এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৯

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৯
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

আমায় শান্ত করার জন্য আনভীর হঠাৎ করে আমার কোমড় চেপে শক্ত করে বুকে জরিয়ে ধরলেন আমাকে। আমি তখন কাপঁছি অস্বাভাবিকভাবে। নিঃশ্বাস হয়ে আসছে প্রগাঢ়।আমায় এ অবস্থায় দেখে উনি আলতো ভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।আমি উনার বুকে চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে আছি। একচুল পরিমাণও নড়াচড়া করিনি। কেননা আমার শুধু এটাই মনে হচ্ছে এই একটু নড়াচড়া করলেই অপূর্ব হয়তো টেনে-হিচড়ে এখান থেকে নিয়ে যাবে আমায়।আনভীর এবার কোমলভাবে আমার সামনের চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বললেন,

-‘আহি? কান্না বন্ধ করো। কিছুই হয়নি। আমি আছি তো!’

আমি তখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি। ভয়-ত্রাস সবকিছু আমায় তটস্থ করে ফেলেছে। উনি এবার আমার বাহু চেপে নিজের আবদ্ধ থেকে সরানোর চেষ্টা করতেই আমি উনার বুকে আরও গভীরভাবে মিশে গেলাম। আসলে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি আমি। সেই পূর্বের মতোই বুকে রীতিমতো ভয়ে দ্রিমদ্রিম শব্দ তৈরি হচ্ছে। আমায় এভাবে ভয় পেতে দেখে উনি আর নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন না আমায়। মিশিয়ে রাখলেন নিজের সাথে। শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘ডোন্ট বি প্যানিক আহি। লুক এট দেয়ার। এভরিথিং ইজ ফাইন। প্লিজ শান্ত হও।’

আমি এবার একবুক সাহস নিয়ে উনার বুক থেকে মাথা তুলে পেছনে তাকালাম। না, কেউই নেই ওখানে। তাহলে কি সব আমার মনের ভয় ছিলো নাকি অন্যকিছু? কেননা , আমি স্পষ্ট সেই মানুষটার কথা শুনেছি ।আনভীর আমার মনের অবস্থা বুঝলেন কি না জানিনা তবে সে আস্তে করে আমার বাহু চেপে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন আমায়। সিটবেল্টটিও লাগিয়ে দিলেন ধীরভাবে। আমি তখনও যেন একটা ট্রমাতে আছি। নিঃশ্বাস ফেলছি বারবার। আনভীর আমায় দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না যে ঠিক কি হয়েছিলো। আমিও চুপ ছিলাম তাই।

_______________
বাসায় ফিরে এসে আমি কোনো কথা না বাড়িয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলাম এবার। কোচিংয়ের সামনের সেই ঘটনাগুলোর জন্য মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। তাই গোসল সেরে বেরিয়ে এলাম আমি। দেখি আনভীর খাটে বসে আছে। আমি উনার দিকে তাকালাম না এবার। অপ্রস্তুতভাবে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছতে থাকলাম। আনভীর আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নিবিড়ভাবে। আমি আয়নার উনার সেই প্রতিচ্ছবি দেখতে পারছি। আমার হঠাৎ চিন্তা জেগে ওঠলো মনে। উনি কি এখন তাহলে রাস্তায় আমার হঠাৎ সেরকম রিয়্যাক্টের কারনটি জিজ্ঞেস করবেন? আমি আসলে চাচ্ছি না এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে। কারন আমি নিজেই নিশ্চিত না যে আমার হয়েছিলো আসলে কি। আগে আমায় নিজে নিশ্চিত হতে হবে। আনভীর খাটে থেকে উঠে এবার এগিয়ে আসতে থাকলেন আমার দিকে। আমি সেদিকে না তাকিয়ে চুল মুছতে লাগলাম।
এবার আমার ঠিক পেছন বরাবর দাঁড়ালেন আনভীর। চোখের দৃষ্টিতে কিঞ্চিত রাগ। ঠোঁট জোড়া চেপে এমনভাবে আয়না দিয়ে আমায় দেখছেন যে কোনো কারনে আমার ওপর প্রচন্ড বিরক্ত। আমি এবার আয়না দিয়ে বোকাসুলভ চাহিনী দিলাম উনাকে। বললাম,

–‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?’

–‘তোমার ইনটেনশনটা আসলে কি আমায় বলবে?’

আমি ভ্রু কুচকালাম এবার। জিজ্ঞেস করলাম,

–‘মানে?’

আনভীর এবার বড় বড় নিঃশ্বাস ফেললেন নিজেকে শান্ত করার জন্য। তারপর কানের কাছে পেছন থেকে গম্ভীর স্বরে বললেন,

–‘আমার সামনে আর একবার নিজের ঠোঁটটা কামড়িয়ে জাস্ট দেখো , আমি নিজেই তারপর তোমার ঠোঁট খেয়ে ফেলবো স্টুপিড !’

আমি বিস্ফোরিত চোখে আয়না দিয়ে তাকালাম উনার দিকে। আমি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছি যে রীতিমতো আমার হাত থেকে তোয়ালেটা ফ্লোরে পড়ে গেলো উনার টনক নাড়ানো কথায়। আসলে আমার একটা অভ্যাস আছে , কোনো কিছু গভীরভাবে ভাবলে অজান্তেই আমার ঠোঁট আমি কামড়ে ধরি। তবে এর জন্য কেউ যে আমার ঠোঁট খেয়ে ফেলার মতো ভয়াভহ ওয়ার্নিং দেবে এটা আমার ধারনার বাহিরে ছিলো। আনভীর এবার সরে আসলেন আমার কাছ থেকে। তারপর ফর্মাল ড্রেস চেন্জ করার জন্য আলমারি থেকে গেন্জি আর প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।

__________________

ঘড়ির কাটা সাড়ে ছয়টা ছুই ছুই। শিউলি ভাবি আমাদের রুমে এসে বললেন আমাদের তাড়াতাড়ি রেডি হতে। সাতটার সময় আমরা রওনা দেবো অনুষ্ঠানের জন্য। আমি এবার আলমারি থেকে আমার পছন্দমতো একটি কালো রঙের শাড়ি পড়ে নিলাম। আনভীর চোখ রাঙিয়ে বারবার আমার উদ্দেশ্যে বলছেন গতরাতে উনার পছন্দ করা সেই সবুজ রঙের শাড়িটি পড়তে। কিন্ত আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিনি। একে তো উনার বিষয়ে মাথা ঘামালে উনি তো শুধু পারেননা আমায় কাচা গিলে ফেলতে। তাহলে আমার বেলায় উনার এত বাড়াবাড়ি কিসের? আমি তাই আমার পছন্দমতো শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিলাম এবার।
ড্রইংরুমে যেতেই আমি আজরান ভাইয়া আর আরিয়া ভাবিকে পেয়ে যাই। দুজন জুটি বেঁধে নীল রঙের শাড়ি আর ম্যাচিং করে পান্জাবী পড়েছে। আমি এবার আড়চোখে আমার গোমরামুখো চশমিশ বিলাইটার দিকে তাকালাম। উনি কালো রঙের ব্লেজার আর কালো শার্ট পড়েছে। আমি মনে করি আমাদের ম্যাচিংটা হয়েছে কাকতলীয়ভাবে। কেননা উনার হিসেবে আমার সবুজ শাড়ি পড়ার কথা ছিলো। উনি আর যা-ই করুক না কেনো , আমার সাথে ম্যাচিং করে ড্রেস নিশ্চয়ই পড়তে চাইবেননা যেদিকে আমরা দুজনেই যাচ্ছি একপ্রকার জোরাজুরিতে।
আজরান ভাইয়া সরু চোখে আনভীরের দিকে তাকালেন। বললেন,

-‘কই যাচ্ছিস তুই?’

আজরান হতভম্ব হয়ে বললো,

-‘কেনো ? বিয়ের অনুষ্ঠানে।’

আজরান হেসে দিলো এবার। তারপর হাসি চেপে বললো,

-‘আমি তো মনে করেছিলাম যে তুই বিয়ে তে তো না , এজ ইউজুয়াল ভার্সিটিতে ক্লাস করাতে যাচ্ছিস।’

আবারও হেসে দিলেন ভাইয়া। সেই সাথে শিউলি ভাবিও। আমি কোনোমতে নিজের হাসি চাপিয়ে আছি। আনভীর অদ্ভুত চোখে তাকালেন আমাদের সবার দিকে। তারপর বিরক্ত হয়ে আজরান ভাইয়াকে বললেন,

-‘কেন ভাই? কি সমস্যা?’

-‘চশমাটা রেখে আয়। চুলগুলো স্পাইক করবি, পান্জাবি পড়বি , তাহলেই তো মনে হবে যে তুই কোনো দাওয়াতে যাচ্ছিস !’

-‘আমি এভাবেই কম্ফোর্টেবল। সো আমি এভাবেই যাচ্ছি।’

বলেই আনভীর মোবাইল স্ক্রল করতে করতে চলে গেলো বাইরে। আমি এই লোকের ব্যবহার যতটাই ভালোভাবে দেখছি ততই যেন অবাক হচ্ছি। কেমন মানুষ এটা? সবসময় নিজের মনমর্জিতেই চলে। আজরান ভাইয়া তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললেন,

-‘এই ছেলে জীবনেও শুধরাবে না।’

তারপর আমি , আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবি বাবা-মা’য়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে গেলাম। আনভীর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আমাদের জন্য। আজরান ভাইয়া নিজের গাড়িটি গ্যারেজ থেকে বাইরে নিয়ে আসলেন এবার। সবাইকে ইশারায় বললেন দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়তে। আনভীর ফ্রন্ট সিটে আজরান ভাইয়ের পাশে বসতে গিয়েই আজরান ভাইয়া থমথমে গলায় বললেন,

-‘তুই কি জীবনেও ভালো হবিনা?’

আনভীর প্রশ্নবোধক চোখে সেদিকে তাকালেন। বললেন,

-‘আবার কি করলাম আমি?’

-‘ তুই এখানে বসছিস কেনো? এখানে তোর ভাবি বসবে। আমাদের বিয়ের পর থেকেই তোকে দেখছি তুই আমাদের পিছে পড়ে আছিস। এখন তো তোরও বউ আছে। তুই তোর বউয়ের সাথে পেছনে গিয়ে বস, আর আল্লাহর ওয়াস্তে আমার বউকে এখানে আসতে বল।’

অপমানে থমথম হয়ৈ উঠলো আনভীরের মুখশ্রী। জড়ানো গলায় বললো,

-‘ঠিক আছে,,,,,,,,,,,আমি পেছনে বসছি।’

আমি আর আনভীর পেছনে বসলাম এবার। আজরান ভাইয়ার অন্যরকম ব্যবহার মোটামোটি আমাদের সবাইকেই ভাবিয়ে তুলছে।আনভীর বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

-‘ভাইয়ের আবার কি হলো।’

আমি উনার কথা শুনেও কিছু বললাম না। প্রায় এক ঘন্টা পর আমার চলে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত স্থানটিতে। আশেপাশে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য অনেক মানুষের শোরগোল চলছে। এক বৃদ্ধলোক পরম আন্তরিকতার সাথে আমাদের চারজনকে অভিবাদন জানালেন। বুঝলাম , ইনিই আজরান ভাইয়ার ক্লায়েন্ট শাহজাহান সাহেব। উনি আসলে জানতেন না আমার আর আনভীরের তাৎক্ষণিক বিয়ের কথা। তাই কিছুটা অবাক হলেও আনভীর তা সামলে নেন সুণিপুনভাবে।আমরা চারজন এবার ভেন্যুর একপাশে নীরব হয়ে দাঁড়ালাম। আজরান ভাইয়া ইতিমধ্যে বাকি মানুষদের সাথে কথা বলছে। সাথে শিউলি ভাবিও। আমি আর আনভীর নীরব হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। তখনই পাশ থেকে কেউ বলে ওঠলো,

–‘কেমন আছিস আনভীর?’

আমি পাশ ফিরে তাকালাম সেদিকে। এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মুখে স্মিত হাসি। আনভীর মিহি গলায় বললো,

–‘এইতো ভালো। তুই?’

যুবকটি প্রতিউত্তরে বললো, ‘আমিও ভালো। এটা কে? তোর সেই বউ যার কথা তুহিন বলেছিলো?’

আনভীরের হাসি উবে গেলো হঠাৎ। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললো,

-‘তুহিন তোকে সব বলেছে?’

যুবকটা আলতো হেসে বললো, ‘বলতে চায়নি। তবে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।’

আমি বুঝে গেলাম যে উনি কিসের কথা বলছেন। আনভীর আগেই বলেছিলেন যে আমাদের এগ্রিমেন্ট এর কথাটি তুহিনকে বলেছেন। তবে এই যুবকটিও এ ব্যাপারে জেনে গিয়েছেন বলে আনভীর খানিকটা অসন্তুষ্ট । সে আনভীরের কাধে চাপড় দিয়ে বললো,

–‘আরে আমিই তো। তুই-আমি-তুহিন আমরা ছোটবেলার ক্লাসমেট। সো লুকিয়ে লাভ নেই।(আমার দিকে তাকিয়ে বললেন) হ্যালো, আমি ধ্রুব। তোমার মেডিক্যাল এডমিশন টেস্টের জন্য আমিই তোমায় কিন্তু কোচিংয়ে পড়াবো।

বলেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি অবাক হলাম উনার কথা শুনে। উনার সাথে হাতমিলাতে গেলেই বাধাঁ দিলেন আনভীর। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বললেন,

–‘তোমার হাত ধরার জন্য আমি আছি। অন্য কারও হাত ধরতে হবে না।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে আনভীরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে আমার হাত ধরে। ধ্রুব তারপর মিহি হাসি দিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,

–‘এমন করলেন কেনো?’

–‘কেমন করলাম?’

–‘এইযে আমার হাত ধরে আছেন যে?’

আনভীর বিরক্ত হয়ে বললেন,

–‘তো কি হয়েছে?’

মহা জ্বালা তো! আমি কড়া গলায় বললাম,

–‘এত কিসের অধিকার খাটাচ্ছেন আপনি?উনি তো জাস্ট হাতটাই মেলাতে চাচ্ছিলো আমার সাথে। এতে এমন করলেন কেনো?হাত ছাড়ুন।’

আনভীর ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে।তারপর আমার হাত ছেড়ে কোমড় ধরতেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আনভীরের চোখে মুখে রম্যতা। বাকা হেসে বললেন,

–‘এবার তো তোমার কোমড় ছাড়ছিনা মিস।আফটার অল, হাজবেন্ট আমি তোমার। আমি চাইলে তোমার হাত কেন! কোমড়, পেট , পিঠ সব কিছু ধরে রাখতে পারবো।পারলে সারাদিন নিজের সাথে ফেবিকলের মতো আটকে রাখবো। কি করতে পারবে তুমি?’
.
.
.
.
~চলবে……..ইনশাআল্লাহ!

বৃষ্টির জন্য কারেন্ট চলে গিয়েছিলো হঠাৎ করে। তাই পোস্ট করতে দেরি হয়ে গেলো।
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here