এমনও প্রেম হয় পর্ব:-১০

0
1186

#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-১০

দুপুর গড়িয়ে গেলো, লিয়ার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। মৃতের মত পড়ে আছে। অক্সিজেন চলছে। শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। তাই বুক ওঠা নামা করছে খুব দ্রুত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।

ওর মা বাবা ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে গিয়ে একই জায়গায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন মেয়ের জ্ঞান ফিরবে। লিয়ার মায়ের চোখের পাতা শুকাচ্ছেই না। কেঁদেই চলেছে। মায়ের মন বলে কথা।

অনেক বলেও লিয়ার মাকে আই সি ইউ র সামনে থেকে সরানো যায়নি।



সে ভেবে চলেছে মেয়ের জন্মের সময়ের কথা।
কত সুখময় স্মৃতি আছে ওকে গর্ভে ধারণ করার পর।

লিয়ার মায়ের নাম আফরোজা।
আফরোজার বিয়ের পর ছয় বছর পর লিয়া গর্ভে আসে। কত দোয়া, কত মানত, আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে কত মোনাজাত করে অবশেষে লিয়া পেটে আসে।

ও গর্ভে আসার পর পেটে হাত রেখে কত আদর করেছে বাচ্চাটাকে। কত শত মায়াভরা কথা বলেছে। কত স্বপ্ন সাজিয়েছে এই বাচ্চাকে ঘিরে। কত মায়া জন্মেছে বাচ্চাটার প্রতি যেই বাচ্চাটা তখনও দুনিয়াতেই আসেনি।



পেটে হাত রেখে যখন কথা বলতো বাচ্চার সাথে তখন মনে হতো ও আমার সব কথা বুঝতে পারছে। সব কথায় রেসপন্স করছে। এইসব ভেবে কতো আদর করতো। পেটের ওপর হাত রাখলেই মনে হতো বাচ্চাটাকে ছুয়ে দিতে পারছে,
মনে হতো ও আমাকে আম্মু আম্মু বলে ডাকছে আর খিলখিল করে হাসছে।



আর আল্ট্রা সাউন্ড করার পর যখন জানলো পেটের ভিতরের বাচ্চাটা মেয়ে তখন তার খুশি দেখে কে। মনে হয়েছিলো পুরো পৃথিবীর খুশি সে হাতের মুঠোয় পেয়েছে।
মনে মনে একটা মেয়ে বাচ্চাই আশা করছিলো স্বামী স্ত্রী দুজনেই।

শুধু সে নিজেই না
পরিবারের সবাই অনেক খুশি হয়েছিলো মেয়ে বাচ্চা হবে শুনে।



মিজানুর রহমান মেয়ে হবে শুনে এতো খুশি হয়েছিলো যে বাচ্চা জন্মের আগেই সে মেয়ের জন্য একটা রুম পিংক কালার করিয়ে, পিংক কালারের সব কিছু কিনে এনে ঘর সাজায়। অনেক খেলনা, জামা কাপড় , জুতা , দোলনা, বেবী কট,বাউন্সার,ওয়াকার,ছোট রকিং চেয়ার সব কিনে নিয়ে আসছিলো।

মিজানুর রহমান অফিস শেষ করে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই বসতো বেবির খোজ নিতে ।

আফরোজার পেটের ওপর কান লাগিয়ে বাচ্চার হার্টবিট শোনার চেষ্টা করতো। পেটের ওপর হাত রেখে কিক অনুভব করতো।
বাচ্চার সাথে মিষ্টি মিষ্টি অনেক কথা বলতো।

বলতো, মামনি আমি তোমার আব্বু হই , তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো,
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি ।
তুমি দুনিয়াতে আসার পর আমি তোমার সাথে অনেক গল্প করবো, অনেক খেলা করবো। তোমাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবো। স্কুলে নিয়ে যাবো। দুজনে আইস্ক্রীম খাবো, খুব মজা করবো আমরা। এতটাই আদরের মেয়ে এই লিয়া।



আফরোজার পেটের ভিতর থেকে প্রথম যেদিন কিক মেরেছিল সেই অনুভূতিটা এখনও তাজা।
মনে হয় এইতো সেদিনের কথা।

সেই কিক মারার অসহ্য ব্যাথাও সুখে পরিণত হইছিলো কল্পনায় ওর মায়াবী মুখটা ভেবে ।

তারপর ধীরে ধীরে সাত মাসে পড়লে পেট ফুলে ওঠা, চামড়ায় অসহ্য টান পরা, পেটের চামড়া ফেটে যাওয়া, পুরা শরীর ভারী হয়ে যাওয়া , শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হতো সে সময়টাতে।
খাটের সাথে পিঠে বালিশ নিয়ে হেলান দিয়েই রাত পার করে দিতো। রাতে ঘুমাতে পারতো না

পায়ে পানি আসা, হাটতে না পারা, হাটতে গেলেই পায়ের চামড়ায় টান পড়তো মনে হতো এখনই পায়ের পাতার চামড়া ফেটে পানি গড়িয়ে পড়বে।

সব কষ্টের মাঝেও বিশাল এক সুখ অনুভূত হতো যে, এটা আমার বাচ্চা, আমার নাড়ির সাথে ওর যোগসূত্র । আমার নাড়ি ছেড়া ধন। আমার বাচ্চার জন্য আমি সব কষ্ট সহ্য করতে পারি।

বাচ্চার জন্য পৃথিবীর সব মায়েরাই সব কষ্ট মেনে নিতে পারে।
জন্মের পর ওর মুখ দেখে আমি সব কষ্ট নিমিষেই ভুলে গেলাম।



তারপর যেদিন পৃথিবীতে এসে প্রথম চোখ খুললো, সেই স্মৃতি তো চিরঅম্লান। সেই সুখের তুলনা হয় না।

প্রথম কোলে নেয়ার সুখ,
ওর কপালে পরম মমতায় প্রথম চুমু খাওয়ার সুখ,
কচি কচি ছোট ছোট হাত পা ছুয়ে দেখার মত খুশি বোধয় আর কোন কিছুতে নেই।

প্রথম কোলে তুলে নেয়ার পর পিটপিট করে আমার দিকে তাকানো দেখে আমার মনে হয়েছিলো আমি বিশ্ব জয় করেছি।

এগুলি কি ভুলা যায় ?

কত আদরের মেয়ে আমার আজ নির্জীব হয়ে পড়ে আছে।
কেউ ওকে ডেকে তোলো।
ওর জন্য যে আমার কলিজা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

আমি যে ওর মা আমি কেমন করে এই কষ্ট সহ্য করবো।



তারপর প্রথম যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল, সেকি খুশী।
বারবার হাত তালি দিচ্ছিলো। বারবার পড়ে যাচ্ছিলো আবার উঠে দাড়িয়ে যাচ্ছিলো।

তার কিছুদিন পর ছোট ছোট পায়ে হাটতে শিখলো।
ক্ষুধা পেলে আমার কাছে ফিডার হাতে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেটে আসতো।

ওর পায়ে ছোট দুটি নূপুর পড়িয়েছিলাম, যখন হাঁটতো ওর নূপুরের রুমঝুম আওয়াজে মনটা খুশিতে নেচে উঠতো।

প্রথম যেদিন স্কুলে গেল, কিছুতেই আমাকে রেখে ক্লাসরুমে যেতে চাইছিল না, কান্না করছিলো ভীষন।

অনেক বোঝনোর পর ক্লাসে পাঠাতে পেরেছিলাম সেদিন ।
এই গুলি আমি কেমন করে ভুলবো?

আল্লাহ আমার বুকের মানিক আমাকে ফিরিয়ে দাও।
আমার বুক তুমি খালি করো না।
এই মায়ের ফরিয়াদ তুমি শোন খোদা।

একদিন তুমি খুশি হয়ে লিয়াকে আমার কোলে দিয়ে আমাকে খুশিতে ভরিয়ে দিয়েছিলে, আমার ঘর আলোকিত করেছিলে,
আজ সব অন্ধকার করে দিও না।
বলে আল্লাহর কাছে হাত তুলে অঝোর ধারায় কাদছে।



এদিকে অফিস শেষে বাসায় ফিরে আসার পর দাদুকে ড্রইং রুমে বসা দেখলো। দাদু টিভিতে টক শো দেখছে।

উদয়ের দাদু ওকে জিজ্ঞেস করলো, নতুন বউর সাথে ভাব ভালোবাসা কতদূর এগুলো?

কি যে বলোনা দাদু,
আমি এখন আসলাম অফিস থেকে আর তুমি ভাবছো বউ নিয়ে বেড়াতে গেছি! হায়রে__দাদু!

ঘরে এসে কাপড় চেঞ্জ করে, উদয় তার সদ্য বিয়ে করা বউকে ফোন দিল।

লিয়ার ফোন বন্ধ।
আবার কল করলো, এবারও বন্ধ বলছে।

উদয়ের একটু রাগ হলো,

কালকে কত করে বলে আসলাম, আমি ওর ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।

একটা কল করলে কি এমন ক্ষতি হতো?

অফিসে বসে সারাদিন মনে হইছে এই বুঝি ও ফোন করলো।
কিন্তু না ওর কোন ফোন আসেনি। বারবার ফোন চেক করেছি।

মনে হয় নিজ থেকে ফোন দিতে লজ্জা পাচ্ছে।
আমাকেই ফোন দিতে হবে।

পিচ্চি বউটারে যে আমি খুব ভালবেসে ফেলেছি। ওর মুখটা চোখের পাতা থেকে সরাতে পারছি না। খুব মিস করছি বউটাকে।
পিচ্চী বউ, ওকে ভাব ভালোবাসার অনেক কিছু শিখাতে হবে।

স্বামীর সাথে প্রেম করা শিখাতে হবে।
ফিলিংস কি জিনিস সেটা বোঝাতে হবে। যেটা পিচ্চি বউটার ভিতর একটুও নেই ।

নানান কিছু ভেবে চলছে।
নতুন বিয়ে হইছে, কোথায় তারা দুজন মন খুলে কথা বলবে, বাইরে
ঘুরতে যাবে, ভালোবাসার আদান প্রদান হবে তা না তার ফোন বন্ধ।

আমি তার জন্য যেমন উতলা হইছি অপর পক্ষের তো কোন মাথা ব্যাথাই নেই।
কি বিয়ে করলাম দাদুর কথায়,
বউ তো পাত্তাই দিচ্ছে না।

অথচ বিয়ের পর বৌকে ভালবাসবো বলে জীবনে একটা প্রেম পর্যন্ত করিনি।
বউর জন্য সমস্ত ভালোবাসা তুলে রেখেছি। আমার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা শুধু আমার বউয়ের জন্য গচ্ছিত রেখেছি।

উদয় আর থাকতে না পেরে এবার লিয়ার বাসার ল্যান্ড ফোনে কল দিল।
ফোন ধরলো লিয়ার ছোট বোন রিয়া।

সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে বলছেন ?

ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে বললো,
আমি উদয়।
তুমি কে বলছো?

ওহ ভাইয়া, আমি রিয়া। আপনি কেমন আছেন?

আমি ভাল আছি।
তুমি কেমন আছো শ্যালিকা ?

আমিও ভালো আছি।

দাদু কেমন আছে আর বাসার সবাই কেমন আছে?

হ্যা সবাই ভালো আছে।

তোমার গলার আওয়াজ এতো ভারী ভারী লাগছে কেন?

তুমি কি কাদছিলে?

না তো! আমার ঠাণ্ডা লাগছে তাই গলার আওয়াজ এমন শোনাচ্ছে।
(আসলে ও ঠিকই কাদছিল )

তোমার আপু কই?তার খবর কি?
সে কেমন আছে?

আপু ভালোই আছে।

আম্মুর সাথে মামার বাসায় গেছে । কালকে অনেক কান্নাকাটি করছিলো তাই আম্মু ঘুরতে নিয়ে গেছে।

তোমার আপুর ফোন বন্ধ কেন?

আপু ফোন নিতে ভুলে গেছে। তাই আমি বন্ধ করে রেখেছি।

আপু আসলে কিছু বলতে হবে?

না কিছুই বলতে হবে না। আমিই পরে আবার ফোন করবো। এখন রাখি, ভালো থেকো ।

রিয়া সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

দাদু বাসার সবাইকে এই কথা বলতে শিখিয়ে দিছে।

ওদিকে উদয় একটু মনক্ষুন্ন হলো।
আমি ম্যাডামের জন্য জ্বলে পুড়ে মরছি আর উনি মামার বাড়ি বেড়াচ্ছেন।

হায়রে ভালোবাসা।
ভালোবাসা এতো পোড়ায় কেন?
বুকের ভিতরটা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। এক নজর দেখার জন্য একটু কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করছে। কেমন করে এই ব্যাকুলতা কমাবো! খুব অস্থির লাগছে।

উদয় রিমিকে ডেকে রিমির মোবাইলে তোলা সব ছবি নিজের ল্যাপটপে নিয়ে সেই ছবিতে ডুব দিলো। হারিয়ে যেতে থাকলো পিচ্চি বউয়ের কল্পনায়।

উদয় প্রতিটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কোন ছবি জুম করে দেখছে আবার কোন কোন ছবি ক্রপ করে সেভ করছে। কিছু ভালো লাগা ছবি মোবাইলে সেভ করে নিলো।



সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে ।
প্রফেসর ডক্টর আবার
এলেন। তাকে কল করে আনা হইছে অন্য এক সিরিয়াস রোগী দেখার জন্য।

সেই রোগী দেখা শেষ করে, উনি যেনো লিয়াকেও আবার দেখেন সেজন্য মিজানুর রহমান অনুরোধ করলেন।

প্রফেসর ডক্টর বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিজানুর রহমানকে বললেন, আর কোন চিন্তা নেই ,

আপনার মেয়ে এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।

ডিউটি ডক্টরকে সব বুঝিয়ে বলা আছে,
জ্ঞান ফেরার পর তারা সব ব্যবস্থা নিবে।
বলে উনি চলে গেলেন ।

লিয়া সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত শুনে খুশিতে দুজনে দুজনকে জরিয়ে ধরে কেদে ফেলে আর আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানায় ।

(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here