ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-৩১

0
817

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

রাত নেমেছে শহরে। রাতের প্রতীক হিসেবে আকাশে উঠেছে বিশাল এক চাঁদ। ঈষৎ হলদে রং তার! রাতের হিম আভার গায়ে ছোঁইয়ে দিতেই আভার ঘুম ভাঙ্গলো। আহনাফের রাগের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল, বলা মুশকিল! আভা চোখ খুললো। আড়মোড়াও ভাঙ্গলো।

— ” বসে থাকা অবস্থায় কেউ ঘুমিয়ে পড়ে, ডাফার? ”
পাশ থেকে এক ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আভা হুড়মুড়িয়ে পাশ ফিরলো। আহনাফ সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। হাতে নতুন এক ফোন। এই ফোনটা কবে কিনলেন? আগে তো দেখেনি। যায় হোক, উনি কখন আসলেন? আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর? হবে, হয়তো। আভা কোনো কথা বললো না। বরং, সকল ভয়কে প্রশ্রয় না দেওয়ার ভয়ংকর এক পণ করে চুপ করে রইলো। মুখে বিশাল এক কুলুপ এঁটে ভাবলো, ‘ এই নিষ্টুর মানুষের সাথে কথা বলাই উচিৎ না। মোটেও না! ‘
কিন্তু, এতে আহনাফের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ’ই লক্ষ্য করা গেলো না। সে ধীরে-সুস্থে হাতের ফোনটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো। বেডের লাগোয়া টেবিল থেকে আভার মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে নিয়ে আভার পাশটায় বসলো। ফাইলটা খুলে উল্টে-পাল্টে দেখলো। ভ্রুযুগল কুঁচকানো, দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে সে। এই গম্ভীর অবস্থায় আহনাফকে পাক্কা এক চকলেট বয় লাগছে। যা দেখে, আভার ছোট্ট মনটা হাঁসফাঁস করে উঠলো। বুকের ভিতর ভয়ংকর ঝড় সবকিছু তছনছ করে দিতে লাগলো। ইশ! মানুষটা এত সুন্দর কেন? একটু বদসুরুত হলে কি এমন দোষ হতো? উফ! আর তাকানো যাচ্ছে না! মনে হচ্ছে, তাকালেই একটা-দুটি ভুল করা যাবে অনায়াসে। হয়তো, এ কারণে আভা নিজের পণ রক্ষা করতে পারবে না। তখন? না, না! তাকানো যাবে না। আভা চোখ ফেরালো। আহনাফ ফাইল বন্ধ করে বালিশের পাশে রাখলো। আভার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কোমর আর পায়ের ব্যথা কেমন এখন? ”
আভা ছোট্ট করে বললো,
— ” ভালো। ”
আহনাফ একটু পিছিয়ে পায়ের কাছে বসলো। পায়ের ফ্র্যাকচার হওয়া জায়গায় আস্তে করে আঙ্গুল চেপে ধরলো। আভা কিছুটা ব্যথা পেলো। তবে, ব্যথাটা সহনীয়! আহনাফ জিজ্ঞেস করলো,
— ” ব্যথা হচ্ছে? ”
আভার হঠাৎ করেই রাগ উঠলো। মনকে ক্ষতবিক্ষত করে, এখন বাহ্যিক ব্যথার কথা জিজ্ঞেস করছে? আশ্চর্য! আভা দাত খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
— ” আমার ব্যথার কথা আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। ছাড়ুন আমার পা। ”
আভা কথাটা বলে পা বটে নিতে চাইলো। কিন্তু আহনাফ হাত দিয়ে পা আটকে নিলো। আভার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
— ” যেটুকু জিজ্ঞেস করেছি, সেটুকুর উত্তর দাও। বেশি কথা বলো কেন? ”
আভা মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। ফ্র্যাকচার হওয়া জায়গায় আহনাফ দুটো আঙ্গুল আরো একটু চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” এবার ব্যথা করছে? ”
আভা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেও, মাথা ডানে-বায়ে নাড়ালো। যার অর্থ, ও হার মানবে না। তবে, আভা মানা করলেও আহনাফ সেটা বুঝতে পারলো। আভার রন্ধ্র-রন্ধ্র ওর চেনা! আহনাফ এবার বাঁকা হেসে আরো জোরে আঙ্গুল চেপে ধরলো। আভা এবার সজোরে চিৎকার করে উঠলো। রেগে বলে উঠলো,
— ” মেরে ফেলতে চান, নাকি? মেরেই ফেলুন। একটা গেলে আরেকটা আসবে। তাইনা? ”
আহনাফ পা থেকে আঙ্গুল সরালো। এগিয়ে এসে আভার পাশে বসলো। আভা এখনো চোখ খিচে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, ওর দুচোখ দিয়ে আহনাফকে ভস্ম করে দিলেই ওর শান্তি! আহনাফ আভার চোখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলো। নরম গলায় বললো,
— ” মেরেই তো ফেলতে চাই। তাহলে, আর জ্বালাবে না আমাকে। স্বপ্নেও এসে ধরা দিবে না। চোখ খুললেও তুমি হাসবে না। মেরেই ফেলবো একদিন! ”
আভা কি বলবে, কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে, খুঁজে পেলো না। তবে কি, ওর মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া বাটন নষ্ট হয়ে গেলো? আভা চোখ সরালো। তাকালো, অন্যপাশে। আহনাফের ওমন স্থির চোখের দৃষ্টিতে আভাকে মেরে ফেলছে। আভা নিজের মনের ধ্বংস দেখতে পায়, ওই দুচোখে! আহনাফ বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ড্রয়ার থেকে ঔষুধের বক্স বের করে আবারও বেডে বসলো। ঔষুধের বক্স থেকে দেখে শুনে ঔষধ বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
— ” এত জেলাসির কারণ কি? আগে তো এমন ছিলে না।হুট করে এত পরিবর্তন? কাহিনী কি? ”
আভা আহনাফের প্রশ্নে থতমত হয়ে গেলো। সে কি, সত্যিই জেলাস? কিন্তু, কেনো? আহনাফকে নিয়ে তার জেলাসির কারন কি? আভা আমতা আমতা করে বললো,
— ” কে জেলাস? ”
আহনাফ ইতিমধ্যে ঔষধ বের করে আভার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। চোখের ইশারায় ঔষধ নিতে বললো। আভা আহনাফের হাত থেকে ঔষুধ নিলো। আহনাফ পানি এগিয়ে দিতে দিতে উত্তর করলো,
— ” তুমি খুব ভালো করে জানো, আমি কার কথা বলছি। ”
আভা একদমে ঔষধ খেয়ে ফেললো। আহনাফের কথায়, তার বড্ড অস্বস্তি লাগছে। সে জেলাস, ভাবতেই কেমন যেনো লাগছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি! যেই অনুভূতির সাথে ও মোটেও পরিচিত নয়। আভা মিথ্যে বললো,
— ” হুহ! আমি মোটেও জেলাস না। আর আপনাকে নিয়ে জেলাসির কি আছে? ”
আহনাফ হাসলো তার প্রটিউত্তরে! তবে, এর বিপরীতে কোনো কথা বললো না। পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে কল দিলো। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতে আহনাফ বললো,
— ” ৩১৪ নাম্বার রুমের রোগীর ডিসচার্জের ব্যবস্থা করো। ”
— ” ওকে, স্যার। ”
আহনাফ ফোন কেটে দিলো। আভা একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, আহনাফ যখন ওর সাথে কথা বলে, তখন মনে হয় আহনাফ খুব উচ্ছল মনের ছেলে। কিন্তু,যখন বাইরের মানুষের সাথে কথা বলে, তখন মনে হয় ও খুব গম্ভীর প্রকৃতির। এক মানুষের দুই রূপ? বড়ই অদ্ভুত!
আহনাফ আভার ঔষধ পত্র গুছাতে গুছাতে এক ভয়ঙ্কর কথা বললো,
— ” আমার শাস্তি কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। সো, বি প্রিপায়ার্ড বেবী। ”
আহনাফের কথা শুনে আভার আত্মারাম লাফিয়ে উঠলো। একটু আগে হেসেহেসে কথা বলা দেখে আভা ভেবেছিল, আহনাফ সব ভুলে গেছে। কিন্তু, এ তো দেখছি খুব শেয়ানা!
________________________
আভা বাসায় এসেছে, প্রায় দুঘন্টা হলো। ওদের বাসার অবস্থা রমরমা। আভার অসুস্থতার খবর শুনে অনেকেই দেখতে এসেছে আভাকে। আভা বিছানায় বসে ফল খাচ্ছে। আম, নাশপাতি, আপেল টুকরো টুকরো করে কেটে থালাভর্তি করে আভার সামনে রাখা হয়েছে। আভা একটা একটা করে ফল খাচ্ছে আর সবার কথা শুনছে। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তার। কড়া ডোজের ঔষধের ফলস্বরূপ! কিন্তু, বাসায় ঘুমানোর কোনো পরিবেশ নেই। তার রুমে কয়েকজন বসে আছে। সবাই গল্প গুজবে মগ্ন। এদের ফেলে আভা ঘুমাবে কি করে?
হঠাৎ রুমে আভার মা প্রবেশ করলেন হন্তদন্ত হয়ে। এসেই সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
— ” ভাবি, আপনারা আমার রুমে চলে আসেন। আভা একটু রেস্ট নিক। জার্নি করেছ তো। ”
আভার মায়ের কথা শুনে সবাই একে একে রুম থেকে চলে গেলেন। আভার মা যাওয়ার আগে আভাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আস্তে করে বললেন,
— ” আহনাফ না বললে আমি তো জানতেই পারতাম না , তোর যে এখন ঘুমের সময়। তুইও তো একবার বলতে পারতি। ”
আভা মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
— ” তুমি তো রান্নাঘরে ছিলে। কিভাবে বলতাম? ”
আভার মা হাসলেন। আভার মাথায় আরো দুবার হাত চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আভা মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলো। থাক! তার জীবনে নিজের পরিবার ছাড়াও আরো একজন যত্ন নেওয়ার মানুষ আছে। আচ্ছা, আহনাফের পারেন কিভাবে? এতদিক তার খেয়াল থাকে কি করে? ক্লান্ত হন না উনি? সবদিক সামলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন না?কিন্তু আভা এটা জানলো’ই না, ভালোবাসলে সবই পারা যায়। ভালোবাসার শক্তি, পৃথিবীর সকল শক্তিকেও হার মানায়!

#চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/242542587790309/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here