#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৮
উদয় চলে যাওয়ার পর হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচলাম। আমার মনের মধ্যে কালবৈশাখীর ঝড় বইছে।
সেই ঝড় কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।
সব লন্ড ভন্ড হয়ে যাচ্ছে।
হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
কলিজা পুড়ে যাচ্ছে।
বুকটা কষ্টে ভারী হয়ে গেছে। এতো কষ্ট আর নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে সব ভেঙে তছনছ করে ফেলি।
সব কিছুতে আগুন লাগিয়ে দেই।
গা ভর্তি গহনা, ভারী শাড়ি, মুখে মেকাপ সবকিছু মিলে অসহ্য লাগছিলো।
শাড়ি গহনা সব খুলে ফেলে নিজের কাপড় পরলাম।
তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ভালমতো সব মেকাপ ধুয়ে মুখটা পরিষ্কার করলাম।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসলাম। একটা খাতা টেনে নিয়ে কলম দিয়ে ইচ্ছামত আকি বুকি করলাম। খাতাটার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে কুটি কুটি করলাম।
নিজের হাত নখ দিয়ে আঁচড়ে খামচে রক্তাক্ত করলাম। মাথার চুল টেনে টেনে ছিড়লাম কিছু।
–
–
এতো কিছু করলাম, তাতেও আমার রাগ কমেনি আর চোখের পানি ঝড়াও বন্ধ হয়নি।
নিজেকে কেমন যেন অবাঞ্ছিত লাগছে।
রাগে দুঃখে হাতের পিঠ দাঁত দিয়ে কেটে রক্তাক্ত করে ফেলেছি।
এই বাড়িতে মানুষ হিসেবে আমার কোন মূল্য নেই, আমার মতামতেরও কোন মূল্য নেই, যে বাড়ির মানুষগুলি আমাকে মানুষ মনে করেনি,
অবহেলা করেছে আমি তাদের মাঝে আর থাকবো না।
আর সবচেয়ে বড় কথা আমি জিয়ানকে ভালোবাসি। আমি শুধু জিয়ানের হয়ে থাকবো বলে কথা দিয়েছি।
আমি দাদুর ঘরে গেলাম, দেখলাম দাদু ঘরে নেই, মনে হয় বসার ঘরে আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলছে।
আমি কোনদিকে না তাকিয়ে দাদুর মেডিসিন বক্স থেকে ঘুমের ওষুধের কৌটাটা নিয়ে এলাম।
আর দেরি না করে কৌটার সব কটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম। আর মনে মনে জিয়ানের কাছে ক্ষমা চাইলাম আমার অপারগতার জন্য।
আমার কিছুই করার ছিল না।
আমি টোটালি হেল্প লেস ছিলাম।
আব্বু আম্মু তোমরাও আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আমার কাছে মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই।
তোমরাই আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানায় লুটিয়ে পরলাম।
লিয়ার মা মেহমান বিদায় দেয়ার পর মেইডকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে লিয়ার ঘরে আসে ।
মেয়ের সাথে বসে দুদণ্ড কথা বলতে।
হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে এটা তারাও জানত না। এই ব্যাপারে মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য ওর ঘরে এলো।
আর সেই কখন থেকে মেয়েটা কাদছে, ওকে একটু বুঝানোর জন্য একটু শান্তনা দেয়ার জন্য ওর কাছে আসা।
এসে দেখে লিয়া কেমন করে যেন পরে আছে।
ওর পা দুটি ফ্লোরে
ঝুলছে আর অর্ধেক শরীর বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না, ধাক্কা দিলেও নড়ছে না।
লিয়ার মা জোড়ে চিৎকার দিল লিয়ার নাম ধরে। দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিলো_
এই লিয়া ওঠ। কি হইছে তোর! বলছে আর কাদছে।
–
চিৎকার শুনে সাথে সাথে সবাই দৌড়ে লিয়ার ঘরে চলে আসলো।
–
ওর আব্বু হাত ধরে পালস চেক করে দেখে পালস খুব স্লো চলছে।
–
লিয়ার বাবা কেদে ফেললো, দৌড়ে গেলো গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে।
গাড়ি বের করে, ঘরে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটলো গাড়ির দিকে।
–
ওর মাও কান্না করতে করতে ছুটলো পিছুপিছু।
–
গাড়িতে উঠে ওর মা ওকে কোলে নিয়ে পিছনের সিটে বসেছে। আর ওর বাবা কাদছে আর ড্রাইভ করছে।
–
ওর কখন থেকে এই অবস্থা?
তুমি কিছু দেখোনি?
না,
আমিতো রান্নার দিক আর মেহমানদের সাথেই ব্যস্ত ছিলাম।
তাছাড়া শেষের দিকে উদয় ছিল ওর ঘরে।
মেহমান চলে যাবার পর বুয়াকে ওর ঘরে পাঠিয়েছিলাম কিছু লাগবে কিনা দেখতে।
বুয়া দেখছে ও
বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে ওর ঘরে গেল। জিজ্ঞেস করছিল কিছু লাগবে কি না,
ও বলছে কিছুই লাগবেনা।
ইতিমধ্যে স্কয়ার
হসপিটালে পৌঁছে গেলো ওরা।
স্ট্রেচারের অপেক্ষা না করে ওকে কোলে করে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে গেলো।
ডক্টর দেখে বললো, পেশেন্টের কি হইছে!
মিজান সাহেব (লিয়ার বাবা) বললো,
আমরা জানি না।
হঠাৎ দেখি বিছানায় অনড় অসাড় হয়ে পড়ে আছে।
ডক্টর পালস চেক করে দেখলো, পালস খুব ধীরে চলছে।
টাঙ ডিপ্রেসর দিয়ে মুখের ভিতর চেক করার জন্য হা করালো, টর্চ দিয়ে দেখলো,
তারপর বললো, ট্যাবলেট টাইপের কিছু কি খেয়েছে।
–
লিয়ার বাবা বাসায় ফোন করলো,
বাবা আপনার ওষুধের বক্সটা চেক করেন তো।
সেখানে কোন ওষুধ কম আছে কি না দেখে বলেন।
বাবা চেক করে বলেন,
ঘুমের ওষুধের কৌটাটা নাই। যেটা বৌমা কালকে এনে দিয়েছিল।
অন্য সবগুলি ঠিক আছে।
বুয়া দৌড়ে ওর ঘরে গিয়ে চারিদিকে খুঁজে ফ্লোরে একটা কৌটা খুজে পেয়ে বাবার কাছে জিজ্ঞেস করে,
এইডা? চাচা মিয়া এইডা নি দেহেন তো,
দাদু বলে, হ্যা এটাই ।
কোথায় পেলে,
লিয়ার ঘরে?
হ , মাটিতে পইরা আছিলো, কিন্তু কৌটাটা তো খালি।
লিয়ার দাদু ছেলেকে বুয়ার আনা খালি কৌটার কথা বললেন।
লিয়ার বাবা ডক্টরের কাছে বললো, ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। নাম বললো ওষুধটার।
–
–
ডক্টর বললো,আত্মহত্যার চেষ্টা, এটাতো পুলিশ কেস।
এই রোগীর চিকিৎসা আমরা করতে পারবো না।
আপনারা রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে নিয়ে যান।
যত দ্রুত সম্ভব। রোগীর অবস্থা ভালো না।
লিয়ার বাবা খুব রিকুয়েস্ট করলো ডক্টরকে, আমার মেয়েকে বাঁচান, ঢাকা মেডিকেল নিতে নিতে পথেই আমার মেয়ে মারা যাবে।
যত টাকা লাগে আমি খরচ করবো। প্লিজ আমার মেয়েকে বাঁচান।
–
–
ডক্টর বললো আমি কেন, কোন বেসরকারী হসপিটালে
এই রোগী অ্যাডমিট করবে না ।
অন্য কোন হসপিটালে দৌড়ে সময় নষ্ট না করে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে নিয়ে যান।
–
–
লিয়ার বাবা মিজান সাহেব আর দেরি না করে মেয়েকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালের দিকে ।
লিয়ার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেদেই চলেছে।
আর বলছে,
–
আমি ওকে এভাবে
বিয়ে দিতে চাইনি।
বিয়ে দিতাম, ওকে বলে কয়ে জানিয়ে,
হুট করে বিয়ে দেয়ায় মেয়েটা আমার খুব কষ্ট পেয়েছে। তাই মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিছে মনে হয়।
মরে যাওয়াই ভালো মনে করছে ও। বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ওর বয়সই বা কত, মাত্র ষোল বছর।
এখনকার দিনে এই বয়সে কেউ বিয়ে দেয়?
ওকে বিয়ে দিয়ে ওর ওপর সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
আজ না হোক কদিন বাদে ওকে ওই সংসারের দায়িত্ব নিতেই হবে।
এটা কি ঠিক হইছে?
মিজান সাহেব বললো, যা ঘটেছে সব তোমার সামনেই ঘটেছে। আমারও তো মত ছিলো না। বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয়েছে। সবই তো তুমি জানো।
এখানে আমাদের কি করার ছিল।
বাবা কেমন জিদ ধরলো, আর সমন্ধ টাও ভালো, ছেলেটা ভালো, তাই রাজি হইছি।
এখন আর এসব কথা বলে লাভ নেই, দুয়া করো যেন আমাদের মেয়েটা সুস্থ হয়ে যায়।
–
–
ঢাকা মেডিকেল পৌঁছে দ্রুত ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেল। গেটেই পুলিশ আর সাংবাদিকদের দেখা গেলো। এরা সেখানে সব সময় থাকে।
ডক্টর এসে
জিজ্ঞেস করলো কি হইছে,
মিজান সাহেব বললো, ঘুমের ওষুধ খেয়েছে মনে হয়।
ডাক্তাররা নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললো,
স্টমাক ওয়াশ দিতে হবে।
–
–
যা যা করতে হয় করেন, আমার মেয়েকে বাঁচান।
ডক্টর বললো,
রোগীর কন্ডিশন খুব একটা ভালো না। ট্যাবলেট কখন খেয়েছে, কতগুলি খেয়েছে?
আমরা ঠিক জানি না কখন খেয়েছে।
আপনি গিয়ে কনসেন্ট
ফর্মে সই করে আসেন।
স্টমাক ওয়াশ করবেন এতে ফর্মে সই করতে হবে কেন?
কারন চিকিৎসা চলাকালীন রোগীর কিছু হলে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
কথা না বাড়িয়ে দ্রুত যান, রোগীর অবস্থা ভাল না। স্টমাক ওয়াশ দিয়ে তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে।
মিজান সাহেব কনসেন্ট পেপারে সই করে দিল।
পুলিশ নানান ভাবে জেরা করতে শুরু করলো।
লিয়ার মুখে টাং ডিপ্রেসর দিয়ে হা করিয়ে মোটা বড় একটা পাইপ পেট পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিলো।
পাইপের অপর প্রান্ত দিয়ে দুই লিটারের এক বোতল পানি পেটে ঢুকানো হলো। তারপর পাম্প করে পেটের সেই পানি বের করা হলো।
এটা খুব কষ্টের একটা প্রসেস।
কষ্টে বেহুঁশ লিয়াও বারবার ঝাঁকি দিয়ে উঠছে।
এইভাবে বারবার পেটে পানি ঢুকিয়ে
পাম্প করে সেই বিষাক্ত পানি বের করা হচ্ছে।
তিনবার করার পর স্টমাক পরিষ্কার হলো কিন্তু লিয়ার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল।
ডক্টর বললো,
ইমিডিয়েট আই সি ইউ তে শিফট করতে হবে।
পেশেন্ট সিরিয়াস।
পালস নেই বললেই চলে। খুব ধীরে চলছে পালস।
–
–
মিজান সাহেব আর তার স্ত্রী সজোরে কান্না করতেছিলো।
ডক্টরের কথা মত আই সি ইউ তে শিফট করা হলো।
ট্রিটমেন্ট শুরু করা হলো।
লিয়ার আব্বু আম্মু দুজনেই আই সি ইউ র বাইরে বসে অঝোর ধারায় কাদছে আর আল্লাহর কাছে দুয়া করছে মেয়ের জীবন ভিক্ষা চেয়ে।
–
–
পুলিশ এসে ডক্টরের সাথে কথা বলে, রোগীর বাড়ির লোকের সাথে আবার কথা বলার জন্য তাদের দিকে আসে।
রোগী আপনার কে হয় ?
আমার মেয়ে।
আপনার মেয়ের আত্মহত্যার চেষ্টা করার কারণ কি?
মিজান সাহেব
বিয়ের কথা সম্পূর্ণ চেপে গেলো।
বিয়ের কথা বলাই যাবে না কারণ ওর এখনও আঠার বছর হয়নি।
তাহলে বাল্য বিবাহ কেসে ফেঁসে যেতে হবে।
মিজান সাহেব বললো, পড়াশুনা করে না ঠিকমত তাই বকা দিছিলাম,
সেইজন্য হতে পারে।
শুধুই কি এই কারণ নাকি অন্য কিছু?
অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। যেটা আপনারা
লুকাচ্ছেন।
না আর কিছু না আমাদের জানা মতে।
ওর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছুই সঠিক বলতে পারবো না।
পুলিশ বললো ঠিক আছে আপাতত মেনে নিলাম।
ডাক্তারকে বললো,
রোগীর জ্ঞান ফিরলে আমাদের জানাবেন।
মিজান সাহেব ডক্টরকে লিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে ডক্টর বললো,
চব্বিশ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা সম্ভব না।
রোগীর অবস্থা ভালো না। আল্লাহকে ডাকেন। আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন )
(চলবে)