এমনও প্রেম হয় পর্ব:-৩৮

0
1256

#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৩৮

উচ্ছাস সত্যিই রিয়াকে খুব ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা যাতে হারিয়ে না যায় তাই সে ওদের দুজনের সম্পর্কের মাঝে বিয়ে নামক মোহর লাগিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলো গোপনেই থাকবে ওদের ভালোবাসার সম্পর্কের কথা। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। আলাদা হয়ে গেল দুজন দুজনের কাছ থেকে।

রিয়াকে না দেখে, রিয়ার সাথে কথা না বলে আমি থাকবো কিভাবে?

রিয়া তখন কি ভীষণভাবে কাদছিল, দেখে কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর চোখের পানি মুছে দেই। আর সাহস দিয়ে বলি, কেদোনা আমি সারাজীবন তোমার হয়ে তোমার পাশে থাকবো। শুধু তোমাকেই ভালোবাসবো। কিন্তু কিছুই বলা হলো না।

রিয়ার কষ্ট, ওর চোখের পানি দেখে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো তখন।

রিয়ার কষ্টটা আর নিতে পারছিলো না, রিয়ার সাথে সাথে উচ্ছাসেরও চোখের পানিতে বুক ভিজে যাচ্ছে।

অসহ্য যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে রিয়াদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল সে।

.
রিয়া উচ্ছাসের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে। চোখ থেকে বয়ে চলেছে লোনা পানির ধারা।

বলেতো দিলো আর উচ্ছাসের সাথে যোগাযোগ রাখবে না, কিন্তু সে কি পারবে উচ্ছাসকে ছাড়া থাকতে। পারবে না কিছুতেই। অনেক কষ্ট হবে মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
উচ্ছাস যে ওর জীবনের সবটুকু জায়গা জুড়ে আছে। ও নিজের চেয়েও উচ্ছাসকে বেশি ভালোবাসে।

.
মিজান সাহেব বললো, লিয়া রিয়াকে এখান থেকে নিয়ে যা। তোর দায়িত্বে ওকে দেয়া হলো।
এখন থেকে ও তোর ঘরে থাকবে, তোর সাথেই থাকবে, মনে থাকে যেনো। সর্বক্ষণ ওকে চোখে চোখে রাখবি। এখন এখান থেকে যা। আমরা একটু কথা বলবো।

.
ঘরের ভিতরে রইলো, লিয়ার বাবা মা আর উচ্ছাসের বাবা মা।

মিজান সাহেব বললো, বেয়াই সাহেব আমাদের ছেলে মেয়ে উভয়েরই দোষ আছে। খুবই অন্যায় কাজ করেছে ওরা।

আপনারাও কিন্তু কম অন্যায় করেননি। আপনারা লিয়াকে উচ্ছাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন।
কিন্তু কেন ?

মতামত জিজ্ঞেস করা আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন সম্পর্ক চাপিয়ে দেয়া দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।

উচ্ছাস রাজি হয়নি, লিয়াও রাজি হতো না। লিয়াকে আমি চিনি। আমি ওর বাবা তাই ওর মনোভাব ভালোভাবেই জানি।

সত্যি বলতে কি আমি নিজেও এই ব্যাপারে রাজি না।

মাঝখান থেকে দুই পরিবারের সুসম্পর্ক নষ্ট করলেন।
আজ কালকার ছেলে মেয়েরা আগের দিনের মত বাবা মায়ের কথা মাথা নত করে শোনে না। চোখ বুজে মেনে নেয় না।

তার ওপর আপনারা চেয়েছেন দেবর ভাবির বিয়ে দিতে।

আজকাল দেবর ভাবির বিয়ে হয়? ইদানিং কোথাও শুনেছেন?
আর হলেও কি ওরা কখনও সুখী হতো?

এখনকার বাচ্চারা স্বাধীনচেতা, নিজের মন মত চলতে পছন্দ করে। কারো পরামর্শ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। কেউ জ্ঞান দিলে এই বয়সের ছেলে মেয়েরা বিরক্ত মনে করে।

এতো কিছু করার আগে আমাকে যদি একবার বলতেন, তাহলে আমি এই প্রস্তাবে শুরুতেই না করে দিতাম। তাহলে আজকের এই জল ঘোলা হতো না।

.
যাহোক, যা হবার তাতো হয়েই গেছে। উচ্ছাস আর রিয়া নিজেরাই তো বিয়ে করে ফেলেছে। এখন তো আর করার কিছুই নেই।

বিয়ে তো আর ছেলে খেলা না। এটা অস্বীকার করার সাধ্য আমাদের কারো নেই। ওরা দুজন পড়াশুনা শেষ করুক। বয়সও কম ওদের, আরেকটু ম্যাচিউর হোক, বুদ্ধি বিবেচনা হোক। উচ্ছাস পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকার পর আমরা ওদের আবার বিয়ে দিবো ধুমধাম করে।

এই কথাটা এখনই ওদের জানানো যাবে না। এই কথাটা ওদের কাছ থেকে গোপন রাখতে হবে। আপনারা কি বলেন,

.
হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন।

আর বেয়াইন আপনাকে বলি, ওদের দেখা সাক্ষাত না হলে, আপনিও মনে শান্তি পাবেন কিছুটা, ছেলে প্রেম করে বেড়াচ্ছে এটা আর আপনার মনে হবে না। বিয়েটাও প্রেমের বিয়ে মনে হবে না। তখন রিয়াকে ইজিলি মেনে নিতে পারবেন।

উচ্ছাসের বাবা মা দুজনেই স্বীকার করলো যে তাদের খুব বড় ভুল হয়ে গেছে।
ব্যাপারটা যে এমন হতে পারে সেটা তাদের মাথায়ই আসেনি। আসলে আমরা লিয়াকে আর আয়ুশকে আমাদের নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছি।
লিয়ার সুখের চিন্তা করেছি। ওর জন্য আমরাও ব্যথিত।

.
আপনারা আমার মেয়েকে ভালোবাসেন, ওকে নিয়ে ভাবেন দেখে ভালো লাগলো। তবে রিয়াও কিন্তু আমারই মেয়ে। বড় মেয়েকে দিতে না পারলেও ছোট মেয়েকে দিলাম। সময় হলে এসে ধুমধাম করে বউকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন।

আপনারা কি আমার প্রস্তাবে রাজি?

.
উচ্ছাসের বাবা মা দুজনেই খুশি মনে রাজী হলো।

লিয়ার মা সবাইকে মিষ্টি মুখ করালো।

.
লিয়ার বাবা বললো, আমি আরেকটা কথা বলতে চাই। তখন বলেছিলাম না লিয়ার পরীক্ষা শেষ হলে আমি লিয়ার আবার বিয়ে দিবো, এ কথাটা কিন্তু আমি সিরিয়াসলি বলেছি।
কোন মসকরা করে বলিনি। মেয়েটার আমার কতোই বা বয়স।

ওর কথা মনে হলে আমার খুব কষ্ট হয়। খুব খারাপ লাগে ওর মুখের দিকে তাকালে। বড় দুর্ভাগা ও। এই বয়সে মেয়েরা স্বামীর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করে। দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। স্বামী সোহাগী হয়। হেসে খেলে বেড়ানোর বয়সে স্বামীকে হারালো। বিধবার বেশে চলাফেরা করে। উদয় যাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত কোন রঙিন কাপড় গায়ে তোলেনি। সাদা কাপড় পরে থাকে সবসময়। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

ওর জীবন থেকে যে রঙ হারিয়ে গেছে, আমি ওকে আবার বিয়ে দিয়ে ওর জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া রঙ ফিরিয়ে দিতে চাই। বাবা হিসেবে এটা আমার কর্তব্য।

আমার সেই হাস্যোজ্জ্বল লিয়াকে আর খুঁজে পাই না। আমার সেই মিষ্টি মেয়েটা দুঃখের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।

একটা অপরাধবোধ কাজ করে ওর ভিতরে। স্বামী মারা গেছে এটা যেনো ওর অপরাধ। ওকে কে বোঝাবে যা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে। জন্ম মৃত্যুর ওপর কারো হাত নেই।

আপনার বাড়িতেও নিজেকে বাড়তি বোঝা মনে করতো, আর আমার এখনেও তাই মনে করে। আমি এটা বুঝতে পারি।

এটা ওর নিজের বাড়ি, একথা আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু তারপরও কেমন মনমরা হয়ে থাকে।

কলেজে যায় রিক্সায় করে, বাসার গাড়ি ব্যবহার করে না। শপিংয়ে যায় না। রেস্টুরেন্টে যায় না। মুভি দেখতে যায় না। কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই। জীবনের সব আনন্দ বুকের ভিতর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। আমার বুকটা ফেটে যায় ওর কষ্টে। বলেই আবেগ প্রবণ হলো মিজানুর রহমান।

আবার বিয়ে দিয়ে ওর সুখ খুঁজে দিতে চেষ্টা করবো। ওর মনের খুশি বলতে যা বুঝায় আমি তা করে দেয়ার চেষ্টা করবো।

.
আফরোজা বললো লিয়ার আবার বিয়ে দিলেও আয়ুশ আমার সাথেই থাকবে না দিলেও আমার কাছেই থাকবে। আয়ুশকে লিয়ার নতুন সংসারে যেতে দিবো না এটা আমি অ্যাডভান্স বলে রাখলাম।

.
রফিক সাহেব বললো লিয়ার বাচ্চা বয়স, এভাবে ওর জীবন কাটুক এটা আমিও চাই না।

.
হেলেন বললো,
আমারও একই মত। ভালো ঘর দেখে ওকে পাত্রস্থ করতে হবে। এখন হেলায় খেলায় দিন যাচ্ছে, একসময় একা থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠবে।

আয়ুশকে আমরাই সামলে নিবো। আর মায়ের জায়গায় খালা রিয়াতো রইলোই। সেই না হয় আয়ুশকে দেখাশুনা করবে।

.
বিভিন্ন কথাবার্তার মাঝে সবাই একসাথে বসে রাতের খাবার খেয়ে নিল।

উচ্ছাসের জন্যও খাবার প্যাক করে দিলো।

আফরোজা বললো আমার মেয়েটা কাল থেকে কিছুই খায়নি। সেই থেকেই কেঁদে চলেছে। আপনারা ওকে একটু দোয়া করে যান।

হেলেন ও রফিক সাহেব লিয়ার ঘরে গেলো। গিয়ে দেখলো তখনও রিয়া কেঁদেই যাচ্ছে। রফিক সাহেব রিয়ার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলো। হেলেন চোখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে আদর করলো। বাবা মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চায় না। সেটা সন্তানেরা বোঝে না।
ঠিক মত পড়াশুনা করবে। বাবা মায়ের কথা মত চলবে।
.
রিয়া তাদের কাছে পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাইলো।

হেলেন লিয়াকে বললো রিয়াকে যেনো কিছু খাইয়ে দেয়। তারপর তারা বিদায় নিলো।

.
লিয়ার এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু হয় গেলো। ভালো রেজাল্টের আশায় খুব পরিশ্রম করছে সে।

আয়ুশকে মোটেও সময় দিতে পারছে না। ওর খাওয়া গোসল অন্যান্য যত্ন সব আফরোজা আর রিয়াই করে। রিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ তে চান্স পেয়েছে। সেখানে নিয়মিত ক্লাস করছে।

আয়ুশকে বাসার কাছেই একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে ভর্তি করেছে।

রিয়া নিজের পড়ার পাশাপাশি আয়ুশকেও পড়তে বসায়। সময় পেলে স্কুলে নিয়ে যায়।

এসব করে রিয়া নিজেকে ব্যাস্ত রাখে।
উচ্ছাসকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ভুলে থাকতে পারে না। একা হলেই খুব কাদে।

উচ্ছাসকে ভুলে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। ভুলতে চাইলে আরও বেশি মনে পড়ে যায়।
ভালোবাসা কেন এত কাদায়? রিয়া আড়ালে বসে কাদে কাউকেই বুঝতে দেয় না ওর হৃদয় ভরা ব্যাথা আর বুক ভরা কান্না।

.
লিয়া রিয়ার সব কষ্ট ভালোভাবে বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে।
কিন্তু ওর কিছুই করার নেই। আব্বুকে ওরা যেমন ভালোবাসে তেমনি ভীষণ ভয় পায়।

মিজান সাহেবের কথার বাইরে কেউ যায় না। তার কথাই সবার শিরোধার্য।

মাঝে মাঝে লিয়া ফোন করে উচ্ছাসের সাথে কথা বলে।
রিয়াকে সামনে রেখে ফোনের স্পিকার অন করে কথা বলে যাতে একটু হলেও রিয়া শান্তি পায় স্বস্তি পায়।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে সব জেনে নেয়, যা যা জানতে চায় রিয়ার মন।

এতে ওর মনও ভালো রইলো আর আব্বুকে দেয়া কথারও খেলাপ হলো না।

এভাবেই চলতে চলতে একদিন লিয়ার এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হলো। সবগুলি পরীক্ষা ভালোভাবেই দিয়েছে।
এখন শুধু রেজাল্টের অপেক্ষা।

.
মায়ের শরীর একটু সুস্থ হলেই জিয়ান কানাডা ফিরে যায়। যেতে বাধ্য হয়। কারণ ও বেশিদিনের ছুটি নিয়ে আসেনি। অফিস থেকে বারবার ফোন আসতেছিলো। মাত্র দশ দিনের মধ্যেই ফিরে যাবার কথা তারপরও দুই সপ্তাহ কাটিয়ে গেছে দেশে। কিছু কাজ অনলাইনে করেছে বলে চার পাঁচ দিন বেশি থাকতে পেরেছে। যাবার সময় মায়ের কান্নাকাটি দেখে
মাকে কথা দিয়ে গেছে এবার অনেক দিনের ছুটি নিয়ে আসবে। আর ছুটি না পেলে চাকরিতে রিজাইন দিয়ে চলে আসবে। তুমি আমার কথা ভেবে অসুস্থ হবে না। আমি খুব শীঘ্রই আসবো আবার।

(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here