এমনও প্রেম হয় পর্ব:-৩৩

0
839

#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৩৩

উদয় চলে গেল
ওর ভালোবাসার দুনিয়া ছেড়ে। এক আসমান দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করে চলে গেলো আরেক দুনিয়ায়, আমাকে একা করে দিয়ে।

.
ঘরের প্রতিটা জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। কোন জিনিসে উদয়ের ছোঁয়া নেই?

সব জিনিসে উদয়ের ছোঁয়া আছে। যেদিকেই তাকাই ওকে হাসিমুখে সামনেই দেখতে পাচ্ছি। বিছানায় বসে থাকতে দেখছি, ঘরময় হেঁটে বেড়াতে দেখছি। পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কানে ফু দিচ্ছে অনুভূত হচ্ছে। জানালার পর্দা সরিয়ে গ্রিলে দুহাত ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখছি।

আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না উদয় নেই। কেমন করে বিশ্বাস করবো, আমার সামনেই তো ঘরময় চলতে ফিরতে দেখছি।

.
আলমারি ভরতি ওর কাপড় চোপড়।
এক সাইডে হ্যাঙ্গারে ওর সব স্যুট আর জ্যাকেট ঝুলানো।
পাশের তাকে থরে থরে সাজানো ওর শার্ট প্যান্ট, আয়রন করে ভাজ করা। আরেক তাকে নানা রঙের পাঞ্জাবি পাজামা, ফতুয়া, ট্রাউজার।

ড্রয়ারে ব্র্যান্ডের কয়েকটা ঘড়ি, সানগ্লাস, টাই পিন পারফিউম।
রুমাল, ওয়ালেট, দুইটা মোবাইল সব কিছুতে হাত বুলিয়ে উদয়কে অনুভব করছি।
সবকিছু পড়ে আছে শুধু মানুষটা নেই।
.
মনে হচ্ছে এখনই মানুষটা অফিস শেষে বাসায় ফিরে আসবে। এসেই আমাকে ডাকবে, ডেকে বলবে, লিয়া একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো।
কোথায় ছিলে আজ তুমি দরজা খুলে দিলে না যে! কতদিন বলেছি আমি বের হবার সময় তুমি দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকবে আবার বাইরে থেকে ফিরে এলে তুমি দরজা খুলে দিবে।
তুমি সব ভুলে যাও কেন? আর কখনো যেনো বলতে না হয়। মনে থাকে যেনো।
চা করে নিয়ে এসো। চলো ছাদে বসে দুজনে চা খাই আর গল্প করি।

.
এসব আমি কেমন করে ভুলবো?
আমি কেমন করে বেচেঁ থাকবো। কি নিয়ে বাঁচবো।

.
যখন উদয়ের সাথে থাকতে চাইতাম না তখন বাধ্য হয়েছি থাকতে। আর যখন মানুষটাকে মনে প্রাণে ভালোবাসতে শুরু করলাম, যখনই উদয়কে আমার দুনিয়া বানিয়ে নিলাম ঠিক তখনই উদয় পার্থিব দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো। আমাকে চির একা করে দিয়ে।

.
আমি এক পৃথিবী একাকীত্বের কষ্ট বুকে নিয়ে পাথরের মত কঠিন হয়ে গেছি। থেমে গেছে আমার পৃথিবী। স্তম্ভিত হয়ে গেছে আমার আশেপাশের দুনিয়া।
চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।এখন আর চোখে পানিও আসে না।

.
আয়ুশ চারিদিকে তাকিয়ে বাবাই বাবাই করে, উদয়কে খুজে ফিরে।

কোথায় ওর বাবা?
এই দুনিয়াতে ওর বাবা বলতে কেউ নেই। বাবা নামক অমূল্য ধন আয়ুশের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।

.
সব বাচ্চারা বাইরে গেলে তাদের বাবার হাত ধরে হাটে। আমার আয়ুশ তার বাবার হাত ধরে হাঁটার সুযোগই পেলো না। কঠিন ব্যাধি লিভার সিরোসিস
ছিনিয়ে নিয়ে গেল আয়ুশের জীবন থেকে ওর বাবাকে।

.
বাবার কোলে বসে আদর পাওয়ার ভাগ্যও হলো না। বাবার হাতে মাখানো ভাত খেতে পেলো না। মাছের কাঁটা বেছে খাওয়ানোর ভাগ্য হলো না।

বাবার সাথে স্কুলে যাওয়া, মেলায় যাওয়া, বাবার কাছে আইস্ক্রিমের বায়না ধরা, খেলনার বায়না ধরা, বাবার সাথে বল খেলা, ক্রিকেট খেলা কোন কিছুই আমার আয়ুশের ভাগ্যে হলো না।
এই ছোট্ট বয়সে আমার আয়ুশ হলো এতিম।

.
উদয় যেদিন মারা গেলো সেদিন থেকেই আম্মু আমার কাছে আমার শ্বশুর বাড়িতেই আছে। বাসায় ফিরে যায়নি।
আব্বু যখন আম্মুকে নিয়ে যেতে চাইলো, আম্মু বলল, ওই ঘরটাতে আমার লিয়া একা থাকবে কি করে? শোকে আর ভয়ে মেয়েটা আমার মরে যাবে।

যেখানে সারা ঘরময় উদয়ের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ও সব কিছু বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে আর কাদছে, এই অবস্থায় আমি ওকে রেখে যাবো কোন প্রাণে। আমি কিছুতেই যাবো না ওকে রেখে।

.
চারদিনের মিলাদ শেষে মেয়েকে নিয়েই বাসায় ফিরবো। মেয়েকে এখানে রেখে যাবো না।

উদয় নেই তাহলে লিয়া এখানে থেকে কি করবে? এখানে থাকলে মেয়ে আমার গুমরে গুমরে মরবে।

ওর কষ্টগুলো কারো সাথে শেয়ার করতেও পারবে না। ওর দুঃখ শোনার কেউ নেই এখানে।

ছেলেকে হারিয়ে ওর শাশুড়ি নিজেইতো দিশে হারা। সারা বাড়িতেই শোকের মাতম।

.
উদয়ের চলে যাওয়ার আজ চার দিন। বড় করে কুলখানির আয়োজন করা হয়েছে।

গরীব মিসকিনদের খাওয়ানোর সাথে নগদ টাকাও দেয়া হচ্ছে। আত্মীয় স্বজনদের আগমনে বাড়ি গমগম করছে।

সবাই আমাকে সান্তনা দিলো। ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিলো।
উদয়ের চাচী মামীরা আমাকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ কান্না করলো। ওদের সহানুভূতিতে আমার থেমে থাকা কান্না বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। চিৎকার করে অঝোর ধারায়
কাদলাম।

.
সবাই আছে শুধু উদয় নেই।
মিলাদ শেষ হলে তাবারক বিতরণের মধ্য দিয়ে কুলখানির অনুষ্ঠান শেষ হলো।

.
উদয়ের কুলখানি শেষে সব আত্মীয় স্বজনরা চলে যাওয়ার পর, আব্বু আম্মু আমার শ্বশুর শাশুড়ির কাছে আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলো।

.
আম্মু আমার শাশুড়িকে বললো, বেয়াইন উদয় নেই তাহলে লিয়া এখানে থেকে কি করবে? একা ঘরে বসে বসে শুধুই কাদবে।
আমাদের বাসায় গেলে ভাই বোনের সাথে ওর সময়টা ভালোভাবে কেটে যাবে। কষ্ট থেকে কিছুটা হলেও রিলিফ পাবে। আর এখানে থাকলে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকবে আর কাদবে।

তাই আমরা লিয়াকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাই।
শাশুড়ি মা বাঁধ সাধলো। সে বললো, আমার ছেলে চলে গেছে নাতিটাকে দেখলেও আমার মনে শান্তি লাগে। ওরা কোথাও যাবে না বেয়াইন। এসব কথা বলবেন না। লিয়া এখানেই থাকবে।

.
আম্মু বললো, বেয়াইন আপনি দুই বছরের নাতির কথা ভাবছেন কিন্তু আমার বিশ বছরের মেয়েটার কথাটা একবার ভেবে দেখেন। মেয়েটা আমার এখানে কিভাবে থাকবে? ওর মনের দিকটা একবার ভাববেন না?

উদয়ের স্মৃতি হাতরে ও মরে যাবে। ওকে বাঁচতে দেন। আপনিও তো মেয়ের মা, বোঝার চেষ্টা করেন। আপনার কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছি।

.
তারপর বাবা আর দাদু দুজনেই বললো, লিয়ার যখন যেখানে থাকতে মন চাইবে ও সেখানেই থাকবে। কেউ কোন বাধা দিবে না। শশুর বাড়ি বাবার বাড়ি কোন ভেদাভেদ নেই ওর জন্য।

.
শাশুড়ি মা বললো, কোন মেয়ের স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হয়। ইদ্দত কালীন সময়ে পার না হলে লিয়া ঘরের বাইরে যেতে পারবে না।

.
বাবা বললো, এসব কথা বাদ দাও এখন। ও বাচ্চা মেয়ে। ওর ওপর এতো কঠিন নিয়ম চাপিয়ে দিও না।

আজ যদি লিয়া চাকরি করতো তবে কি ও চার মাস দশ দিন ঘরে বসে থাকতে পারতো? কোনভাবেই না।
ওকে ওর কর্মস্থলে যেতেই হতো।

তাই বলছি, ওকে আটকাবে না। ও যখন খুশি এ বাড়ি ও বাড়ি যাবে আবার আসবে। ওর বয়স কম। ওর মনের ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।

.
আব্বু আমার শ্বশুরের কথায় খুব খুশি হলো। শাশুড়ি মা বলল, তাহলে যাও।
মাঝে মাঝে এসে আমার আয়ুশকে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যেও।

.
আয়ুশের আর তোমার, যা কিছু প্রয়োজন সেগুলি গুছিয়ে নাও।

আমার আয়ুশের যেনো কোন কষ্ট না হয়।

.
তারপর আমার শ্বশুর তার ঘরে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। এসে আমার দিকে এক বান্ডিল টাকা এগিয়ে দিলেন।

এই টাকা আমার নাতির জন্য দিলাম। ওর যা লাগে কিনে নিবে। টাকা শেষ হলে আমায় বলবে। আমি পাঠিয়ে দিবো।

.
আমি নিতে চাইনি। বাবা জোর করে হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিলো।

.
আব্বু ও বললো ভাই নাতি যেমন আপনার তেমনি আমারও। টাকা কেন দিচ্ছেন? যা লাগে আমিই কিনে দিবো।

.
বাবা কেদে ফেললো, আমার উদয় দুনিয়ায় নেই মাত্র চার দিন। এখনই যদি ওর সন্তানের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেই তবে আমার উদয়ের আত্মা কষ্ট পাবে।

.
উদয়ের সাথে গড়া চার বছরের দুনিয়া পিছনে ফেলে চলে এলাম বাবার বাড়ি বিধবার বেশে সাদা থান গায়ে জড়িয়ে। আয়ুশকে বুকে নিয়ে অশ্রু জলে সিক্ত হয়ে।

.
আব্বুর বাসায় আসার পর আমার তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো, তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো।
মেয়েরা বিয়ের পর সুখের বেরানো বেড়াতে আসে বাপের বাড়ি। আর আমি এসেছি একরাশ দুঃখের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে।
আমি এখন দুই বাড়ির জন্যই বোঝা স্বরূপ। আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি যেনো বাড়তি বোঝা, উটকো ঝামেলা।পৃথিবীর বুকে নিজেকে খুব অপ্রয়োজনীয় লাগছিলো।

.
আমার মনমরা ভাব দেখে দিন সাতেক যাওয়ার পর আব্বু আম্মু আমাদের সবাইকে কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে গেলো। আমার কোন কিছুতেই মন বসছিল না, তাই একদিন পরেই বাসায় ফিরে আসি।
আব্বু আম্মু আমাকে হাসি খুশি রাখতে খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার ডিপ্রেসন কাটাতে পারছে না।

.
একদিন আমাকে ডেকে বললো, কালকে আমার সাথে যাবি।

.
আমি বললাম কোথায় যাবো আব্বু?

.
আব্বু বললো, তোকে আবার পড়াশুনা শুরু করতে হবে। তোকে কলেজে ভর্তি করে দিবো। তোর কলেজে ভর্তির সব ব্যাবস্থা করে এসেছি। তুই আবার আগের মতো লেখাপড়া করবি। নিজের পায়ে দাড়াবি। মানুষের মত মানুষ হবি।
সারাদিন হাসি খুশি থাকবি।

.
কিন্তু আব্বু আয়ুশ?

আয়ুশের চিন্তা করিস না। ওকে আমরা সবাই দেখে রাখবো। প্রয়োজনে ওর জন্য আলাদা আয়ার ব্যাবস্থা করবো।

.
আয়ুশকে ওর নানুই নিজের কাছে বেশি রাখে। যাতে আয়ুশ মায়ের অতিরিক্ত বাধুক না হয়ে যায়। তাহলে লিয়ার পড়াশুনায় ব্যাঘাত হবে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবে না।

.
লিয়া ওর আব্বু আম্মুর সাপোর্টে ভালোভাবেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে।

.
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আয়ুশকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যায়। সবার সাথে সময় কাটায়। রিমি আপু ভিডিও কলে অনেক গল্প করে। ভাইয়ার জন্য খুব আফসোস করে।

.
দাদু বাড়ির সাথে যেনো আয়ুশের সম্পর্ক অটুট থাকে তাই লিয়া প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে চলে যায়।

শ্বশুর বাড়ির সবাই আয়ুশের জন্য অস্থির থাকে, অপেক্ষা করে থাকে।
কবে লিয়ার কলেজ ছুটি হবে আর কবে আয়ুশ তাদের কাছে আসবে।
আয়ুশ যেনো সবার জান।

(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here