এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ৪৮

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৮

আকাশে আজ পুন্জ পুন্জ মেঘের আনাগোনা। সেখানে পাখিদের ঝাঁক উঁড়ে চলছে সমানতালে। গতকাল থেকেই প্রকান্ড গরম পড়েছে। যে কেউ চট করে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যেতে পেরে এটা কিসের মৌসুম। আমি ড্রইংরুমে বসে শিউলি ভাবিকে দেখছিলাম। সময়ের সাথে উনার শরীর গুলুমুলু রূপ ধারন করেছে। মুখে স্নিগ্ধতার রেশ। অন্তঃসত্বা হওয়া সত্বেও মাঝে মাঝে মুখের ভাবে কিশোরীর ন্যায় খামখেয়ালীপনা ফুটে উঠে। আজরান ভাইয়া তাই এখন আমার কাছাকাছি রেখেছেন ভাবিকে। উনি নিজেই বাবার সাথে কাজে ব্যস্ত আর এদিকে আমিও ভাবির কেয়ার নিতে পারবো তাই যত্নের যাতে কোনো ক্রুটি না হয়, সেজন্যই এখানে রাখা। নীলুও এখন সারাদিন এখানে ভাবির সাথে খোঁশগল্পে মেতে থাকতে ব্যস্ত।

সেই ঘটনার দশদিন পার হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। ফ্যামিলির সবাই এখন তুমুল ব্যস্ত বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে।। কিছুদিন আগে মামু মামি গাজীপুর থেকে এসছিলেন। তারপর কথা আনলেন এ আমার পক্ষ বা পরিবার থেকে আয়োজন সব উনারা করবেন। বাবার প্রসঙ্গ এদিকে না টানাতে মনে শান্তিই পেলাম আমি। মনে মনে অপূর্ব ভাইয়ার ভয় থাকলেও এখন জানি উনি কিছু করতে পারবেন না আর। আমার উচিত অতীতকে ভুলে বর্তমান নিয়ে ভাবা।

আমি ঘড়ির কাটার দিকে মনোনিবেশ করলাম। ছোট কাটাটি আট পেরিয়ে নয়ের দিকে গন্তব্যহীন ভাবে এগোচ্ছে। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ি আমি। কারনটা আনভীর। বিগত আধ ঘন্টা ধরো সুইমিং করছেন পুলে। তাই উঠে ইয়ার্ডের দিকে গেলাম আমি পা বাড়ালাম। রৌদ্দুরের আলোকে চিকচিক করছে পুলের নীলাভ পানি। সেখানেই ব্যস্ত অতিমাত্রার নির্বিকার সেই মানবটি। ক্রমাগত পানিতে ডুব দিচ্ছেন বা ঠান্ডা পানিতে শরীর ছেড়ে দিচ্ছেন। শরীরে অন্যরকম উন্মাদনা ছেয়ে গেলো আমার। উজ্জ্বল গায়ে লোভনীয় লাগছে পানির প্রতিটি কণা। রোদ পড়াতে সেই উজ্জ্বলতা যেন দ্বিগুণ হারে বেড়ে গিয়েছে। আমি ধাতস্থ করলাম নিজেকে। পুলের থেকে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম,

‘ আনভীর!’

উনি তৎক্ষণাৎ তাকালেন। আমার বুকে ছ্যাঁত করে লাগলো সেই দৃষ্টিটি। চুল বেয়ে টপটপ পানি ঝরছে। তা ধীরে ধীরে বেয়ে নামছে গলা থেকে বুকে। আমার নিঃশ্বাস অসাঢ় হয়ে এলো। আনভীর তা চট করে ধরতে পেরেছেন কি-না জানিনা। তবুও ধরতে পারার আগেই আমি প্রশ্ন করলাম,

‘ আর কতক্ষণ সুইমিং করবেন আপনি? অনেকক্ষণই তো হলো। ব্রেকফাস্ট করবেন না?’

‘ এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না আহি।’

উনি ফিচেল হাসি দিয়ে বললেন। তারপর বিরতি না কাটিয়ে বলে উঠলেন,

‘ তোমার নজর দেখে মাঝে মাঝে ভয় হয় আমার। যেভাবে তাকাচ্ছো যেন এখনই খেয়ে ফেলবে আমায়।’

গালে লালাভ আভা ফুটে উঠলো আমার। লজ্জায় রীতিমতো হাসফাস করছি। আমার এ অবস্থায় আনভীর পুলে থাকা অবস্থাতেই
এক অসহ্যকর হাসি দিলেন। গা জ্বালানোর মতো সে হাসি। হঠাৎ নিজকেই নিজের চড় মারতে ইচ্ছে হলো আমার। নিজের অন্তরকে বলে উঠলাম,

‘ হোয়াই অন্তর? কেন তুমি আমার সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করে উনাকে সব বুঝিয়ে দাও? একটু নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারো না?’

আমি পরক্ষণে সামলে নিলাম। আনভীরকে বললাম,

‘ তাহলে আরও কিছুক্ষণ থেকে ঠান্ডা বাধাঁবেন?’

‘ উঠবো তো। তুমি উঠাও?’

হঠাৎ আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে স্মৃতিচারিত হলো সেই ঘটনাটি যখন আনভীর আমার টেনে নিজের সাথে পুলে ফেলে দিয়েছিলেন। সে বার ভয়ঙ্কর থেকেও ভয়ঙ্কর মাত্রার লজ্জা পেয়েছিলাম নাহিদ ভাইয়ার সামনে। ভাগ্যিস নাহিদ ভাইয়া সোজাসাপ্টা মানুষ, ঘটনার খিচুড়ী পাকাতে জানেনা। কিন্ত আমাদের নীলু বেগম বা শিউলি ভাবি যদি এমন কিছু দেখে তবে কেলেঙ্কারি বাধাঁতে দু’সেকেন্ড লাগাবে না। ঘটনা এমন পর্যায়ে চলে যাবে যে আজরান ভাইয়াও এসে জিজ্ঞেস করবে,

‘ আহি! শুনলাম তুমি আর আনভীর নাকি পুলে হা-ডু-ডু খেলেছো?’

এসব কথা ভাবতেই আমার যেন মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হলো। ঘটনা যেকোনো পর্যায়ে যেতে পারে। আনভীর যেমন ভয়ঙ্কর, আজরান ভাইয়ার কথাবার্তা এর থেকেও ভয়ঙ্কর। পার্থক্য একটাই আজরান ভাইয়া রসিক মানুষ, ব্যস! এটা ছাড়া টর্চলাইট দিয়ে খুঁজেও তাদের মধ্যে ভেদাভেদ করা যাবে না। তাই তৎক্ষণাৎ আনভীরের দিকে রক্তিম চাহিনী ছুঁড়ে বললাম,

‘ মোটেও না। কি ভাবছেন আগে কি করেছেন সেটা মনে নেই আমার?’

দুঃখেভরা মর্মে সমবেদনা জানালেন আনভীর। অবুঝের ন্যায় বললেন,

‘ তুমি যে অতিপ্রাকৃত স্মৃতিবান নারী তা আমি জানি। কিন্ত আমার যে মনে পড়ছে না? তাই তোমার উচিত না ঘটনাটা আমায় স্মরণ করিয়ে একটু সহায়তা করা?’

আবারও গা জ্বালানো হাসি টেনেছেন ঠোঁটে। আমি পরে হাল ছেড়েই বললাম,

‘ আপনি পুলেই থাকুন। আমি উঠাবোও না। আপনাকে উঠতেও হবেনা। এখানেই চিল করুন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।’

বলেই ভেতরে চলে গেলাম আমি। এখন নিজেরই আফসোস হচ্ছে কেন যে একে ডাকতে গেলাম? ড্রইংরুমে দেখি গভীর চিন্তায় মশগুল আছে ভাবি আজরান ভাইয়া, নীলু এমনকি নাহিদ ভাইয়াও। তবে গভীর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ঠিক কি সে-টা আমি আচঁ করতে পারলাম না। অগত্যাই জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি করছেন সবাই?’

‘ আলোচনা করছি দেখছিস না?’

রাশাভারি কন্ঠ নীলুর। আমি অপ্রতিভ হলাম। তবুও বললাম,

‘ সে তো দেখছিই। কিন্ত ব্যপারটা কি নিয়ে?’

‘ তোমার আর আনভীরের বিয়ে নিয়ে।’

আমি তারপর ভাবনাহীন হলাম। যেই দিন থেকে আনভীর মিডিয়ায় বলেছে আমাদের বিয়ের প্রোগ্রাম হবে, সেইদিন থেকেই এরা শুরু করেছে পরিকল্পনা। প্রথমে ছিলো বিয়ের ভেন্যু কোথায় হবে? একজন বললো ঢাকাতেই, তো আরেকজন অন্য কোনো জায়গায়। নাহিদ ভাইয়া তো শেষে হতাশায় বলেই ফেললো পাহাড়িদের অঞ্চলে বিয়ের কারবার সারতে। নীলু ডিফারেন্ট কিছু চায়, তাই এ থেকে ভালো নাকি কিছু হবেনা। সেবার আমরা হেসেছিলাম খুব। ওদের বিরাট ভেন্যু খোঁজা নিয়ে সমস্যার সমাধান করলো নাহিদ ভাইয়ার বোন রিমি আপু। সে বললো নাহিদ ভাইয়াদের, আই মিন আনভীরের ফুপির বাড়ি ‘খাগড়াছড়িতে’ করলে কেমন হয়? চকচক করে উঠলো সবার মুখ। সেই সাথে আমারও। কারন খাগড়াছড়ি বরাবরই আমার প্রিয় জায়গাগুলোর একটি। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম মামুর সাথে। সেবার প্রথম ছুয়েছিলাম মেঘ। সেও ছিল এক অপরূপ দৃশ্য। যা এখনও মনের মানসপটে ভেসে আছে। কেউ কিছু বলার আগে আমি তৎক্ষণাৎ বললাম,

‘ হ্যাঁ ওটাই ভালো হবে।’

তারপর সবার চাউনি দেখে বিব্রতও হয়েছিলাম বেশ। বিয়ের কন্যাকে সচরাচর এভাবে কথা বলা মানায় না। আনভীর অদূরে তখন ল্যাপটপে কাজ করছিলো। আমায় কথায় টান দিয়ে বললেন,

‘ ইসস! মেয়েটা বিয়ের জন্য আমার থেকেও উতলা হয়ে আছে খোদা!’

তারপর থেকেই বাকিরা এ নিয়ে আলোচনা করলে একটা কথাও বলিনি আমি। এখনও তাই করতে চাইলাম। টুপ করে কেটে পড়ার প্রচেষ্টা করতেই নাহিদ ভাইয়া বললেন,

‘ ভাবি ব্রেড টোস্টটা একটু গরম করে দিবেন প্লিজ?’

আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম। উনার অনুনয়ের জন্য আর না করা সম্ভব হলো না। অতঃপর প্রতিউত্তরে বললাম,

‘ আচ্ছা দিচ্ছি।’

কিচেন মোটামুটি পরিষ্কার। জানি এ শিউলি ভাবিরই কাজ। আমার এত বারণ করা সত্বেও সে এ কাজ করবে। কিচেন কেবিনেটে তাকাই আমি সেখানে থেকে অল্প আচেঁ টোস্ট করা ব্রেড টোস্টের প্লেটটা দেখে সেটা হাতে নিলাম। তারপর সেটাকে টোস্টারে রেখে সুইচ অন করে ওয়েট করতে থাকলাম কখন টুং করে একটা সাউন্ড হবে।

গুণগুণ করছি আমি। ড্রইংরুমে শোনা যাচ্ছে হাসির কলরব। এ যে আজরান ভাইয়ার জন্যই তা অজানা না। টোস্টার থেকে টুং করে শব্দ হওয়াতে আমার ধ্যান ফিরলো। সুইচ অফ করতে যাবো তখই পেছন থেকে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আমায়। তার ভার হঠাৎ পিঠে অনুভব করারতে শরীরটা আমার বরফের মতো জমে গেলো। আনভীরের হাত কোমড়ে খেলা করছে আমার। টের পেলাম উনি আমার ঘাড়ের ডান পাশের চুলে সরিয়ে সে অংশটা উন্মুক্ত করে সরিয়ে রাখলেন বামপাশে। সেই উন্মুক্ত অংশে ভেজা ঠোঁটের চাপ পড়াতে শরীরের ওপর দিয়ে যেন গা ছমছম করা বায়ু বয়ে গেলে। আমি জানি এ আনভীর। উনার স্পর্শ, উনার নিঃশ্বাসই আমায় বিক্ষিপ্ত করতে পারে। ঠোঁট কামড়ে ধরলাম আমি। কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে বললাম,

‘ কি করছেন?’

‘ দেখছো না?’

উনার ভরাট কন্ঠ। ছোট্ট তিনটি শব্দ উচ্চারিত করে পুনরায় নিজের কার্যে মত্ত হয়ে পড়লেন। আমি বললাম,

‘ পাগল হলেন নাকি আপনি? এখনি ছাড়ুন। ওদিকে সবাই আছে।’

‘ তো কি হয়েছে। এদিকে তো আসেনি। তারা তাদের কাজ করুক, আমরা আমাদের কাজ করি।’

বলে উনি পুনঃকাজে মত্ত। কান দিয়ে রীতিমতো ধোঁয়া বের হচ্ছে লজ্জায়। হে বিধাতা! আমায় তোমার বিরাট দুনিয়ায় এক মুঠো মাটি ফাঁক করে যাও। এই অসভ্য কথন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য একটু সময়ের জন্য হলেও ওখানে ঢুকে যাই। আমি উনার বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি তা শক্ত করে আমার ঘাড়ে মুখ নামালেন। আলতো করে আমার কাধেঁ নিজের থুতনি রাখাতে আমি কিছু বলার জোর পেলাম না। উনার বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে ঘাড়ে। ইতিমধ্যে ড্রেস পাল্টে ফেললেও শরীরটা অসম্ভব ঠান্ডা। চুলগুলো এখনও ভিজে আছে। ভরাট কন্ঠে ডাকলেন,

‘ আহি?’

আমি অপ্রতিভ হলাম। হু না কিছুই বললাম না। উনি আবার বললেন,

‘ তারা তো পুরোদমে প্ল্যান করছে যে বিয়ের আগে আমাদের একসাথে থাকতে দিবে না। কথাগুলো ভয়ঙ্কর না? যেদিকে তোমায় ছাড়া কনসার্টের জন্য দু’বারই তিনরাত নিদ্রাহীনতায় কাটিয়েছি সেখানে এতদিন কিভাবে থাকবো? আমার তো ভাবতেই দমবদ্ধ হয়ে আসছে আহি। ইচ্ছে করতে সব অনুষ্ঠান ক্যান্সেল করে তোমায় নিজের কাছে বসিয়ে রাখতে।’

‘ কি বলছেন এসব? সবাই কত আগ্রহ করছে? নীলু, নাহিদ ভাইয়া, রিমি আপু সবাই। এসব এসব পাগলামি কথা শুনে সবাই হাসবে বুঝেছেন?’

‘ হাসলে হাসুক। বাট তোমায় নিয়ে কম্প্রোমাইজ এই আনভীরের পক্ষে অসম্ভব।’

বলে গালে একটা চু’মু দিতে যাবেন ওমনি পেছন থেকে নাহিদ ভাইয়া বলে উঠলেন,

‘ উহুম…উহুম, ভাইয়া! এটা কিচেন রুম!’
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

————–
ভুলক্রুটি মার্জনীয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here