এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৪৮
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
-এখন ওয়াশরুমে লুকিয়েই বা কি লাভ মিসেস আহি? যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছি। প্রয়োজন হলে ওয়াশরুমে এসে আবার দেখে যাবো তোমাকে। কি বলো?
এমন খাপছাড়া কথাবার্তা শুনে কান দিয়ে রীতিমতো গরম ধোয়া বের হচ্ছে আমার। আনভীরের সেদিকে ভাবান্তর নেই। উনি দরজার অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজের অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেই যাচ্ছেন। আমি পড়েছি মহাবিপদে। একে তো ভিজেঁ জামা-কাপড়ের জুবুথুবু অবস্থা, তার ওপর শুকনো জামাকাপড় নিয়ে আসতে পারিনি বলে দরজার বাইরেও বেরোতে পারছি না। আমি অসহায় মুখ নিয়ে দরজার বাইরে উঁকি দিলাম। আনভীর দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার উকিঁ দেওয়া মাত্রই ভ্রু জোড়া নাচিয়ে বলে ওঠলেন,
-কোনো হেল্প লাগবে সুইটহার্ট?
-আমার ড্রেস এনে দিন না!
বিব্রত হয়ে বললাম আমি। উনি পরোয়া করলেন না। বলে ওঠলেন,
-কেনো শুনবো আমি তোমার কথা? তুমি আমার একটাও কথা শুনো? তোমায় কতবার বলতাম যে ওই ইরিটেইট ধ্রুবের সাথে কথা বলবে না। আমায় ইগ্নোর করবে না। কিন্ত কি করেছিলে তুমি? আমার কথা অমাণ্য তো করেছোই সাথে আমার থেকে দূরেও চলে যেতে চেয়েছিলে। কি মনে করো, ওগুলো ভুলে গিয়েছি আমি?
আমি তো পড়েছি মহাফ্যাসাদে। না পারছি কিছু বলতে আর না পারছি ফট করে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি এবার ইনোসেন্ট ফেস করে বললাম,
-প্রমিস! কখনোই আপনার কথা আর অমাণ্য করবো না।
-তুমি যেই হারে আমায় প্রমিস করো , একদিন দেখবে প্রমিসেরও শ্রাদ্ধ হয়ে যাবে।
-আনভীর প্লিজ…….
আমি এবার দ্বিগুণ ইনোসেন্ট মুখ করে বলতেই উনি তপ্তশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বলে ওঠলেন,
-উফফফ! তুমি না ! পেয়েছো আমার একটা উইকনেস, আর এটা দিয়েই নিজের কার্যসিদ্ধি করে নাও। তোমায় পরে দেখে নিবো।
বলেই উনি আমায় ব্যাগ থেকে জামা-কাপড়গুলো নিয়ে দিয়ে দিলেন আমায়। আমিও সেটা খপ করে টেনে দরজা লাগিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলাম। নিজেকে এখন একজন যুদ্ধে জয়ী নারীর তুলনায় কম কিছু মনে হচ্ছেনা। নিজেকে একপলক আয়নায় দেখতেই আমার মুখে পুনরায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। ইসস! আমি কিভাবে গেলাম এই অবস্থায় উনার সামনে? আর ওই লোকটার মুখে একটু লাগাম থাকলেই বা কি কোনো ক্ষতি হতো? মহাশয় বোধহয় জন্মই নিয়েছেন আমায় নিয়ে লাগামহীন কথাবার্তা বলার জন্য।
_________________
দুপুরে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। হুট করে আনভীরের ডাক পড়াতেই অগত্যাই কাচা ঘুম ভেঙে গেলো। উনি অলরেডি রেডি হয়ে গিয়েছেন। আমি ঘুমুঘুমু চোখে জিজ্ঞেস করলাম,
-কোথায় যাচ্ছেন?
-আমার সাথে তুমিও যাচ্ছো বাহিরে।
-কিন্ত কেনো?
-সাজেক কি ঘুমানোর জন্য এসেছো?
-না তো ! এখানে তো এসেছি আপনার সাথে হানিমুন করতে।
কথাটি আমি বলে ফেলেছিলাম একেবারেই ঘুমের ঘোরে। কিন্ত নিজের কথার মানেটা যখন টের পেলাম অটোমেটিক আমার হাত চেপে ধরলো আমার ঠোঁটজোড়া। চোখের ঘুমও ফানুসের মতো উড়াল দিয়েছে। আমি বড় বড় চোখ করে তাকালাম আনভীরের দিকে। উনার বিস্ফোরিত চেহারা দেখে আমার শরীর যেন জমে গেলো। হয়তো ভাবতে পারেননি যে আমি ফট করে এরকম কিছু বলে ফেলবো। আমি অপ্রস্তুত হয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই বড় বড় পা ফেলে খাটে এসে বসে পড়লেন উনি। আমার পাশে বললে ভুল হবে, এককথায় আমার খুব কাছে বসেছেন।
আমি উনার এমন কাজে তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে যেতেই উনি চেপে ধরলেন আমার কোমড়। চোখে মুখে তুমুল আগ্রহ। ঠোঁট জোড়ায় একটা চাপা হাসি ফুটে উঠেছে। তারপর কৌতুহলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-তাই নাকি? আমি জানতাম না তো যে তুমি তলে তলে আমার সাথে হানিমুনের প্ল্যান করছো? ব্যাপার কি মিসেস আহি! এত শখ এই আনভীর রেজওয়ান খানকে সিডিউস করার?
কি অসভ্য মার্কা কথাবার্তা আল্লাহ! আমি , আবার সিডিউস করবো উনাকে। আমি শুকনো ঢোক গীলে দুত উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। প্রখর কন্ঠে বললাম,
-সবসময় আপনার মাথায় কি এসবই চলে?
-ল্যা! তুমি যদি আমায় এসব বলো তো মাথায় এসব চলবে না?
আমি হার মেনে নিলাম। উনার সাথে কথা বলা মানেই ধাপে ধাপে লজ্জার আবরণ অতিক্রম করতে হবে। উনি খানিকটা কাছে এসে আমার বিভ্রান্ত মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলেন। গহীন কন্ঠে বললেন,
-ইউ আর টু মাচ ডার্টি মাইন্ডেড আহি। এসব বাদ দাও। ফটাফট রেডি হও। একটু পর কংলাক পাহাড় দেখতে যাবো আমরা।
বলেই উনি উঠে বারান্দায় চলে গেলেন। আমি বোকা বোকা চাহিনী নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম উনার দিকে। তারপর দ্রুত রেডি হওয়ার জন্য জামা নিয়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে।
______________________________
কংলাক পাহাড়ের এই পথটি খুব একটা সুবিধাজনক নয়। জীপের গতিবেগ উনিশ থেকে বিশ হলেই খাদে পড়ে যাওয়ার তুমুল সম্ভাবনা আছে। আমি পুরোটা সময় নিঃশ্বাস আটকে বসে ছিলাম। সেই সাথে তুমুল অবাকও হয়েছিলাম ওই ভাইয়া আপুদের এতটা দুঃসাহসিকতা দেখে। ওদের মধ্যে কোনোরকম কোনো ভয় নেই। বরং নির্ভয়ে আশপাশের বিপদজনক দৃশ্য উপভোগ করে যাচ্ছে। আমি এবার আনভীরের কাছে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনার ভয় লাগছে না আনভীর?
উনি কথা বললেন না। অবশ্যও চোখ মুখ দিয়েই ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে উনি আসলে তেমন একটা ভয় পাচ্ছেন না। বা ভয় পেলেও সেটা প্রকাশ করছেন না। আনভীর ব্ল্যাক শার্ট পড়েছেন আজ। সেই সাথে গ্রে জিন্স। উনি সচরাচর অফিসিয়াল প্যান্ট পরেই বাইরে বের হন তবে খাগড়াছড়ি আসার পর থেকে উনাকে জিন্স ছাড়া একদিনও দেখিনি। হয়তো উনি ঘুরাফিরার সময় এসব পরতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাই। কালো শার্টটি উনার গৌর বর্ণের গায়ে চমৎকার লাগছে অনেক। অবশ্য শার্টের হাতাগুলো ভাজ করে দিয়েছি আমি নিজে। আনভীর আমার এমন দৃষ্টিতে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-ব্যাপার কি আহি? আজ মন-মেজাজ এত ভালো যে?
-আপমাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে আজ। আমি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে। এভাবেই অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছে গেলাম।
সাজেকে হ্যালিপ্যাডের পর আরেক অনন্য সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে কংলাক পাহাড়। সাজেকের একেবারে শেষ গ্রাম কংলাক গ্রামটি লুসাই উপজাতীদের অধ্যুষ্যিত এলাকা। তাই এখানকার উপজাতীদের জীবনযাপন , বাচ্চাদের ছুটে চলা , এসব কিছুই আমার কাছে খুব সুন্দর। ছোট্ট, অথচ কি শান্তিই বা এই পরিবারগুলোতে আছে যা হয়তো এতদিন আমি পাইনি। আমায় ওখানে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে আনভীর শক্ত করে আগলে ধরলেন আমার হাত। নিজের মোহনীয় চোখজোড়ার দ্বারা ইশারায় আমায় বলে ওঠলেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।
আমাদের মতো আরও অনেক কাপলরাই এসেছেন এখানে। কিন্ত তারা যেসব রোম্যান্টিক পোজ দিয়ে ছবি পুলছে আমি তো জীবনে পারবোই না, আর আনভীরকে দিয়েও একেবারে অসম্ভব। আমরা জাস্ট এভাবৃই দু’তিনটা ছবি তুলে নিলাম স্মৃতি হিসেবে। উনি আবার ছবি তুলার ঘোর বিরোধী। বলেন, ছবি তুলতে গেলে নাকি এসব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না।তবে এর মাঝে উনি লুকিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছিলেন যা আমি বিন্দুমাত্রও টের পাইনি।
সন্ধ্যা নামছে। পশ্চিম আকাশের সূর্য নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। আমি ঘোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। কংলাক পাহাড়ের শেষ প্রান্তে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ স্থাপন করেছে ট্যুরিস্টদের জন্য, সেখানেই বসে আছি দুজন। আমার কাছে এমন দৃষ্টি একেবারেই বিরল। ছোটবেলায় এই পাহাড় দেখা , মেঘের দৃশ্য , পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সূর্যাস্ত দেখা এসব কিছুই আমার জন্য নতুন। আমি , যে কি-না পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো কারনে সহজে ঘর থেকে বেরোনোর আনুমতি পেতাম না আজ সেই আমি এত্ত দূরে, এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গিয়েছি এই পাহাড়ের মাঝে? আমি এবার আনভীরের কাধে নিজের মাথা এলিয়ে দিলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম উনার বাহু। আনভীর শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-ভালোলাগছে এখানে?
-অনেক।
-আজকে রাতে আমাদের ট্যুর মেটদের সাথে ছোটখাটো একটা বার বি কিউ পার্টির আয়োজন করবো ভাবিছি। খোলা আকাশের নিচে এসব অনেক সুন্দর লাগবে।
আমি আরও গভীরভাবে জরিয়ে ধরলাম উনার হাত। উনি স্মিত হাসলেন এতে। জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমার হয়েছে টা কি মেয়ে? এত প্রেম তো আগে জাগেনি কখনও!
-জেগেছে তো। আপনার মোহনীয় কর্মকান্ডে উঠতে বসতে প্রেম জেগেছে। আপনার ঠোঁট নাড়ানো, চোখ রাঙিয়ে তাকানো, দুষ্টু হাসি টেনে কথাবার্তা সবকিছুকে দেখলে এখন মনে হয় আপনি একেবারেই আমার। আমি আপনাকে ছাড়া একবিন্দুও কল্পনা করতে পারিনা। আপনি রেগে গেলে আপনাকে যখন হুটহাট টুমু দিয়ে দেই সেই রিয়্যাকশনটার প্রেমে বারবার পড়ি আমি। আমি তো আগে কারও জন্য এত টান অনুভব করতাম না ! আপনি আসার পর আমার লাইফটা আপনিময় হয়ে গেলো কেনো?
আনভীর রইলেন নিঃশব্দে। হয়তো এর উত্তর টা উনার কাছেও নেই। আমিও কথা বাড়ালাম না। আমাদের সামনেই সূর্যটা যেকোনো মুহূর্তে ডুবে যাবে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। আমি মাথা উঠিয়ে আনভীর গলায় চুমু দিলাম হঠাৎ করে। তারপর আড়ষ্ট কন্ঠে বললাম,
-ধন্যবাদ আপনাকে আমায় এত সুন্দর একটা মোমেন্ট উপহার দেওয়ার জন্য।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
কালকে রাতেই গল্প দিতাম। তবে ব্যাক্তিগত কিছু কারনের জন্য দিতে পারিনি।ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।