এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখনিতে – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ৩৫

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখনিতে – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৫
(রিচেক করিনি। তাই বানান সংক্রান্ত ভুল হলে ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন প্লিজ।)
‘চুলটা মুছে দাও তো আহি!’

নির্বিকার কন্ঠ আনভীরের। কথাটির আড়ষ্ট সুরে প্রকাশ পেয়েছে এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। আমি বিনাবাক্যে তাকিয়ে থাকলাম উনার পানে। একজন মানুষের সাথে এতকিছু হয়ে গেলো, বাইরে না জানি উনাকে নিয়ে কত বানোয়াট কথা বলা হচ্ছে তবুও উনি বসে আছেন এতটা ভাবনাহীন ভাবে? এর সঙ্গে আমি জড়িত আছি বলেই কি মানুষটার এত মৌনতা? আমি পাহাড় সমান অস্বস্তি নিয়েই উনার হাত থেকে কেড়ে নিলাম শুভ্র রঙের তোয়ালেটি। অন্যরকম লাগছে। এভাবে আনভীরের কাছে এসে এমন অভিজ্ঞতা কমই হয়েছে আমার।চুলগুলো তারপর আমি মুছে দিতে থাকলাম সন্তর্পণে। আমায় অবাক করে দিয়ে আমার কোমড় জরিয়ে বসে রইলেন আনভীর। চোখের নিষ্প্রভ দৃষ্টি আমার দিকে। এমন চাহিনীতে আমার ধীরগতিতে চলা হাত আরও স্থির হয়ে গেলো। না পারছি এভাবে থাকতে আর না পারছি এই দৃষ্টির মর্ম বুঝতে। চশমাবিহীন এই চোড়জোড়া অন্যরকম লাগছে এই মুহূর্তে। উনার কপট নীরবতা বিষাক্ত লাগছিলো আমার কাছে। হাল ছেড়ে অবশেষে বলেই ফেললাম,

‘এমন কেন আপনি আনভীর? বাইরে যে অপূর্ব ভাইয়ার জন্য আপনার নামে লোকে নানা কথা রটাচ্ছে সেগুলো থামাবেন না? এভাবে চুপ করে থাকলে কি সব মিটমাট হয়ে যাবে?’

‘ সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে আহি।’

জড়ানো প্রতিউত্তর আনভীরের। উনার এমন নিরুক্ত ব্যবহার ভালো লাগছে না আমার কাছে। উনি কিছু বলছেন না ঠিকই তবে আমি জানি, এসবের পেছনে দায়ী আমিই। আনভীর অপূর্ব ভাইয়াকে মেরেছেন আমার জন্য, প্রেস কনফারেন্সের পর জরুরি কাজ ছেড়ে শুধুমাত্র ছুটে এসেছেন আমার জন্য। আর তথাকথিত মিডিয়ার কাছে আমি যাতে এআরকে’র প্রোস্টিটিউট হিসেবে পরিচয় না পাই সেজন্যেও উনি সেটা চেপে গিয়েছেন শুধুমাত্র আমার জন্য। অপূর্ব ভাইয়া হয়তো এদিক দিয়ে ঠিকই বলেছেন আমায় সেলফিস বলে। আমি নিজের ভালোর জন্যই তো এভাবে উনাকে বিপদে ফেলে পড়ে আছি বেহায়ার মতো। ঠোঁট কামড়ে নিজের ভারক্রান্ত দুঃখগুলোকে নিয়ন্ত্রনে আনি এবার। ঘোরগ্রস্থের ন্যায় বলি,

‘ আমার জন্যই এসব হচ্ছে আনভীর। আপনি বলুন বা না বলুন, আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। আমি…..’

আচমকা বিনাবাক্যে আমায় নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন আনভীর। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। নিজের বোধবুদ্ধি হারিয়ে অস্থির দৃষ্টি ফেললাম উনার দিকে। মুখে ভাবনার লেশমাত্র নেই। বরং অয়নজোড়ায় খেলা করছে অজস্র অব্যক্ত কিছু কথা। সেই দৃষ্টির অতলে হারিয়ে যাওয়াতে ক্রমেই অস্থিরে ছটফট করতে থাকা মন শান্ত হয়ে গেলো। আনভীর খাটের একপ্রান্তে রাখা হাত উঠিয়ে আমার ঘাড়ের পিছে রাখলেন এবার। আর অন্যহাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিলেন কানপিঠে। হাতের শীতল স্পর্শ, যা স্পষ্টই ইঙ্গিত দিচ্ছে অন্যকিছু। রুদ্ধশ্বাস ফেলে অবশেষে তাই বলেই ফেললাম,

‘ আনভীর!’

‘ হুসসস! আর কথা না।’

উনি কথা কাটলেন। উনার মতিগতি সবই যাচ্ছে আমার মাথার ওপর দিয়ে। গতকাল থেকেই অন্যরকম আচরণ করছেন উনি। অপূর্ব ভাইয়ার আমার প্রতি সেই ব্যবহারগুলো উনার মনে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে এখন এক মুহূর্তের জন্যও চাননা আমায় কষ্ট দিতে। উনার এই রূপটা অন্তরে ভালোলাগার আরও একধাপ সৃষ্টি করলো। খুব ইচ্ছে করছে এখন উনার ওষ্ঠ্যে একটা ছোট্ট আদুরে স্পর্শ করতে। কিন্ত সাহস নেই। সেই সাথে একদিন তো এই মায়া ছেড়ে আমায় ওই জাহান্নামে ফিরে যেতেই হবে উনার ভালো জন্য। তো কি লাভ এই মায়া বাড়িয়ে?

আনভীর গালে হাত রাখলেন আমার। প্রগাঢ় কন্ঠে বললেন,

‘ তোমায় না বলছি আহি আজেবাজে কথা না বলতে? তোমার জন্য কিছুই হয়নি বুঝেছো? অপূর্ব আঘাত পাওয়ার প্রাপ্য ছিলো। ওর বোঝা উচিত ছিলো যে আমার আহি এখন আর ওর কাঠের পুতুল না। যেই আহির গাল ও হিংস্রের মতো চেপে ধরেছে, প্রোস্টিটিউট বলে সম্বোধন করেছে, সেই আহি আপাদমস্তকই আমার।’

একদফা স্থির রইলাম আমি। এমন কথায় কি প্রতিউত্তর দেয়া উচিত আমার জানা নেই। আমি উনার চুলগুলো মুছে উঠে দাঁড়ালাম উনার কাছ থেকে। মৌনকন্ঠে বললাম,

‘ আমি ন-নিচে য-যাচ্ছি। ক-কাজ আছে আ-আমার।’

কথাটি বলে একদন্ড রুমে দাঁড়াইনি আমি। চুপচাপ নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।

__________________________

টিভি স্ক্রিনে টেলিকাস্ট করা নিউজের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে অপূর্ব। হাতে একমগ কফি। সেটা সে খাচ্ছে তৃপ্তির সহকারে। কপালে ব্যান্ডেজ থাকলেও সেদিকে ওর কোনো মাথাব্যাথা নেই। ইকবাল সাহেব নিজের আদরের ভাতিজার কাজকর্ম দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। না পেরে অপূর্বের বাবার কাছে ফিসফিসিয়ে বলেই ফেললো,

‘ ভাইজান! চাচাজি ওই ছেলের হাতে মাইর খেয়ে মনে হয় মাথা নষ্ট হয়ে গেসে। নাহলে অপূর্বের মতো একটা ভয়ঙ্কর ছেলে, যে একনাগাড়ে পাঁচটা মানুষের জান কবজ করে সেই ছেলে এভাবে মাইর খেয়ে বিন্দাস ঘুরে বেড়ায়?’

‘ এজন্যই তুই একটা মাথামোটা ইকবাল। বয়সে তুই বড় হলেও আমার ছেলের মতো বুদ্ধি তোর হয়নাই বলে ও আহির প্রোপার্টির কাগজ ওর হাতে আর তোর মেয়ে হয়েও তুই নিতে পারলি না।’

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো ইকবাল সাহেবের। অগত্যাই চুপ রইলেন তিনি। তবে আনভীরের বাবার চোখে মুখে সন্দেহের আভাস। গালের দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে উনি বললেন,

‘ আমার আগেই মনে হয়েছিলো যে অপূর্ব ব্যাটায় জানে আহির কথা যে ও কোথায় আছে। নইলে ও এভাবে স্থির থাকত? আর আমি ভাবতেও পারিনি যে আহির নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তোর ওই পুরনো বন্ধু ইমতিয়াজের ছেলেও জড়িত আছে।’

আনভীরের বাবার এই প্রসঙ্গে দুশ্চিন্তার রেশ দেখা দিলো ইকবাল সাহেবের চোখে-মুখে। কোনো একটা কারনে ইমতিয়াজ খান এর নাম শুনলেই উনি ভীত-সতস্ত্র হয়ে পড়েন। কেননা ইমতিয়াজ খানের এই ছোট ছেলেটার সাথে একটি সুপ্ত অতীত লুকিয়ে আছে আহির। যেটা অপূর্ব আর অপূর্বের বাবা, দুজনেরই অজানা। এরা শুধুএটাই জানে যে আহির মায়ের মৃত্যুর পেছনে ইকবাল সাহেবেই দায়ী।

ইকবাল সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,

‘ ইয়ে মানে, ভাইজান হঠাৎ এসব বলছেন যে?’

‘ হঠাৎ বলছি না। আচ্ছা তোর কি মনে হয় যে ওই ইমতিয়াজের ছেলে, কি জানি নাম? হ্যাঁ, আনভীর। আনভীরের সাথে কি সম্পর্ক তোর মেয়ের সাথে? একজন রকস্টার এমনি এমনিই আহিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো যেদিকে এটা ওর ক্যারিয়ারের বিষয়?’

এটা নিজেও জানে না ইকবাল। আহির মায়ের মৃত্যুর পর ও আর যোগাযোগ করেনি ইমতিয়াজের সাথে। এর একটা কারন আহির মা মৃত্যুর পূর্বে ওর উইলের কথা বলে দিয়ছিলো আনভীরকে। আনভীর তখন নাবালক হলেও অবুঝ ছিলো না। লন্ডন যাওয়ার পূর্বে শেষ সাক্ষাতেই আনভীরকে আহির মা উইলের কথা বলে। সাথেএটাও বলে এই কথাটি ওর বাবাকে জানাতে। আহির মা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলো বলে প্রথম কয়েকটা বছর আনভীরদের বাড়িতেই থেকেছিলো তারা। তখনই আনভীর আর আজরানের সাথে আহির মায়ের একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে যায়। আনভীর অজ্ঞান ছিলো ছোটমার প্রতি। আর পরবর্তীতে যখন আহির মা জানতে পারে যে ইকবাল আসলে ওকে বিয়েই করেছে সম্পর্তির জন্য তাই আনভীরকেই বলে যায় তার অব্যক্ত কথা।

ইকবাল সাহেবকে এতটা চুপ থাকতে দেখে অপূর্বের বাবা কিছু বললেন না আর। পা এগিয়ে গেলেন অপূর্বের দিকে। বললেন,

‘ ব্যাথা কমেছে?’

‘ আমি কখন বললাম যে আমার ব্যাথা করছিলো।’

নিষ্প্রভ কন্ঠ অপূর্বের। উনি নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না উনি। তাই বললেন,

‘ তুই এত খুশিতে আছিস কেন বল তো অপূর্ব? তোর কাজকর্ম আমার ভালো ঠেকাচ্ছে না।’

‘ কেন কি হয়েছে?’

‘ কি হয়েছে মানে? তুই আমায় বলিসনি কেন যে আহি কার কাছে? আর ওকে নিয়েই বা আসলিনা কেনো? তুই কি ভুলে যাচ্ছিস যতদ্রুত সম্ভব ওগুলো হস্তান্তর করতে হবে? আহিকে এতগুলো বছর বড় করেছি কি এমনি এমনিই? শোন, আহিকে নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নাই। আমি শুধু ওর মায়ের নামে ওই যে ভিটে পড়ে আছে ওটা আমার চাই। এর বাজারমূল্য ১০ কোটি ছাড়িয়েছে এখন।’

হাসফাস করে বললেন অপূর্বের বাবা। অপূর্ব বললো,

‘ চিন্তা করো না। আহি নিজেই আসবে।’

‘মানে?’

‘ সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে। আপাতত ইন্জয় করো ড্যাড। প্রথমে ওই রকস্টারকে মেরে মাটিতে পুতে ফেলতে ইচ্ছে করেছিলো। কিন্তু এমন করিনি কেন জানো? যাতে ওর ইমেজটা সোসাইটিতে নষ্ট হয়। নাহলে অপূর্বকে আঘাত দেওয়া মানুষ এত হজে ফিরে যায়না ড্যাড।’

এমনটা আগেই ভেবে নিয়েছিলেন উনি। অপূর্বের আশ্বাস পেয়ে কিছু না বলে উনি চলে গেলেন এখন। এদিকে অপূর্বের মাথায় চলছে অন্য চিন্তা। যেভাবেই হোক, যেকারনেই হোক, আনভীরের পাস্ট কোনো না কোনো ভাবে আহির সাথে জড়িত। সেটা বের করতেই হবে।

_________________

বিগত দু’দিন ধরে আনি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করছি আনভীরকে। এর একটি কারন মনের আতঙ্ক। বস্তুত অপূর্ব ভাইয়ার সেই কথায় আসলেই ভয় পেয়েছিলাম আমি। আর তাই আমি চেষ্টা করছি যতদ্রুত সম্ভব এর একটা ব্যবস্থা করতে। অপূর্ব ভাইয়ার কাছে ফিরবোনা আমি। যেহেতু মামুর সাথে যোগাযোগ হয়েছে উনাকেই একটা ব্যবস্থা করতে বলবো। নাহিদ ভাইয়াকে বলেছিলাম আমার সব কথা। উনি প্রথমে আমার এই সিদ্ধান্তে তেড়ে উঠলেও আনভীরের চিন্তা করে শান্ত রেখেছিলেন নিজেকে। বলেছিলেন,

‘ ভাইয়ের অমতে এই প্রথম আপনার সহায়তা করতে আমি বাধ্য হচ্ছি ভাবি। কিন্ত ভেবে দেখবেন, এই দুরত্ব কষ্ট ছাড়া কিছুই দিবে না। তাই একটু সময় নিন।’

আমি নির্বাক ছিলাম তখন। এভাবেই তারপর মশগুল হয়ে পড়লাম নিজের প্রফেশনাল কাজে। সকালে বেরিয়ে যেতাম, আসতাম সন্ধ্যার দিকে। আনভীরের সাথে সাদামাটা কথা ছাড়া কোনো ধরনের কোনো কথাই বলিনি। রাতে উনি ফিরলে দুদন্ড আমার সাথে কথা বলতে চাইলেই আমি এড়িয়ে যেতাম। উনি বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন যে হঠাৎ আমি এমন করছি কেনো, আমি শুধু কাতর কন্ঠেবাধ্য হয়েই বলতাম,

‘ আমার একা থাকতে ভালোলাগছে আনভীর।’

তবে আজ আমার কথা শোনেননি উনি। হসপিটালে সন্ধ্যার সময় সচরাচর নাহিদ ভাইয়াই থাকেন আমার সাথে। তবে আজ আনভীর এসেছেন। আমায় এভাবে চুপ থাকতে দেখে রাস্তার ধারে হুট করে গাড়ি থামালেন উনি। আমি আগেই খেয়াল করেছিলাম যে এটা উনার বাড়ির পথ না। এই জায়গাটি ঢাকা থেকে বাইরের ডিসট্রিক্টে নিয়ে যায়। দুধারে খোলা ঘাসে আচ্ছাদিত মাঠ আর মাঝে বিশাল একটা পথ।সন্ধ্যের আবরণে তা অন্যরকম লাগছে।

আনভীর গাড়ি থামিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন আমায়। আমায় অবাক করে দিয়ে চুপচাপ গাড়ির ডিকিতে বসিয়ে দিলেন। আমি প্রতিরোধে কিছু বলবো তা পূর্বেই হাত চেপে ধরলেন উনি।

কাছে এসে থমথমে গলায় বললেন,

‘ সমস্যা কি তোমার?’
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ!

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here