এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৪৬

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৪৬
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

রুনি আপুর সাথে চরম অস্বস্তি নিয়ে ছাদের একপ্রান্তে বসে আছি। উদ্দেশ্য আজ আমি আনভীরের কাছে যাবো না। কিছুতেই যাবো না। এমনিতেও তখন দুপুরের দেওয়া আইসক্রিম টাইপ ওয়ার্নিং এ আমি বেশ ভয় পেয়েছি। তাই তারপর থেকে উনার মুখোমুখি থাকলেও ভয়টা তেমন একটা প্রকাশ করলাম না।

কনেকে নিয়ে এ বাড়িতে ফিরে এসেছি বিকেলের পরপর দিয়ে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা মজা চললেও আনভীর এর ধার কাছেও আমি ছিলাম না। তারপর রাতে ভাবীকে বাসরঘরে রেখে আসা হলো। রুনি আপু সহ আরও বেশ কয়েকজন আজগুবি সব এডভাইস ও দিলো ভাবিকে। আফসোস! আমি কিছুই বলতে পারলাম না। যেদিকে আমি বিবাহিত মেয়ে আর আমার বড় গলায় এডভাইস দেওয়ার কথা সেদিকে আমি চুপসে আছি। কারন বাসররাত নিয়ে একজন মানুষকে আদৌ কেমন ধরনের এডভাইস দেওয়া যায় তা আমার জানা নেই। চরম হতাশা নিয়ে আমি সবার সাথে বেরিয়ে এলাম। তবে বাকিরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যাতে রাফিদ ভাইয়া,আসতেই বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পারে।আমি তাই ক্লান্তি নিনির্মেষে বসে পড়ি ড্রইংরুমে সোফায়। আনভীর ওদিকে মামুন ভাইয়াকে নিয়ে ও বাড়ি থেকে যা আনা হয়েছিলো সেগুলো এক এক করে নিয়ে আসতে ব্যস্ত। আমি দূর থেকে গভীর চোখে দৃষ্টিপাত করছি উনার ব্যস্তময় মুখটা।

হাতে বেশ কয়েকটা বড় বড় কার্টন থাকার কারনে উনার চেহারা ভালোমতো দেখা যাচ্ছে না। নীল পান্জাবি পরিহিতা এই মানুষটিকে দেখতে তবুও ভালোলাগছে আমার। উনি এবার সব সামলিয়ে রেখে সোফয় বসে পড়লেন আমার পাশে। এইতো একটা সুযোগ উনার মাথা থেকে শাস্তির ব্যাপারটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার৷
আমি মুখোমুখি হয়ে বসলাম উনার। আনভীর চোখ বন্ধ করে সোফায় শরীর এলিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। যার দরুন ওঠানামা করছে উনার প্রশস্ত বুক৷ আমি আলতো হাতে উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে টেনে দিলাম। বললাম,

-কিছু খাবেন আপনি?

-না।

আনভীর তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন মিহি কন্ঠে। আমি নিজের কাজ অব্যাহত রেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,

-তাহলে পানি নিয়ে আসি? না,,,না, শরবত নিয়ে আসি। শরবত খেলে ভালো লাগবে আপনার।

আমি উঠেই পড়েছিলাম প্রায়,তবে আনভীর টেনে আমায় আবার নিজের পাশে বসিয়ে দিলেন। চোখেমুখে উনার অবাকের রেশ, সেই সাথে বিদ্যমান সীমাহীন কৌতুহলতা। উনি ভ্রু উচিয়ে বলে ওঠলেন,

-ব্যাপারটা কি আহি? তোমার এই অতিরিক্ত টেনশন আমাকেও রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে কিন্ত।

আমি শুকনো ঢোক গিললাম অগোচরে। মানুষটা কিছু বুঝে গেলো না তো? আমি তবুও নিজের সাথে উনাকেও ধাতস্থ করে বলে ওঠলাম,

-আরে, এতে আপনাকে ভাবতে হবে কেনো? আমি কি আপনার জন্য টেনশন করতে পারি না?

-তোমার টেনশন কেনো যেনো ইনটেনশন মনে হচ্ছে আমার।

উনি চাপা গলায় কথাটি বললেন। চোখজোড়ায় এখনও সীমাহীন সন্দেহ। আমি অবগত হলাম উনি হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। এখন নিজেকেই নিজের চড় মারতে ইচ্ছে হলো আমার৷ কেমন মেয়ে আমি, নিজের বরকেও ভালোমতো পটাতে পারি না?

আনভীর বাকা হাসি দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলেন,

-তুমি যতই এসব আজগুবি কাজকর্ম করে আমার প্ররোচিত করার চেষ্টা করো না কেনো, শাস্তি তো তোমার পেতেই হবে মিসেস ওয়াইফি। আমি আইসক্রিম টাইপ না কি করলা টাইপ সেটা আমার প্রমাণ করতে হবে তো!

ব্যস!তখন থেকেই আমি আনভীরের শতভাগ দূরে। উনার কথাগুলো শুনে আমি যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েলাম। এখন নিজেরই আফসোস লাগছে কেনো ওই ছেলেটার সাথে যেচে পড়ে কথা বলতে গেলাম৷ শুরুতে আমি বিবাহিত জানিয়ে দিলে হয়তো আমায় আর বিরক্ত করতো না, বরং আমিই তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছি।

এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। এসময় খাগড়াছড়িতে হালকা একটু শীতের আমেজ। আমি রুনি আপু, মামুন ভাইয়া সাথে বাকিরাও ছাদে রেলিং য়ের একপ্রান্তে বসে আছি৷ ঠান্ডার প্রকোপ খুব একটা বেশি না হলেও আমার পাতলা জামা এই ঠান্ডা মানিয়ে নিচ্ছে না৷
ছাদে গোল বৈঠক করার কারন হলো সবাই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে সম্ভবত সেটা বাস্তবায়ন হবে না কিছু বিশেষ কারনের জন্য৷ একেতো রাদিফ ভাইয়ার সবেমাত্র বিয়ে হলো, তারওপর তাদের পারিবারিক আরও কিছু কার্যক্রম রয়েছে, তাই হয়তো এবার আর না-ও যাওয়া হতে পারে।

আমি তাদের প্রত্যেকটি কথারই নীরব দর্শক। কেননা আমি জানি আমার তাদের সাথে যাওয়া সম্ভব না। এমনিতেও আজরান ভাইয়া আনভীরকে বহুত জোরাজোরি করে পাঠিয়েছেন এখানে৷ তার ওপর আনভীর সরাসরি বলে দিয়েছেন উনি তিনদিনের বেশি থাকবেন না। আমি উনাকে অনেক বলেছিলাম আরও কিছুদিন থাকি কিন্ত আমার বরসাহেব তার সিদ্ধান্তে অনড়।

আমার ভাবনার ইতি টেনেই হঠাৎ আনভীর ছাদে আমায় পেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ আমি প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যাই। সাথে বাকিরাও৷ আমি অবাক প্রসন্ন গলায় কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি ক্ষিপ্র কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-রেলিংয়ে বসতে গিয়েছো কেনো? সুসাইড করার প্ল্যান আছে? প্ল্যান থাকলে বলো , আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই।

আমি চোখমুখ কালো করে ফেললাম উনার ধমকে। উনার তো সেদিকে ধ্যানই নেই। উনার ঐতিহাসিক স্টাইলে চোখ রাঙানি দিতে আমার আর কিছু বলার সাহস হলো না। উনি মানুষটা আসলেই একটু অদ্ভুত , রেলিংয়ে বসেছি বলে এভাবে ধমক দিতে হবে?সুন্দর করে বললেই তো পারতো। নাহিদ ভাইয়া আমতা আমতা করে বলে ওঠলো,

-ইয়ে মানে , ভাই , রেলিংয়েই তো বসছে। এতে এমনে ধমক দিতে লাগে?

আনভীর সরু চোখে নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-বিয়ে কর ব্যাটা, তারপর বুঝবি যে আমি এমন কেনো করেছি।রাফিদের বিয়ে শেষ না , এবার তোর দিন ঘনিয়ে আসবে। টেনশনে রাতের ঘুম হারাম। আর তুমি, (আমায় উদ্দেশ্য করে) এখানে যে সন্নাসীর মতো বসে ছিলো এট এনি চান্স পড়ে গেলে কি হতো ভেবে দেখেছো? আর যাই হোক তৈমায় নিয়ে রিস্ক নেওয়াটা অসম্ভব আমার জন্য। একেবারেই অসম্ভব।

আনভীরের কথা শুনে সবাই মিটমিটিয়ে হেসে উঠলো এবার। আমি এবারও কথা বললাম না। উনি এবার সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলেন,

-ঘুমাবি না তোরা ? এত রাতে ছাদে ভূত দেখা হলে জলদি ঘুমাতে চলে যা। আমি আহিকে নিয়ে যাচ্ছি।

রুনি আপুর বড় বোন রম্য সুরে বলে ওঠলো,

-বুঝি রে ভাই! বুঝি! যে তোর কিসের এত তাড়া।

লজ্জায় আমার গালে রীতিমতো রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। আপুর কোথায় বাকিরা সশব্দে হেসে উঠলেও আনভীর আড়চোখে তাকাতে চুপসে গেলো একেবারে। উনি এবার আমার হাত চেপে মিহি কন্ঠে বললেন,

-রুমে চলো আমার সাথে। এখানে অনেক ঠান্ডা।

বলেই উনি রীতিমতো আমায় টান দিয়ে ছাদ থেকে নিয়ে আসলেন। সবাই উল্টাপাল্টা ভাবলেও উনি যে ঠিক কি কারনে আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন এটা ভালোমতই আমার জানা আছে। রুমে আসা মাত্রই উনি সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিতেই আমায় মনে ভয়ের দানা বেধেঁ গেলো। আমার পা দুটো ফ্লোরের সাথে একেবারে যেন আটকে আছে প্রায়। আমি ভীত সতন্ত্র থাকলেও তেমন একটা প্রকাশ করলাম না। উনি খাটে বসে পড়লেন আয়েশ করে। ঠোঁটে বাকা হাসির প্রবল রেশ। অতঃপর ইশারা করলেন আমায় কাছে আসার জন্য। আমি না নড়তেই উনি বলে ওঠলেন,

-কি হলো আসছো না কেনো? আমি কি উঠে আসতে পারবো না?

সাথে সাথেই আমি উনার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি টেনে আমায় নিজের পাশে বসালেন। কানের কাছে গম্ভীর ফিসফিসালো কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-তো বলো তো তোমায় কি শাস্তি দেবো আমি? আজ শাস্তিটা তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।

আমি শুকনো ঢোক গিললাম পরপর দু’বার। মেকি হেসে বললাম,

-আমি তো বলবো আমায় শাস্তিই দিতে না। এই পিচ্চি বউকে শাস্তি দিতে আপনার খারাপ লাগবে না?

শেষ কথাটা ইনোসেন্ট ফেস করে বললেও মনে হয়নি যে উনি গলেছেন। বলে ওঠলেন,

-পিচ্চি বউ হলেও শয়তানের হাড্ডি তুমি। ওই ছেলেরে কিভাবে ব্যাকাঁ করে দিলে ভাবা যায়? আর তোমার সাহস কি করে হলো ওই ছেলের সাথে ফ্লার্ট করার? লিসেন , এই আমি থাকতে তুমি অন্য কারও কথা ভাবতে পারবে না, অন্য কারও সাথে ফ্ল্যার্ট করতে পারবে না আর ঠোঁট কামড়ানো তো দূরের কথা। তুমি তোমার এই ছোট্ট কাজটা দিয়ে কতবার আমার নিয়ন্ত্রন হারিয়েছি এটা তুমি জানো?

আমি উনার কথার কোনো প্রতিউত্তর দিলাম না।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম খাটে। আমার এমন মুখানা দেখে উনি হুট করে কোলে তুলে বারান্দায় নিয়ে রেলিংয়ে বসিয়ে দিলেন আমায়। ঘটনাটা এতই আকষ্মিকভাবে হয়েছে যে আমি রীতিমতো স্তব্ধ। উনার চোখে এতক্ষণ যেই চাপা রাগ আর শয়তানি হাসি দেখতে পাযছিলাম মুহূর্তেই সেটা রূপ নিয়েছে অন্য এক দৃষ্টি নেশায়। উনি আমায় রেলিংয়ে বসানো অবস্থাতেই কোমড় চেপে কিছুটা কাছে আনলেন। মিহি কন্ঠে বললেন,

-তখন ছাদে তোমায় বকেছিলাম কেনো জানো? কারন তুমি রেলিংয়ে একা বসে ছিলে। এট এনি চান্স কোনো দুর্ঘটনা হলে আমার কি হতো ভেবে দেখেছো? তবে এখন কিছু বলবো না। কারন আমি নিজেই এখন তোমার সিকিউরিটি গার্ড মাই ওয়াইফি!

শেষ কথাটা উনি বললেন একেবারে আমার কানের কাছে , ফিসফিসিয়ে। আমার সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেলো। উনি মানুষটা অন্যরকম। সবসময় রসকষহীন টাইপ মুড নিয়ে থাকেন আর মাঝে মধ্যে নিজের দৃষ্টি নেশা দিয়ে অন্য এক পৃথিবীতে নিয়ে যান আমায়।উনি হয়তো এমন একজন যে কখনোই মুখ ফুটে আমার উদ্দেশ্যে ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলতে পারেননি। তবে নিজের সবটুকু দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে আমি আমি উনার কাছে ভালোবাসার চাইতেও বিশেষ কিছু। উনি চাপা স্বরে বললেন,

-আহি?

-হুম !

-তোমার ওই সফট লিপস দুটো খুব টানছে আমাকে।

উনি আমার ওষ্ঠ্যদ্বয় স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে খানিকটা ঝুকতেই হঠাৎ উনার প্যান্টের পকেটে ফোন বেজে ওঠলো। এতে চরম বিরক্তি হলেন উনি। আহাজারি হয়ে বলে ওঠলেন,

-ফোন বাজার আর সময় পেলো না।

স্ক্রিনে আজরান ভাইয়ার নাম দেখে কল রিসিভ করলেন। স্পিকারে রেখেই ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,

-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

-ওয়ালাইকুম আসসালাম। তো কেমন কাটছে তোদের দিনকাল? রাফিদের বিয়ে ঠিকঠাকমতো হয়েছে তো?

-হ্যাঁ।

স্বস্তি পেলেন ভাইয়া। তারপর বললেন,

-তোকে বলেছিলাম না যে তোর আর আহির জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখেছি? সেটার জন্যই কল দিলাম।

-মানে? তুমি সিরিয়ালি বলেছিলে কথাটা? কি সারপ্রাইজ?

আশ্চর্য হয়ে বললেন আনভীর। তারপর আমি আর আনভীর যা শুনলাম সেটা ভেবে অবাক না হয়ে পারলাম না। আজরান ভাইয়া সাজেক ভ্যালিতে একরাতের জন্য রিসোর্টের এক রুম বুক করেছেন আমাদের জন্য । তাও আবার কাপল রুম। আনভীর হতবুদ্ধি হারিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন এর কারন কি। আজরান ভাইয়া বললো আমরা তো আর হানিমুনে যাইনি তাই এক দিনের একটা ট্যুর সেট করলো আমাদের জন্য। হানিমুন ট্যুর না হলেও একটা নরমাল ট্যুর তো দেওয়াই যায়। আজরান ভাইয়ার জোরাজুরিতে আর না করতে পারলেন না আনভীর। অতঃপর কল কেটে আমার উদ্দেশ্যে কৌতুহলী স্বরে বলে ওঠলেন,

-তোমার ঠোঁটে কি জাদু আছে মেয়ে?তোমারে কিস না করতেই এদিকে ভাইয়ের কাছে চরম গিফট পেয়ে গেলাম , তাহলে ভাবো তোমারে কিস করলে কি হতো?

বিব্রত হয়ে পড়লাম আমি। বুঝলাম এই লোক সাজেক না যাওয়া পর্যন্ত এই পুরোটা রাত আমায় জ্বালিয়ে মারবেন। বিড়বিড়িয়ে তাই বলে ওঠলাম, ‘অসভ্যটা!’
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ!

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।
প্রত্যেকেই কমেন্ট করবেন প্লিজ! প্রয়োজন হলে স্টিকার কমেন্ট করুন।পেজের রিচ আবার ডাউন হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here