ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-৩০

0
824

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

হাসপাতালের স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে এতদিন ধরে পড়ে থাকা কারো জন্যেই সুখকর নয়। তেমনই, আভা। বছরে একবারও যে মেয়ে হাসপাতালের চৌকাঠে পা দিত না, সেই মেয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে শুয়ে আছে। আভা এখন অনেকটাই সুস্থ। তার মাথায় আপাতত একটাই চিন্তা ঘুরছে, ও বাসায় যাবে। কেবিনে এখন শুধু মিনহাজ বসে আছে। বাকি সবাই বাসায় ফ্রেশ হতে গেছে। আভার মা যেতে চান নি। কিন্তু আভা’ই উনাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাসায় পাঠিয়েছে। আভার মা বরাবর খুব পরিষ্কার মানুষ। হাসপাতালের বিষাক্ত জীবাণু তার কখনোই সহ্য হয়না। একটা গোসল নিতে পারলে ভালো লাগবে তার। মিনহাজ একটা চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। আভা সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। শুয়ে থাকতে থাকতে কোমর ধরে এলো, পুরো। আভা বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পায়ে আর কোমরে ফ্র্যাকচার হওয়ায় নিজে থেকে বসতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত, হাল ছেড়ে দিয়ে বেডে গা এলিয়ে দিলো। মিনহাজের দিকে চেয়ে আভা আস্তে করে ডাক দিল,
— ” ভাইয়া..! ”
মিনহাজ আভার ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে ল্যাপটপ রেখে আভার কাছে এলো। জিজ্ঞেস করলো,
— ” কিছু লাগবে? শরীর খারাপ করছে? কিছু কি খাবি? ”
আভা অবাক হলো ভীষন! যে ভাই তার সাথে দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই ঝগড়া করে, সেই ভাই এখন তার এত খেয়াল রাখছে। এটাই হয়তো, ভাই-বোনের মধ্যকার আদর,ভালোবাসা! আভার চোখে লাল-নীল মুগ্ধতা ছড়ালো। আভা আস্তে করে বললো,
— ” আমাকে উঠাও একটু। বসবো। ”
মিনহাজ আলতো করে আভার কাঁধ ধরে আভাকে আস্তে করে বসালো। আভার পিঠের দিকে একটা বালিশ দিয়ে দিলো। বসার সঙ্গেসঙ্গে আভার কোমর ব্যথায় কুঁকড়ে এলেও ও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো। ডাক্তার বলেছে, আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা যত বেশি নড়াচড়া করা যাবে, ততই ভালো। এতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মিনহাজ জিজ্ঞেস করলো,
— ” আর কিছু লাগবে? ”
আভা মানা করলো। না, কিছুই লাগবে না। মিনহাজ কব্জিতে থাকা কালো রঙের ঘড়ি’টায় চোখ বোলালো। আভার ঔষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মিনহাজ আর দেরি করলো না। বেডের লাগোয়া টেবিল থেকে একটা বক্স বের করে প্যাকেট থেকে ঔষধ খুললো। তিনটা গোল ঔষুধ আভার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। আভা ঔষুধ খেয়ে পানি খেলো। মিনহাজ পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে আভার দিকে ফিরলো। জিজ্ঞেস করলো,
— ” এখন শুয়ে পড়বি? ”
আভা এবারও মাথা ডানে-বায়ে নাড়ালো। যার অর্থ, না। আভা বললো,
— ” তুমি তোমার কাজ শেষ করে ফেলো। আমি ঠিক আছি।”
মিনহাজ আবারও সোফায় বসলো। ল্যাপটপ পুনরায় কোলের উপর রেখে কাজ করা শুরু করলো। বোনের অসুস্থতার কারনে, সাত দিনের ছুটি নিয়েছে ও। কিন্তু বসের কড়া নির্দেশ অনুযায়ী, ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করতে হবে। নাহলে, এক সপ্তাহের বেতন কেটে যাবে। বেতন নিয়ে মিনহাজের কোনো কালেই মাথা ব্যাথা ছিলো না। কিন্তু সামনে বিয়ে তার। আরোহীকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে, এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে।

আভার মন খারাপ। সেদিনের পর, আরো দুদিন কেটে গেলো। আহনাফ এখনো আসেনি। আভার রাগ লাগছে। সেই রাগটা ধীরে ধীরে দুঃখে পরিণত হচ্ছে। সেই দুঃখ বয়ে আনলো, এক উত্তাল-পাত্থাল কান্না! আভা বহু কষ্ট কান্না থামালো। বড় ভাইয়ের সামনে নিজের হবু স্বামীর জন্যে চোখের জল ফেলা, বড্ড লজ্জাজনক। আভা বেডের চারপাশ হাতড়ালো। ওর ফোন কোথায়? কিন্তু, ফোন পাওয়া গেলো না। হয়তো, সেদিনের অ্যাক্সিডেন্টের কারণে, ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। এখন? আহনাফকে কল দিবে কি করে? আভা মিনহাজের দিকে তাকালো। মিনহাজ ভ্রু কুঁচকে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। ভাইয়াকে বলবে, তার ফোনটা দেওয়ার কথা? কিন্তু কি বলে ফোন চাইবে? মায়ের কথা বলা যেতে পারে। আভা মিনহাজকে ডাক দিলো। মিনহাজ ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে আভার দিকে তাকালে আভা জড়তা নিয়ে বললো,
— ” তোমার ফোনটা একটু দাও না। মা’কে কল দিবো। ”
মিনহাজ কোনোরূপ বাক্য ক্ষয় না করে, সোফার উপর থেকে ফোন নিয়ে আভার দিকে এগিয়ে দিলো। আভা এক ঢোক গিলে ফোন হাতে নিলো। কিন্তু, আহনাফের নাম্বার কি দিয়ে সেভ করা? এত এত নাম্বারে, খুঁজবে কি লিখে? একবার আহনাফ লিখে সার্চ দিলো। আহনা নামে আরও তিনটা নাম্বার দেখালো। এখানে কোন নাম্বারটা আহনাফের? ও নাম্বার তো মুখস্তও করেনি। ইস! বড্ড খারাপ হলো ব্যাপারটা। বাসায় যাওয়ার পর আহনাফের নাম্বার একদম মুখস্ত, টুতস্থ ,কণ্ঠস্ত সবশেষে আত্বস্থ করে ফেলতে হবে। কোনো ছাড় নেই!
— ” লাস্টে ৪৫ যেটা, ওটাই আহনাফের নাম্বার। ”
আভা চমকে তাকালো মিনহাজের দিকে। মিনহাজের চোখ এখনও ল্যাপটপের দিকে। যেনো, একটু আগে সে কিছুই বলেনি। আভা এক ঢোক গিললো। বড্ড লজ্জা লাগছে ওর। ইশ, ভাই কি ভাবলো? আভা খুঁজে আহনাফের নাম্বার বের করলো। কল বাটনে চাপ দিয়ে ফোন কানে লাগিয়ে বসে রইলো।
একটু পর, মিনহাজ সোফা ছেড়ে উঠে গেলো। ল্যাপটপ আবারও সোফায় রেখে আভার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। চা খাবো। ভয় পাস না। একটু পরই চলে আসবো। ”
আভা মাথা নেড়ে সায় দিলো। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, মিনহাজ কেনো আভাকে একা রেখে চলে গেলো। বড় ভাইয়ের সামনে আহনাফের সাথে কথা বলতে হয়তো আভার সংকোচ হবে। সেজন্যেই, খুব কৌশলে মিনহাজ বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। বাহ্!
একটু পর কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে আহনাফ ব্যস্ত গলায় বললো,
— ” আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া, আভা কেমন আছে? ”
আহনাফের কণ্ঠস্বর শুনে আভার নিঃশ্বাস আটকে এলো। বুকের ভিতর’টা ধরফর করছে। আভা সামলাতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আহনাফ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আলতো সুরে ডাক দিলো,
— ” বউফ্রেন্ড..! ”
আভা যেনো কেঁপে উঠলো।ইস! এই ডাকটা কতদিন পর শুনলো আভা? এক বছর পর, নাকি কয়েক যুগ পর? আভার চুপ থাকার কারন আর ওর বড় নিঃশ্বাস ফেলার কারণ দুটোই আহনাফ জানে। তবুও, আহনাফ নিজেকে এক শক্ত খোলসের ভিতর আবৃত করে বললো,
— ” কেনো ফোন দিয়েছ, জলদি বলো। আমার একটু পর বাইরে যেতে হবে। ”
আহনাফের ওমন কঠোর ব্যবহারে আভা মোটেও অভ্যস্ত নয়। আহনাফ বরাবরই আভার প্রতি নম্র! কিন্তু, আজ কি হলো? কেনো করছে এমন উনি? আহনাফ কি জানেনা,তার এই শক্ত ব্যবহার আভাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আভা ভস্ম হয়ে, ছাই হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আহনাফ জানে। জানে বলেই, সে এমন করছে। কারণটা মূলত আভার বেখেয়ালি আচরন, আভার নিজের প্রতি উদাসীনতা! আভাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতেই আহনাফ নিজেকে শক্ত চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। হয়তো আহনাফ জানে, তার এক শিক্ষা আভাকে আর কোনোদিন ইমমিচিউর কাজ করতে বাঁধা দিবে। আহনাফ বললো,
— ” কিছু বলবে? বলার হলে জলদি বলো, আমার বেরুতে হবে। ”
আভা এবার চোখ-মুখ মুছে শক্ত গলায় বললো,
— ” আপনার কাছে আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, তাইনা? আজকাল, নতুন কাউকে মনে ধরেছে? আমি অসুস্থ। তা জানা সত্ত্বেও, আমি একবারও আমাকে দেখতে আসেন নি। এই আপনার ভালোবাসা? ”

আভার এমন মনোভাব আহনাফ হতবাক হয়ে গেলো। তার এই শাস্তি, আভা এমন করে নিচ্ছে? আহনাফ অবাকও হলো, বটে! তবুও সে অত্যন্ত শান্ত গলায় উত্তর করলো,
— ” তুমি খুব ভালো করেই জানো, তুমি আমার জন্যে কি? তবুও, এমন মনোভাব? ওকে, জাস্ট ফরগেট ইট। ঔষধ-গুলো ঠিকমতই খেয়ে ঘুমাও। রাখছি। ”

আভা যেনো তেঁতে উঠলো এমন উত্তরে। আহনাফের শান্ত উত্তরে আভা দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললো,
— ” একদম মিষ্টি কথায় আমাকে ভুলাবেন না। আপনি জানেন, এ কদিন আমি ঠিক কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। না, আপনি জানবেন কেনো? আপনার তো অন্য কেউ জুটে গেছে। আমি অসুস্থ। আমাকে আপনার কি দরকার, তাইনা?”
আহনাফ আভার এমন কথায় নীরব থাকলো। এক রত্তিও কথা বললো না। প্রচন্ড শান্ত সুরে বললো,
— ” এতগুলো কথার শাস্তি পাই-পাই করে ফিরিয়ে দেবো। রেডি হও। আমি আসছি। ”
কথাটা বলেই আহনাফ ধাম করে ফোন কেটে দিলো। আভা ফোন কান থেকে নামিয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এখন কি হবে? আবেগের বশে এত বড়বড় কথা বলে ফেললো! এবার? আহনাফের রাগ তো ওকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ইয়া আল্লাহ! রক্ষা করো! রক্ষা করো!

#চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/241951501182751/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here