#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-২৬
নিজের জীবনের পরোয়া না করে, নিজের জীবন বিপন্ন হবে জেনেও বাচ্চাটা গর্ভে ধরে রেখেছে লিয়া। নিজের থেকে আলাদা হতে দেয়নি।
প্রেগনেন্সিতে অনেক কম্প্লিকেশনস থাকার পরও নষ্ট করতে দেয়নি বাচ্চাটিকে। সবার অনেক রিকুয়েস্ট ইগনোর করে, ধমক খেয়েও নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলো সে।
না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, অমানুষিক শারীরিক কষ্ট সহ্য করেছে লিয়া।
গর্ভে আসার পর থেকেই লিয়া বাচ্চাটার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করতো।
সাত মাসের পর থেকে চিৎ হয়ে শুতে পারতো না কাত হয়ে শুতে পারতো না, কি যে কষ্ট হতো, তখন বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকতো সারা রাত।
আট মাসের শেষের দিকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম দিলো এক ছেলে শিশুর।
গর্ভাবস্থায় এতো মাস কষ্ট করার পর, বাচ্চা জন্ম দিয়েও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে লিয়া। মরতে মরতে বেচে গেছে সে।
মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছে। সবার দোয়ায় আর ভালোবাসায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে সে।
সেদিনের সেই ছোট্ট লিয়া আজ সদ্য জন্মানো ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের মা। একটি সুস্থ ছেলে শিশুর জন্ম দিয়েছে আজ সে।
নারী জন্ম সার্থক হলো আজ। ওর নারী জনম মাতৃত্বের মাধ্যমে পূর্ণতা পেল।
এ এক অন্যরকম সুখ। দুনিয়ার কোন কিছুর সাথে এ সুখের তুলনা হয় না। মাতৃত্বের সুখের কাছে সব সুখ তুচ্ছ।
লিয়ার পরিবার আর উদয়ের পরিবারের সবাই খুব ভয় পেয়েছিল লিয়ার ক্রিটিক্যাল অবস্থা শুনে। যখন শুনেছে লিয়ার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়েও অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না,
তখন লিয়ার মা বাবা চিৎকার করে কেঁদেছিলো।
নিজেদের কে দায়ী করছিলো। কেনো তারা এতো অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো। সে দিন কেনো বিয়ে দিতে জোরালো ভাবে মানা করেনি।
লিয়ার মায়ের কান্নায় গাছের পাতাও যেনো ঝরে পড়েছিলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছিলো আফরোজা।
এতো আদরের বাচ্চা মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আজকে লিয়ার এই অবস্থার জন্য তারাই দায়ী। তারা তাদের মেয়ের হত্যাকারী, এই বলছে আর কাদছে।
হেলেন নিজেও কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করছে যেনো মেয়েটা প্রাণে বেচেঁ যায়।
আজকে লিয়ার এই অবস্থার জন্য নিজেও অনেকাংশে দায়ী।
সেদিন যদি সেই কুট চাল না চালাতো তবে হয়তো মেয়েটা আরো কিছুদিন সময় পেতো গর্ভ ধারণ করতে। তাহলে আজকের এই সংকটের সৃষ্টি হতো না।
উদয় একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। উদয়ের পৃথিবী যেন থমকে গেছিলো। প্রতি নিঃশ্বাসে সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে,
লিয়ার জীবন বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য। ওর লিয়াকে ওর কাছে ফিরিয়ে দিতে কেদে কেদে ফরিয়াদ করেছে আল্লাহর দরবারে।
অবশেষে আল্লাহ সবার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। লিয়া ফিরে এসেছে সবার মাঝে।
মা বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে। এই কথা শোনার পর উদয়ের দেহে যেনো প্রাণ ফিরে এলো।
সাতদিন পর বাচ্চাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরলো লিয়া।
সাধারণত সিজার করার পর মা বাচ্চা তিন/চার দিন পর বাসায় ফিরে যায়। কিন্তু উদয় লিয়াকে হসপিটালে রেখেছে ব্যান্ডেজ খোলা পর্যন্ত।
সে কোন রিস্ক নিতে চায়নি। এমনিতেই লিয়ার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। অনেক দুর্বল সে। ওর আরামের দরকার অনেক।
লিয়ার বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকে উদয় দেখে আসছে ওর অসহনীয় কষ্ট।
কি দুর্বিষহ কষ্ট সহ্য করেছে এই বাচ্চাটাকে দুনিয়াতে আনতে।
মায়েরা বুঝি এমনই হয়। মায়ের স্নেহ মমতার কোন তুলনা হয় না। মা তার সন্তানের জন্য ঢাল স্বরূপ।
এইজন্যই সবাই বলে, মা আল্লাহর তরফ থেকে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত, শ্রেষ্ঠ উপহার।
মা বাচ্চাকে হসপিটাল থেকে বাসায় আনার এক সপ্তাহ পরে খুব ধুমধাম করে বাচ্চার আকীকার অনুষ্ঠান করা হয়।
আকিকার দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিন বেলা গরীব মিসকিনদের খাবার খাওয়ানো হয়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মাঝে কাপড় বিতরণ করা হয়। টাকা পয়সা দান করা হয়। মাদ্রাসায় খাবার রান্না করে ডেগ সহ পাঠিয়ে দেয়া হয়।
লিয়া সারাক্ষণ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বাচ্চাটার মুখের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।
কি মায়া ভরা ছোট্ট একটা মুখ। ছোট্ট দুটি চোখ দিয়ে পিট পিট করে তাকায়। আবার ঘুমিয়ে পড়ে। গোলাপী পাতলা দুটি ঠোঁট। ছোট ছোট হাত পা। বারবার ছুঁয়ে দেখে আর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।
বাচ্চার মুখের দিকে তাকালে পরম মমতায় ওর বুকটা ভরে যেতো, মনে মনে ভাবে এটাই ওর পৃথিবী। এই পৃথিবীকে ঘিরেই সে বেঁচে থাকবে, যতদিন তার হায়াত আছে।
নিজের মনেই বাচ্চার নাম দেয় আয়ুশ।
আমার আশেপাশে শুধু আমার আয়ুশ
থাকলেই হবে আর কিছুই চাই না।
উদয় অফিস থেকে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো। চেয়ে থাকতো বেবির মুখের দিকে। একটা ভালোলাগা কাজ করতো ওর ভিতর। বাচ্চাটার কচি মুখ ওর ভিতরটাকে আন্দোলিত করতো। খুশিতে ভরিয়ে রাখতো ওকে।
অফিসে কাজ করার সময় বারবার করে ভিডিও কল করে বাচ্চাটাকে দেখতো।
বাচ্চাটার সাথে সাথে উদয়েরও নতুন জন্ম হয়েছে। এ এক নতুন উদয়। কোন কিছুতেই আর সে রেগে যায় না। বরং অনেক শান্ত ধীর স্থির হয়েছে। দায়িত্বশীল হয়েছে।
বাচ্চাটা ওদের দুজনের সম্পর্ককে মজবুত করেছে। সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।
লিয়া এখন উদয়কে ভালোবাসে। কেয়ার করে। আর এখন ওরা একে অপরকে বুঝে। খুব ভালোভাবে বোঝে।
লিয়া আর উদয় দুজনে মিলেই লিয়ার পছন্দের নাম রেখেছে আয়ুশ। উদয়েরও নামটা খুব পছন্দ হয়েছে।
লিয়া আর উদয়ের ছেলে আয়ুশই এখন ওদের জীবন।
অফিসে থাকলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে খোজ নেয় লিয়া কি করছে, আয়ুশ কি করছে। আয়ুশ বেশি বিরক্ত করছে কিনা।
তারপর বলে একটু ধৈর্য্য ধরে আয়ুশ কে রাখো, অফিস থেকে ফিরে আমিই রাখবো আয়ুশকে।
না হয় মায়ের কাছে দিয়ে এসে তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও।
মাঝে মাঝে শাশুড়ি মা নিজে থেকেই নিয়ে যায় আয়ুশকে। বলে যায় তুমি বিশ্রাম করো, বাবুর খাওয়ার সময় হলে তোমার কাছে ওকে দিয়ে যাবো।
এইভাবেই চলছিল লিয়ার দিনকাল। কখনো মায়ের বাসায় কখনো শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু লিয়া যেখানেই থাকুক উদয় একদিনের জন্যও লিয়াকে ছাড়া কোথাও থাকেনি। লিয়া আর আয়ুশ যেখানে উদয়ও সেখানে।
লিয়ার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না।
আফসোস ও পড়তে চেয়েছিলো। সব চাওয়া সবসময় পূরণ হয় না। কিছু চাওয়া আজীবন অপূর্ণই থেকে যায়।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর ভিতর থেকে।
জীবনে কি চেয়েছিলাম আর কি পেলাম সে হিসেব এখন আর মিলাতে বসি না।
আমার সব অপূর্ণতা সব ব্যর্থতা, না পাওয়ার যত কষ্ট সব আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে আমার আয়ুশ।
ওর মুখের দিকে তাকালে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।
সারাদিন ওকে নিয়েই কেটে যায় সারাবেলা আর অন্য কিছু ভাবার সময় কই।
আমি এখন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। একজন নারী। একজন মা। কোন হতাশা নেই জীবনে।
লিয়ার স্কুল লাইফের কোন বান্ধবীর সাথেই আর কোন যোগাযোগ নেই। ওর বিয়ের পর একমাত্র নাফিসা ছাড়া আর কেউ যোগাযোগ রাখেনি।
নাফিসার সাথে ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে।
আব্বুর বাসায় গেলে ফোন করে আসার জন্য ডাকলে, সুযোগ পেলে এসে দেখা করে যায়।
অনেক গল্প করে ওর মন ভালো করে দিয়ে যায়।
নাফিসা পড়াশুনা করছে। সে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে পড়ে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে এখন।
একটা মেয়ের যখন স্কুল লাইফেই বিয়ে হয়ে যায়, তখন সে সব কিছু থেকে ছিটকে পরে, আলাদা হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে জীবনের ছন্দ।
কোনভাবেই আর সে পিছনে ফিরে যেতে পারে না।
আগের প্রিয় বান্ধবীরাও কেউই আর খুব একটা মিশতে চায় না
বিবাহিতা বলে।
তখন আর বান্ধবী ভাবে না, ভাবে মহিলা। মেয়ে থেকে এক লাফে হয়ে যায় মহিলা।
ম্যারেড মেয়েদের সাথে আনম্যারেড মেয়েরা সহজ হতে পারে না। তখন অবিবাহিতা বান্ধবীরা ওদের দেখলে মুখ টিপে হাসে, টিপ্পনী কেটে কথা বলে।
সবাই চলে যায় অনেক দূরে। দুই একজন ছাড়া। ম্যারেড মেয়েটির জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। লিয়ার বেলায়ও তাই হয়েছে।
নাফিসা লিয়ার সম্পর্কে সব জানে তাই ও লিয়াকে বোঝে।
লিয়ার কষ্টগুলো কিছুটা হলেও ফিল করে।
আমার সারাটাদিন আয়ুশকে নিয়ে হেসে খেলেই পার হয়ে যায়। উদয়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। ভালো লাগে ওর জন্য অপেক্ষা করতে। মানুষটা নিজেকে আমূল পরিবর্তন করে নিয়েছে। আগের উদয় হারিয়ে গেছে, নতুন উদয়ের জন্ম হয়েছে। এই উদয় এখন প্রতিদিন লিয়ার জন্য কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসে।
উদয়ের নিয়ে আসা জিনিসটা খাবার জাতিয় কিছু হলে লিয়ার পছন্দ না হলেও খুশি হয়ে খায়। আর যদি নিয়ে আসা জিনিসটা অন্য কিছু হয় তাহলে পরম যত্নে রেখে দেয়।
কোন কিছু নিয়েই উদয় এখন জেদ করে না। লিয়ার পছন্দ মত নিজেকে ঢেলে সাজিয়েছে।
রিমি আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে।
রিমি আপুর অনেক সাপোর্ট ছিলো আমার জীবনে। এমন ননদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার কষ্টের সময় গুলিতে আমাকে নিজের বোনের মত আগলে রাখতো। কান্না করতেও একটা বিশ্বস্ত কাধ চাই। রিমি আপু ছিলো আমার সেই বিশ্বস্ত কাধ। যার কাধে মাথা রেখে কেঁদেও শান্তনা পেতাম।
জীবন থেকে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
খুব ভালো করে
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, জীবন আমাদের প্রতি পদক্ষেপে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। আমরা সেগুলি বুঝিনা বা বুঝতে চাই না ।
যেমন ,শ্বশুর শাশুড়ি ছেলের জন্য বউ আনবে অল্প বয়সের মেয়ে দেখে আর নিজের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় বলবে মেয়ে এখনো ছোট। বিয়ের বয়স হয়নি।
আমার ননদ আমার থেকে দুই বছরের বড়। এখন তার বিয়ে ঠিক হইছে।
অথচ আমার জন্য সেই সময় বিয়ের প্রস্তাব না গেলে আমার বিয়েটা তখন হতো না। আমার জীবনটা হতো অন্যরকম। আমার বান্ধবীদের মত আমিও কলেজে পড়তাম।
বিয়ের পর আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে পড়ানোর ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ তারা বিয়ের সময় কথা দিয়েছিলো আমাকে পড়ার সুযোগ দিবে। উদয় ও কথা দিয়েছিলো কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।
এসব ভাবলে বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
দেখতে দেখতে দুই বছর পেরিয়ে গেলো।
অনেক হাসি কান্না,
মান অভিমানের মধ্য দিয়ে পার করলাম দিনগুলি।
এদিকে জিয়ান ভেকেশনে দেশে এসেছে।
লিয়া নিজ থেকে ফোন করবে বলেছিলো কিন্তু কোনদিনও একটা ফোন করেনি।
তাই সে আর থাকতে না পেরে অস্থির হয়ে দেশে এসেছে। না হলে এই ভেকেশনেও দেশে আসতো না।
লিয়ার নাম্বারে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। এভেইলেবল না বলছে বারবার।
কানাডা থাকতেই ফেইসবুকে লগইন করে দেখেছে বারবার। কিন্তু আইডি ডিএকটিভ করা।
দেশে এসেও চেক করছে, আইডি বন্ধ। হন্যে হয়ে জিয়ান লিয়াকে খুঁজছে।
কোনভাবেই লিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। অস্থির হয়ে উঠেছে জিয়ান।
(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)
(চলবে)