ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-৩

0
2490

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্ব ০৩
#সিলিভিয়া_ফারাশ

(৬)

“শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় পাওয়া গেছে নৃশংসভাবে খুন হওয়া লাশ। উলঙ্গ অবস্থায় লাশটা কেউ ফুটওভারব্রিজে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। লাশটা একজন পুরুষের। লাশের বুকের চামরা আর মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে খুবই নৃশংসভাবে । গোপনাঙ্গ কেটে মুখে ঢুকিয়ে মুখটা সেলাই করে দিয়েছে। অদ্ভুত ব্যপার হলো লাশের সারা শরীরে নৃশংসভাবে অত্যাচারের চিহ্ন থাকলেও মুখে একটা আচরের দাগও নেই। যেন খুনি ইচ্ছে করেই মুখটা অক্ষত রেখেছে। কিন্তু কেন? সাধারণত এসব মার্ডার কেসে খুনি ভিক্টিমের চেহারা নষ্ট করে ফেলে।

দেশের সব নিউজ চ্যানেলে এখন এই খবরটাই প্রচার হচ্ছে। বেহান টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে কথা বলায় মনোযোগ দিল।

“তোর কি মনে হয় সায়ান খুনি কেন লাশের চেহারা নষ্ট না করে অক্ষত রেখেছে?”

সায়ান ডিম ভেঙে প্যানে দিয়ে দিল। কিচেন টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে বলল,

” স্বাভাবিক ব্যপার লাশের মুখ অক্ষত কারণ খুনি চাইছিল সবাই যেন লাশটার পরিচয় জানতে পারে।”

সায়ান এমন ভাবে বলল যেন সে নিজেই খুনটা করেছে। বেহানের কৌতুক করে বলল,

“এটা তোর কাজ নয় তো সায়ান?”

” ধুর শা’লা তুই তো আমাকে খুনি বানিয়ে দিচ্ছিস।”

বেহান দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মজা করে বলল,

” তুই তো খুনিই। দেশের নাম্বার ওয়ান সিরিয়ার কিলার। তোকে আবার নতুন করে খুনি বানাতে হবে নাকি? আচ্ছা শোন বস দেখা করতে বলেছে। রাতে চলে আসিস। হয়তো নতুন কোনো খুনের সুপারি পেয়ে যাবি।”

” তুই লোকেশন আর টাইম ম্যাসেজ করে দে আমি ঠিক সময় পৌঁছে যাব।”

_______________________

শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল বারের একটা গোপন চেম্বারে বসে আছে সায়ন আর বেহান। রুমে হালকা লাল আলোর ড্রিম লাইট জ্বলছে। সায়নসহ উপস্থিত সবার পোশাক একরকম। কালো কোট কালো মাক্স। এদের কেউ কাউকে চেনে না চেহারাও হয়তো দেখেনি কোনদিন। সায়ন হাত ঘড়িতে সময় দেখল রাত ২ টা বেজে ৫৭ মিনিট। মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করল সে। বসের আসার কথা ছিল ১ টা ৩০ এ। উনি ১ ঘন্টা ২৭ মিনিট লেট। সায়ন গম্ভীর ভাবে চারদিকে চোখ বুলাল। আবছা আলো আবছা অন্ধকারে রুমটাকে রহস্যময় করে তুলেছে। সবার হাতে দামী ব্র্যান্ডের ড্রিংস। নিজের হাতে থাকা ড্রিংকসে চুমুক দিল সে।

” আর ৩ মিনিট অপেক্ষা করব। তখনও যদি বস না আসে তাহলে আমি চলে যাব বেহান।”

বেহান নিজেও বিরক্ত। নিজের বিরক্তি ভাবটা চেপে গিয়ে বলল,

” চলে গেলে সমস্যা হবে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি।”

পাক্কা ৩৩ মিনিট পর বস রুমে প্রবেশ করলো। তার সারা শরীর কালো কাপড়ে মোড়ানো। শরীরের কোনো অংশ দৃশ্যমান নয়। তাদের কাজটাই এমন সবকিছুতেই গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। বস আসার পর কেবল ১০ মিনিট কথা বলে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

(৭)

ক্লাসে সবসময় চুপচাপ থাকে তুর। কারো সাথে তেমন কথা বলে না আবার কেউ কিছু বললেও জরুরি মনে না হলে উত্তর দেয় না সে। এতে সবাই তাকে নিয়ে কানাঘুষা করে ” মেয়েটা প্রচুর মুডি।” তুরের অবশ্য এসবে কিছু যায় আসে না। ক্লাসে প্রবেশ করে নিজের বসার জায়গা ঠিক করতে পুরো ক্লাসে চোখ বুলাল সে। লাস্ট বেঞ্চে এক কোণে চুপচাপ একটা মেয়ে বসে রয়েছে। সামনে ফাঁকা জায়গা থাকতেও তুর সোজা হেঁটে লাস্ট বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটা দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। তুরের উপস্থিতি টের পায়নি এখনও। তুর গম্ভীর গলায় বলল,

” আমি কি এখানে বসতে পারি?”

মেয়েটা চট করে মাথা তুলে তাকালো। তুরকে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। নিজের ছড়ানো ছিটানো জিনিস পত্র একপাশে নিয়ে ছটফট করতে লাগলো। মেয়েটার এমন ছটফটানি দেখে হাসি পেলো তুরের।

“হ্যালো আমি তুর। তুমি?”

” ওর নাম ফেল্টু সাবিরা। এই ভিন গ্রহের প্রাণীর মুখ থেকে বোম মেরেও কথা বের করতে পারবে না। এই এলিয়েন সবাইকে ভয় পায়। কারো সাথে কথা বলে না। সবসময় একা একাই বসে। পড়া লেখাও বিশেষ একটা পারে না। তুমি এই অটিস্টিকটার সাথে বসেছো কেনো তুর? সামনে চলে আসো।”

সামনের বেঞ্চ থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো। তার বেঞ্চের সবাই হেসে উঠলো। চট করে তুরের মেজাজ গরম হয়ে গেল। সাবিরার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে‌। মেয়েটা কি প্রতিবাদ করতে পারে না? আজব। সাবিরার উপর প্রচুর রাগ হলো তুরের। সে গাল ফুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে পাশের বেঞ্চে চলে গেলো। শব্দ করে ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে রাগে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস নিতে লাগল।

” হ্যালো তুর আমি আফরা। সাবিরা মেয়েটা এমনি। মেয়েটা ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল স্টুডেন্ট। ক্লাসেই সবাই কম বেশি ও’কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। এমনকি টিচাররাও বাদ যায় না। ‘ও’ কখনও প্রতিবাদ করে না। ভার্সিটি এসে যে এই বেঞ্চে বসে ছুটির আগে আর বেঞ্চ থেকে ওঠে না মেয়েটা।”

তুর আফরা পাশাপাশি করিডোর দিয়ে হাঁটছে। আফরা নামের অর্থ মুচকি হাসি। নামের মতোই সবসময় ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলা করে আফরার। আফরা হাবিজাবি বিষয়ে গল্প করছে। তুর শুধু হুঁ হা করে জবাব দিচ্ছে। চারদিকে ভ্যাপসা গরম। তুরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঠান্ডা কিছু খেতে না পারলে মনে হচ্ছে গলা শুকিয়ে এখানেই মারা যাবে সে। তুর আফরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” ক্যান্টিনে চলো।”

ক্যান্টিনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলো আফরা। ভয়ার্ত চোখে তাকালো তুরের দিকে। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

” এখন ক্যান্টিনে যাওয়া নিষেধ তুমি জানো না?”

“নিষেধ বলতে? ক্যান্টিন অফ?”

” না, এখন ক্যান্টিন জুবান আর তার দলবলের দখলে। এই সময় ক্যান্টিনে যাওয়া নিষেধ এটা জুবানের নিষেধাজ্ঞা।”

” নিষেধ! নিষেধ মানে কী? নিষেধ করার সে কে? ক্যান্টিন কি তার বাপের? নাকি এটা তার বাপের ভার্সিটি যে তার হুকুম মানতে হবে?”

” বলা যেতে পারে এটা তার বাপের ভার্সিটি তাছাড়া সে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত তাই না চাইতেও সবাই তার কথা মেনে চলে। জুবানের সাথে ঝামেলায় জড়াতে যেও না। সে ভিশন সাংঘাতিক লোক।”

তুর আফরার দিকে তাকালো। জুবানের নাম বলার সময় কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটা। ভয়ে নয় ভালোলাগায়। চেহারায় কেমন আলোর ঝলকানি ফুটে ওঠেছে। আফরার গোলাপী আভা ছড়ানো গালের দিকে তাকিয়ে নিরবে হাসলো তুর। মেয়েটার হাত ধরে বললো,

” আমার সামনে তোমার জুবানের রাজনীতি চলবে না আফরা।”

পুরো ক্যান্টিক ফাঁকা। জুবান তার বন্ধুদের নিয়ে মাঝের দিকের একটা টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটু পর পরই উচ্চ স্বরে হাসিতে ফেটে পরছে তারা। টেবিলে নানান রকমের নাস্তা সাজানো। তুর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ক্যান্টিনের মামার সামনে দাঁড়াল। একশ টাকার কচকচে নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,

” একটা ঠান্ডা দিন মামা।”

তুরের গলার স্বর শুনে তার দিকে ছয় জোড়া চোখ বিষ্ময় নিয়ে তাকালো। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ক্যান্টিনে প্রবেশ করায় ক্ষেপে গেলো জুবানের বন্ধুরা। জুবান বন্ধুদের হাতের ইশারায় থামতে বলল। তুর ঠান্ডা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন জুবানের বন্ধু মাফি বলে উঠলো,

” হেই হটি। তোমাকে দেখে ওয়েদার হট হয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা করে যাও বেইব।”

উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো। তুর শীতল দৃষ্টিতে তাকানোর পর সবাই চুপ হয়ে গেল। ক্যান্টিনের ছেলেটা ধোঁয়া ওঠা গরম চা এনে টেবিলে রেখে চুপচাপ এক কোনে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যান্টিনে এখন পিনপতন নীরবতা। ধীর গতিতে টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো তুর। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শীতল গলায় বলল,

” এই কথাটা কে বলেছে?”

মাফি চেয়ার ছেড়ে উঠে তুরের সামনে দাঁড়াল। শয়তানি হেসে বলল,
” আমি বলেছি জান।”

মাফির সাথে সাথে সবাই হেসে উঠল। তুরকে নিরব থাকতে দেখে সাহস পেলো মাফি। তুরের খুব কাছাকাছি এসে কোমরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ফিগারটাতো জোসস বানিয়েছো বেবি।”
কথা শেষ করেই আলতো হাতে তুরের কোমর ছুঁয়ে দিল মাফি। তুর তড়িৎ গতিতে মাফির হাত চেপে ধরলো। গরম চায়ের কাপে চুবিয়ে দিল ততক্ষণাৎ। মাফি চিৎকার করে উঠল। তুর টেবিলে থাকা আরেকটা কাপ তুলে নিয়ে মাফির মুখে ছুড়ে মারল। যন্তণায় চিৎকার করতে থাকল সে। হাত ছাড়াতে চেয়েও পারল না। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো সবাই। তুর যে এমন কিছু করবে তা ভাবতেও পারেনি কেউ। জুবান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তুরের সামনে এসে দাড়াতেই তুর মাফিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জুবানের দিকে এগিয়ে এলো। জুবানের কলার চেপে ধরে আঙ্গুল তুলে শাঁসিয়ে বলল,

” আপনার বন্ধুদের সামলান জুবান। মেয়েদের সম্মান দেওয়া যদি পরিবার না শেখায় তাহলে আমার কাছে আসবেন আমি খুব ভালো করেই শিখিয়ে দেব। আর আপনাকে লাস্ট ওয়ার্নিং আপনি আর আপনার বন্ধরা শুধু শুধু আমার সাথে লাগতে আসবেন না।”

তুর জুবানের কলার ছেড়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। আফরা এতক্ষন শ্বাস বন্ধ করে সবটা দেখছিল। সেও দৌড়ে তুরের পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো। জুবান তুরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো। তার কাঁচা মরিচের রসগোল্লায় বেশ ভালোই ঝাঁঝ আছে। মেয়েটার প্রতি বারবার ইমপ্রেস হচ্ছে জুবান।
জুবানকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠল মাফি,

” তুই ঐ মেয়েটাকে যেতে দিলি জুবান? ওকে কিছু বললি না কেন? তোকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তোর সামনে ঐ মেয়েটা আমার উপর অ্যাটাক করল আর তুই বসে বসে মজা দেখলি?”

সিফাত এগিয়ে এসে মাফির কাঁধে হাত রাখল।

” ছাড় তো মাফি জুবান ঐ মেয়েকে কিছুই বলবে না। আগেরদিন আমার হাত মুচরে দিয়েছিল মেয়েটা। তখনও জুবান কিছু বলেনি। আমার কি মনে হয় জানিস? আমার মনে হয় জুবান মেয়েটার প্রেমে পরেছে।”

মাফি তাচ্ছিল্য করে বলল,

” ও আবার কারো প্রেমে পরেছে? হাসালি আমায়। ওর প্রেম ঐ বেড প্রর্যন্তই। একবার বেডে নিতে পারলেই ছুড়ে ফেলে দিবে দেখিস।”

মাফির কথায় একটুও রাগ হলো না জুবানের। সে গা দুলিয়ে হাসলো। মাথার সিল্কি চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,

” আমি কাউকে ফোর্স করি না। ওরা নিজ ইচ্ছায় এই জুবান ইমজাতের বেডে আসে। এক রাতের জন্য জুবানকে কাছে পেতে কত কি করে ওরা সেটা তো তোরা জানিস।”

যন্তণার মধ্যেও হাসলো মাফি। বরফ পানিতে চুবানো ফোস্কা পড়া হাতটা দেখে দৃঢ়তার সাথে বলল,

” তুই মেয়েটাকে কিছু না বললেও আমি ছেড়ে দেব না ও’কে। একে ভাইরাল করতে দুমিনিটও লাগবে না আমার।”

জুবানের শরীরে হাজারো সুচ ফুটার অনুভূতি হলো। সে মাফির দিকে তাকিয়ে বলল,

” ওর দিকে কেউ তাকাবি না। এই রসগোল্লা শুধু জুবানের। জুবান জিনিসের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাক এটা জুবানের পছন্দ নয় মাফি।”

মাফি মুখ বিকৃত করল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
” ঠিক আছে ওকে ছুঁড়ে ফেলার পরই নাহয় আমি মজা বুঝাবো। চল একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাক। মেয়েটাকে একমাসের মধ্যে বেডে নিতে হবে তোর।”

জুবান আবারও হাসলো। আসলে তার গালে টোল পড়ে।‌ তার গালের এই টোলের উপর কত মেয়ে যে ফিদা সেটার হিসাব নেই।

” চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড।”

চলবে…..

বিঃদ্রঃ কিছু কারণবশত গল্পের নামটা চেঞ্জ করতে হয়েছে #রক্তজবা নামে বেশ কয়েকটি গল্প ফেসবুকে আছে তাছাড়াও কয়েকজন পাঠক পাঠিকা নামটা চেঞ্জ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। সবদিক বিবেচনা করে নামটা চেঞ্জ করে ফেললাম। গল্পটা কেমন হচ্ছে? সবাই ছোট করে নিজের মতামত দিয়ে যাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here