কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১
শুভজিৎ জানা
________________
১।
গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তায় খুব ধীরগতিতে বিয়ের গাড়ি চলছে স্নেহার। নানান ধরনের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটি বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। ছোট্ট একটা বাঁক ঘুরতেই স্নেহার চোখ আকাশ আর নিলেশের উপর অর্পিত হলো। রাস্তার এক পাশে দুইজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা এমনভাবে স্নেহার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তারা এর আগে কখনো স্নেহাকে দেখেনি।স্নেহা তাদের কাছে অপরিচিত একটি মেয়ে। তাদেরকে দেখতেই স্নেহার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসলো। ছাব্বিশ বছর ধরে পরিচিত গ্রামের রাস্তা গুলো আজ ভীষণ অপরিচিত লাগছে। সবকিছুই নতুনত্ব। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষের ঢল নেমেছে, বরযাত্রী দেখার জন্য। সেসব কিছুই ভালো লাগছে না স্নেহার। এক সুন্দর তৃপ্ত অনুভূতি হলো বিয়ে। কিন্তু সেই অনুভূতি এত জ্বলন্ত আর বেদনাদায়ক তা জানতো না।
মেয়ের বিয়ের গাড়ি, চোখের আড়াল হতেই পাশে থাকা একটি টুলের ওপর বসে পড়লেন দীপক বাবু। বাহান্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া দীপক বাবুর চোখ দুটি লাল। তিনি আড়ালে কেঁদেছেন। মাথায় চুল উস্কোখুস্কো। চোখের নিচে কালি জমেছে। ঠোঁট দুটি ভীষণ শুষ্ক। ক’দিন ধরে রাতে ঠিকমতো ঘুম নেই। এত ব্যস্ততা আর হাসিখুশির মধ্যেও একটা চাপা কষ্ট উনার বয়স দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একাগ্রতার সাথে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। গেটের সামনে আশেপাশে তেমন কোনো মানুষ নেই। বাড়িতে হাজারো কাজ পড়ে রয়েছে। সেই সব কাজে তারা হাত লাগিয়েছে। কয়েকদিন ধরে দীপক বাবু নিজে হাত লাগিয়ে সবকিছু করেছেন। আজ কাজ করার কোনো মানসিকতা নেই। তিনি স্নেহশীল মেয়েকে বিদায় দিয়েছেন। স্নেহশীল মেয়েকে বিদায় দেওয়া কতটা কষ্টের সেটা কেবল একজন পিতা বোঝেন। নিজের মেয়েকে অন্যের বাড়িতে পাঠাতে কোনো বাবাই চান না। কিন্তু তাঁরা নিরুপায়! সমাজের নিয়ম মানতে বাধ্য। স্নেহা শশুর বাড়ি যাওয়ার সময়,বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো, তখন দীপক বাবু নিজেকে সামলাতে পারেননি। উনার বুক চিন চিন করছিল। কোনো উত্তর দিতে পারেননি। মেয়ে বারবার কেঁদে বলছিল, আমি ওই বাড়িতে যাবো না বাবা। তোমার কাছে থাকব। এতো তাড়াতাড়ি আমাকে পর করে দিচ্ছ কেন? দীপক বাবু মুখে ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। চুপচাপ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে গেছেন। সামান্য সান্ত্বনা দিতে পারেননি। স্নেহা বড্ড অভিমানী। বাবাকে কিচ্ছু বলতে না দেখে,একাই বাবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। বাবাকে হাত ধরে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হয়নি। একাই গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে।
স্নেহার সেই ছোট বেলার মুখটি বারবার মনে পড়ছে। তিনি কখনো বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কোলে নিতেন না। তাদের কান্না উনার কাছে ঘ্যান ঘ্যানানি মনে মনে হয়েছে বারংবার। হঠাৎ একদিন তিনি কাজ থেকে ফিরে, ধাইমার কাছে শুনলেন উনার কন্যা সন্তান হয়েছে। তিনি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেননি। সোজাসুজি স্ত্রীর রুমে প্রবেশ করেন। হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে ছিলেন কেন, তার উত্তর এখনো খুঁজে পাননি। কারোর বাধা না মেনে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নেন।চোখ থেকে অশ্রু ধারা বয়ে যায়। বাবার কোলে উঠেই কান্না শুরু করে স্নেহা। দাঁড়ি ভর্তি এলোমেলো মানুষটিকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে। কিছুতেই থামাতে পারেননি। স্ত্রী হেসে ওঠেন। দীপক বাবু স্ত্রীকে ভালো করে প্রখর করেন। বিয়ের প্রথম দিনে কবিতা দেবী জানতে চাইছিল, সত্য ভালোবাসা আসলে কী? সেদিন কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনি জানতেন না সত্য ভালোবাসার আসল মানে। আজ বুঝতে পারলেন, সত্য ভালোবাসা আসলে কী! তিনি স্ত্রী দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন,বিয়ের প্রথম দিনে তুমি জানতে চাইছিলে না সত্য ভালোবাসা আসলে কী? কবিতা দেবী মাথা নাড়ালেন। তাঁর কোলে একটা ছোট্ট শিশু রয়েছে। ওই শিশুকে নিয়ে তিনি এই মুহূর্তে যা যা ভাবছেন সেটাই সত্য ভালবাসা। তীক্ষ্ণ চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ করে যেন মানুষটি সবকিছু বুঝতে শিখে গেছে। অনেক বড় হয়ে গেছে। দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। আস্তে আস্তে করে স্নেহা বড় হয়ে ওঠে। স্নেহা বাবার কাছে হয়ে ওঠে কটো। দীপক বাবু মেয়েকে সবসময় কটো বলে ডাকেন। কাজে ফাঁকি দিয়ে স্নেহার ছোট্ট ছোট্ট আঙুল ধরে বসে থাকেন। অনুভব করেন পিতৃত্ব। কোনো অভাব রাখেননি। মেয়ে যখন যা চেয়েছে তাই এনে দিয়েছেন। স্নেহা না চাইতে অনেক কিছুই পেয়েছে। দামি কলেজ! দামি পোশাক! দামি স্কুটার! কোনো কিছুরই অভাব পায়নি সে। স্নেহা বাবার প্রতি সবসময় আনুগত্য ছিল। বাবার কোনো কথায় অবাধ্য হয়নি। যদিও কিছু ক্ষেত্রে….
রোজ সকালে উঠে তিনি মেয়েকে ডেকে তোলেন। তারপর একসঙ্গে ব্রাশ করেন। স্নেহা নিজে হাতে বাবার জন্য চা তৈরি করে। মেয়ের হাতে চায়ের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারপর নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দুপুরবেলায় স্নেহা বাবার মাথায় তেল না মাখিয়ে দিলে তিনি কিছুতেই স্নান করবেন না। স্নান করে আসার পর, বাবার মাথা স্নেহাই আঁচড়ে দেয়। সন্ধ্যার সময় পাশাপাশি দুটো দোলনায় বসে কত রূপকথার গল্পের সাক্ষী আছেন। আর কি কোন দিন ফিরে আসবে ওই দিনগুলো? দীপক বাবু রোজ সকালে কটো বলে কি আর কাউকে ডাকতে পারবেন? এখন কেউ আর মাথায় তেল মাখিয়ে দেবে না। মাথা কেউ আঁচড়ে দেবে না। সবকিছু নিজেকে করতে হবে। তিনি জানেন, মেয়েকে যে বাড়িতে পাঠিয়েছেন সেখানে অনেক সুখে থাকবে। কোনো কিছুতে অসুবিধা হবে না।আদর-যত্ন-ভালোবাসা পাবে। কিন্তু নিজের ভালোলাগাকে অনেকটা বিসর্জন দিতে হবে। ছোটবেলায় সামান্য কিছু আঘাত পেলে কান্না করে ভাসিয়ে দিতো। কান্না থামানোর একটাই উপায় ছিল,তাকে সারাদিন পড়াশোনা থেকে মুক্ত দিতে হবে আর দোকানে নিয়ে যেতে হবে। কেউ তাকে বকুনি দিলে বাবার কাছে এসে কান্না করত। তার দোষ থাকলেও বিপরীত মানুষটিকে বকুনি দিতে হতো।কিন্তু আজকের পর জীবন আলাদা। শত আঘাত আর কষ্ট পেলেও কাউকে বলতে পারবে না। পারলেও খুব অল্প। নারী জাতিও বড্ড অদ্ভুত। হঠাৎ করে সব কিছু বুঝে যায়। সবকিছু মানিয়ে দেয়। তাইতো তারা গুনের তুলনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাগে এগিয়ে থাকে।
ছাদে একদম পাশের রুমটি ঋষি আর স্নেহার। দুজনে একটা রুমে থাকে। ক্লাস সেভেনের স্টুডেন্ট ঋষি,জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামের সরু রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। যে রাস্তা দিয়ে স্নেহার বিয়ের গাড়ি ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে।গাড়ি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তার চোখ দুটি ভেজা। দিদির বিদায়ের কথা মনে পড়ছে। শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে বুকে আগলে নিয়ে যেভাবে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, তাতে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। দিদিকে এর আগে কখনো এমন কান্না করতে দেখেনি। বিয়ে একটি অনুষ্ঠান। সেই বিশেষ মুহূর্ত না আসলে, ঋষি কোনদিনই জানতে পারতো না তার দিদি তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। শাসনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অপূর্ব ভালোবাসা। বিয়ের পূর্ণ লগ্নে ঋষি কত কিছু করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। বিয়ের আগে কত আনন্দ। তার একমাত্র দিদির বিয়ে। চার চারটি নতুন পোশাক এনেছিল। বিয়েতে পরে সবার সঙ্গে ছবি তুলবে। কিন্তু সেসব কিছুই করতে পারেনি। বিয়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যে উত্তেজনা ছিল, সেই উত্তেজনা বিয়ের দিন অজানা কোনো এক কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। দিদিকে হারানোর ভয় তার মধ্যে চলে এসেছিল।ঋষি পালঙ্কের উপর এসে বসল। বিছানা বেশ এলোমেলো তার উপর পড়ে আছে একটি পুরনো দামি ফোন। সামান্য এই ফোন কিছুক্ষণ নেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে কত ঝামেলা হয়েছে। স্নেহা কখনো নিজের ফোন ঋষিকে দিত না। কিন্তু ঋষির চাই। একসময় যে ফোন স্নেহার জীবন ছিল। আজ সেটা সে নিজের ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে গেছে। ঋষির চোখের নোনা জল চিবুক বেয়ে পড়ছে। সে ক্লান্ত। দিদির পুরনো স্মৃতি যত মনে পড়ছে ততই কান্না করে উঠছে। আজ থেকে তার পাশে কেউ ঘুমোবে না। তাকে একা ঘুমোতে হবে। রাতে বাথরুমে একা যেতে হবে। রাতে ভূতের ভয় পেলে কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না। কেউ ভালো করে অঙ্ক বুঝিয়ে দেবে না। স্কুটার করে কেউ আর স্কুলে ছেড়ে দিয়ে আসবে না। তাকে নিজেই যেতে হবে। মাংসের ছোট পিস নিজে নিয়ে বড়ো পিস তার দিকে কেউ বাড়িয়ে দেবে না। নিজে লাড্ডু চুরি করে অন্য কারোর নামে আর চাপিয়ে দিতে পারবে না।বিকেলবেলায় কারোর ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে না। দরজার কোণে লুকিয়ে ধাপ্পা দিতে পারবে না।
শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল আড়াল করছেন কবিতা দেবী। অন্যান্য বাড়ির সদস্যের মতো তিনিও ভীষণ দুঃখী। নয় মাস দশ দিন নিজের গর্ভে ধারণ করে তিলে তিলে মেয়েকে বড় করেছেন। সেই সন্তানকে বিদায় দিতে হৃদয় কেঁপে উঠেছিল। জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক মুহূর্ত হয়তো মেয়েকে বিদায় দেওয়া। যার দায়িত্ব এতদিন নিজের কাঁধে ছিল, তাকে অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়া কতটা কষ্টের সেটা একমাত্র মাই বোঝেন। মা মেয়ের সম্পর্ক ততটা ভালো ছিল না। সব সময় বাদানুবাদ লেগে থাকতো। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করলে মেয়ের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতো। রাগ করে খাবার না খেলে মেয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিতো। স্নেহা বাইরে থেকে এসেই প্রথমে ‘মা’ ‘মা’ বলে চিল্লাচিল্লি করত। বড্ড অতিষ্ঠ হতেন কবিতা দেবী। চিল্লাচিল্লি, রাগারাগি, অভিমান, রাগ করে না খাওয়ার মধ্যে ছিল এক নিবিড় ভালোবাসা। আজকের পর থেকে সবকিছু স্লান হয়ে যাবে। তিনি বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকলেন না। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে তিনি সর্বপ্রথম দরকারী কাগজ গুলো গোছাতে লাগলেন। কাগজ গোছাতে গোছাতে…. একটা কাগজ উনার দুটি চোখকে স্থির করে তুলল। তিনি কাগজটি হাতে তুলে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। মনে পড়ল আজ থেকে প্রায় সাত-আট বছরের আগেকার ঘটনা। হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। দু-চোখ ভিজে উঠেছে। তিনি মা হয়ে এটা কি করলেন?
পলাশ দিঘি পেরিয়ে যাওয়ার পর স্নেহার মন পুরোপুরি ভেঙে গেল। হঠাৎ করে জোরে জোরে কেঁদে ওঠে। পাশে থাকা আপন মানুষটি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে, সে সব কিছুই বোঝে। কিন্তু মানিয়ে নিতে হবে। যখনই মন খারাপ করবে তখন চলে আসবে। কোনো কিছুতেই আপত্তি থাকবে না তাদের। স্নেহা মুখ লুকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসে। নিতান্ত আঠারো বছরের যুবতী নয় সে। বাস্তব কতটা নির্মম হয় -সে জানে। অজুহাত দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব নয়। স্নেহার শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। মিনিট দশেকের মধ্যে দু দু বার বমি করল। জল থেকে মাছ তুলে আনার পর, মাছ কিছুক্ষণ ছটপট করতে করতে যেভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, দুবার বমি করার পর স্নেহার অবস্থা ঠিক তেমনটা হলো। ক্লান্ত শরীর আপন মানুষটির কাঁধে এলিয়ে দিল। চোখ মিটমিট করছে। মনে পড়ছে বাড়ির উঠোনের সামনে সেই আমগাছ আর কৃষ্ণচূড়া গাছ, দূরের ট্রেন লাইন। গাছের তলায় বসে কাটানো কয়েকটি মুহূর্ত। বাড়ির প্রতিটি কোণা, ঠাকুর ঘর,বারান্দা, জানালা, বাড়ির ছাদ সবকিছুই তার নখদর্পণে। আজ যে বাড়িতে যাচ্ছে ওই বাড়ির কিছুই জানে না সে। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ। নতুন একটা পরীক্ষা। কোনো প্রিপারেশন নেই। তবুও উত্তীর্ণ হতে হবে। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা অনেক রেজাল্ট পান।কিন্তু বাবা-মা জীবনে একটাই রেজাল্ট পান, তাঁর ছেলে মেয়ে কেমন হয়েছে? স্নেহাকে প্রমাণ করতে হবে, সে আদর্শ বাবা-মায়ের আদর্শ সন্তান। সুগন্ধি ফুলের মোহ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। নতুন শাড়ির নতুন গয়নার একটা নতুন গন্ধ রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে অজস্র পারফিউমের রংবেরঙের গন্ধ। সেসব কোনো গন্ধই ভালো লাগছে না তার। এই সুগন্ধি তাকে বিরক্ত করে তুলছে। তার তো মায়ের আঁচল মাখা আর বাবার ঘামের গন্ধটাই সবচেয়ে প্রিয় -যে গন্ধ নাকে ভেসে আসে না, অনুভব করতে হয়।
কবিতা দেবী দৌড়ে বাড়ির সামনে আসলেন। নারকেল গাছের উপর একটি কাক বসে অবিরাম শব্দ করে যাচ্ছে। অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই দীপক বাবুর। যিনি কাক কে সবচাইতে বেশি অপছন্দ করেন। পাশেই কয়েকটি কুকুর বিয়ে বাড়ির অবশিষ্ট খাবার খেয়ে ক্লান্তভাবে শুয়ে রয়েছে। শরীর এলিয়ে দিয়েছে বালির উপর। তিনি যতটা আগ্রহ নিয়ে ছুটে এসেছিলেন স্বামীর কাছে, কাছে আসতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। স্বামীকে দেখে করুণা হতে লাগল। উনাকে মাঝিবিহীন নৌকার মত লাগছে। কাছে আসলেন। স্বামীর কাঁধে হাত রাখলেন। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বারবার ডাকার পর কবিতা দেবীর দিকে মুখ ফেরালেন। মুখ বিষন্নতা এবং তামাটে রং ধারণ করেছে। কালো কালো দাগ পড়েছে।স্বামীর মুখের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন। আড়ষ্ঠতা ভেঙ্গে বললেন,”কি হয়েছে তোমার অবস্থা? তোমাকে এতটা দুর্বল লাগছে কেন?” কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন দীপক বাবু। তারপর হালকা স্বরে বললেন,”আমি ঠিক আছি। তুমি খেয়েছো?”
“না, আমরা জীবনে সবচাইতে বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।”
“ভুল!” বিস্মিত স্বরে বললেন তিনি।
“হ্যাঁ, ভুল! আজ থেকে সাত-আট বছরের পূর্বের ঘটনা মনে আছে তোমার!”কৌতুহল জাগতে থাকল দীপক বাবুর মধ্যে। সাত-আট বছরের মধ্যে এমন কি ঘটেছিল, এখন জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। অনেক মনে করার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। তবে নিশ্চিত হলেন, বড়ো কিছু ঘটনা ঘটেনি। হয়তো কিছু ছোটখাটো ব্যাপার ছিল, এখন মনে নেই। তিনি কবিতা দেবীকে সবকিছু স্পষ্ট ভাবে বলতে বললেন।
“আমাদের মেয়ে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার।” ডাক্তারের রিপোর্ট স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন। দীপক বাবু সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টটিতে চোখ বুলিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
” ওহ, এই বিষয়ে! তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। এটা আমার মনে ছিল।”
“এটা তোমার কাছে সামান্য লাগছে। তোমার চিন্তা হচ্ছে না?”
“এতে চিন্তা করার কি আছে? এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন বহু মানুষই থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করে যাচ্ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো উচিত নয়।” টুল ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। ভীষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। কিন্তু,কবিতা দেবী স্বামীর কথাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না। তাদের পরিবারের উপর কত বড়ো একটা ঝামেলা আসতে চলেছে তা বোঝা কঠিন। তিনি কান্না মাখা গলায় বললেন,”আমরা কিন্তু জামাইয়ের মেডিকেল রিপোর্ট জানি না। আমরা একবারের জন্য দেখার চেষ্টাও করিনি। স্কুলে থ্যালাসেমিয়া রিপোর্ট দেওয়ার সময় প্রদীপ বাবু বারবার বলে দিয়েছিলেন, মেয়ের বিয়ের আগে যেন জামাইয়ের থ্যালাসেমিয়া রিপোর্ট জেনে নি। এই পৃথিবীতে হয়তো এক লাখ মানুষের মধ্যে একজন থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সেই একজন যদি আমাদের জামাই হয়।তাহলে, তোমার মুখে এই উজ্জ্বল হাসি থাকবে তো? আমাদের মেয়ের জীবনের আলো জ্বলে থাকবে তো! না, হারিয়ে যাবে! আমরা তো শিক্ষিত নয়, আমরা উচ্চশিক্ষিত। আমরা যদি এতটা কেয়ারলেস হই, তাহলে সাধারণ মানুষ কি করবে?” দীপক বাবু শান্ত হয়ে গেলেন। ধপ করে আবার টুলের উপর বসে পড়লেন। তিনি কিছুই ভাবতে পারছেন না। ঘটনা যদি সত্য হয়। খুব শিগগিরই ভয়ানক কিছু ঘটতে চলেছে। তাঁর মেয়ের প্রতি এই ভালোবাসা। সব কিছু না জেনে এমনটা ভুল কি করে করলেন? বিয়ে কি শুধুমাত্র একটা সামাজিক বন্ধন? মন্ত্রপাঠ আর কিছু পুরনো নিয়ম,ব্যাস এইটুকু -আর কিছু নয়? বিয়েকে শুধুমাত্র সামাজিক বন্ধন হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি না। বিয়ের সংজ্ঞা অনেক বড়। বিয়েতে মন্ত্র পাঠ ভুল করলে তেমন কিছু হবে না, কিন্তু ছোটখাটো এমন কিছু ভুল থাকে,যেগুলো করলে সারা জীবন ধরে তার মাশুল দিতে হয়। তবুও শান্তি পাওয়া যায়। সন্তানের গায়ে যত দিন পর্যন্ত মায়ের আঁচল আষ্টেপিষ্টে থাকে ততোদিন তার কিছু হতে পারে না। মায়ের আঁচল তুলে নিলে সন্তানের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে ওঠে।
পর্ব ২ আসছে
আশা করি,সবাই উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত পড়বেন। আমি সবসময় নিখুঁতভাবে লেখার চেষ্টা করি তাও অনেক ভুল থেকে যায়। আশা করছি, সেই সমস্ত ভুল আপনারা ধরিয়ে দেবেন। ধন্যবাদ।।