ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-২

0
3369

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্ব_২
#সিলিভিয়া_ফারাশ

(৪)

অন্ধকার কামরায় গোঙাচ্ছে সাঈদ। হসপিটালের বেডের মতো একটা বেডের সাথে লোহার শিকল দিয়ে হাত পা বাঁধা সাঈদের। বেডে কোনো বালিশ নেই ঘাড়টা এক পাশে বাকা হয়ে হেলে পড়েছে। মুখে কালো টেপ মারা। চোখের আশেপাশের এড়িয়া কালো হয়ে গেছে। গাঁয়ের চামরায় কালশিটে ভাব ফুটে উঠেছে। শরীরের জায়গায় জায়গায় নিল হয়ে ফুলে গেছে। সাঈদ হালকা চোখ মেলে চারদিকে তাকায়। অন্ধকারের জন্য কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। মাথার পেছনে তীব্র ব্যথা। এখানে আসলো কীভাবে কিছুই মনে নেই তার। শুধু মনে আছে রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তখনি কেউ পেছন থেকে মাথায় আঘাত করলে দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে। সাঈদ মাথা কাত করে এদিক সেদিক দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আচমকা ঘরের লাইট জ্বলে উঠে। তীব্র আলো সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। চোখ সয়ে গেলে দরজার দিকে তাকায় সাঈদ। একজন ডাক্তার সার্জারির পোষাক পড়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখে সার্জিক্যাল মাক্স। হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে বিভিন্ন ধরণের সার্জারির যন্ত্রপাতী। সাঈদ আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল এটা কোনো পরিত্যক্ত হসপিটালের OT রুম। অথবা কেউ নিজের বাড়িকেই এমন বানিয়ে রেখেছে। চারদিকে প্রচুর নোংরা। দেয়ালের রং খশে পরেছে। মেঝেতে প্রচুর ময়লা আর ধুলো জমা হয়েছে। মেঝের ফাটল দিয়ে গাছের শিকড় বেড়িয়েছে। কিছু কিছু নতুন গাছ ফাটল থেকে উঁকি দিচ্ছে। ডাক্তার সাঈদের মাথার দিকে বেডের সাথে লাগোয়া টেবিলটায় ট্রে রেখে সাঈদের দিকে এগিয়ে এলো। সাঈদ চিৎকার করে বলতে চাইছে তার মুখ খুলে দিতে‌। ডাক্তার যেন তার কথা বুঝতে পারল। সাঈদের মুখের টেপ খুলে দিলে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। বাতাসে বিদঘুটে পঁচা একটা গন্ধ। সাঈদের পেটের ভেতরের সবকিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে।

“কে আপনি? আমাকে কিডন্যাপ করেছেন কেন? বিশ্বাস করেন আমার আব্বা আম্মা বড়লোক নয়। তাদের কাছে পাঁচ হাজার টাকা চাইলেও তারা দিতে পারবেন না। আমাকে ছেড়ে দেন। বাড়িতে আমার বাবা মা অপেক্ষা করছে। আমি ছাড়া তাদের দেখার মতো কেউ নেই।”

ডাক্তার কোনো কথা না বলে সাঈদের গাঁয়ের চাদরটা টেনে কোমড় পর্যন্ত নামালো। নগ্ন বুকের মাঝ বরাবর ছু-রি চালিয়ে নিচের দিকে টেনে নামালো। গলগল করে তাজা র-ক্ত ছড়িয়ে পড়ল সাঈদের বুক পেটে। গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করছে সাঈদ। সাঈদের চিৎকারে ডাক্তার একটুও বিচলিত হলো না। ছু’রি দিয়ে খুব দক্ষতার সাথে বুকের চামরা তুলে নিল তারপর ধীরে ধীরে মাংস কেটে পাশের ট্রেতে রাখতে লাগলো। সাঈদের কাকুতি মিনতি কিছুই তার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। তার প্রতিটি চিৎকারে যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে ডাক্তার। বুকের হাড় দৃশ্যমান হওয়ার পর ট্রে থেকে একটা সাদা রঙের কৌটা তুলে নিল। কৌটার ঢাকনা খুলে লাল রঙের মরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে দিল ক্ষত স্থানে। সাঈদের শেষ চিৎকারে কামরার শ্যাওলা পড়া দেওয়ালটাও কেঁপে উঠলো।

(৫)

চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমেছে। পুরো শহর কালো মেঘে ঢাকা। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তুর। টিউশন করিয়ে ফিরতে আজ একটু লেট হয়েছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল ছয়টা বেজে পনেরো মিনিট। তুরের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে আগের মতোই হেলেদুলে বৃষ্টি বিলাস করতে করতে এগিয়ে চলেছে। বোরকা আর হিজাব ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। এই রাস্তাটা একটু নির্জন। একটু না বেশ অনেকটাই নির্জন। তুর হঠাৎ খেয়াল করলো কেউ তার পিছু করছে। ততক্ষণাৎ পেছনে ফিরে তাকালো তুর‌। তুরের থেকে হাত দশেক দূরে একদল বখাটে দাঁড়িয়ে। তারা তুরকে বিশ্রি ইঙ্গিত করছে। চট করেই মেজাজ গরম হয়ে গেলো তুরের। এখানে বখাটেরা সংখ্যায় ৩ জন। এদের চেনে সে। শাকিল মারুফ আর সবুজ। ওরা সবসময় এখানেই বসে নেশা করে আর পথচারী মেয়েদের বিরক্ত করে। এই ভর সন্ধ্যায় নির্জন রাস্তায় তুর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না। তাই চুপচাপ হাঁটা শুরু করেছে। মারুফরাও তার পেছন পেছন আসছে। রাস্তার হলুদ বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। তুর চারদিকে চোখ বুলাল। রাস্তা পুরো ফাঁকা। মাঝে মধ্যে প্রচন্ড গতিতে প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে। হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ইতিমধ্যে বখাটে গুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। বিশ্রি ভাবে হাসছে তারা। বিশ্রি ভাষায় কথাও বলছে। তুর সবার দৃষ্টির আড়ালে হ্যান্ড পার্স থেকে ছোট ধারালো পেপার কাঁ’টা’র বের করে হাতের মুঠোয় নিল। ওদের মধ্যে থেকে সবুজ নামের ছেলেটা এগিয়ে এসে তুরের ভেজা শরীরের দিকে লুভাতুর দৃষ্টিতে তাকালো। তুরের গায়ে স্পর্শ করতে গেলে তুর ছেলেটার গালে বেশ কয়েকবার পেপার কাঁ’টা’র’টা চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত পরা শুরু করল। সবুজ চিৎকার করে হাত দিয়ে গাল চেপে ধরে পিছিয়ে গেলো। বৃষ্টির পানি মিশ্রিত রক্তে সবুজের অফহোয়াইট শার্টের উপরের অংশ লাল হয়ে গেছে। শাকিল তুরকে ভয়ঙ্কর বিশ্রি একটা গালি দিয়ে বলল,

” এই মারুফ ধর মা**রে।”
মারুফ আর শাকিল ক্ষিপ্ত গতিতে তুরের দিকে এগিয়ে গেল। তুরকে একটুও বিচলিত দেখালো না। মারুফ নামের ছেলেটা দৌড়ে তুরের কাছাকাছি আসতেই তুর মারুফের দুপায়ের মাঝখানে সারা শরীরের শক্তি দিয়ে লাথি দিল। মারুফ ওখানেই কর্দমাক্ত নোংরা পানিতে বসে পড়লো। যন্তণায় ওর মুখ নীল হয়ে গেছে। তুর ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। এই সুযোগে শাকিল পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছে তুরকে। তুর কি করবে ভাবতে ভাবতেই পায়ের দিকে নজর গেলো। ভাগ্যিস আজ হিল পরে বেরিয়ে ছিল। স্মিত হেসে হাই হিল দিয়ে শাকিলের পায়ে আঘাত করল সে। কিছুক্ষণের জন্য তুরকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো শাকিল। এই সুযোগে শাকিলের দু’হাতের তালুতে এবরো থেবরো ভাবে ধা’রা’লো কাঁ’টা’র দিয়ে পোচ দিল সে। হাতের তালু কেটে যাওয়ায় হাত ব্যবহার করতে পারছে না শাকিল। প্রথম থেকেই এই ছেলেগুলোকে শিক্ষা দিতে চাইছিল তুর। এলাকায় নতুন বলে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায়নি সে। তবে এবার আর এদেরকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তুরের মাথায় র’ক্ত উঠে গেলো। আশেপাশে খুঁজে মাঝারি আকারের একটা কাঠের টুকরো পেলো সে। এটা দিয়েই বখাটেদের পিটিয়ে পিটিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো,

” জা’নো’য়া’রে’র দল মেয়ে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়? মেয়েদের দেহ কী তোদের ভোগের বস্তু? দুমিনিটের মজার জন্য একটা মেয়ের পুরো লাইফটা নষ্ট করে দিস তোরা। তোদের মতো জা’নো’য়া’র’দে’র বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। শরীরের এতো জ্বালা থাকলে প’তি’তা’ল’য়ে যা। নিরীহ মেয়েদের জীবন নষ্ট করে কী আনন্দ পাস তোরা? তোদের নিজেদের ঘরেও তো মেয়ে আছে। তাদের সাথে এমন হলে কি করবি?”

সায়ন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। তখনি রাস্তায় একটা দৃশ্য দেখে গাড়ি ব্রেক কশল সে। নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। বৃষ্টির মধ্যে একটা মেয়ে পাগলের মতো কয়েকটা ছেলেকে পেটাচ্ছে। এ-যেনো এক বিরল দৃশ্য। সায়ন ছাতা খুলে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এতো। দৌড়ে এগিয়ে এসে তুরকে দেখেই থকমকে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে কোথায় যেনো দেখেছে সে। কিন্তু আপাতত মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছে মেয়েটাকে। মেয়েটার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনার চেষ্টা করলো সায়ন। মেয়েটার চিকন গলায় চিৎকার করে বলছে,

” মেয়ে দেখলেই নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারিস না তাই না? যে মেশিন তোরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিস না সে মেশিন রাখার কি দরকার…….।”

সায়ন কিছুক্ষণ নিরব দর্শকের মতো পুরো ব্যপারটা দেখলো। দেশের প্রতিটা মেয়ে যদি এভাবে আত্মরক্ষা করতে পারত তাহলে দেশের ধর্ষণ ইভটিজিং যৌন হয়রানির মতো জঘন্য সমস্যা গুলো অনেকাংশই কমে যেত। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি আত্মরক্ষার ট্রেনিং নিশ্চিত করা ও কঠোর আইন প্রয়োগ এর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়তো এই ধরণের জঘন্যতম অপরাধ নির্মুল করা যেত। অবস্থা বেগতিক দেখে তুরের কাছে এগিয়ে গেল সায়ন। তুরকে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সায়নের কথা তুরের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হয় না। সায়ন এগিয়ে গিয়ে তুরের পেছনে দাঁড়ায়। আচমকা তুর পেছনে ঘুরে সায়নের উপর হামলা করে। সায়ন সরে গিয়ে লাঠির আঘাত থেকে বেঁচে যায় এবং শক্ত করে লাঠিটি চেপে ধরে। তুর এখনো চিৎকার করছে আর লাঠিটি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। সায়ান তুরের হাত থেকে লাঠিটি নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে। তুর তখনো হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। নিজের আত্মরক্ষা কৌশল গুলো একের পর এক সায়ানের উপর প্রয়োগ করছে সে। সায়ানও বুদ্ধিমত্তার সাথে সেগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করছে। তুরকে শান্ত করার কোনো উপায় না পেয়ে সায়ান তুরের দুহাত ধরে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। বৃষ্টির ফোঁটায় দুজনেই ভিজে গেছে। তুর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে। সায়ন শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তুরকে। শীতল গলায় বলছে,

” কী করছিলেন মেয়ে? আরেকটু হলে ওদের মেরেই ফেলছিলেন। এতো মাথা গরম হলে চলে? মাথা পাগল মেয়ে। ওদের শাস্তির জন্য তো দেশের আইন আছে।”

তুর সায়নের বুকের সাথে মিশে রয়েছে বিরবির করে বলছে,

” মেরে ফেলব। ওদের সবাইকে আমি মেরে ফেলব। জা-নো-য়া-র…”

ধীরে ধীরে তুর নিস্তেজ হয়ে গেল। নিজের সব ভার ছেড়ে দিল সায়নের উপর। সায়ন আরো ভালো ভাবে আগলে নিল তুরকে। রোড লাইটের আলোতে তুরের আদুরে মুখখানায় দৃষ্টিপাত করলো সে। এমন নিষ্পাপ চেহারার একটা মেয়ে যে প্রয়োজনে এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারত না সে। মেয়েটার গোলগাল মুখটা লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে ঠিক যেনো বৃষ্টিস্নাত তাজা রক্তজবা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here