এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৪৭

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৪৭
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পের সামনে খা খা করছে রৌদ্দুরে। আশেপাশে নানা ধরনের মানুষের সমাগম। খাগড়াছড়ি শহর থেকে লম্বা সময়ের যাত্রা পাড়ি দিয়ে আমরা অবশেষে এসে পড়েছি দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পের সামনে৷ আমার বুক উত্তেজনায় কেমন যেন দ্রিম দ্রিম করছে। যাই হোক, সাজেক ভ্যালীতে এটাই আমার প্রথম যাওয়া।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এখানে সকাল আর সন্ধ্যার পর একটু ঠান্ডার প্রকোপ দেখা যায়। প্রকোপটি এমন যে খা খা রৌদ্রময়ের আবরণেও তা কেটে ওঠছে না। বরং আরাম লাগছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পের রাস্তার একটু পাশে। আনভীর ওপাশে লাইনে দাঁড়িয়েছেন নিজেদের নাম খাতায় লিখানোর জন্য। বলা বাহুল্য, সাজেক ভ্যালী সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার কারনে এখানে ট্যুরিস্টদের সেফটির জন্য প্রত্যেককেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পার্মিশন নিতে হয়। সেই জন্যই আনভীর ওপাশে অন্যদের সাথে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। যাওয়ার আগে বারবার বলে গিয়েছেন আমি যাতে এখান থেকে এক পাও না নড়ি।

সকাল চাচী ফুপি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খারাপ লাগছিলো বেশ৷ কেননা এই তিনদিন উনাদের সাথে সময়টা আমার বেশ কেটেছে। সেই সাথে সাজেক ভ্যালী যাওয়ার জন্য আলাদা এক উত্তেজনাও কাজ করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর এসে পড়লেন আনভীর। আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম,

-এত সকালে আসার প্রয়োজনটা কি ছিলো বলুন তো? আরও কিছুক্ষণ পরে আসলেই তো এত ভিড় পাওয়া যেতো না।

-উহু। সেনাবাহিনীর এসকোর্টের জন্য দুইটা সময় বরাদ্দ থাকে , এক সকাল সাড়ে নয়টা আর নাহয় দুপুর আড়াইটায়। দুপুরে তো আসা ইম্পসিবল তাই সকালেই আসতে হলো।

আমি কথা বাড়ালাম না। উনি আমার গায়ে ভালোমতো চাদর পেচিয়ে দিতে দিতে মৃদু কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-এখন টায়ার্ড হলে চলবে মিসেস আহি?

-আমি টায়ার্ড না। শুধু একটু শীত শীত লাগছে।

পুনরায় শুরু হয়ে গেলো উনার ভাষণ। কারন আমি খুব বেশি গরম কাপড়-চোপড় আনিনি। আরেহ্ আমি কি জানতাম যে আজরান ভাইয়া হ্যুট করে আমাদের জন্য ট্যুর প্ল্যান করবে। আনভীর যেমন রেগে আছেন তেমনিভাবে বিচলিত হয়ে আছেন। কারন উনার ধারনা এভাবে আমার ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা ৯৮ পার্সেন্ট। আমি বিরক্ত না হয়ে পারলাম না। কারন সবকিছু লিমিটেডে থাকাই ভালো , অতিরিক্ত ব্যাপারটা সবসময় বিপদ নিয়ে আসে।আনভীর সত্যিই কেয়ারিং আমার প্রতি , তবে সেটা মাত্রাতিরিক্ত লেভেলের। উনার এসব এগ্রোসিভ কেয়ারিং মাঝে মাঝে আমায় অতীষ্ঠ করে তুললেও কিছু করার নেই। বরটা আমার। তাই আমাকেই সামলাতে হবে এই চশমিশ বিলাইটাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চান্দের গাড়ি রওনা হবে সাজেকের জন্য। সবগুলো গাড়ি এক সারিতে ক্রমানুসারে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা শেয়ারে গাড়ি ভাড়া করেছি। আমি আর আনভীর সহ একদল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরতে এসেছে এখানে। সবমিলিয়ে আমরা ৮ জন। এই ছেলে মেয়েগুলো আসলেই খুব ভালো। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সাথে আমার সখ্যতা হয়ে ওঠেছে, এমনকি আনভীরেরও।
যেই না গাড়িটি চলা শুরু হলো এক অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠলো আমার মনে। সারা শরীরে প্রবল এক ঝিম ধরে গেলো। আনভীর আমায় শান্ত করার উদ্দেশ্যে গভীরভাবে আ্ার হাত চেপে ধরলেন। মিহি কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-সামনে আরও সুন্দর দৃশ্য আছে আহি। এখনই এত এক্সাইটেড হতে হবে না।

-আপনি এর আগে এসেছিলেন এখানে?

-একবার স্টুডেন্টদের নিয়ে ট্যুরে এসেছিলাম। বলতে গেলে বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়েই। তবে তখনকার ফিলিংস আর এখনকার ফিলিংস তো আলাদা। আগে তুমি না থাকলেও এখন পাশে তুমি আছো তো , তাই মনে হয় !

উনার এই কথার গভীরত্ব খুব অল্প হলেও আমার হৃদয়ে গভীরমাবে কথাটির প্রভাব বিরাজ করলো। আমি ঘাড়টা সামান্য বাকিয়ে উনাকে দেখে নিলাম। সূর্যের আলো পেছন দিয়ে তেরছাভাবে উনার গায়ে পড়াতে সোনালী রঙ ধারন করেছে গায়ের রঙ। উনি বরাবরই একটা চিকন ফ্রেমের চশমা পড়ে থাকেন। আর এতে উনাকে সবসময় মারাত্নক লাগে যেমনটা আজকে লাগছে। ফর্সা মুখে ছোট ছোট দাড়ি , লালচে পুরু ঠোঁট , খাড়া নাক সবমিলিয়ে উনি অনন্য। আমার প্রতি উনার এক্সট্রিম পাগলামিটার জন্যই আমি উনার প্রতি বড়সড়ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি।

গাড়িটা ওপরের দিকে উঠছে ধীরে ধীরে। অবশেষে তা আরও উপরে উঠতে থাকলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক দূরে। আমাদের সামনে বসা ভার্সিটির ভাইয়া আপুরা চরম রকমের ইন্জয় করছে। এক ভাইয়া খালি গলায় গানও গাচ্ছে। গানগুলো এই যাত্রার সাথে একেবারেই মানানসই। ভাইয়া আমাকেও অনেক অনুরোধ করলেন গান গাওয়ার জন্য । কিন্ত আমি তখন উনাদের আনন্দে মশগুলে বুদ হয়ে ছিলাম। অতঃপর উনাদের ফ্রেন্ড সার্কেল এবার গান গাওয়া শুরু করতেই আমি তাদের সাথে তাল মিলিয়ে গান গাইতে থাকলাম,

সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে,
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে
জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে।
সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে,
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে
জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে।

তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে,
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছুটে
চোখ মেল যদি পারো বুঝতে।
তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে,
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছুটে
চোখ মেল যদি পারো বুঝতে।।

(সে যে বসে আছে-অর্নব)

এ সবকিছুই আমার জন্য ছিলো নতুন এক অনুভূতি। আনভীর পুরোটা পথে গহীন নজরে দেখে চলছিলেন আমায়। উনার হাতজোড়া ছিলো ভাজঁ করা, কপালে সুক্ষ্ণ ভাঁজ, কালো চোখের আড়ষ্ট দৃষ্টি এতটাই দুর্বিষহ ছিলো যে আমায় টনক নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আচ্ছা উনার কি আমায় এভাবে দ্বিধায় না ফেললে ভালোলাগে না? উনি জানেন যে উনার এসব ছোট ছোট কাজকর্ম আমার হার্টবিট মিস করার জন্য যথেষ্ট। তবুও কেনো এসব করেন উনি?

অবশেষে আমরা এসেই পড়েছি মেঘের দেশ সাজেকে। পুরো যাত্রাটা ছিলো একেবারেই মোহনীয়। আমাদের ট্যুরমেটরাও অনেক ভালো পড়েছে। যাত্রাপথে আমার খুব ইচ্ছে ছিলো সে আমি চান্দের গাড়ির ছাদে চড়বো। অনুভব করবো উচুনিচু পথের নৈসর্গিক রৃপ। তবে আমার যদি আনভীরের মতো এমন ওভার প্রোটেকটিভ বরসাহেব থাকে তা কি আদৌ সম্ভব? উনাকে কত্ত রিকুয়েস্ট করলাম যে ওই আপুটাও তো উঠেছে, আমি উঠলে সমস্যা কি। উনি বললেন, ‘ওই মেয়ে কি উনার ওয়াইফ নাকি আমি উনার ওয়াইফ? তাই আমায় নিজের কাছ থেকে একবিন্দুও দূরে সরালেন না।

আমাদের এসব দেখে একজন ভাইয়া অবাক হয়ে আনভীরকে জিজ্ঞেস করলো,

-আপনাদের কি লাভ ম্যারিজ?

অবাক হলাম আমি। সেই সাথে আনভীরও। কেননা এধরনের প্রশ্ন আমাদের কেউই করেনি এর আগে। আনভীর গলা খাকারি দিয়ে বললো,

-উহু ! আমাদের এরেন্জ ম্যারেজ।

উনার উত্তর শুনে আশ্চর্য হয়ে রইলো সবাই। যেন আমাদের এই কথা কোনো ক্রমেই উনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। তবুও কিছু বললো না তারা। আনভীর এবার মিহি হেসে তাদের বললো,

-বিকেলে দেখা হবে আবার। আমরা আমাদের রুমে যাচ্ছি।

আমাদের রিসোর্টটি সুন্দর। বারান্দা দিয়ে পাহাড়ের চমৎকার একটা ভিউ দেখা যায়। বোঝা গেলো, আজরান ভাইয়া বেশ পরিকল্পনা করেই এখানে পাঠিয়েছেন আমাদের। ভালোই হয়েছে, এতে যদি উনার গোমরামুখো ভাইয়ের একটু সুবুদ্ধি ঘটে। কই বউ নিয়ে ঘুরাঘুরি করবে , তা না, সবসময় পড়ালিখা আর ধমকের ওপর রাখে। সাথে একশো একটা এডভাইস তো ফ্রি। এখানে এসেই আমি আগে শিউলি ভাবিকে জানিয়ে দিলাম যে আমরা গন্তব্যে এসে পড়েছি। আনভীর ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসেছেন ওয়াশরুম থেকে। আমার কথা বলার মাঝেই উনি গহীন কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-ভাবিমণির সাথে পরে কথা বলো আহি। এখানে গিজারের ব্যবস্থা আছে। একটা ফ্রেস গোসল সেরে আসো। ঠান্ডাটা কেটে যাবে।

ওপাশে শুনে ফেলেছিলো সেটা শিউলি ভাবি। ঠোঁট চেপে বললো,

-যাও যাও, মেয়ে ! আমার দেবরের কথা শুনো।

আমি মিহি হেসে কল কেটে চলে গেলা ওয়াশরুমে। কিন্ত গোসল শেষেই হলো এক বিপত্তি। আমি যা জামা কাপড় এনেছিলাম ওয়াশরুমে সবই ফ্লোরে পড়ে ভিজে গিয়েছে। কি একটা অবস্থা ! টাওয়াল পড়ে তো বেরিয়ে আসা অসম্ভব। মাথা উকি দিয়ে বাহিরে তাকালাম আমি। মৃদু কন্ঠে ডাকলাম আনভীরকে।উনার সাড়াশব্দ নেই। খানিকভাদে টের পেলাম উনি বারান্দায় মোবাইলে আলাপ চালাচ্ছেন। আমি ভেজা কাপড় পড়েই বেরিয়ে আসলাম। জামাকাপড় ব্যাগ থেকে বের করতেই আনভীর পেছন থেকে বললেন,

-তুমি এই অবস্থায় আমার ব্যাগ নাড়াচাড়া করছো কেনো?

আমার নিজের মাথায় নিজেরই বারি দিতে মন চাচ্ছে। সেম কালারের ব্যাগ হওয়ায় বুঝতেও পারিনি এটা উনার ব্যাগ। আমি তৎক্ষণৎ উনার দিকে ঘুরে বলে ওঠলাম,

-সরি সরি , আমি আসলে এটা আমার ব্যাগ ভেবেছিলাম।

আনভীর কর্ণপাত করলেন না আমার কথায়। বরং ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে উপর থেকে নিচে আমার শরীরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। আমি নিজেকে দেখতেই থমকে গেলাম। ইয়া আল্লাহ ! আমি এই অবস্থায় কিভাবে দাঁড়িয়ে আছি উনার সামনে। আমি এতটাই বোকা বনে গিয়েছিলাম যে জামাকাপড় না নিয়েই আবার ওয়াশরুমে চলে গেলাম। আমার কান্ড দেখে আনভীর আমায় আরও দ্বিগুন লজ্জা দিয়ে বললেন,

-এখন ওয়াশরুমে লুকিয়েই বা কি লাভ মিসেস আহি? যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছি। প্রয়োজন হলে ওয়াশরুমে এসে আবার দেখে যাবো তোমাকে। কি বলো?
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

কালকে স্কুল আর এখন রীতিমতো কম্বলের নিচে লুকিয়ে লিখেছি যাতে আম্মু না দেখতে পারে। দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। এখন আমায় সান্তনা দেও গাইস। সবার মন্তব্যের আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here