাছের মতো ছটফট করতে থাকলাম। আমি কোনোমতে ‘আনভীর’ শব্দটা উচ্চারণ করতেই আচমকা একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আগ্রাসী অধিকারে আঁকড়ে ধরলো আমার কোমড়। তারপর আমায় মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। আমি তখন চোখ বুজেই বলে ফেললাম,
‘ ছাড়বেন না আমায় আনভীর!’
.
.
.
.
~চলব ইনশাআল্লাহ
আরেকটু লিখার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু হাত ব্যথায় টনটন করছে দ্রুত লিখার কারনে। রিচেক করতে পারিনি। বানানে কিছু ভুল থাকলে সেটা ক্ষমাসুলভ চোখে দেখার অনুরোধ রইলো৷ আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায়…