এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ৩৬

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৬
‘ সমস্যা কি তোমার?’

ভরাট কন্ঠ আনভীরের। আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না৷ চুপচাপ কথা এড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম অন্য দিকে। উনার চোখেমুখে স্পষ্ট ক্রোধ। ক্রমেই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে নিখুঁতভাবে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

‘ আমার কোনো সমস্যা নেই।’

‘ তাহলে……..এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো আমায়?’

কথাটি বলে আরেকটু সামনে এগোলেন আনভীর। দাঁড়ালেন একেবারেই আমার কাছাকাছি। আমি গাড়ির সামনের সাইডে বসে ছিলাম বলে উনার উচ্চতা আমার সমান সমান এখন। সেই সুবাদে উনার ঘোলাটে চোখজোড়ার তীক্ষ্ণ চাহিনীর উপেক্ষা করা যেমন কঠিন, তেমনই অসম্ভব মুখ ফুটে কথা বলা। আমি দ্বিধায় আছি। এদিকে অপূর্ব ভাইয়ার ভয় আর এদিকে উনাকে সত্য না বলতে পারার ভয়ে ক্রমেই বিষিয়ে যাচ্ছি। আমি নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করলাম। মৌন স্বরে বললাম,

‘ আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছি না আমি আনভীর। আমি শুধু এখন একাকীত্ব চাচ্ছি।’

‘ আর সেটা কেনো?’

উনার পাল্টা প্রশ্ন। এর উত্তর আমার জানা নেই। তাই হতাশ হয়েই বলি,

‘ জানা নেই।’

‘ লিসেন আহি! আমি আগেও বলেছিলাম এখনও বলছি, ডোন্ট ট্রাই টু কনফিউজ মি। নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবো তুমি তাই না? তাই তো বেশ চালাকির সাথেই এড়িয়ে যাচ্ছো আমায়। তোমার এই ওভার স্মার্টনেস নাহিদ বা অন্য সবার চোখে পড়লেও আমার সাথে চলবে না। আই এম হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিউর কিছু লুকাচ্ছো তুমি আমার কাছ থেকে।’

আমি মলিন হাসলাম। বলে উঠলাম,

‘ আর আপনি কিছু লুকান নি?’

সচকিত হলেন আনভীর। আমার অস্থিরভাব পাল্টে আজকের শীতল ব্যবহার উনাকে ভাবিয়ে তুলেছেন আচমকা। বিস্ময়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

‘ মানে?’

‘ বলছি, সবসময় কি আমিই কথা লুকাই? আপনি কখনও আমার কাছ থেকে কিছু লুকান নি?’

প্রশ্নটা আমি করতাম না। কখনোই করতাম না যদি অপূর্ব ভাইয়া বিষয়টা মাথায় না ঢুকিয়ে দিতো। হয়তো অপূর্ব ভাইয়া মানুষটা খারাপ, কিন্ত এটা আনভীরের কোনো একটি ব্যাপার ঠিকই ধরতে পেরেছেন উনি। নাহলে কেন বললেন উনার অতীত ঘাটতে? এ বিষয়ে প্রশ্ন ছিলো আমারও। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কেন রাহি আপুকে ঘৃণা করেন উনি? আনভীর সবসময় বলেছেন রাহি আপুর জন্যই নাকি উনি ফ্যামিলি থেকে আলাদা হয়েছেন। কিন্ত কেনো? আর আমার হয়ে কেনো অপূর্ব ভাইয়ার প্রতি রিভেন্জ নিতে চাচ্ছেন উনি। এর মানে কি অপূর্ব ভাইয়ার কথাই সত্যি দাঁড়ায় যে আনভীর কিছু লুকাচ্ছেন?

আনভীর হঠাৎ চুপ করে গেলেন আমার এ প্রশ্নে। আমি আবার বললাম,

‘ চুপ হয়ে গেলেন যে?’

‘ কারন তোমার এই ব্যবহার ভাবিয়ে তুলছে আমায়। আগে তো এরকম ছিলে না?’

‘ কারন আগে এরকম কিছু আমি ভাবিনি তাই।’

আনভীর প্রগাঢ় দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। ক্ষোভ নিয়ে বললেন,

‘ কথা পাল্টানোর মতো চালাকি করবে না। আমি বলেছিলাম না যখন সময় হবে তখন সবটাই ক্লিয়ার হবে? এখন ক্লিয়ারলি বলো, এড়িয়ে যাচ্ছিলে কেনো আমায়? আজ সারাদিন কল রিসিভ করলেনা কেনো?’

‘ কাজের প্রেশার ছিলো।’

‘ এতই প্রেশার যে কল ধরার টাইম নেই?’

‘ অনেকটাই তাই।’

আমি নামার চেষ্টা করতেই আনভীর বাঁধা দিলেন। আমি সচকিত হয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনার উথাল পাতাল বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস নিঃড়ে পড়ছে আমার মুখে। মুখভঙ্গি অগোছালো। সেই অগোছালো মুখ বলছে অজস্র কথা। আনভীর কন্ঠস্বর কোমল করলেন। নীরবে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ আমি জানি যে অপূর্বের কথায় তুমি এখনও ট্রমাতে আছো আহি। বাট রিমেম্বার দ্যাট! অপূর্ব বললেই তুমি তো আর আমার আশ্রিতা হবেনা, তাই না?’

‘ হুম।’

‘ তুমি আমার ওয়াইফ আহি। হোক কয়েকটা বিশেষ কারনে সেটা জনসম্মুখে এখনও অপ্রকাশিত কিন্ত আমরা তো স্বামী-স্ত্রী, এটা মানো?’

‘হ-হ্যাঁ।’

‘ তাহলে? কার ভয় পাচ্ছো তুমি?’

হঠাৎ চোখ অশ্রুতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠলো আমার। সময় অতিক্রম না করে আনভীরের বুকে তাই মাথা গুঁজলাম। ক্ষণে ক্ষণে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিলাম না। একজন মেয়েই জানে যে সেই ভয়াবহ কথাগুলো কতটা তিক্তকর। আনভীর চুলে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিতে মগ্ন হয়ে পড়লেন এবার। আমি বললাম,

‘ আপনার জন্য…..আপনার জন্য ভয় পাচ্ছি আমি আনভীর। আমার সমস্ত ভয় আপনাকে ঘিরেই। আপনি…আপনি জানেন না ওরা কতটা ভয়ঙ্কর। আমার ওই প্রোপার্টি চাই না আনভীর। আমি আগেই বলেছিলাম। মায়ের ওই সিদ্ধান্তই আমার জীবনটাকে এই নরকে পুঁতে ফেলেছিলো। ওরা আমাকে এখন চায় শুধুমাত্র ওই জন্যেই। আর এতে বাঁধা আপনি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আপনি কি ভাবেন ওরা এমনেই আপনাকে ছেড়ে দিবে? আমি আপনার কোনো ক্ষতি মানতে পারবো না আনভীর। ওরা মানুষের চেয়েও অধম…..!’

আনভীর সর্বস্বরে সামলে নিয়েছেন আমায়। নিঃশব্দতা কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আগ্রাসী কন্ঠে বললেন,

‘ ওরা কিছু করতে পারবে না আমার আহি। তুমি শুধু আমার প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ওরা যতটা না ভয়ঙ্কর, আমি এর থেকে দ্বিগুণ ভয়ঙ্কর হতে পারবো তোমার জন্য।’

রাত বাড়ছে হু হু করে। সেই সাথে বহমান শীতল বাতাস। উনার আগ্রাসী কন্ঠ আমার দেহে এক অন্য মাদকতার প্রতিফলন ঘটালো। আমি তাই কথা বললাম না আর। চুপচাপ গুটিশুটি হয়ে থাকলাম উনার বুকে।

___________________

নাহিদ ভাইয়া কোনো একটা কারনে বিরক্ত আমার ওপর। প্রচন্ড রকমের বিরক্ত। কিন্ত এই বিরক্তির কারন কি তা আমি আঁচ করতে পারলাম না। আমি চুপচাপ ব্রেকফাস্ট করছি আর সামনে মুখ চুপসে বসা নাহিদ ভাইয়া। পাশেই আনভীর নীরবে খাচ্ছেন। নুড়ী আপা এসে নাহিদ ভাইয়ার গ্লাসে জুস ঢেলে দিলো। বললো,

‘ আজকে এত চুপচাপ যে ভাই?’

‘ ওহ! শেষমেষ তুমিই তাহলে বুঝলে নুড়ী আপা। নইলে সামনে যেই দু’জন শুধু মুখে খাবার ঠুসে যাচ্ছে তাদের কাছে তো আমি একজন অধম ছাড়া আর কিছুই না।’

বোধগম্য হলো না আমার নাহিদ ভাইয়ার কথা। তাই সপ্রশ্নে মাথার ঘুরালাম আনভীরের দিকে। উনি প্রতি উত্তরহীন। একঝলক শীতল চোখে নাহিদ ভাইয়াকে পরখ করে আবার খাবারে মনোনিবেশ করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি হয়েছে আপনার?’

‘ আপনার বরকেই জিজ্ঞেস করেন। একদিনের ছুটি চেয়েছিলাম। বলেছি আজকে আসিফকে সাথে রাখতে। পেন্ডিং কাজগুলো আমি রাতে করবো। কিন্ত তা আর করতে দিলো কই?’

‘ আপনি হঠাৎ ছুটি চাচ্ছেন যে?’

বিষম খেলেন ভাইয়া। আমতা আমতা করে বললেন,

‘ ইয়ে, মানে, এভাবেই!’

এবার মুখ খুললেন আনভীর। বললেন,

‘ ওকে বলে দাও আহি যে কারন ছাড়া আমি ছুটি দিবো না।’

অপ্রসন্ন হয়ে গেলেন ভাইয়া। শেষমেষ একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে বললেন,

‘ আসলে ভাবি, আজকে তো আপনার মামাতো বোন নীলু আসবে। মানে, আপনার কি বাইরে যাওয়ার প্ল্যান আছে তার সাথে? যদি থাকে, নির্দ্বিধায় বলেন। আমি নিয়ে যাবো।’

আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলাম ভাইয়ার দিকে। নাহিদ ভাইয়ার এমন খামখেয়ালি স্বভাব আমার এই প্রথম দেখা। নাহিদ ভাইয়ার এমন আগ্রাসী চেতনার জন্য বুঝতে পারছিনা কি বলবো। এটা সত্যি যে আজকে নীলু আসবে এখানে। অনেকদিন ধরে ওর সাথে কথা হয়না তাই একটু ঘুরতে চেয়েছিলাম ওর সাথে। আনভীর এবার খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,

‘ চল্ এখন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

হতাশ হলেন নাহিদ ভাইয়া। বললেন,

‘ ঠিক আছে।’

উনারা চলে যাওয়ার পর আমি নুড়ী আপাকে বললাম দরজা লাগিয়ে দিতে। আজকে নীলু আসবে বলে হসপিটালে যাইনি আমি। তারপর ল্যাপটপ নিয়ে একটা মুভি চালু করলাম নেটফ্লিক্সে। দুপুরে ধ্রুব স্যার ফোন দিয়েছিলেন কথা বলার জন্য। হসপিটালের কয়েকজন মিলে এমনিতেই ডিনার থ্রো করছেন তাই উনি চাইছিলেন যে আমিও যাই। তবে আনভীরের কথা ভেবে আপত্তি জানালাম আমি। উনি অনেক মানানোর পর অবশেষে রাজি হয়েছিলাম। তবে কল কাটার পর দেখি যে আনভীর এর মধ্যে বহুবার কল দিয়ে ফেলেছেন। পাগল নাকি ইনি! বুঝে না যে কল বিজি আছে? আমি দ্রুত কল ধরলাম এবার। বলি,

‘ হ্যালো?’

অপরপাশে আনভীর নিশ্চুপ। আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি উনার নিঃশ্বাসের শব্দ। সেটা যে স্বস্তির বুঝতে বাকি রইলো না। আমি পুনরায় বললাম,

‘ হ্যালো আনভীর?’

‘ কল ধরোনি যে? এতবার কল দিচ্ছিলাম বুঝোনা যে কেন কল দিয়েছি? এভাবে আমায় বিপদে ফেলে তোমার ভালোলাগে?’

শেষ কথাটি খানিকটা রেগে বললেন উনি। আমি প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে ঠিকই বুঝেছি এর কারন। অপূর্ব ভাইয়ার সেই ইন্সিডেন্ট এর পর উনি আরও প্রোটেকিভ হয়ে পড়েছেন আমায় নিয়ে। আমি মিনমিনিয়ে বলে উঠি,

‘ অন্য একজনের সাথে কথা বললে আপনার কল রিসিভ করবো কিভাবে?’

‘ কার সাথে কথা বলছিলে?’

‘ ধ্রুব স্যার।’

কথাটি বলে জিভ কাটলাম অজান্তেই। এই মুহূর্তে তার নাম বলে আগুনে ঘি ঢেলেছি এমন হয়ে দাঁড়ালো ব্যাপারটা। প্রথম কিছুসেকেন্ড চুপ ছিলেন আনভীর। অতঃপর বললেন,

‘ হসপিটালে যেহেতু যাওনি তাই জরুরি কল করেনি ও। কেন ফোন দিয়েছিলো?’

এবার মিথ্যে বলার সুযোগ নেই। তাই বলি,

‘ ডিনারের জন্য অফার করেছিলো।’

‘ আর তুমি কি বলেছো?’

‘ রিকোয়েস্ট করেছিলো বলে না করতে পারিনি।’

আনভীর আবার চুপ হয়ে গেলেন। হঠাৎ ওপর পাশ থেকে শুনলাম,

‘ স্ক্রিপ্ট রেডি এআরকে। জলদি আসুন আমাদের সাথে।’

‘ আসছি।’

আনভীর কল কেটে দিলেন এবার। আমি ভেবেছিলাম এবারের মতো আমি বেঁচে গিয়েছি। কিন্ত পাঁচমিনিট পর যেই মেসেজ আসলো সেটা যেন সমস্ত স্বস্তি কাটিয়ে দিলো। আনভীর লিখেছেন,

‘ রেডি থাকো বেবিগার্ল। ধ্রুবর জায়গায় বদলি হয়ে এআরকের সাথে ডিনারে যাবে আজ!’

আমি হতাশ হয়ে ফোন রাখলাম। হিংসা কাহাকে বলে কত প্রকার, কি কি, এসব আনভীরকে দেখেই জানা সম্ভব।
.
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here