এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব- ৩৪

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব- ৩৪
‘ ব্রেকিং নিউজ! গতকাল আলাস্কা হসপিটাল এ ‘স্টার হিট’ এর ওয়ান অফ দ্য মোস্ট পপুলার আইডল এআরকে নির্মম ভাবে আঘাত করেছেন চট্টগ্রামের মাশহুর বিজনেসম্যান অপূর্ব হাসানকে। কথা উঠেছে যে এআরকের অপ্রকাশিত প্রেমিকার সাথে কোনো যোগসূত্র আছে তার। হসপিটালের ফুটেজে ভেসে উঠা এমন দৃশ্য ভাবিয়ে তুলছে এআরকের ফ্যানডমকে। বাকি আপডেট পরবর্তীতে হাজির হবে। ন্যাশনাল টিভি। ঢাকা।’

সকাল ১০ টার নিউজে বড় স্ক্রীনে এমন খবর দেখে চমকে উঠলাম আমি। হাতে থাকা কফি মগটা আপনাআপনি রেখে দিলাম সোফার সামনে রাখা টি-টেবিলে। নাহিদ ভাইয়া নিরুত্তর বসে আছেন। অনমনস্কভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন মোবাইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘ এসব কি ভাইয়া?’

মলিন হাসলো সে। বললেন,

‘ গতরাত থেকে আপনি যে চিন্তায় ঘুমাতে পারেননি সেটাই।’

কথাটি সত্যি। গতকাল আনভীরের অপূর্ব ভাইয়ার সাথে হাতাহাতির পর মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিলো যে মিডিয়ায় খবরটা প্রকাশ পেলে কি অবস্থা হবে। আর আমার ভয়টাই সত্যি হলো। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে এআরকের গোপন প্রেমিকার খবর। সৌভাগ্যবশত মিডিয়া এখনও জানতে পারেনি এআরকের অপ্রক্যাশিত প্রেমিকা কে। সেই সাথে এটাও জানতে পারে নি যাকে তারা অপ্রকাশিত প্রেমিকা ভাবছে, সে আসলে এআরকের ওয়াইফ। গতকাল হসপিটালের ধস্তাধস্তির বিষয়টা সবাই খেয়াল করলেও কারও নজরে এটা পড়েনি যে এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম আমিও। এআরকে যে ‘স্টে ইওয়ে ফ্রম মাই গার্ল’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন, কেউ বিন্দুমাত্র আচঁ করতে পারেনি যে সেই মেয়েটা আমি। একদিক দিয়ে এটা গুড লাক হলেও পরন্তু ভাবলাম এই সবকিছুর পেছনে আমিই দায়ী। এআরকের চিফ সেক্রেটারি হওয়া সত্বে নাহিদ ভাইয়ার মোবাইলে আসছে একের পর এক নিউজ চ্যানেলের কল। নাহিদ ভাইয়া পরনে গ্লাসটা একটু ঠিকঠাকভাবে পড়ে তপ্তশ্বাস ছাড়লেন। মোবাইলের পাওয়ার বাটন অফ করে বললেন,

‘ আজ এরা শান্তিতে থাকতে দিবে না।’

আমি পাশ থেকে ল্যাপটপ নিয়ে অন করলাম এবার। উদ্দেশ্য একটু হসপিটালের ওয়েবসাইট চেক করে দেখা যে আজ কোনো ডিউটি আছে কিনা। কিন্ত পোর্টালে একের পর এক সেই ট্রেন্ডিং নিউজ দেখে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো যেনো। যেই সাইটে যাই সেই সাইটেই এআরকে। আর হেডলাইনগুলো এমন ছিলো যে সেই রাগ আরও চড়ে উঠলো মস্তিষ্কে। টিআরপি বাড়ানোর জন্য মানুষ যে ঠিক কি কি করতে পারে আজ স্পষ্ট টের পেলাম।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ শাট ডাউন করলাম। নাহিদ ভাইয়া বললেন,

‘ আজ হসপিটালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আপনার। আবার আপনার ওই অপূর্ব ভাইয়া এসে পড়লে আনভীর ভাই হয়তো মেরেই ফেলবেন অপূর্বকে।’

কথাটা নেহাত মিথ্যা না। কিন্ত ‘অপূর্ব’ নামটা কর্নকুহরে বেজে উঠতেই গতকাল তার বলা কয়েকটি কথা মনে পড়লো। ব্যাপারটা আমি শুরু থেকেই খেয়াল করেছি যখন আনভীর জোরপূর্বক তুলে নিয়ে এসেছিলেন আমায়। কিছু এটা লুকাচ্ছেন আনভীর। প্রথমে উনি চেয়েছিলেন রাহি আপুর খোঁজ পেতে যার জন্য আমায় ব্যবহার করেছিলেন কিন্ত এখন ব্যাপারটি অন্য। উনি আমার পাস্ট লাইফ সম্পর্কে মোটামুটি সবটাই জানেন যা আমার নিকটাত্নীয় ছাড়া কারও জানার কথা নয়। হ্যাঁ আমার বাবা মায়ের লাভ ম্যারিজ ছিলো বলে আনভীরের বাবার সাথে একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো আমার বাবা মায়ের। কিন্ত মায়ের মৃতুর পর বাবার আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে আনভীরের বাবা অনেক আগেই আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এর মানে কি এই দাঁড়ায় যে আনভীর আমার আমার পাস্ট কোনো না কোনোভাবে জড়িত?

নাহিদ ভাইয়া উঠেই যাচ্ছিলো তখনই আমি নাহিদ ভাইয়াকে বললাম,

‘ কিছু কথা আছে আপনার সাথে।’

আমার কথার ধরনে তার গুরুত্ব আন্দাজ করতে পেরেছেন হয়তো নাহিদ ভাইয়া। তাই সবিনয়ে বললেন,

‘ কি কথা?’

‘ আচ্ছা আপনি তো বলেছিলেন যে রাহি আপু আনভীরকে ব্ল্যাক মেইল করছে উনার মেন্টালি কন্ডিশনের জন্য।’

‘ মেন্টালি সিকনেস!’

শুধরিয়ে দিলেন নাহিদ ভাইয়া। উনার কথায় আমি একটা বিশেষ ক্লু পেয়ে গেলাম৷ হঠাৎ একটা দিক স্পষ্ট হয়ে আসতেই বাঁকা হাসি দেই আমি। বলে উঠলাম,

‘ আমি ঠিকই বলেছি নাহিদ ভাইয়া। গুগুলে সার্চ দিন, প্যারানয়েরড পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার মেন্টাল কন্ডিশন, নাকি মেন্টাল সিকনেস।’.

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন নাহিদ ভাইয়া। বললেন,

‘ তো এখন এ কথা বলছেন যে?’

‘ উনার রিপোর্ট গতরাতে আবার দেখেছি আমি ওই রুমে গিয়ে যেটা আপনি দেখতে দেননি৷ আর যা দেখলাম, উনার এই প্রবলেমটা খুব একটা বড় পর্যায়ে যায় নি। যদি যেত তাহলে অহেতুক সন্দেহ করতো আমায়, অদ্ভুত আচরণ করতো। এতমাসে এর এক অংশও আমি দেখিনি। তাহলে রাহি আপু কেনো ব্ল্যাকমেইল করবে আনভীরকে। এর মানে কি এই যে আপনারা আমার সামনে যেই যুক্তি স্থাপন করেছেন সেটা একটা বাহানা? আপনাদের অন্য সম্পর্ক আছে রাহি আপুর সাথে?’

নাহিদ হকচকিয়ে গেলো এতে। তবুও স্থির রাখার চেষ্টা করলো নিজেকে। আনভীর যে আহির নামের প্রোপার্টি আর আহিকে ওর চাচার ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচাতে চাচ্ছে সেটা আহির জানার কথা নয়। নিঃশ্বাস ফেললো সে। বললো,

‘ সেটা আনভীর ভাইকেই নাহয় জিজ্ঞেস করুন।’

‘ কেন আপনি জানেন না?’

‘ না জানি না আমি।’

আমি জানি মিথ্যে বলছেন নাহিদ ভাইয়া। অবিশ্বাসের সুরে বললাম,

‘ এমন কোনো খবর নেই যেটা আনভীর আপনাকে না জানিয়ে করে। তাহলে আপনি ভাবলেন কিভাবে যে আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করবো মিঃ নাহিদ রেজয়ান?’

নাহিদ ভাইয়া তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। যেন পণ করেছে বোমা ফাটালেও বলবে না সত্য কথাটা। অবশ্য আমি আগেই বুঝেছিলাম যে এমন কিছুই একটা হবে। নাহিদ ভাইয়া এবার বলে উঠলো,

‘ আমি আগেই বলেছি ভাবি যে আমার কোনো কিছু বলার সুযোগ নেই। আমার কাজ আপনার টেক কেয়ার করা এন্ড ছায়ার মতো আপনার পাশে থেকে আপনার প্রতিটা খবর এআরকের কাছে দেয়া। আর রইলো রাহির কথা। আমি শুধু এতটুকুই বলবো, যাকে আপনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছেন সেই বড়বোনই আপনার পিছপিছে ছুরি মেরেছে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো যে আপনার মতো এমন বাবা-বোন আল্লাহ যেন কাউকে না দেয় যারা টাকার জন্য রক্তের সম্পর্ক কে বিনাশ করতে পারে।’

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে চলে গেলো নাহিদ ভাইয়া৷ আমি চুপচাপ বসে ছিলাম সেভাবেই। কেমন যেন গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছি। আমার অতীত নিয়ে ঘাটার ইচ্ছে নেই সত্যি, না ইচ্ছে ছিলো সেগুলোর কথা মনে করার। আমি চেয়েছিলাম আনভীরের সাথে সারাজীবন কাটাতে। হয়তো ভাগ্য সেটাও কেড়ে নিবে আমার থেকে। চাচী ঠিকই বলতো,

আসলেই ভালোবাসার মানুষ পাওয়ার সৌভাগ্যটা আমার নেই। যেই আমার সাথে জড়ায়, তারই জীবন ধ্বংস৷ যেমনটা আনভীরের হচ্ছে। আমি জানি যে এই নিউজের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে হলেও অপূর্ব ভাইয়ার হাত আছে। আর তাই আমি চাইনা আমার জন্য আনভীরের জীবন বা ক্যারিয়ারে কোনো প্রভাব পড়ুক।

আমি সিড়ি ভেঙে উপরে গেলাম এবার। আনভীর সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করছিলেন আর দেখছিলেন টিভিতে উনাকে নিয়ে অজস্র নিউজ। অন্য কেউ হলে হয়তো ভেঙে পড়তে এমন নিউজ দেখে বা একটু হলেও টেনশনে থাকতো৷ অদ্ভুত হলেও এমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখিনি আমি আনভীরের৷ যেন এসব কোনো ব্যাপারই না।

তারপর উনি সেই যে রুমে গেলেন, আর বের হলেন না।আমি পা টিপে টিপে রুমে গেলাম এখন। অফ হোয়াইট কালারের ওয়ালে দেখা গেলো আনভীরের একটা বড়ো ফ্রেমের ছবি৷ ছবিটা আনভীরের খুব পছন্দের। কারন এই বার্থডে তে উনার ফ্যানরা উনার উদ্দেশ্যে সারপ্রাইজ হোল্ড করেছিলেন। রুমে কেউই নেই। বারান্দায়ও উনার গিটার পড়ে আছে। আমি সেটা নিয়ে ডেস্কের সাইডে গিটার রাখার জায়গাটিতে রেখে দিলাম। তখনই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন আনভীর৷
একটা কালো ট্রাউজার পড়েছেন উনি। এক হাত দিয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত। ফর্সা লোমহীন বুকের বিন্দু বিন্দু পানি দেখে অস্বস্তি হলো আমার। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকানোর কর নজর ফিরিয়ে বাইরেই পা বাড়াচ্ছিলাম আমার হাত টেনে নিজের কাছে টানলেন আনভীর৷ আমার পুরো শরীর স্তব্ধ। আনভীর বেডে বসে পড়লেন। জড়ানো গলায় বললেন,

‘ চুলটা মুছে দাও তো আহি!’
.
.
.
.
#চলবে..ইনশাআল্লাহ

এখন থেকে পূর্বের অপ্রকাশিত বিষয়গুলো একটু একটু করে তুলে ধরা হবে। কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভুলক্রুটি মার্জনীয়।
❤️কায়াভ্রমর❤️-{Stories of Kayanat Afrin}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here