ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১

0
5906

(১)

কড়া রোদের মধ্যে বাইরে থেকে এসে বাড়ির দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে মতো দরজা ধাক্কাচ্ছে তুর। প্রায় দুমিনিটের অধিক সময় ধরে অভদ্রের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছে সে। বাড়িতে সে আর ছোট বোন তোয়া একাই থাকে। তোয়া ভেতরে করছে টা কি? দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে? মেজাজ খারাপ ভাবটা সম্পূর্ণ দরজার উপর উগড়ে দিতে চাইছে যেন। বাম হাতে বোরকাটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে হিজাবের সবগুলো পিন খুলে কোনো মতে মাথায় কাপড়টা দিয়ে রেখেছে সে।‌ ঘেমে নেয়ে চেহেরার অবস্থা বেহাল। মনে মনে তোয়াকে ইচ্ছে মতো গালাগাল দিয়ে তোয়ার মোবাইলে কল দিচ্ছে। কিন্তু কি অদ্ভুত এই মেয়ে কল রিসিভ করলে তো। দরজায় ধাম ধাম করে আরোও কয়েকটা ঠাপ্পর দিল তুর। আর কলিং বেল তো বাজাচ্ছেই। ইচ্ছে করছে জোড়ে কয়েকটা লাথি দিতে কিন্তু এই বাড়িতে নতুন সিফট করেছে তারা বিধায় মনের ইচ্ছেটা মনের মধ্যেই দাফন করে দিল সে। ভেতর থেকে কারো ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাগে আর গরমে পুরো মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তুরের। মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছে দরজা খোলার পর তোয়াকে কি কি বলে ধমকাবে। কিন্তু দরজা খোলার পর স্তব্ধ হয়ে গেল সে। দরজা তোয়া খুলেনি। খুলেছে একজন ছেলে। খালি গায়ে কালো রঙের টাওয়াল পরে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন। মাথার চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে। সায়নের চেহারায় গম্ভীর ভাব বিরাজ করছে। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুরের দিকে। কিন্তু তুর ভাবছে তাদের ফ্লাটে ছেলে আসলো কোথা থেকে? তোয়া কোথায়? তোয়ার কথা ভাবতেই আঁতকে উঠল তুর। মুহূর্তেই চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। এই ছেলেটা তোয়াকে কিছু করেনি তো? । সায়ান কিছু বলার আগেই তুর রুমে ঢুকার জন্য দৌড় দিল কিন্তু ঢুকার আগেই দরজায় বাঁধা পড়ল। সায়ান দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

” তোয়া! তোয়া! আমার বোন কোথায়? আপনি কি করেছেন ওর সাথে? আর আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই রুমে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন? দরজা থেকে সরুন।”

তুর রুমে ঢুকার জন্য ছটফট করছে। সায়ান গমগমে গলায় বলল,

” এই মেয়ে পাগল আপনি? অপরিচিত মানুষদের দরজায় এভাবে অভদ্রের মতো নক করছেন কেন? আরেকটু হলে তো দরজাটা ভেঙ্গেই ফেলতেন। আর আমার ফ্লাটে দাঁড়িয়ে আমাকেই কথা শুনাচ্ছেন আপনার সাহস তো কম নয়।”

তুর এক পা পিছিয়ে মাথা উঁচিয়ে দরজার উপরে তাকিয়ে দেখল ফ্লাট নাম্বার ‘6_ A’। তুরের ফ্লাট ‘5_A’ পাঁচ তলার বদলে ছয় তলায় এসে তান্ডব চালিয়েছে বুঝতে পেরে জিভ কেটে এক দৌড়ে পাঁচ তলায় নেমে আসে সে। তাদের ফ্লাটের দরজা খোলাই ছিল। দৌড়ে ফ্লাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাঁফাতে থাকে তুর। তোয়া ঠান্ডা সরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। তুর এক নিঃশ্বাসেই পুরো গ্লাস খালি করে ফেলে।

“কিরে আপু আজকে তোর আসতে এতো লেট হলো যে? পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস?”

তুর তোয়াকে সবটা বলতেই দুবোন পেট ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ে।

(২)

ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করে চারদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তুর। দু’চোখ ভরে দেখছে স্বপ্নের ভার্সিটি। নিজের স্বপ্ন পূরণের আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে সে। খুব সকালে ভার্সিটি চলে এসেছে বিধায় মানুষদের আনাগোনা কম। ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের বুক চিরে হেঁটে চলেছে সে। হালকা মৃদু মন্দ বাতাস।‌ বাতাসে‌ মিষ্টি একটা ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

” এই মেয়ে! এই! হ্যাঁ তোমাকেই বলছি।‌ এদিকে আসো।”

তুর অবাক চোখে কাঠ বাদাম গাছের নিচে বসে থাকা তরুণ তরুণীদের দিকে তাকালো। মোটা করে একটা মেয়ে ওকে হাতের ইশারায় ডাকছে। এদের কাউকেই চিনে না তুর। চেনার কথাও না। আগের ভার্সিটি থেকে ট্রান্সফর নিয়ে এই ভার্সিটিতে এসেছে সে। তুর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটা বলল,

” নতুন নাকি?”

“হুম।”

“নাম কি?”

“তাসবিহ্ শাহরিয়ার তুর”

“আমি জারিন তুমি ফাস্ট ইয়ার?”

“সেকেন্ড ইয়ার।”

“আমরা তোমার সিনিয়র। তা সিনিয়র ভাই-বোনদের কীভাবে সম্মান করতে হয় জানো তো?”

“জানি।”

জারিন একটা খাম এগিয়ে দিল তুরের দিকে।
তুর খামটা না নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কী এটা?”

জারিন সহ তার দলবল হেসে বলল,

“লাভ লেটার।”

চোখ দিয়ে গেইট এর দিকে ইশারা করে একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলল এটা ও’কে দিয়ে এসো।
তুর ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটিকে দেখল। তারপর জারিনের চোখের দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

“পারব না।”

জারিনের পাশ থেকে সিফাত এগিয়ে এসে বলল,

” এই বেয়াদব মেয়ে তোমার এতো বড় সাহস! তুমি আমাদের মুখের উপর কথা বলো। সিনিয়রদের কীভাবে সম্মান করতে হয় জানো না?”

সিফাত এগিয়ে এসে তুরকে থাপ্পড় মারতে নিলে তুর সিফাতের হাত ধরে ফেলে। হাত পেছনে ঘুরিয়ে মুচরে ফিসফিস করে বলে,

“সিনিয়রদের সম্মান করতে জানি বলেই আপনার হাতটা এখনও ঠিক আছে। সম্মান পেতে হলে আগে সম্মান দিতে হয়। আমাকে অন্যদের মতো ভাববেন না। দূরে থাকবেন আমার কাছ থেকে তা না আপনাদের কী হবে সেটা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না।”

যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সিফাত। তুর ওর হাতটা ঝারা দিয়ে ফেলে গটগট করে হাঁটা শুরু করলো। ইতিমধ্যে ওদের আশেপাশে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। সিফাত হাতের লাল হয়ে যাওয়া জায়গাটায় হাত বুলিয়ে সবার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল,

“এখানে কি? মধু! দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবাই নিজেদের ক্লাসে যাও।”

সিফাতের ধমক শুনে ধীরে ধীরে ভিড় কমে গেল।

(৩)

প্রতিটা ক্লাস খুব ভালো ভাবেই কেটেছে তুরের। টিচারদের ব্যবহারও খুব ভালো। টিচাররা বলেছেন ক্লাস টপার হাসিবা নামক মেয়েটার কাছ থেকে সব নোটস কালেক্ট করে নিতে। হাসিবা মেয়েটা একটু অহঙ্কারী। তাতে তুরের কী? তার তো শুধু নোটস গুলো পেলেই হলো। ক্লাস থেকে বের হতেই জারিন সামনে এসে দাঁড়ালো। তুরকে সাথে যেতে বলল। তুরও কোনো ঝামেলা করলো না। পার্কিং এড়িয়াতে এসে থামল জারিন। দেশের নামকরা ব্র্যান্ডের কালো রঙের গাড়ির উপরে গর্বের সাথে বসে থাকা যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল’

“নিয়ে এসেছি জুবান।”

জুবান লাফিয়ে গাড়ির উপর থেকে নেমে তুরের সামনে এসে দাঁড়ালো। অবাক চোখে তুরকে দেখল। এই কালো বোরকার সাথে চকলেট কালার হিজাব পড়া সাধারণ মেয়েটা সিফাতের মতো ছেলের হাত মুচরে দিয়েছে? সিফাতের দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকালো জুবান।

“আর ইউ সিওর সিফাত যে এই মেয়েটাই তোর হাত মুচরে দিয়েছে?”

সিফাত নিজের হাতের লাল জায়গাটায় হাত বুলিয়ে বলল, “টু হান্ডেড পারসেন্ট সিওর দোস্ত।”

ওদের কথপোকথনের মাঝেই তুর বিরক্তি গলায় বলল,

” আমাকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে?”

জুবান আর সিফাত দুজনেই তুরের দিকে তাকালো। মেয়েটার গোলগাল মুখটায় বিরক্তি ভাব ফুটে উঠেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো সূর্যের আলোয় মুক্তর মতো ঝিলিক দিচ্ছে। হুট করেই জুবান তুরকে একটা উপমা দিয়ে বসল।

” রসগোল্লা”

জুবানের দেওয়া উপমা অবশ্য কেউ শুনল না। তুর এগিয়ে এসে জুবানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। গাড়িতে হাত দিয়ে বারি দিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

” যদি আমাকে এখানে সকালের ঘটনার জন্য সরি বলতে ডাকা হয় তাহলে এখনি বলে রাখছি আমি কাউকে সরি ফরি বলতে পারব না। আমি কোনো অন্যায় করিনি আর না কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করব। সো মি. জুবান আপনি আপনার বন্ধুদের সাবধান করে দিবেন তারা যেন আমার সাথে লাগতে না আসে। আমার সাথে লাগতে আসলে পরিণাম ভালো হবে না।”
তুর কারো জবাবের অপেক্ষা না করে হন হন করে চলে গেল। তুরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জুবান মুচকি হাসলো বিরবির করে বলল,

“শুধু রসগোল্লা নয় কাঁচা মরিচের রসগোল্লা।”

চলবে….

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#সূচনা_পর্ব
#সিলিভিয়া_ফারাশ

( বিঃদ্রঃ ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এটা আমার প্রথম লেখা তাই সবাই সাধ্য মতো রেসপন্স করবেন। ভুল হলে ভুল গুলো দেখিয়ে দিবেন। পরবর্তী পর্ব কিছুক্ষণ পর পোস্ট করা হবে।

বিঃদ্রঃ কিছু কারণবশত গল্পের নাম এডিট করেছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here