কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব ২৮

0
467

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২৮
________________
রাত্রিতে ঘুমানোর পূর্বে রুমের মধ্যে এলোমেলো পড়ে থাকা বহু জিনিস গোছাতে শুরু করলো স্নেহা। সহকর্মী হিসেবে সাহায্য করল উৎপল। তাদের বাড়ির জিনিসপত্র গোছাতে ভালো লাগে। জমিয়ে সংসার করছে দুজন। একে অন্যের ভালোলাগা খারাপ লাগা গুলো উভয় মানিয়ে নিয়েছে।প্রথম প্রথম ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতি গুলো একে অপরের কাছ থেকে আদান-প্রদান করতে দারুন লাগছে। কি মধুর অনুভূতি! হয়তো, জিনিস গুলো বেশি এলোমেলো নয়। তবুও একসঙ্গে সেগুলো সাজাতে ভালো লাগছে। মুহূর্ত কিনতে কিংবা তৈরি করতে সবারই ভালো লাগে। অবচেতন মনে কিছু মুহূর্ত কেনার পর পালঙ্কের উপর গিয়ে বসলো উৎপল। কিছুক্ষণ পর পাশে বসল স্নেহা। কেমন একটা পুরোনোর মধ্যে নতুনের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে। উৎপল বিছানার উপর থেকে ফোন তুলে নিয়ে বলল,”তোমার কি সত্যি আরও দুটো রুমের প্রয়োজন? তাহলে বল, এবার তো কাজ শুরু করতে হবে।”
“না,প্রয়োজন নেই। ওটা একটা গল্পের অংশ ছিল তাই বলে ফেলেছিলাম। তবে আরও একটা পালঙ্ক চাই। এই যে সামনে আলমারি রয়েছে ওটা ঠাকুর ঘরে রেখে দিয়ে আসবো। একটা বড় অংশ ফাঁকা হয়ে যাবে। ওইখানে পালঙ্ক রাখবো। আমাদের বাচ্চাকাচ্চা হলে এখানেই থাকবে। ওদের কিছুতেই আলাদা ঘরে রাখবো না।” উৎপলের চোখমুখ মুগ্ধতায় ভরে উঠলো। মোবাইল বিছানার ওপর ফেলে দিয়ে স্ত্রীর বাহু ধরে কাছে টেনে আনলো। বলল,”বাচ্চাকাচ্চা হতে এখনো অনেক বাকি। বাচ্চা হলে তুমি আর আমায় ভালোবাসবে না। তাই এখন আমায় বেশি করে ভালোবাসো।”
“হুশশশ,ছাড়ো তো।” উৎপল ছাড়লো না। বরং আরও জাপ্টে ধরলো। স্বামীর বাঁধন থেকে মুক্তি পেতেও চাইলো না স্নেহা। স্নেহা নিজের মাথা স্বামীর কাঁধে এলিয়ে দিল। লজ্জা পেল। উৎপল নরম কন্ঠে বলল,”বাড়িটা খুব সুন্দর লাগছে তাই না? কত সুন্দর সাজানো গোছানো। সব তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে। এত হাতের কাজ কি করে জানলে?”
“আমি অনার্সে ফার্স্ট ইয়ারে মাত্র তিন দিন কলেজ গেছিলাম। তারপর নিজে থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেই। বাবা কত বকুনি দিয়েছিল, বুঝিয়েছিল, তবুও শুনিনি। বেশ কয়েকদিন খেতেও দিয়েছিল না তাও আমাকে দিয়ে পড়াশোনা করাতে পারেনি। এমন কি যে মনের মধ্যে জেদ ঢুকে গেল আর পড়াশোনা করা হয়নি।ভেবেছিলাম বিক্রম চলে গেছে আমার পড়াশোনা নিয়ে গেছে সে যখন ফিরে আসবে তখন আবার পড়াশোনা করব। কিন্তু সে আসলো না। ইগোই তার কাছে সবকিছু। আর আমি অবসর সময়ে হাতের কাজ শিখে ফেললাম।”
জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো উৎপল। মাথা নাড়িয়ে বলল,”সব বুঝলাম। ভাবছিলাম বিক্রম বোকা কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বোকা তুমি নিজেই। আজকে এখানে দাঁড়িয়ে একবার ভাবো, কার জীবন নষ্ট হয়েছে? তোমার না তার?”
“এক সময় আমি সময় নষ্ট করেছি আর এখন সময় আমায় নষ্ট করছে। ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম চাইলে অনেক কিছু করতে পারতাম। আরও অনেক মানুষের ভালোবাসা পেতে পারতাম। সারা জীবন গৃহবধূ হয়ে থাকতাম না।”
“কেন গৃহবধূ হয়ে থাকতে ভালো লাগছে না?”
স্নেহা কেমন একটা অচেনা হাসি, মুখে ফুটিয়ে তুলে বললো,”খুব ভালো লাগছে।” স্নেহা হাসলেও উৎপল ঠিক বুঝতে পারল, তার স্ত্রী বর্তমান জীবনকে নিয়ে যত বেশি দুঃখী নয় তত বেশি সুখীও নয়। ওই একটা হাসির মধ্যে অনেক আকাঙ্ক্ষা অনেক স্বপ্ন লুকিয়ে রয়েছে। নিজের ভুল আজও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জীবনের ভুলগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। যেগুলো আর শোধরানো সম্ভব নয়। উৎপল প্রসঙ্গ পাল্টালো। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,”সব সময় কি আমরা রুম সাজাবো? নিজেরাও একটু সাজুগুজু করি।”
“ঠিক আছে কালকে যতখুশি সাজুগুজু করো। কেউ বারন করবে না। এখন ঘুমাও।”
“এখনই তোমাকে সাজাতে ইচ্ছে করছে।”
“এত রাতে আমাকে কে দেখবে শুনি?”
“আমি দেখব। সারারাত ধরে তোমায় দেখবো।”
“আচ্ছা, সাজিয়ে দাও তাহলে।” দুজনের মন আনন্দে ভরে উঠলো। তবে স্নেহা কোনো রকম বাধা না দিয়ে সহজে রাজী হয়ে যাওয়ায় উৎপলের মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। ভয় করল। তার সমস্ত পাগলামিতে স্নেহা কেন সহজেই রাজি হয়ে যায়? শুধুই কি বিপরীত মানুষটির প্রতি ভালোবাসা না ওই মানুষটির সঙ্গে কোনো ভাবে বেশি কথা বলতে চায় না। তাই সবকিছু তে হ্যাঁ বলে। আর কথা বাড়ার কোনো সুযোগ থাকে না।আজ পর্যন্ত স্নেহাকে কোনো কিছুতে জোর করতে হয়নি। সব কিছুতে নিজে থেকে দিয়েছে। সবকিছু পাওয়ার মধ্যেও যেন অপূর্ণতা রয়েছে। সে চায় স্নেহা অনেক কথায় না বলুক। তার উপর রাগ করুক অভিমান করুক। সে তাকে জোর করে রাগ ভাঙ্গাবে। কিন্তু দু-একটা যুক্তিহীন প্রসঙ্গ ছাড়া সব কয়টাতে রাজি হয়ে যায় স্নেহা।মনের এই সংকোচন উৎপলকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে বারবার। প্রশ্ন ওঠে স্নেহার ভালোবাসা নিয়ে। প্রসন্ন হাসি বিনিময় করে উৎপল বলল,”তুমি একটা নতুন শাড়ি পরে নাও আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”
“আচ্ছা।” লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল স্নেহা। নিজের পছন্দের মত একটা লাল রঙের শাড়ি পরল। অল্প সময়ের পর দরজা ঠেলে উৎপল প্রবেশ করল। জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দিল। মেঝের মধ্যে চুপিসাড়ে বসে পড়ল স্নেহা। পাশে উৎপল বসলো। পায়ের গোড়ালি থেকে হালকা শাড়ি তুলল। উৎপল নিজের মত করে স্ত্রীর পায়ে আলতা লাগিয়ে দিল। হাতে নেইলপালিশ লাগিয়ে দিল। মাথায় চুল খোঁপা করে বেঁধে দিল। যত গয়না ছিল সব পরিয়ে দিল। তারপর উঠে গিয়ে পালঙ্কের উপর বসলো উৎপল। তার কোলের উপর বসল স্নেহা। দশমীর রাতের চাঁদের আলো পর্দা সরানো জানালা দিয়ে প্রবেশ করে তাদের চোখে মুখে পড়েছে। লাজুকতায় ভরে উঠে চকচক করছে মুখমন্ডল। চতুর্দিকে নিস্তব্ধতায় ভরা। বিকেলের দিকে বৃষ্টি কমে গেছে। মেঘের গর্জনও থেমে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সামান্য শব্দ পর্যন্ত শোনা গেল না। স্ত্রীকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ের কাছে নিজের থুতনি নিয়ে গেল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গালে লাগতেই ছটফট করে উঠলো স্নেহা। বলল,”লাগছে তো।”
“লাগুক।”
আবার অনেক সময় নিস্তব্ধতা। ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের মৃদু শব্দ হলো।
“একটা কথা বলি?” খুব শান্ত গলায় বলল স্নেহা।
“বল?”
“আমার বেবি চাই। বেবি দাও।”
“ও মা! আমাদের বিয়ে তো মাত্র এক বছর হল। আরও কিছু বছর একসঙ্গে কাটাই। একে অপরকে ভালো করে চিনি তারপর তো বেবি।”
“তুমি তো সবকিছু জানো উৎপল। বাড়িতে একা থাকার সময় খুব মন খারাপ হয়। ভালো লাগে না। একটা বাচ্চা থাকলে অনেক খুশি থাকব।”
উৎপল কিছুক্ষণ ভাবল। স্নেহা অমূলক কিছুই বলেনি। স্ত্রীর খুশির জন্য সব কিছু করতে পারে। হাসিমুখে বলল,”ঠিক আছে? তবে তার আগে দুজনের মেডিকেল চেকআপ করা উচিত।”
“কি?” বেশ উঁচু স্বরে বলে উঠলো স্নেহা। নিস্তব্ধতার মধ্যে কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হয়ে উঠলো। এতটা উত্তেজিত হয়ে মাথা নাড়িয়েছে যে তার মাথা উৎপলের থুতনিতে লেগে ঠোঁট কিছুটা কেটে গেল। উৎপল রেগে গিয়ে বলল,”কি হল? এভাবে চেঁচালে কেন? হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন?” এত প্রশ্নে স্নেহা আরও বিরক্ত হয়ে পড়ল।নিরুত্তর রইল। উৎপল ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখল নরম ঠোঁট শক্ত দাঁতের আঘাত পেয়ে সামান্য কেটে গেছে। অন্ধকারের মধ্যে রক্ত বেরিয়েছে কি না বুঝতে পারল না। স্নেহাকে কিছুই বুঝতে দিল না। না হলে কেঁদে ফেলবে। কিছুক্ষন পর বলল,”কি হলো? তোমায় এত উত্তেজিত লাগলো কেন?”
“মেডিকেল চেকআপ করাতে যাবে কেন? তোমার কিছু সমস্যা রয়েছে?” আমতা আমতা করে বলল স্নেহা।
“আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে এ ত কর্তব্য। সন্তান জন্ম দেওয়া আর সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়া দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে গেলে জেনেটিক কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন।”
“এই কথাগুলো বিয়ের আগে মনে ছিল না। সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য বিয়ের আগেও জেনেটিক কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন ছিল।”
“আমার কোনো বংশগত রোগ নেই যে চিকিৎসা করার প্রয়োজন থাকবে। তোমাকে এত উত্তেজিত এবং কঠোর লাগছে কেন? তোমার কি কিছু রোগ রয়েছে?” স্নেহা কোনো জবাব দিল না। আরও এক-দুবার প্রশ্ন করল উৎপল। কিন্তু স্নেহা একবারের জন্যও মুখ খুললো না। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।বুঝতে পারল আজ রাতে তার কাছ থেকে কোনো কথা বের করতে পারবে না। সাজগোজ অযথা বৃথা হয়ে গেছে। স্ত্রীকে নতুন করে আদর করতে না পারায় একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলো উৎপল। চুপচাপ বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর স্বামীর পাশে স্নেহাও শুয়ে পরলো। ঘুম কিছুতেই আসলো না। নানা ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। দীর্ঘ বছর আগে প্রদীপ বাবু বলেছিলেন বিয়ে করার আগে ছেলের যেন মেডিকেল রিপোর্ট চেক আপ করে নেয়। কিছুতেই যেন থ্যালাসেমিয়া বাহক ছেলের সঙ্গে বিয়ে না হয়। একটা রোগের জন্য জীবনের বড় একটা সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। কিন্তু বাবা-মা ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত আবার একটা ভুল করে বসেছে। এবং এই ভুল নিজেরও। বিয়ের আগে একবারের জন্যও ভাবেনি।আজ যদি রিপোর্টে উৎপল থ্যালাসেমিয়া বাহক হয়। তাহলে আগামীকাল থেকে তাদের জীবন কেমন হবে? অক্ষুন্ন থাকবে তো এমন সুখের সংসার? এত বড় একটা ভুল কি করে সম্ভব হল? বাবা মা কি করে এমনটা করলেন? বাবা-মাকে দোষ দেওয়া নিছক শুধুমাত্র একটা অজুহাত। নিজেও যথেষ্ট শিক্ষিত। কয়েক বছর আগে এমন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছিল। তাও কেন এই বিষয়টি বিয়ের সময় মাথায় আসেনি? নিজের ভুলের মাশুল সবসময় নিজেকেই দিতে হয়। চোখ কোনো বাঁধ মানলো না। জল গড়িয়ে যেতে রইল।

আর্য কর্নাটকের অসংখ্য সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় হলেও বিয়ে বাড়ির সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়ে উঠতে পারেনি। এখানকার বিয়েবাড়ির সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কলেজের প্রথম থেকে লক্সমির সঙ্গে সঙ্গে সোয়াতির সঙ্গেও একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। লক্সমির বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সোয়াতি। এক সঙ্গে মিশতে মিশতে কখন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি। আজ সোয়াতির বিয়ে। লক্সমির সাথে সাথে আর্যকেও ইনভাইট করেছে। এই ভিন রাজ্যে প্রথম কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে আর্য। একটু নতুনত্ব লাগছে। এই অচেনাকে চিনতে ভালো লাগছে। আর্য এবং লক্সমি দুজন মিলে সোয়াতির জন্য উপহার কিনেছে। তাদের বাড়ির সামনে পৌঁছতে হৃদয় মুগ্ধতায় ভরে উঠলো। বেশিরভাগ ফুল দিয়ে সাজানো বিশাল এক প্যান্ডেল। মুগ্ধময়ী রংবেরংয়ে রাতের আলো ফুল গুলোর উপর পড়ে চকচক করে উঠেছে। হালকা মিউজিক বাজছে। চারিদিকে ফুল ছড়ানো। বাড়ির বাইরের দৃশ্য দেখে আর্যর চোখদুটো জুড়ে গেল। বেশ কয়েকটা সাউথ ইন্ডিয়ান মুভিতে এখানকার বিয়ে বাড়ি দেখেছে। আজ কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো। মুভির কোনো অংশই যেন এখানে কম নেই। গুটি গুটি পায়ে তারা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। নতুন করে প্যান্ডেল হওয়ায় কোনটা বাড়ি আর কোনটা প্যান্ডেল সঠিকভাবে বোঝা গেল না। সময় লাগলো। সবাই সেজেছে শিশু থেকে কিশোর কিশোরী, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বৃদ্ধা। সবাই নতুন রংগে মলিন হয়ে আছে। আর্য চুপিসাড়ে লক্সমিকে দেখে বললো,”তোমাদের এখানকার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস কি জানো?” মিউজিকের শব্দ এবং বিয়ে বাড়ির মানুষজনের হই-হুল্লোড়ের মধ্যে আর্যর মৃদু বার্তা লক্সমির কানে সম্পূর্ণ পৌঁছল না। সে আবার একবার বলতে বলল। এবার বেশ জোর গলায় বলল। লক্সমি এবার শুনতে পেল ঠিকই তবে আর্যকে বেশ জোর গলায় কথা বলতে দেখে হেসে উঠলো। তারপর জানতে চাইল আর্যর এখানকার কোন জিনিস সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে? হাসিমুখে আর্য জবাব দিল,”তোমাদের কালচার। তোমাদের মানুষগুলোর নিজস্বতা এবং নিজেদেরকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা। এগুলো আমাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে। এখানকার মানুষ গুলো নিজেকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।”
“কেন তোমাদের এমনভাবে ঘর সাজানো হয় না?”
“অবশ্যই সাজানো হয়। তবে এমন ভাবে ফুলের বন্যা বইয়ে দেওয়া সম্ভব তা কখনো কল্পনার মধ্যেও ছিল না।”
“এটাই তো নিজস্বতা। হয়তো, এখানকার কোনো মানুষ তোমাদের সেখানে গেলে, সেখানকার বিয়ে বাড়ি দেখে খুশি হবে। তাদের সেগুলো ভালো লাগবে।” আর্য মাথা নাড়ালো। কোনো জবাব দিল না। যেখানে বর-কনে সাতপাকে বাঁধা পড়বে সেই জায়গায় পৌঁছতে আবার একবার চমকে উঠলো। সেখানে কোনো রকম কাপড় নেই। সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এবং আরও অসংখ্য ফুল পাশে রয়েছে। আর্য ঠিক বুঝতে পারল না এত ফুল কি হবে? দুচোখ ভরে শুধু দেখে গেল। লক্সমি এগুলোর সম্বন্ধে খুব পরিচিত। তাই বর্তমানে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য তার চোখকে স্থির করতে পারল না। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই নিল। কিছুক্ষণ পর সোয়াতির সঙ্গে দেখা করে এসে আশেপাশে ঘুরতে রইল। লক্সমি তার বান্ধবীর কাছে থেকে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। রাত দুটোয় বিয়ের লগ্ন। সবাই সারা রাত জাগার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কতক্ষণ সেখানে বসে ছিল ঠিক মনে নেই। দুচোখ সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় বাধা পড়েছিল। তাদের নিয়মকানুন জানার চেষ্টা করেছিল। অনেকক্ষণ পর লক্সমি তাকে নাড়িয়ে দেওয়ায় হুশ ফিরলো। সৌন্দর্যের দীপ্ত রেখা থেকে চোখ ফিরিয়ে এক অপরূপা নারীর সৌন্দর্যের দিকে ঘুরে তাকালো।তার সাজানো মুখে এলোমেলো কথাবার্তা এবং হাত ভাঙ্গানোর ভঙ্গি দেখে না হেসে পারলো না আর্য। এই মুহূর্তে তাকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না -সে উনত্রিশ-তিরিশ বছর বয়সী এক যুবতী। বয়স যেন হঠাৎ করে অনেক কমে গেছে। শিশু হয়ে উঠেছে।
“তোমার কি নাচতে ইচ্ছে করছে? ভাবভঙ্গি তো তাই ইঙ্গিত করছে।” খনখনে স্বরে বলল আর্য। লক্সমি মৃদু হেসে চালাকি করে বলল,”ইচ্ছে তো করছে নাচতে। কিন্তু স্টেজ নেই।” এইটুকু কথাতে হেসে ফেলল লক্সমি। তারপর আর্যর একটা হাত ধরে জোরে টান দিয়ে চেয়ার থেকে তুলে নিল। তার চোখে-মুখে রঙ্গিন হাসির আভায় ভরে গেল। মুখে হাত চেপে হেসে ফেললো। বললো,”তুমিতো খুব হালকা। একটা টানে চলে আসলে। একটু বেশি বেশি খেয়ে মোটা হও।”
আর্য লম্বা একটা হাই তুলল। রাত বাড়ছে। চোখ দুটো ঘুমে ডুবে যাচ্ছে। উদাসীন ভাবে বলল,”ঘুম পাচ্ছে তো। আর ভালো লাগছে না।”
“সেকি! ঘুম পাচ্ছে বললে হবে না। বিয়ে বাড়িতে এসেছো সারারাত জাগতে হবে। কদিন থেকে তো বলে বেড়াচ্ছ তোমাদের বিয়ে বাড়ি দেখব আর এখন ঘুমাবে বললে চলবে না।” আর্য আবার একবার হাই তুলে চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল তখনই লক্সমি দ্বিতীয় বার তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল,”খাবে চলো, তারপরে, যেখানে খুশি যত খুশি বস কেউ বাধা দেবে না।” আর্য মাথা নাড়ালো। তারপর লক্সমির পিছু পিছু খাবারের জায়গায় গেল। ওই জায়গাটা অতটা সুসজ্জিত ভাবে সাজানো গোছানো এবং বড়ও নয়। ক্ষুদ্র একটা জায়গা। বেশ কয়েকটা বেঞ্চ রয়েছে। বেঞ্চের একটা পাশে আর্য এবং লক্সমি পাশাপাশি বসলো। সমবয়সী একটা ছেলে এসে কলাপাতা দিয়ে গেল। আর্য মৃদু হাসলো। অনেক দিনের পর কলাপাতায় ভাত খাবে। বাড়িতে পুজো হলে ঠাকুরের ভোগ মাঝেমধ্যে কলাপাতায় খেত। আধুনিক যুগে গ্রামবাংলায় কলাপাতার খাওয়ার প্রবণতাটা উঠে গেছে। বিয়ে বাড়ি কিংবা পুজো বাড়ি সবকিছুতে আধুনিক ছোঁয়া লেগে গেছে। আর এখানে এত বড় শহরে ব্যতিক্রম জিনিসটা ভালো লাগলো।এরপর আবার একজন এসে সবাইকে পুরো একটা গোটা কলা দিয়ে গেল। আর্য মুখের হাসি কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারছে না। লক্সমি বেশ বুঝতে পারল আর্যর মনের কৌতুহল। তার পায়ে চিমটি কেটে বারণ করল হাসতে। অন্য মানুষ গুলো খারাপ ভাবে নিবে। তারপর সামান্য কিছু একটা খাবার দিল যা আর্যর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। খাবারটি খেয়ে দেখল যতটা ভেবেছিল ততটা মন্দ নয়। তারপর আরও দুটো পরিচিত গোটা ফল দিল। তারপর পরিচিত খাবার ধোসা,সাম্বার দিল। সেগুলো কিছুই খেলো না আর্য। অপেক্ষা করল ভাতের। বাঙালি ভাত মাংস না হলে চলে না। বিয়ে বাড়ি মানে ভাত মাংস মাছ এগুলো তো চাই চাই। লক্সমি তাকে খেতে বলল কিন্তু সে একটুখানি মুখে তুলে থেমে গেল। মাছ মাংস ভাতের অপেক্ষা করল। কিন্তু আর্যর আশা পূরণ হলো না। লক্সমির খাওয়া শেষ হওয়ার পর আর্যকে তাড়াতাড়ি খেতে বলল। কোনো রকম খাবার শেষ করে অবসন্ন মুখে খাবার থালা ছেড়ে উঠে পড়তে হলো। তার অবসন্ন মুখশ্রী দেখে একটা লম্বা হাসি দিল লক্সমি। বলল,”কি হলো? মুখ ভারী করে রেখেছো কেন?”
“বিয়ে বাড়িতে এসে পেট ভরল না। খালি পেটে সারারাত কিভাবে জেগে থাকবো বলতো?”
“ওও, এই ব্যাপার। তোমরা সব সময় ভাত খাও, তাই না?”
“আর ভাত…. বিয়ে বাড়ি না পুজো বাড়ি খেতে এসেছিলাম তাই বুঝতে পারলাম না।” আর্যর উত্তর ঠিক শুনতে পেল না লক্সমি। পাশে কেটে হাতমুখ ধুতে চলে গেল। উভয় হাত মুখ ধোয়ার পর বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখল দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে একটা একটা করে লাল রং এর ব্যাগ দিচ্ছে সবাইকে। আর্য এবং লক্সমি দুজনেই ব্যাগ নিল। লক্সমি ব্যাগ না খুললেও আর্য কৌতুহলী হয়ে পরলো। কৌতূহলবশত ব্যাগ খুলে দেখল তার মধ্যে একটা গোটা নারকেল এবং পাঁচটা পান রয়েছে। পান গুলো আবার সাজানো নয় সদ্য গাছ থেকে তুলে আনার পর যেমন থাকে তেমন। খিলখিল করে হেসে উঠল আর্য। তার হাতে চিমটি কেটে লক্সমি রুগ্ন কন্ঠে বলল,”এভাবে বোকার মত হাসছো কেন?”
“না হেসে পারা যাচ্ছে না। এমনিতে প্রথমে খেতে দিল সামান্য কিছু। আমাদের পুজো বাড়িতে প্রসাদ তোমাদের বিয়ে বাড়ির খাবার থেকে অনেক বেশি দেয়। আবার এগুলো কি দিয়েছে নারকেল পান….।”
হাসতে রইল আর্য।
“বাড়িতে গিয়ে যত খুশি হাসো। এখন আর এত মানুষের সামনে হাসতে হবে না।” বরযাত্রী চলে আসায় সবাই ওখানে ছুটে চলে গেল। মুহুর্তের মধ্যে জায়গাটি ফাঁকা হলো। লক্সমিও আর্যকে টেনে টেনে বরযাত্রী দেখতে নিয়ে গেল।

চেয়ারে বসে বারবার ঘুমে ঢলে পড়ছে আর্য। খিদের চোটে পেটে ইন্দুর লাফাচ্ছে। বিয়ে শুরু হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজন সবাই বিয়ে মন্ডপের আশেপাশে উপস্থিত রয়েছে। গভীররাত, দু-একটা বাচ্চা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বর কনের মতো বাচ্চা ছেলে মেয়েদের অনুপস্থিতি যেন বিয়েতে কোনো কিছুর একটা অভাব দেখা দেয়। আর্য যখন সীমাহীনভাবে ঘুমে ঢলে পড়ছে লক্সমি ঠিক তখনই তার পিঠে চিমটি কেটে তার ঘুম বিচলিত করছে। তারপর একা একা হেসে উঠছে।
“তুমি আমায় বিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছো না পিঠে চিমটি কাটতে নিয়ে এসেছো? সঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতো। আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।” আধো আধো ঘুমে আর্যর নরম কণ্ঠস্বর লক্সমিকে উতলা করে তুলল। ঘুম জড়ানো মুখমন্ডলে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে আর্যকে। হাত সামনের দিকে দেখিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,”ওইদিকে দেখো বেশ কয়েকটা বাচ্চা এখনো জেগে আছে। আর তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো।” আর্য মুখ তুলে বাচ্চাগুলোকে দেখল। সোজা হয়ে বসলো। বলল,”খিদে পেয়েছে আমার।”
“আবার!”
“দুবার তো খাইনি। এক বারই খিয়েছিলাম। সত্যি সত্যি বড্ড খিদে পাচ্ছে।”
“মজা করছো? তোমায় এমনি খেতে বললে তো খাওনা। আর আজকে খাবার নেই দেখে খিদে পাচ্ছে।” চরম সত্য কথা আর্য কিছুতেই লক্সমিকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। একটু বিরক্ত বোধ করলো। আরষ্ট মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,”এমন সময় মজা করতে যাব কোন দুঃখে? তুমি একজন ডাক্তার তোমার বোঝা উচিত। দিনও বারো ঘন্টা হয়, রাতও বারো ঘন্টা হয়। দিনের বেলা তিন থেকে চারবার খাই। আর রাতের বেলা মাত্র একবার। রাতের খাবার একটু বেশি খেতে হয়। রাতে বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়ে কাটাই তাই খাবারের অতটা প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আজ জেগে রয়েছি খাবার তো দরকার।” লক্সমি এবার নড়েচড়ে বসল। আর্যর যুক্তিপূর্ণ কথা ভাবলো। বুঝলো, সে মিথ্যা কথা বলছে না। খিদে পেয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খাবার কোথায় পাবে? রাত একটার বেশি হয়ে গেছে। কোনো দোকান নিশ্চয়ই খোলা নেই। আর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলল,”কিন্তু এখন তো কোনো দোকানও খোলা নেই। তোমায় কি খেতে দেবো বলতো!” পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল আর্য। পেটের খিদে চেপে রাখলো। লক্সমি উপায় খোঁজার চেষ্টা করল। অনেক ভাবার পর একটা উপায় বের করল। হাসিমুখে বলল,”স্টেশনে যাবে? ওখানে তো সারারাত ধরে প্যাসেঞ্জারের আসা-যাওয়া চলতে থাকে। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো খাবার দোকান খোলা আছে।” পেটের খিদে এতটা জোরালো যে আর্য একবারের জন্যও বারণ করল না। সঙ্গে সঙ্গে যেতে রাজি হলো। বিয়ে বাড়ি ফেলে গভীর রাতে এক যুবক-যুবতী বেরিয়ে গেল বাইরে। স্কুটারে স্টার্ট দিল লম্বা জার্নির জন্য। রাতের জ্যোৎস্না আলোকিত আকাশ। আশেপাশে রয়েছে শহরের কৃত্তিম আলো। সবকিছু ভেদ করে পৌঁছে গেল স্টেশনে। সারা রাস্তায় লোকের আনাগোনা দেখা না গেলেও স্টেশনে ঠিক লোকের আনাগোনা রয়েছে। লক্সমির ভাবনা ব্যর্থ গেল না। বেশ কয়েকটা খাবারের দোকান খোলা রয়েছে। একটা বাঙালি ধাবায় উঠল দুজন। মাছ আর ভাত নিয়ে বসলো। লক্সমি খেয়াল করলো আর্য বড্ড খুশি হয়েছে মাছ ভাত পেয়ে। অনেক দিন পর তাকে খুশি দেখে ভালো লাগলো। বিপরীত মানুষটার হাস্য উজ্জ্বল মুখ দেখতে ভালো লাগলো। একমুঠো ভাতও মুখে না তুলে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আর্য তা খেয়াল করতে পারল। তার খাবার অনেকখানি হয়ে গেলেও লক্সমি একটুও খাইনি। আর খেতে পারল না সে। কারোর খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর্যকে খেতে না দেখে লক্সমি বলল,”খাচ্ছো না কেন? খাওয়ার জন্য তো এত দূর ছুটে এলে। বিয়েটা দেখতে দিলে না। এখন বসে থাকলে হবে!”
“এ ভাবে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকলে কিভাবে খাব?” লক্সমি লজ্জা পেয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। খানিকক্ষণ মৌনতা রইল। একটু পর দুইজন আবার খাওয়া শুরু করলো। কিছুটা বিস্ময় কিছুটা কৌতুক সুরে লক্সমি বলল,”জানো আর্য, তোমায় দেখে মাঝেমধ্যে আমার কি মনে হয়?”
“কি?”
“মনে হয় তুমি আমার সন্তান। আর আমি মায়ের মত তোমায় আগলে রেখেছি। এই যে তুমি ছোট ছোট বায়না করো আর আমি সেগুলো পূরণ করে বড্ড খুশি হই। তোমার বায়না পূরণ করতে ভালো লাগে আমার।”
“হুশশশ, পেট ভরে খাও তো। এত রাতে বেশি ভাবতে হবে না।”
“হুম, খাচ্ছি তো।” আরও বেশ কিছুক্ষণ খাবার খাওয়ার পর আর্য লক্ষ করল লক্সমি খুব বেশি একটা খেতে পারেনি। সামান্য খাবার খেয়েছে। আর্য হেসে বলল,”তোমাদের ভালো খাবার সহ্য হবে না। তোমাদের জন্য ধোসা আর ইডলি কিংবা কোনো টক জাতীয় খাবারই ঠিক আছে।” লক্সমি জবাব দিল না। নিরব রইল। ধাবা থেকে বেরিয়ে আসার পর কোনো কারণবশত লক্সমির পোশাকে মুগ্ধ হয়ে উঠলো আর্য। টুকটুকে শ্বেত বর্ণ গায়ের রংয়ের সঙ্গে গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা বেশ মিশে গেছে। দু-হাত ভর্তি চুড়ি, হালকা লিপস্টিক,কপালে ছোট্ট চন্দনের ফোটা, মাথাভর্তি ফুল দেখতে বেশ ভালো লাগছে। কাছে গিয়ে বলল,”তোমার এই পোশাকটা দুর্দান্ত লাগছে। আগেরগুলো থেকে এটা বহুগুণ ভালো। এটা অবশ্য মোটা তবুও ভালো।”
“আজকেই শুধু ভালো লাগলো। এর আগের গুলো ভালো লাগেনি? এই যে আমরা মেয়েরা এত পোশাক পরে সাজুগুজু করি কাদের জন্য? কাছের মানুষগুলোর জন্য। দেখবে তো একটু। তুমি তো কোনোদিনই দেখলেই না। এভাবে যদি না দেখো তাহলে কি আর আমরা নতুন পোশাক কিনবো? দোকানদার গুলো অনাহারে মরবে তো।” টুক করে হেসে ফেললো আর্য। লক্সমির কথাগুলো মজা হিসেবে নিল। আবার বিয়ে বাড়িতে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিল। অনেকটা পথ আসার পর থেমে গেল লক্সমি। তাকে থামতে দেখে আর্য জিজ্ঞেস করল,”কি হলো থামলে কেন?” লক্সমি কোনো জবাব না দিয়ে স্কুটার এক পাশে রাখল। তারপর রাস্তার মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরল। সম্পূর্ণ ফাঁকা রাস্তা।একটাও নর মানুষের চিহ্ন নেই।নিঝুম রাত। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে ভেসে আসছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোর খুব কাছে নাম-না-জানা অসংখ্য পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে। মিটমিটে আলো জ্বালিয়ে এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে বহুদূরে।আর্য আর কোনো কথা বলল না। বুঝতে পেরে গেল এমন সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছে।

শূন্য শূন্য বলে লাভ কি হবে?
মুহূর্ত তো রয়েছে শূন্যের সঙ্গী হয়ে।
শূন্য হবে পর যদি বাঁধো মুহূর্তের ঘর।
মুহূর্ত হয় না কখনো পর, যদি
মুহূর্তের মধ্যে থাকে না লোভ লালসার
কোনো ছল।
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে লক্সমি বলল,”ভাগ্যিস তোমার খিদে পেয়েছিল। তাই, এত সুন্দর একটা পরিবেশ অনুভব করলাম। নাহলে মিস করতাম। গভীর রাতের নিঝুম নিস্তব্ধ শহর যে এত সুন্দর হয় তা জানা ছিল না।”
“ঠিক বলেছো। আসলে কি জানো, লক্সমি? মানুষের জীবনে মাঝেমধ্যে এমন মুহূর্ত ভীষন প্রয়োজন।সব সময় অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে নয় মাঝে মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ একা ভাবে এই মাতাল রাতে বিলিয়ে দেওয়া উচিত। অন্তত তাতে এই পৃথিবীকে নতুন করে চিনতে পারবে। এই মুহূর্তগুলো কখনো মরবে না। আজীবন অমর হয়ে যাবে। এই যে তুমি আর সোয়াতি কত ভালো বন্ধু। একে অন্যকে ছাড়া চলে না।কত মুহূর্ত রয়েছে দুজনের মধ্যে। কিন্তু দেখবে কালকের পর থেকে তোমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়বে। তুমি যতই অস্বীকার করো কিংবা সম্পর্ক অটুট রাখার চেষ্টা করো না কেন,দেখবে,একটা দূরত্ব তৈরি হবেই। আর আমি যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাব। তখন আমাদের মধ্যেও বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আস্তে আস্তে মলিন হয়ে উঠবে।সবকিছু মলিন হয়ে গেলেও এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলো কখনো মলিন হবে না। এগুলো আজীবন থেকে যাবে। জীবনের চাইতে যদি কোনো দামি জিনিস থাকে তা হল মুহূর্ত।”

পর্ব ২৯ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here