এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা- কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ৪৬+৪৭

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা- কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৬+৪৭

‘ ডোন্ট ডেয়ার টু চাচ মাই গার্ল!’

কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারবেনা ঠিক কতটা অধিকারবোধ আছে এ কথায়। ‘মাই গার্ল’ কথাটি ঝনঝন করে বাজতে থাকলো আমার কানে। আমি এখনও সেভাবেই আছি, সেভাবেই মিশে আছি আনভীরের বুকে। মুখ তুলে আশপাশ দেখার সাধ্য আমার নেই। গার্ড হকচকিয়ে গেলো। তবুও নিজের মুখের শক্তপোক্ত আদল বজায় রেখে বললো,

‘ বাট স্যার…..’

‘ আই সেইড, ডোন্ট ডেয়ার টু চার্ট মাই গার্ল। ‘

আনভীরের এমন থমথমে কন্ঠে আর কিছু বলার সাহস পেলো না গার্ড।

তাই তিনি চোখ সরিয়ে এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাংবাদিকমহলের দিকে,

‘ আপনারা কি করছেন ধারনা আছে?’

‘ আমরা আমাদের কাজই করছি স্যার। আমাদের কাজ হলো সত্য তুলে নিয়ে আসা। এবং সেটাই আমরা করছি।’

‘ কাজ মাই ফুট! এভাবে একটা মেয়েকে হ্যারাস করার মানে আপনারা জানেন? সত্য না জেনে এভাবে তার ক্যারেক্টারে হাত তুলা কি সেটা জানেন?’

একজন মেয়ে এগিয়ে এলো এবার। চোখে মুখে জানান দিচ্ছে চাঞ্চল্যতা। গলায় ন্যাশনাল নিউজের আইডি দেখে সপষ্ট বুঝা গেলো যে এই মেয়ে অনেক উচ্চপদস্থের সাংবাদিক। সকলে যেই প্রশ্নটা সরাসরি বাকিরা এআরকের মুখের ওপর করতে ভয় পাচ্ছিলো সেটাই সে করে বলে উঠলো,

‘ তাহলে আপনি যাকে ‘মাই গার্ল’ বলে সম্বোধন করেন এটা দিয়ে কি
এই প্রমাণিত হয়না যে আপনার প্রেমিকা যার সঙ্গে আপনি ছয় মাসের অধিক লিভ টুগেদারে আছেন?’

‘ হোয়াট ডিড ইউ সে?’

বাকা হাসি দিলো মেয়েটি। আজ এই খরবের গোঁড়া পর্যন্ত গেলে নিউজের টিআরপি যে হুলস্থূলভাবে বেড়ে যাবে সেটা ভেবেই বলে উঠলো,

‘ ভুল কিছু বললাম নাকি এআরকে? একজন রকস্টার তার গার্লফ্রেন্ডদের সাথে রাতের পর রাত নিজের বাংলোতে থেকে যাবে এর মানে কি দাঁড়ায়? যতটুকু ফ্যানডম জানে আপনি সেপরেট থাকেন ফ্যামিলি থেকে। সেখানে এক মেয়ের সাথে এভাবে থাকালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা কি হ্যারাসের কিছু?’

‘ হ্যান্ডেট পার্সেন্ট এটা হ্যারাসমেন্ট। আর আপনাদের কোনো রাইট নেই ওর সাথে এভাবে কথা বলার।’

‘ কিন্ত কেন এআরকে?’

‘ সেই কারন জানার অধিকার এটলিস্ট আপনার নেই। যেই মেয়ে অকপটে অন্য মেয়ের চরিত্রে আঙুল তুলতে পারে তার কাছে এআরকে কিছুতেই জবাবদিহিতা করবে না।’

আনভীরেক এতটা ভয়াবহ ভাবে রাগতে এর আগে কখনও দেখা হয়নি তাকে। তাই বুঝতে বাকি নেই এর কারন কি। প্রথম দফা আনভীরের মাই গার্ল বলে আমায় সম্বোধন করা সবাইকে অবাক করলেও এখন সাংবাদিকমহলের কাছে পুরো উন্মুক্ত হয়ে গেলো আনভীর আর আমার সম্পর্কটি। সেই সাথে বেড়ে উঠলো প্রশ্নের জোয়ার। প্রশ্নগুলো এতই বিশ্রি ধরনের ছিলো যে আমি নিতে পারছিলাম না আর। একে এসব কারনে হসপিটাল থেকে সাসপেন্ড তার ওপর এমন বিরূপ পরিস্থিতির সাক্ষাৎ জীবনে এই প্রথবার হওয়াতে হঠাৎ আমার শরীর দুর্বল হয়ে আসতে থাকলো। ক্রমাগত চোখ হয়ে আসতে লাগলো অন্ধকার। আনভীর আমায় নিয়ে সরে আসতে নিলেন তখনই আমি দুর্বল কন্ঠে বললাম,

‘ উনাদের চলে যেতে বলুন আনভীর প্লিজ। আমি…আমি….!’

হঠাৎ মাথায় চিনচিন ব্যাথা হতে থাকলো আমার। ক্রমশ অস্থিরতায় সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসাতে শরীরের ভার অনেকটাই দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে ছেড়ে দিলাম আমি নিজেকে। আমি ঝাপসা চোখে দেখছি আনভীর গালে হাত দিয়ে সমানতালে ডেকে চলছে আমায়। আফসোস কয়েকটা গার্ড ছাড়া কেউ এলো না অজস্র মানুষ থাকা সত্বেও। সবাই ব্যস্ত কে কত আগে আমার ছবি তুলে আনভীরের মুখে বলা কথাটি হেডলাইনে ছাপাতে পারবে। হায়রে সমাজ!

________________________

ফিনফিনে মেঘের আনাগোনা। সেই সাথে বহমান শীতল বাতাস। আকাশের রোদ্দুর মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টির ন্যায় পড়ছে ঝরে ঝরে। আমি চোখ খুলতেই প্রথমে জানালার আলোর মুখোমুখি হলাম। সেটা দিয়ে আলো তেরছাভাবে হাতের ওপর পড়ছে কাত হয়ে শুয়াতে। এটা আনভীরের রুম। কিন্ত আমি মনে করতে পারছিলাম না যে আমি এখানে এসেছি কিভাবে।

পরন্তু হঠাৎই মনে পড়লো গতরাতের কথা। হ্যাঁ জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। সেটা যে উত্তেজনাতেই তা টের পাচ্চছি এখন। কতক্ষণ অচেতন ছিলাম হিসেব নেই। তবে লম্বা সময় হয়তো ছিলাম বলেই ঘাড়ে রগরগে ব্যাথার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে ভেসে এলো এক স্নিগ্ধ মেয়েলি সুর,

‘ এখন কেমন লাগছে তোমার আহি?’

থমকালাম আমি। তৎক্ষণাৎ ঘাড় বাকিঁয়ে পেছনে ফিরলাম। প্রথমক্ষণে মনে হয়েছিলো স্বপ্ন দেখছি আমি। হ্যাঁ এটা স্বপ্নই। আমি এখনও জ্ঞানে আসিনি। নাহলে ঘুম থেকে উঠে এতসময় পর এই স্নিগ্ন মানবীটিকে দেখতাম কিভাবে? আমি ভাবের পরিস্ফুটন ঘটিয়ে বলে উঠলাম,

‘ শিউলি ভাবি তুমি?’

ভাবি ফিচেল হাসি ঝুলালেন ঠোঁটকোলে। মুখে স্নিগ্নতার আদল বিদ্যমান। কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়েছেন ভাবি। আগের তুলনায় অজান্তেই একটু অন্যরকম লাগছে। অল্পসময়ের পরিচয় হলেও আনভীরের পরিবারে নাহিদ ভাইয়ার পর এই হলো আমার কাছের মানুষ। একেবারেই আপন বড় বোনের মতো। রাহি আপু আমার সাথে থাকতো না। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো নিজের সাথে। তাই বড়োবোন থাকতেও সেটা খুব বেশি টের পাইনি ছোটোবেলায়। এই মানুষটা হুট করেই আমার এই শূণ্যতায় পা বাড়িয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আমার গল্পের সঙ্গী। দুরত্ব ছিলো মাঝে, সেই সাথে ব্যবধানও। তবুও ভাবি আগলে নিয়েছিলেন আমায় ছোটো বোন স্বরূপ। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কেমন আছো ভাবি?’

‘ অসুস্থ তুমি, টানা আটঘন্টা অচেতন ছিলে আর আমায় জিঙ্গেস করছো যে আমি কেমন আছি? ভারি অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি!’

আমি দুর্বল হাসি দিলাম। সেই সাথে অবাকও হলাম আমার নিজের শারীরিক অবস্থার কথা শুনে। সত্যই এতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম? ভাবি আমার শরীরের তাপমাত্রা দেখলেন। তারপর বললেন,

‘ গতরাতে আনভীর ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলো আমায়। তার ওপর কাল যা বিদঘুটে অবস্থা হলো, তোমার এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।’

আমি এ নিয়ে কথা বাড়ালাম না। আসলে ইচ্ছে করছিলো না কথা বলতে সেই প্রসঙ্গ নিয়ে। ভাবি বললো,

‘ আচ্ছা আমি আনভীরকে ডেকে আনছি। ছেলেটা সারারাত বিছানায় বসে ছিলো তোমার পাশে। আমি এখানে ছিলাম বলে তোমার পাশে শুতেও পারছিলো না অস্বস্তিতে। শেষরাতে জোর করে আজরানের সাথে ঘুমাতে পাঠিয়েছি।’

‘ আজরান ভাইয়াও এসেছে?’

‘ তোমার শ্বশুড়-শাশুড়ি সব এটা সকালে এসেছে ম্যাডাম। বাড়ির ছোটোবউয়ের এ অবস্থা আর কেউ আসবে না তা কি হয়?’

আমায় এ কথাটি বলে ভাবি দুর্বলভাবে উঠলেন খাট থেকে আনভীরকে ডাকার জন্য। তবে বেশি কষ্ট করতে হয়নি উনাকে। দু’কদম এগোনোর পরেই দরজার নব খুলে ভেতরে আসলেন আনভীর। আমি একপলক উনাকে দেখে নিলাম। ক্লান্তির ছাপ পড়েছে মুখে। চোখের নিচে আবছা কালি জানান দিচ্ছে উদ্বিগ্নতার। ভাবি তা দেখেই বললো,

‘ যাহ! এসে গিয়েছে তোমার বর।’

আনভীর ভাবির উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জানালেন ইশারায়। অতঃপর পা ফেলে আমায় কাছে ছুটে আসলেন। আমি বাচ্চাদের মতোই হাত পা গুটিয়ে খাটে বসে ছিলাম। জ্ঞান ফিরার ফলে বাধা চুলগুলোর আধা খুলে মুখের দুপাশে অগোছালোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আনভীর আর বরাবর বসলেন। আমার চুলগুলো সন্তর্পণে সরিয়ে বললেন,

‘ কেমন লাগছে এখন তোমার?’

কথাটিতে কোনো কৃত্রিম অনুভূতি নেই। শুধু বিদ্যমান একগুচ্ছো পাগলামি ভালোবাসা। আমি আনভীরের চোখ বরাবর তাকালাম। ভ্রু জোড়ার নিচে দুটো টলটলে চোখ যেন অন্যকিছুরই প্রতিচ্ছবি। এই মানুষটার গানের গলার পর আরেকটি অন্যতম ক্ষমতা হলো চোখের মায়া। যা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়। আমি মাথা নাড়িয়ে মিহি স্বরে বললাম,

‘ ভালো !’

‘ যাহ্! তোর মুখে কথাটি শুনে এবার শান্তি পেলো তাইলে ভাইয়া। গতকাল তো তোর জ্ঞান ফিরছিলো না দেখে পুরোই অস্থির হয়ে উঠেছিলো। তা জানিস?’

নীলু বললো কথাটি। দরজা খোলা ছিলো এবং শিউলি ভাবির উপস্থিতি দেখে সে নির্বিকার ভাবেই ভেতরে এসেছিলো। আমি চট করেধ রতে পারলাম না নীলুর কথা। অতঃপর শিউলি ভাবির কথায় বুঝলাম, বেশি স্ট্রেস নেওয়াতে প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিলো আমার। ফলে জ্ঞান আসতে সময় লাগে। তার ওপর শরীর দুর্বল। আনভীর এসব দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বেশ। অগত্যাই মাঝরাতে তাই শিউলি ভাবিকে আসতে বলেন আজরান ভাইয়ার সাথে। আর বাবা-মা আজ সকালেই এসে পড়েছেন। ভাবির কথায় আমি মৌনতা কাটালাম। নীলু এবার বলে উঠলো,

‘ তোর কপাল অনেক ভালো রে আপু এমন ভাবি পেয়েছো যে প্রগনেন্ট অবস্থাতেও রাতে ছুটে চলে আসে তোকে দেখার জন্য। ইশশ!’

বিষম খেলাম আমি। প্রথমে মনে হলো নীলুর মাথা বোধহয় বিগড়িয়ে গিয়েছে। চট করে তাই বললাম,

‘ ত-তুমি প-প্রেগনেন্ট ভাবি?’

‘ ওমা! তুমি জানোনা? একসপ্তাহ আগেই তো প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়ে আনভীরকে জানালাম। কিরে দেবরজী , তুমি জানাওনি?’

‘ না ভাবি। আসলে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।’

বলেই ফিচালো হাসি দিলেন আনভীর। এবার আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কেন সে রাত আনভীর শুধু বেবিপ্ল্যান বেবি প্ল্যান করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলেন। তাহলে তখনই কি আমায় জানাতে চেয়েছিলেন এটা? নীলু আহামরি সুরে বললো,

‘ আহা! ভাবি চলো তো। দু’জন আমরা কেটে পড়ি। ভাইয়া দেখছো না হাসফাস করছে। ওদের নাহয় একটু একা থাকতে দেই।’

এই বলে দ্রুত কেটে পড়লো দু’জন। অতঃপর ছড়িয়ে পড়লো নিস্তব্ধতা। হাজারো শূণ্যতার ভীড়েও বুক কাঁপছে আমার ধড়ফড় করে। আনভীর নিষ্পৃহ চাউনি দিলেন। হাতের ভর ছেড়ে দিলেন খাটে। আমার অস্থিরতা হয়তো টের পেয়েছিলেন উনি। তাই জড়ানো কন্ঠে বলেলন,

‘ যাও ফ্রেস হয়ে এসো।’

__________________

বেশ কিছুক্ষণ করেইর রুমে এসে আমায় দেখে গেলেন বাবা-মা আর আজরান ভাইয়া। এক মুহুর্তের জন্যও আমায় নিচে নামতে দেয়নি। মা এসে চুপচাপ সকালের নাস্তা খাইয়ে দিয়েছিলেন আমায়। আমি তখন বসে ছিলাম চুপচাপ। উনার মুখ থেকে একপলকের জন্যও সরাইনি চোখের দৃষ্টি। তা দেখে আনভীরের মা স্নেহমাখা কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ কি দেখছো এভাবে আহি?’

‘ আপনাকে, লোকে বলে আল্লাহ তায়ালা কাউকে কেড়ে নিয়ে গেলে অন্যকাউকে পাঠিয়ে দেন। মা তো চলে গিয়েছিলো আমায় ছোটবেলাতেই৷ তখন রোজ রাত কাদতাম মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। হয়তো বেশ লম্বা সময় পর হলেও আল্লাহ সেটা ফিরিয়ে দিয়েছেন আমার কাছে।’

মায়ের ঠোঁটকোলে হাসি যেন আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে এতে। চোখের সেই দৃষ্টি যেন অকপটে ধরিয়ে দিচ্ছে সেই প্রাণোবন্ত হাসিটা। মা জানতেন আমার অন্তরের অবস্থা, তাই একবারও কথা উঠালেন গতকালের সেই ঘটনাগুলোর। এমন ভান করলেন যেন কিছুই হয়নি, আর তার মুখ্য কাজ আমার যত্ন করা। মনের অন্ততৃপ্তি যেন এতে আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠলো মায়ের জন্য।

___________

লালাভ বিকেল। পশ্চিম আকাশে বিদ্যমান হালকা সোনালী রোদ। সে রোদে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হলেও যেন মন সেদিকে নেই। দিনটা ঘরে বদ্ধভাবেই পার হয়েছে। শিউলি ভাবি এলো, আজরান ভাইয়া এলো, নীলু এলো এমনকি শেষে নাহিদ ভাইয়াও। কিন্ত কেউ আমার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলার সুযোগ পেলো না। আমার সায় না পেয়ে হতাশ হয়েই চলে গেলো।
বারান্দার দরজার সামনে থাকা ডিভানে শার্লক হোমসের বই পড়ছি আনমনে। চেষ্টা করছি সবকিছু থেকে সরে নিজেকে একা রাখতে। এরজন্য মোবাইলও সুইচড অফ করে রেখেছিলাম যাতে সেদিকে মনোযোগ না দিতে পারি। তন্দ্রাঘোরে আবরণে সাজানো বিকেল এতক্ষণ চুপচাপ থাকতেও হঠাৎ শুনতে পেলাম মানুষের শোরগোল। সময় যতই বাড়ছে ততই বাড়ছে শব্দটা। এবার উঠতে হলো আমায়৷ রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ির সামনে জানালার দিকে বাড়ির লনের সামনে উঁকি দিতেই আমি হতভম্ব। আবারও এসেছে তারা। আতঙ্কে ঠোঁট কামড়ে সরে আসতেই আনভীর কোথা থেকে এসে আমার কোমড় চেপে ধরলো। আমি চোখ তুললাম৷ উনার নিষ্পলক ভাবভঙ্গি নাড়িয়ে দিলো হৃদয়। উনাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

‘ আনভীর, উনা…উনারা আবার এসেছে। প্…প্লিজ কিছু করুন না?’

‘ আহি রিল্যাক্স।’

‘ গার্ডকে বলে দিন চলে যেতে উনাদের। আবার ওসব বাজে প্রশ্ন করলে আমি মরেই যা…..’

‘ আহি!’

শীতল কন্ঠে পুনরায় ডাকলেন আমায়। আমি নিজেকে শান্ত করলাম। পূর্ণ চোখে তাকালাম আনভীরের দিকে। চুল মুখ ছেয়ে গিয়েছে এক অব্যক্ত সৌন্দর্যে। আনভীর বলে উঠলেন,

‘ আমি ওদের আসতে বলেছি আহি।’

বিস্ময় বাড়লো। সেই সাথে বাড়লো ভয়ও। বললাম,

‘ কিন্ত কেনো?’

‘ কারন টা সময়ের সাথেই জেনে যাবে। চলো আমার সাথে।’

‘ না প্লিজ আনভীর! আমি নার্ভাস ফিল করবো এত মানুষের সামনে।’

বাচ্চারা যেন ভয় পেলে তাদের ভরসাযোগ্য মানুষকে নির্দ্বিধায় বলে ঠিক সেমনভাবেই নিজের দুর্বলতার কথা জানালম আনভীরকে। আনভীর সেরকম ভাবেই আশ্বস্ত করলেন আমায়। কোমড় চেপে কাছে টেনে নিয়ে এসে বলে উঠলেন,

‘ রিলেক্স! আমি আছি। ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। গতকাল আমার থাকাতেও ওরা যে প্রশ্নগুলো করেছিলো এবার তা করার বিন্দুমাত্র সাহস পাবে না।’

অবশেষে দোতলার সামনের দিকের লনের সামনের উঁচু বারান্দায় নিয়ে গেলেন আমায়। নিচে লনে অসংখ্য মানুষ। অন্যসময় এখানে বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড পাহারা দিলেও এখন এখানে মানুষের সমারোহ। এক বিশাল অংশ এর মধ্য সাংবাদিক। আর বাকি গেটের বাইরে যারা ভিতরে ঢুকার জন্য প্রচেষ্টায় আছে তারা খুব সম্ভব এআরকের তথাকথিত ফ্যানরা।

আমি হঠাৎ গুটিয়ে ফেললাম নিজেকে। ভয়ে সিটিয়ে আসতেই আনভীর কোমড় চেপে নিজের ঠিক পাশাপাশি দাঁড় করালেন আমায়। অতঃপর বলে উঠলেন,

‘ যাকে আপনারা ভাবছেন আমার আশ্রিতা হিসেবে, সে আমার আশ্রিতা না, আর না আমরা লিভ টুগেদারে আছি। সি ইজ মাই ওয়াইফ মিসেস আনভীর রেজওয়ান খান। অল অফ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’

পুরো পরিবেশ বিস্ময়ে ছাড়িয়ে গেলো এবার। একে একে সবাই৷ নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। এত কিছুর পর ওরা বিন্দুমাত্র ভাবতে পারেনি যে আনভীর আর আহি হাজবেন্ড ওয়াইফ হতে পারবে। একজন প্রশ্ন তুললো,

‘ বাট এআরকে এটা কত পার্সেন্ট সত্য মানবো কিভাবে আমরা৷ মিস আহির হসপিটালে সার নেম চেইন্জ না, না মিসেসের ট্যাগ লাগানো আছে, তাহলে? এমনটা কি আমরা ধরতে পারি না যে এটাও আপনাদের সত্য লুকানোর একটি প্রচেষ্টা। আনভীর বাঁকা হাসি দিলো। বলে উঠলো,

‘ আমি জানতাম কেউ না কেউ এমন প্রশ্ন তুলবেনই। যাই হোক আপনাদের প্রমাণপত্র আমি ওসির কাছে দিয়েছি। প্রমাণপত্র মানে বুঝলেন তো, আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার। সেখানে সিগনেচার এন্ড ডেট মনোযোগ দিয়ে দেখে নিবেন৷ ‘

‘ ও..ওসি?’

হতভম্ব হয়ে গেলো সবাই। যেন এখানে পুলিশি মামলায় জড়িয়ে যাবে ভাবনায়ও ছিলো না। আনভীর বলে উঠলেন,

‘ আপনারা কি ভাবলেন আপনাদের এই স্টুপিড কাজকর্ম একজন মেয়েকে হ্যারাস করবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকবো? যাই হোক উত্তর জেনেছেন তো যে আহি আমার কে? তাই ব্যাপারটা এখানেই থামাবেন। আদারওয়াইজ আমি আমার ওয়েতে তা বন্ধ করতে ভালোবাসবো।’

আর কোনো প্রশ্ন তুললো না কেউ। আনভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। অতঃপর তাকিয়ে আমার অস্বস্তি ভাব কাটিয়ে তুলতে আশ্বস্ত করলেন। তারপর বলে উঠলেন,

‘ বিয়ের ব্যাপারটা লুকানোর পার্সোনাল কারন ছিলো আমার৷ এর একটি কারন সামবডি ট্রাইড টু মার্ডার হার৷ যার জন্য ওকে এভাবে লুকিয়ে রাখা। আর দ্বিতীয় কারন বিয়েটা হয়েছিলো একেবারেই হুট করে। বলতে পারেন বাবা বাধ্য করেছে। আর তাই আমি চেয়েছিলাম সবার সামনে খোলাসা করেই ব্যাপারটা আগাতে। যাই হোক, ব্যাপারটা যেহেতু গড়িয়ে গিয়েছে তাই আমি এনাউন্স করছি সবার সামনে আবারও বিয়ে হবে আমাদের। সবার সামনে, পূর্ণরূপে। আগে যেভাবে লুকিয়ে আহিকে বিয়ে করেছিলাম এবার সবার সামনেই আমি আহিকে এক্সেপ্ট করবো৷ ‘কজ আই লাভ হার!’

বুকে এক ঠান্ডা বায়ু আমার প্রবাহিত হতে থাকলো। এত ক্যামেরার আলোকে অন্যরকম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে আনভীরের চোখে মুখে৷ ওষ্ঠে চাপা হাসি, মুখে গাম্ভীর্যের রেশ, চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালে, আর হাতের দৃশ্যমান নার্ভ যে কাউকে কাঁপিয়ে দিতে বাধ্য। এই পুরো মানুষটাই তাইলে আমার? মনে হচ্ছে স্বপ্নে আছি। এতগুলো মানুষের সামনে আমায় এক্সেপ্ট করাতে স্তব্ধ হয়ে আছি। উনি আরও একবার প্রকাশ করলেন আমার প্রতি উনার অসীম ভাললবাসার।

.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

সবার সুন্দর সুন্দর মন্তব্য চাচ্ছি আজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here