#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
পর্ব ০৯
#সিলিভিয়া_ফারাশ
(১৮)
অফিসার শাহরিনকে দেখে খুব সন্তর্পণে বন্দুকটা একপাশে ফেলে দিল সায়ন। তারপর নিজেই এগিয়ে গেলো শাহরিনের দিকে।
” আপনি এখানে কি করছেন মি. সায়ন।”
” হাওয়া খেতে বের হয়েছি অফিসার।”
” রাত দুটো বাজে কে হাওয়া খেতে বের হয় মি? তাও আবার ওভারকোট মাক্স গ্লাবস আর হ্যাট পরে।”
শাহরিন সায়নের চারপাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কথা বলছে। সায়ন বিরক্ত হলো। বিরক্ত গলায় বলল,
” আমি বের হই তাছাড়া আপনার আইনের কোথায় লেখা আছে যে রাত দুটোয় ওভারকোট পরে রাস্তায় বের হওয়া যাবে না?”
” আপনি কোনো কিছু লুকাচ্ছেন সায়ন। এভাবে অপরাধীদের মতো আপাদমস্তক ঢেকে চলছেন কেন আপনি? মাক্স ওভারকোট হ্যাট আপনি পড়তেই পারেন কিন্তু গ্লাবস? শুধু শুধু গ্লাবস পড়তে যাবেন কেন?”
” আপনি নিজের কেসের তদন্তের ব্যপারে মনোযোগ দিন অফিসার। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”
” আপনার কাজ? কি কাজ করেন আপনি? রাত দুটোয় কোথাও ডক্টরি করতে বের হচ্ছেন নাকি? আজও কোনো সার্জারি আছে?”
শাহরিনের কথায় চমকে গেল সায়ন। কিছুক্ষণ থ মেরে তাকিয়ে থাকল শাহরিনের দিকে। নিজেকে সামলে নিয়ে আশেপাশে তাকালো সে। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রমনীটিকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো তার।
” আমি আমার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে এসেছি অফিসার।”
” কোথায় আপনার প্রেমিকা? সেও কি আপনার সাথে ডক্টরি করে নাকি?”
সায়ন দেয়ালের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেলো তুর। সায়নের রুমের গোপন কামরা দেখেই তার উপর সন্দেহ হয়েছিল। রাতে সায়নের খারাপ ব্যবহারের জন্য খারাপ লাগায় ঘুম আসছিল না তুরের তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সায়নকে আপাদমস্তক ঢেকে লুকিয়ে গেটের বাইরে যেতে দেখেই সন্দেহ প্রকোট হলো। তাই আর কিছু না ভেবেই সায়নকে ফলো করতে শুরু করেছিল সে। তুর পালাতেও পারছে না। পা দুটো মনে হচ্ছে সুপার গ্লু দিয়ে কেউ আটকে দিয়েছে। সায়ন তুরের কাছে এসে মিষ্টি একটা হাসি দিল। আলতো হাতে তুরের হাত ধরে শাহরিনের সামনে নিয়ে দাড় করালো তুরকে। তুরকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বিগলিত হাসল সায়ন।
” এইযে আমার গার্লফ্রেন্ড। ওর সাথেই বের হয়েছি আমি।”
তুর প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলতে চাইলে তুরের হাত চেপে ধরল সায়ন। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে চোখের দিয়ে একটা শীতল হুমকি দিল যেন।
” আপনারা তো এক বিল্ডিং এ থাকেন মি সায়ন। তাহলে উনার সাথে দেখা করতে বের হয়েছেন মানে? ব্যপারটা সন্দেহজনক নয়কি?”
সায়ন এবার বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে। এই অফিসার দেখছি অনেক কিছুই জেনে মাঠে নেমেছে।
” অফিসার এখন কি আমার প্রেমিকার সাথে হাঁটতেও বের হতে পারব না। আপনি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।”
কথা শেষ করেই শাহরিনের দিকে তাকিয়ে তুরের কপালে গভীর ভাবে চুমু খেলো সায়ন। শাহরিনকে বিব্রত করতেই কাজটা করেছে সে। শাহরিনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পেরে ভিশন মজা পেলো ছেলেটা।
” দিনকাল কিন্তু ভালো নয় রাতের বেলা একটু সাবধানে ঘুরাঘুরি করবেন। আপনার উপর সর্বদা আমার নজর থাকবে মি.। সি ইউ সুন আপনার সাথে খুব শিঘ্রই দেখা হবে। বাই দা ওয়ে ক্যারি অন মি.”
যাওয়ার আগে তুরের দিকে তাকিয়ে শাহরিন সাবধান করে গেলো।
” আপনার প্রেমিক পুরুষ থেকে সাবধানে থাকবেন লেডি। উনার হাবভাব কিন্তু সন্দেহজনক কেমন অপরাধীদের মতো।”
শাহরিন চলে যেতেই সায়নকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল তুর। সায়নের নিষ্পাপ মুখশ্রীতে তাকিয়ে বলল,
” এই শহরের সব পুরুষ কি এমন সায়ন?”
” কেমন রক্তজবা?”
” চরিত্রহীন।”
সায়নের মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
” সবার কথা তো জানি না রক্তজবা তবে আমার চরিত্র একদম গন্ধরাজের মতো পবিত্র।”
” তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অচেনা একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন আবার অনুমতি ব্যতিত প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছেন।”
সায়ন গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলল,
” আমার চরিত্র আপনার জুবান থেকে তো শত গুণে ভালো রক্তজবা। যাই হোক আমাকে ফলো করছিলেন?”
তুর বুঝতে পারল না এখানে জুবানের প্রসঙ্গ আসলো কোথা থেকে।
(১৯)
মোবাইলে রিং এর শব্দে ঘুম ছুটে যায় তুরের। অসময় ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। বিছানা হাতরে মোবাইল নিল তুর। নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করে মোবাইল লাউড স্পিকারে দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখল। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
” আসসালামুয়ালাইকুম কে বলছেন?”
জুবান সালামের জবাব দিয়ে আহত স্বরে বলল,
” আমার নাম্বারটাও সেভ করোনি রসগোল্লা?”
” অভদ্রের মতো এতো সকালে কল করেছেন কেন?”
” এখন সকাল!! ১২ টার বেশি বাজে রসগোল্লা। কোন জগতে আছো তুমি?”
তুর সটান বিছানায় ওঠে বসল। মোবাইলে সময় দেখল ১২ টার কাটা ছাড়িয়েছে। রাতে দেরি করে ঘুমানোর কুফল।
” আপনি এই অসময়ে কল করেছেন কেন জুবান? ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে ঝেড়ে কাশুন। ”
” কেন? তোমাকে কারণ ছাড়া কল দিতে পারি না?”
জুবানের অভিমান মিশ্রিত কথায় ভাবান্তর হলো না তুরের। তাচ্ছিল্য করে বলল,
” আপনি না একজন রাজনীতিবিদ? আমি তো জানতাম রাজনীতিবিদরা কাজের চাপে খাবার খাওয়ার সময় পায় না কিন্তু আপনাকেই ব্যতিক্রম দেখলাম যার নাকি মেইন কাজ মেয়েদের পেছনে ঘুরা আর অপশনাল হলো রাজনীতি করা।”
” শুনো মেয়ে কথা শুনানোর একটা সুযোগ কখনো হাতছাড়া করো না। তুমি এমন কেন হ্যাঁ? আচ্ছা বাদ দাও। তোমার ফ্লাটের বাইরে একটা পার্সেল রাখা আছে। ওটা নাও আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে আসো আমি অপেক্ষা করছি।”
তুর মোবাইল কানে নিয়েই দরজা খুলল। বাইরে মাঝারি আকারের একটা প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেটটা খুলে বিষ্মিত হলো তুর। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে চোখে পানি চলে আসলো। জুবানকে বলল,
” আমি নিচে আসতে পারব না জুবান।”
” তাহলে আমি উপরে চলে আসব।”
” জীবনটাকে কি গল্প উপন্যাস পেয়েছেন জুবান? আর নিজেকে গল্প উপন্যাসের নায়ক ভাবতে শুরু করেছেন নাকি যে আপনি উপরে আসার কথা বললেই আমি ভয় ছুটে আসব। আমি আসতে পারব না।”
তুরের কথায় মন খারাপ হয়ে গেল জুবানের। মেয়েটা এমন কেন? একটু ভালোভাবে কথা বলা যায় না?
” প্লিজ রসগোল্লা একবার নিচে আসো। আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছি।”
জুবান এতো কাতর স্বরে বলল যে না করতে পারল না তুর। না চাইতেও বোরকা পরে রেডি হয়ে নিচে নামল। জুবানকে দেখা গেল নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে বসে আছে। তুরকে দেখেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো জুবান।
কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,
“গাড়িতে বসো রসগোল্লা। আজকে তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
জুবান গাড়ির দরজা খুলে দিল। তুর ওঠার পর নিজে ড্রাইবিং সিটে বসে গারি স্টার্ট দিল। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
” একটা কথা বলি রসগোল্লা।”
তুর জবাব দিল না। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। তুরের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে জুবান নিজে থেকেই বললো,
“তুমি গাড়ির সামনের সিটে বসা নিয়ে কথা কাটাকাটি করলে না কেন? এই যে পেছনের সিটে না বসে সরাসরি সামনের সিটেই বসলে। তুমি জানো আমি কতো প্লান করেছিলাম তুমি যখন পেছনের সিটে বসবে তখন আমি রাগ নিয়ে বলব, ‘আমাকে কি তোমার ড্রাইবার মনে হয় রসগোল্লা? সামনে এসে বসো।’ তখন তুমি রাগ দেখিয়ে গাড়ির দরজা লাগিয়ে আমার পাশে এসে বসবে। তুমি এতো আনরোমান্টিক কেনো রসগোল্লা?”
জুবানের চিন্তা ধারায় অবাক না হয়ে পারল না তুর। মেকি রাগ নিয়ে বলল,
” আজ কাল গল্প উপন্যাস একটু বেশিই পড়ছেন মনে হচ্ছে। নিজেকে গল্পের নায়ক ভাবা বন্ধ করুন মিস্টার।”
” আমার গল্পের নায়ক কিন্তু আমি নিজেই রসগোল্লা।”
” আর আমার গল্পের ভিলেন।”
জুবান এক নজর তুরের দিকে তাকালো। তারপর আবার সামনে তাকিয়ে ড্রাইবিংয়ে মনোযোগ দিল। উদাসীন তুর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
” কেন আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি রসগোল্লা? কোন অপরাধে তোমার গল্পের ভিলেন হলাম জানতে পারি?”
তুরের চোখ টলমল করছে।
” আপনিই তো সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন জুবান।”
এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। তুর টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল।জুবানের ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে কৌতুক করে বলল,
” জুবান ইমজাতের চেহারায় ভয়? যে কীনা অবলিলায় অসংখ্য মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। আর করছে তার চেহারায় ভয়? ব্যপারটা হাস্যকর না?”
জুবান জোরে গাড়ি ব্রেক কষলো। তুরের কপালে আঘাত লাগার আগেই হাত দিয়ে কপালে ঢেকে দিল জুবান। তুরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আহত স্বরে বলল,
” ঘৃণা করো আমায়?”
” অনেক।”
” কিন্তু আমি যে ভালোবাসি?”
জুবান হঠাৎ করেই কালো রঙের রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দিল তুরের। তুরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আলতো করে হাতটা পেছনমুরে বেঁধে ফেললো।
তুর চিৎকার করে উঠল,
” কি করছেন জুবান? আমার চোখ আর হাত বেঁধেছেন কেন? কোন উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছেন আমায়?”
” আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা রসগোল্লা। আশাকরি এরপর আমার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।”
জুবান তুরকে গাড়ি থেকে বের করল। এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো তুরের। তবে কি জুবানকে বিশ্বাস করে ওর সাথে এসে ভুল করে ফেলেছে তুর? জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তটাই কি কিছুক্ষণ আগে নিয়েছে সে।
চলবে…