#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-১৭
উদয়ের মা বাবা দাদু সবাই একটু রাগ লিয়াদের ওপর।
এতদিন হয়ে গেলো ছেলের বিয়ে দিয়েছে, তারা উদয়কে তাদের বাসায় দাওয়াত করেনি বা নিতেও আসেনি। এ কেমন কথা।
বউ নিজেও শ্বশুর বাড়ির লোকদের কোন খোজ খবর নেয়নি। একটা ফোনও করেনি।
তারা ফোন করলেও দুই একটা কথা আর হু হা ছাড়া বিশেষ কোন কথা হয় নি।
উদয়রা মিজানুর রহমান পরিবারকে দাওয়াত করছিলো কিন্তু ওরাও আসেনি।
লিয়ার দাদুর শরীর খারাপ এইজন্য।
লিয়ার দাদু নিজেও কোথাও যায় না।
আর উনাকে একা রেখে ওর আব্বু আম্মুও কোথাও যায় না। কেউ না কেউ উনার কাছে থাকতে হয়।
মিজান সাহেব দাওয়াত ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, আমরাতো যেতে পারবো না, তাই আপনারা আসুন একদিন।
উদয় পরিবার দাওয়াত ফিরিয়ে দেয়। মনে মনে তারা রাগ করে আছে, তাদের ছেলেকে ওই বাড়িতে এখনও একদিন দাওয়াত করেনি। লোক পাঠিয়ে নিয়েও যায়নি তাই।
তাদের দেশের নিয়ম কাবিনের পর নতুন জামাই শ্বশুর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য থেকে যায়। অথবা শালা শালীরা পরে এসে তাদের দুলাভাইকে নিয়ে যায়।
লিয়ার বাড়ির লোকেরা সেই নিয়মের ধার দিয়েও যায়নি।
ছেলের বিয়ে দিলাম ওর একাকীত্ব কাটাতে,
ছেলে সেই একাই রয়ে গেলো।
বাসার বড়রা বসে সিদ্ধান্ত নেয় খুব শীঘ্রই তারা বউ ঘরে তুলে আনবে।
এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।
এর মাঝেই একদিন ওদের বাসায় যেতে হবে এই ব্যাপারে কথা বলতে। বউ তুলে আনার দিনক্ষণ ঠিক করে আসবে তখন।
লিয়ার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে।
গোল্ডেন এ+ পায়নি, তবে জিপিএ ৫ পেয়েছে।
লিয়ার বাসার কেউ এই রেজাল্টে খুব খুশি না।
তারা আর ওর টিচার রা ধরেই নিয়েছিল যে লিয়া গোল্ডেন এ+ পাবে। তাদের মন মতো রেজাল্ট হয়নি। তাই সবার মন খারাপ।
লিয়ার নিজেরও মন খারাপ। ও নিজেও ভেবেছে গোল্ডেন আসবে।
পরীক্ষাতো খুব ভালো দিয়েছি, তাহলে মন মত রেজাল্ট হলো না কেন?
লিয়ার বড় মামা রেজাল্ট শুনে খুশি হয়ে ওদের বাসায় আসে মিষ্টি নিয়ে। ভাগ্নি ভালো রেজাল্ট করেছে। এসে দেখে সবার মন খারাপ।
উনি সবাইকে বুঝিয়ে বলে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, এটা কম কিসে।
টিভি অন করে নিউজ দেখো কতো স্টুডেন্টতো পাশই করতে পারেনি, ফেল করেছে।
উনি সবাইকে বুঝিয়ে বিশেষ করে লিয়াকে বুঝিয়ে মিষ্টি খাওয়ালো। উনি অনেক মিষ্টি সাথে করে নিয়ে আসছিলো।
আফরোজাকে বললো, এখান থেকে লিয়ার শশুর বাড়ি মিষ্টি পাঠিয়ে দাও।
লিয়াকে দুদিন বেড়ানোর কথা বলে সাথে করে নিয়ে গেল।
লিয়ার মা প্রথমে যেতে দিতে চায়নি,
বললো উদয়দের বাসা থেকে যদি কেউ আসে, তখন লিয়া বাসায় না থাকলে তারা মাইন্ড করতে পারে।
লিয়ার মামা বলে এতদিন যখন কেউ আসেনি এই দুদিনেও ওরা কেউই আসবে না। এই কথা বলে ওকে নিয়ে যায়।
লিয়ার দাদু অসুস্থ তাই তাকে দেখতে উদয় আর ওর দাদু লিয়াদের বাসায় আসে উদয়ের অফিস ছুটির পর।
কোন খবর না জানিয়েই চলে আসছে ওরা।
আর লিয়ার রেজাল্ট বের হয়েছে তাই উদয়কে জোর করে নিয়ে আসছে ওর দাদু।
বৌকে অভিনন্দন জানাতে যেতে হবে নিজেকে সশরীরে গিয়ে, তাই ওকে সাথে করে নিয়ে আসছে।
অনেক মিষ্টি আর প্রচুর ফলমূল নিয়ে আসছে উদয়।
বিয়ের পর এই প্রথম শ্বশুর বাড়ি এসেছে সে।
এসে উদয়ের মন খারাপ হয়ে গেল।
লিয়া বাসায় নেই শুনে।
কত আশা নিয়ে আসলাম বউয়ের সাথে দেখা হবে, মুখোমুখি বসে কিছুক্ষণ গল্প করবো।
চোখে চোখে চেয়ে
চোখের ভাষা পড়বো।
আমার সব আশার গুড়ে বালি।
মনে মনে একটু রাগও হলো।
এর শোধ আমি তুলবোই।
এক সপ্তাহ ফোন করবো না। ফোন করলে রিসিভও করবো না।
তখন বুঝবে কেমন মজা লাগে।
আরো কিছুক্ষন থেকে গল্পগুজব করে তারপর ওরা চলে যায়।
মামার বাসা থেকে লিয়া পরদিনই চলে আসে। ওর ওখানে ভালো লাগছিলো না। মন ভালো না থাকলে কোথাও গেলেও ভালো লাগে না। মনের ভিতর অস্থিরতা নিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে না।
বাসায় এসে শুনে উদয় আসছিলো ওর দাদুকে নিয়ে।
মনে মনে ভাবলো,
ভালো হইছে আমি বাসায় ছিলাম না,
ওর মুখোমুখি হতে
হয়নি।
আমি বাসায় থাকলেই দাদু ওকে থেকে যেতে বলতো আর সেও সুযোগ বুঝে থেকে যেতো।
আর এদিকে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যেতো।
তারপর উদয়কে ফোন দেয়, উদয় ফোন ধরে না।
বারবার কল দিলো
একবারও রিসিভ করলো না।
লিয়া বুঝতে পারলো বাসায় এসে না পাওয়াতে সাহেবের রাগ হইছে।
উদয় ইচ্ছা করেই ফোন রিসিভ করেনি।
তার ওপর ওর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা।
গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। মাথার ব্যথায় বমি হয়েছে কয়েকবার।
এই অসুস্থ শরীর নিয়ে খুব কষ্ট করে অফিস করছে।
অফিস শেষ করে বাসায় এসেই শুয়ে পড়ে।
গায়ে অনেক জ্বর উঠেছে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে জ্বরের তাপে।
উদয়ের মা হেলেন ডাক্তার ডাকতে চাইলে উদয় বললো, ডাক্তার ডাকতে হবে না, আমি অফিসের ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছি।
ওকে জোর করে হালকা কিছু খাওয়ালো হেলেন, তারপর ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মাথায় অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢেলে দিলো।
মাথা মুছিয়ে দিয়ে,
বললো একটু ঘুমের চেষ্টা কর। কিছু লাগলে ডাকিস, আমি একটু পর আসছি।
হেলেন ওর গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে লিয়ার বাসায় ফোন দিলো সে।
কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বললো,
কিছু যদি মনে না করেন তবে লিয়াকে এ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন দুদিনের জন্যে।
উদয় খুব অসুস্থ।
এই সময় বউয়ের পাশে থাকার দরকার।
বউ থাকা অবস্থায়,
বউয়ের সেবা যত্ন পেলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।
বউ না থাকলে আলাদা কথা ছিলো, এখন ছেলের বউ যখন আছে তাহলে আমার ছেলেটা অসুস্থ অবস্থায় একা ঘরে পড়ে থাকবে কেন?
লিয়ার আম্মু মিজান সাহেবকে কল করে সবটা বললো।
আচ্ছা আমি বাসায় এসে লিয়াকে নিয়ে ওই বাসায় যাবো আর জামাইকেও দেখে আসবো।
তুমি কল ব্যাক করে বলে দাও আমি ওকে নিয়ে আসছি।
আর লিয়াকে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বলো।
আফরোজা লিয়াকে বললো, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নে। উদয় খুব অসুস্থ। তোর আব্বু ওকে দেখতে যাবে।
আর তোকে দুই তিন দিনের জন্য ওই বাড়িতে রেখে আসবে।
লিয়ার বিস্ময়ের শেষ রইলো না। আম্মু এগুলি কি বলছে। অসুস্থ কি মানুষ হয় না? তাই বলে কাবিন করা বউকে কি শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হবে বরের সেবা করতে? আগে কি সে কখনো অসুস্থ হয়নি? তখন কিভাবে সুস্থ হয়েছে?
আর আমি গিয়ে কি করবো, আমি কি ডাক্তার?
আর রোগীর সেবা সম্পর্কেই আমি কিই বা জানি।
ধুর ছাই কিছু ভালো লাগছে না।
আমি কেন যে বেচেঁ ফিরলাম! মরে গেলে এসব কিছু ফেস করতে হতো না।
মিজানুর রহমান লিয়াকে নিয়ে উদয়দের বাসায় এলো।
নতুন বিয়াই বাড়ি যাচ্ছে তাই সাথে নিলো অনেক ফলমূল আর মিষ্টি। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে স্যুপ আর চাইনিজ খাবার নিলো পার্সেল করে।
উদয়ের মা বললো এসবের কোন দরকার ছিল না ভাই সাহেব।
শুধু লিয়াকে দিয়ে গেলেই হতো।
উদয়ের জ্বর এখন কিছুটা কম।
মিজান সাহেব আর লিয়াকে নিয়ে ওর মা উদয়ের ঘরে গেলো ওকে দেখতে।
মিজান সাহেব কিছুক্ষণ মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলে অসুস্থতার খোজ নিলো। তারপর ওকে বিশ্রাম নিতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
সাথে ওর মাও চলে গেল রুম থেকে। বসার ঘরে গিয়ে বসলো তারা।
ঘরে রইলো শুধু উদয় আর লিয়া।
লিয়ার সাথে উদয় কোন কথা বলে না।
পাশ ফিরে লিয়ার দিকে পিঠ করে শুয়ে থাকলো।
লিয়া চুপচাপ ওর মাথার কাছে বসে আছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। তবুও উদয় এপাশে ফিরলো না।
এবার লিয়া বললো, আপনার কি খুব শরীর খারাপ লাগছে?
কেমন লাগছে বলেন, না বললে বুঝবো কিভাবে কোথায় আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমার দিকে ফিরেন।
তারপর বিরক্ত হয়ে বললো,
বাসায় আসা মেহমানের সাথে আপনি বুঝি এমন আচরণই করেন?
কি কথা বলছেন না কেন? কথা বলবেন না?
তাহলে আমি চলে যাই। আব্বুর সাথে, আব্বু এখনও আছে বসার ঘরে।
বলেই বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।
উদয় তৎক্ষণাৎ এপাশ ফিরে খপ করে লিয়ার হাত ধরে ফেলে।
কোথাও যাওয়া চলবে না। তুমি আমার কাছেই থাকবে। এতোদিন অনেক জ্বালিয়েছেন মেমসাহেব আর না।
এতক্ষণ তো পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিলেন। তাহলে আমি এখানে বসে থেকে কি করবো।
উদয় ওকে হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।
লিয়ার শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো। কেপে উঠলো ভিতর থেকে। মুখে কিছুই বললো না।
লিয়া আলগোছে উদয়ের কপালে হাত রেখে দেখে এখনও জ্বর আছে।
তবে সামান্যই।
উদয় লিয়ার হাতটা কপাল থেকে সরিয়ে এনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।
লিয়া বললো এখন জ্বরতো খুব সামান্য। উঠেন আব্বুকে বিদায় দিয়ে আসি। হেটে যেতে পারবেন?
হুম পারবো, চলো।
বসার ঘরে এসে বসলো ওরা।
শাশুড়ি মা বললো, তোমাকে উদয়ের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত কয়েকদিন এখানেই থাকতে হবে বৌমা। উদয়ের পাশে তোমার থাকা দরকার। ও হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
শোন তোমার বাবা যে খাবার নিয়ে আসছে ঐযে টেবিলে রাখা আছে_
ওখান থেকে স্যুপ এনে উদয়কে খাইয়ে দাও।
লিয়া পরলো মহা যন্ত্রণায়। এতো কঠিন লজ্জার কথা। আব্বু বসে আছে এ বাড়ির সবাই বসে আছে, তাদের সামনে কেমন করে উদয়কে খাওয়াবো?
উদয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো, মা আমি এখন কিছু খাবো না। রুমে পাঠিয়ে দিও পরে খাবো।
চা নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ সবার সাথে গল্প করে মিজান সাহেব বিদায় চাইলো।
উদয়ের দাদু বলল, এখন যাবে কি, রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবে।
না না আংকেল তা পারবো না।
রাতের খাবারটা আমি বাবার সাথে খাই। জানেনই তো বাবা খুব অসুস্থ থাকে ইদানিং।
বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। অন্য কোন দিন এসে খাবো।
আজ আমি আসি। ফোন করে খবর নিবো। লিয়াকে উদয়ের খেয়াল রাখার কথা বলে লিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
উদয় বসার ঘরের বারান্দায় দাড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
উদয়ের মা হেলেন মিজান সাহেবের আনা খাবার, ফলমূল, মিষ্টি ভাগ করাতে ব্যস্ত।
ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে প্রথম কিছু এসেছে, সবাইকে কিছু কিছু ফলমূল মিষ্টির ভাগ দিয়ে খেতে হবে। না হলে ভালো দেখায় না।
বৌমা তুমি উদয়কে নিয়ে ঘরে যাও।
অসুস্থ শরীরে ও বাইরে দাড়িয়ে আছে কেন?
লিয়া আস্তে করে ডেকে বললো ঘরে চলেন,
ও কোন সাড়া দেয় না। যেমন দাড়িয়ে ছিল তেমনি গ্রীল ধরে দাড়িয়ে রইলো।
তারপর কাপা কাপা হাতে উদয়ের হাত ধরে বললো, চলেন ঘরে। বিছানায় শুয়ে রেস্ট করবেন।
উদয় একবার লিয়ার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে
তারপর ওরা ঘরে চলে যায়।
ঘরে ঢুকে উদয় দরজা লক করে দিয়ে গভীর ভালো বাসায় লিয়াকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
নিবিড় আলিঙ্গনে একে অপরের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।
লিয়া এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরাতে ওর হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
ওর গায়ের জ্বরের হালকা উত্তাপ লিয়ার গায়েও
লাগছে।
(বানানের ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন)
(চলবে)