কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব ৩০শেষ পর্ব

0
1874

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৩০ (অন্তিম পর্ব)
___________________
নিজের ব্যাগ পত্র গোছাতে গোছাতে ফোন বেজে ওঠায় একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলো আর্য। স্ক্রিনে লক্সমির নাম দেখে মুচকি হাসি হেসে ফোনটা ধরল। তারপর তাকে উপরে চলে আসতে বলে আবার সমস্ত জিনিস পত্র গোছাতে শুরু করলো। বেশ কয়েকবার তার রুমে প্রবেশ করায় পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তাই উপরে উঠতে অসুবিধা হলো না। নির্বিধায় দরজার সামনে পৌঁছে হাত চাপড়ে দরজা খোলার ইঙ্গিত করল। আর্য দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে গেল লক্সমিকে। টুলের উপর বসে পড়ল। আশ্চর্য হল সমস্ত জিনিস এলোমেলো দেখে। আর্যর সঙ্গে যত দিন পরিচয় হয়েছে তাকে কখনো অগোছালো দেখেনি। জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কেন বুঝতে পারল না। একটু খেয়াল করতেই বুঝল, আর্য নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছে। অতি আগ্রহে প্রশ্ন না করে পারল না।
“সমস্ত কিছু গুছিয়ে ফেলেছো কেন? কোথাও যাওয়ার আছে নাকি?”
“এই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে লক্সমি। বাড়ি বিক্রি করে আন্টি নিজের সন্তানের কাছে ফিরে যাবেন। ওনার বয়স হয়েছে আর কাজ করতে পারেন না।”
“সেকি! বাড়ি বিক্রি করবে বললেই হলো নাকি! তুমি তো আগে থেকে এগ্রিমেন্টে নিয়ে রেখেছো। এখন কোথায় বাড়ি খুঁজবে? তোমার রুমমেট তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? সে কি করবে?” লক্সমিকে উত্তেজিত দেখে হাসলো আর্য। জিনিসপত্র ফেলে রেখে বিছানার উপর বসল। তার দিকে তাকিয়ে বলল,”জিমি কলেজে গেছে। সে কি করবে জানি না। তবে আন্টি নিজের কথার খেলাপ করেননি।আমি দ্বিতীয়বার চার বছরের জন্য এগ্রিমেন্টে নিয়েছিলাম আর তা অনেক আগে সমাপ্ত হয়ে গেছে। আমি এখানে পাঁচটা বছর থাকতে এসেছিলাম কিন্তু দশটা বছর কাটিয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছে সেদিন এসেছিলাম।”
“ওইসব কথা বাদ দাও। নতুন বাড়ি খুঁজে পেয়েছো তো? নতুন বাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে থাকবে চলো। কোনো অসুবিধা হবে না।”
“এত চিন্তা করছো কেন? আমি বাড়ি খোঁজার কোনো চেষ্টাই করিনি। আমি নিজের বাড়ি ফিরে যাব।” লক্সমি স্থির চোখে আর্যর দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। আর্যর একটা কথাই লক্সমির হৃদয়ের সমস্ত উথাল পাথাল ঢেউ গুলো স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখ কালো করে ফেলল। সে মুখ ফুটে কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই আর্য হেসে ফেললো। সে কি বলবে আর্য তা জানে। আর্য কলেজের ছাত্র থাকাকালীন লক্সমিকে বার বার বলেছিল তার জীবনের স্বপ্নের কথা। শুধু ডাক্তার নয়, বিদেশে গিয়ে বড় বড় ইউনিভারসিটিতে রিসার্চ করতে চায়। সকলের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছিল। সে সফল হয়েছে। বেশ কয়েকদিন আগে ইংল্যান্ড থেকে ডাক পড়েছে আর্যর। একটা ইউনিভার্সিটি নয় অনেকগুলো ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক পড়েছে। শুধু বিদেশ নয় নিজের দেশের বিভিন্ন রিসার্চ কেন্দ্র থেকে সাড়া মিলেছে। অনেক মেইল এসেছে। সবকিছুই জানে লক্সমি। আর্যকে হাসতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। কথা বলতে পারল না।
“হাসলে কেন?”
“তেমন কিছু নয়। তুমি কি বলতে যাচ্ছিলে তা জানি।”
“কি বলতাম?” গম্ভীর কণ্ঠে বলল লক্সমি।
“তুমিই বলে ফেলো?” অদ্ভুতভাবে মুখ প্যাঁচালো সে। হেসে ফেললো আর্য। বলল,”কি বলতে চাইছিলে বলো? আর হাসবো না।” লক্সমি মুখ ফুটে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু আর্যর চোখে চোখ পড়তেই হেসে উঠলো। হঠাৎ করে কি হচ্ছে বুঝতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজেকে শান্ত করল। তারপর ধীরে সুস্থে বলল,”তুমি না স্বপ্ন দেখতে মেডিক্যাল নিয়ে রিসার্চ করবে। অনেক বড় একজন সাইন্টিস হবে। তাহলে আজকে কেন সবকিছু ছেড়ে বাড়ি পালিয়ে যাচ্ছো? বিদেশে যাবে না? নিজের স্বপ্নের কথা ভাববে না?”
“আমি অনেক কিছুই ভেবেছি। কিন্তু আমার মনে হলো আমার বাড়ি ফিরে যাওয়াটাই শ্রেয়। জীবনে হয়তো বড় ডাক্তার হওয়া আমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তার চাইতে বড় স্বপ্ন ছিল আমি সারাজীবন আমার বাবা-মাকে আগলে রাখবো। বৃদ্ধ অবস্থায় তাদেরকে কখনো কষ্ট পেতে দেব না। আজকে আমি এত বড় জায়গায় পৌঁছেছি কাদের জন্য? যারা রাতদিন এক করে পরিশ্রম করে গেছেন শুধুমাত্র তাদের জন্য। আর আমি তাদেরকে অন্যের কাছে রেখে দিয়ে বিদেশে পড়ে থাকবো। সুখে জীবন যাপন করব। পারবো না। দশটা বছর নিজের পরিবারকে ছেড়ে কতটা কষ্টে কাটিয়েছি তোমায় বুঝিয়ে বলতে পারবো না। আর ইচ্ছে করছে না বাইরে থাকতে। আমার বাবা ছোটবেলায় সবসময় বলতেন, বড় হলে কখনো আমাদের ছেড়ে চলে যাস না। বৃদ্ধ হয়ে গেলে মানুষ নিজের সন্তান-সন্ততিদের খোঁজে। তাদের সঙ্গে গল্প করতে চায়। আর আমি আমার বাবা মার জন্য এইটুকু করতে পারব না? আমি এতটা অকৃতজ্ঞ নই।” আর্য কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। লক্সমি টুল ছেড়ে উঠে গিয়ে তার পাশে বসলো। সান্ত্বনা দিলো। তারপর বলল,”তাহলে তোমার এত দিনের পরিশ্রমের কি হবে? এতদূর পড়েই বা কি করবে?”
“পড়াশুনা কখনো বৃথা যায় না লক্সমি। আমাদের গ্রামে কত দিন-দুঃখী মানুষ রয়েছে। তাদের কোনো বড় অসুখ হলে তারা অসুখের চিকিৎসা করে উঠতে পারে না মৃত্যুটাকে বেছে নেয়। আমি না হয় তাদের চিকিৎসা করব। সবাই যদি আমার মত শিক্ষিত গর্ধবরা বিদেশে চলে যায় টাকার লোভে, তাহলে দেশের মানুষের সেবা কে করবে? আমি না হয় শিক্ষিত গর্ধবের মধ্যে একটু ভালো হয়ে নিজের দেশে থেকে গেলাম।” আর্যর কথা শুনে লক্সমি ফিক করে হেসে ফেললো।
“কথার ফাঁকে ফাঁকে গালি দিচ্ছ?”
“কাউকে গালি দিচ্ছি না। এটাই সত্য।”
অনেকক্ষণ নিরব রইল। আর্য উঠে পড়ল। মগ থেকে জল গড়িয়ে খেলো।
“জানো লক্সমি, আমার কাকু কাকিমা সেই বিয়ে থেকেই পুত্র সন্তান কামনা করে এসেছেন। কিন্তু ভগবানের কেমন লীলা দেখো, তাঁরা পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। আমার কাছে তাঁরা সব সময় একটা আবদার করছেন….। বলতেন,’আমাদের তো কোনো পুত্র সন্তান নেই। তুই আমার ছেলের মত। আমাদেরকে বৃদ্ধ অবস্থায় একটু দেখবি। ফেলে দিবি না।’ আমি তাদের বোঝাতাম, মেয়েরা কোনো অংশে কম নয়। মেয়েরাও তোমার ছেলের মতো। কিন্তু কখনো শোনেনি। মনের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস এখনো রয়েছে। আমি সেই সমস্ত মানুষ গুলোকে ছেড়ে বিদেশে কি করে পড়ে থাকবো বলো? বাবা যবে থেকে শুনেছে স্নেহার বিয়ে হয়ে গেছে তবে থেকে ভেঙে পড়েছেন। এখন আদৌ মাঠে যেতে পারেন না। সারাদিন বাড়িতে থাকেন। তিনি ভাবেন, স্নেহাকে ভালোবেসে কাছে না পেয়ে আমি সুখি নই। আমার কষ্ট হচ্ছে। সন্তানের কষ্টে ব্যথা পাচ্ছেন বাবা। বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে তোমার সন্তান ভালোই আছে। যেমন বাবা চান, তার সন্তান সুখে থাকুক ভালো থাকুক,আমিও তো চাই আমার বাবা ভালো থাকুক সুখে থাকুক। তাদের সুখের জন্য আমাকে এইটুকু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।” কিছুটা থেমে আবার বলল,”ছোটবেলায় একটা সম্পর্কের টানাপোড়েনে আমি মার থেকে অনেক দূরে চলে যাই। পিসির কাছে বড় হয়েছি। মার মধ্যে মান অভিমান জমতে থাকে। ওই মান অভিমান থেকে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। মা ঠিকমত কথা বলতেন না। আমি যদি কোনোদিন মাকে জড়িয়ে ধরে একটু কেঁদে ফেলতাম তাহলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তা আমি করিনি। কিন্তু মা ঠিক পেরেছেন। কদিন আগে তিনি ফোন করে বললেন, চলে আয় না রে বাবা। আর একা থাকতে ভালো লাগছে না। বাড়ির ছেলে দশ বছর ধরে বাইরে পড়ে রয়েছে। আর কত বছর থাকবি? বাড়িতে যা জমি জায়গা রয়েছে ওইগুলোতে সঠিক পরিশ্রম করলে খাবারের অভাব হবে না। তোকে চাকরি করতে হবে না। বোন ফোন ধরে সেও কাঁদে। তারও একটা কথা, দাদা বাড়ি ফিরে আয়। এবার তুমি বলো আমার কি করা উচিত?” লক্সমি কোনো সাড়া দিল না। তাদের সুখী পরিবারের সদস্যদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে নিজের চোখ দিয়ে কখন জল গড়িয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। এমন একটা পরিবার থাকলে পৃথিবীর আর কোনো কিছুই প্রয়োজন হয় না। তার চোখের জল জমা হয়েছে -বেশ বুঝতে পারল আর্য। কিছু বলল না। লক্সমি তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,”তোমার সিংহাসন তোমার পরিবারে রয়েছে। তুমি ওখানে ফিরে যাও। তুমি খুব লাকি আর্য। আজ থেকে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, পৃথিবীর প্রত্যেকটা সন্তান যেন তোমার মত হয়। তাতে অত্যন্ত দেশে বৃদ্ধাশ্রম থাকবে না।”
“তুমি ভগবানের কাছে ভুল চাইলে। এমনটা চাইবে না। যদি এমনটা সত্যি হয় তাহলে অনেক বাবা-মা না খেয়ে অনাহারে মরবে।”
“ও মা। বাবা-মা খেতে পারবে না কেন?”
“দেখো, সবাই যদি পড়াশোনা করে নিজের নিজের গ্রামে ফিরে যায় তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অতটা বেশি উন্নত হবে না। কিছু ছেলে মেয়ে পড়াশোনার পর বিদেশে চাকরি করে আর তাদের বাবা-মাকে বাড়িতে রেখে দিয়ে যায়। তাদের বাবা মাকে কোনো দরিদ্র পরিবারের সন্তান দেখাশোনা করে। তাদেরকে দেখাশুনা করে যে টুকু টাকা পায় তা দিয়ে তারা সংসার চালায়। সবাই যদি নিজের বাবা-মাকে দেখাশোনা করে, তাহলে ওই দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা কাজ হারাবে। তখন তারা তাদের বাবা-মাকে কী খাওয়াবে? সমাজের সমস্ত কিছুরই প্রয়োজন রয়েছে, -কোনটা একটু বেশি আর কোনটা একটু কম। বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেশে রেখে সন্তান সন্ততি বিদেশে থাকলে অন্যায় করে না। অন্যায় তারা করে, যারা বাবা-মাকে দেশে রেখে দিয়ে গিয়ে ভুলে যায়। তাদের কথা মনে পড়ে না। দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না। বিদেশে থেকে নিজের দেশকে গালি দেয়। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চাইতে কোনো ইম্পর্টেন্ট মিটিং তাদের কাছে ইম্পর্টেন্ট হয়ে যায়। যারা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ছোট ছোট আবদার গুলোতে বিরক্ত হয়। তাদেরকে বোঝা মনে হয়।”
“তুমি তো দেখছি আমার সমস্ত কথাকে যুক্তি দিয়ে হারিয়ে দিচ্ছ। আমার কোনো কথা তাহলে সঠিক নয়?”
আর্য বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে বসতে বসতে বলল,”না না, তোমার কথা ভুল তা বলছি না। এগুলো শুধুমাত্র আমার মনের ভাব তোমার সামনে প্রকাশ করলাম। আমার মনের ভাব সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা নয়।”
পা মুড়ে বসে আর্য জিনিসপত্রের দিকে তাকালো। সেগুলো একটু একটু করে গোছালো। তারপর শান্ত মাথায় বলল,”আমার বাবা যখন প্রথম এখানে আমায় ছাড়তে এসেছিলেন তখন একটা পুরনো কয়েন দিয়ে গেছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বের টাকা যার মূল্য এখন অনেক। তুমি তো আবার পুলিশের মেয়ে। সব সত্যি জানার পর আমায় ধরিয়ে দেবে না তো?”
কথা থামিয়ে হেসে ফেললো আর্য। লক্সমি বলল,”অন্যায় করলে অবশ্যই ধরিয়ে দেব।”
“তাহলে থাক বলবো না।”
“বলতো? কাউকে কিছু বলব না।”
“আমার কাছে পুরনো যুগের একটা কয়েন রয়েছে। যেটা আমার বাবা আমায় দিয়েছেন। ওই কয়েনের মাধ্যমে আমার বাবা আমাকে একটা জিনিস বুঝিয়েছেন। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ কথাটা নিশ্চয়ই তোমার কাছে অজানা নয়। জীবনে পুরনো সব কিছুই সুন্দর। পুরনো খারাপ কোনো ঘটনা;কিংবা খারাপ কোনো জিনিসও সুন্দর। আজ কত শহরে কত বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে কিন্তু ওইগুলোতে সারা বছর থেকে যত না সুখ পাবে, এক ঘন্টা মাটির বাড়িতে থেকে তার চাইতে অনেক বেশি সুখ পাবে। তোমার জীবনে অনেক বন্ধু এসেছে অনেক পরিচিতি মানুষ এসেছে, ওদের কাছে থেকে তুমি যতটা সুখ পেয়েছো তা কম নয়। কিন্তু এই বয়সে একবার মায়ের কোলে গিয়ে বসলে বুঝে যাবে কোনটা বেশি সুন্দর। এই আধুনিক যুগে কত নতুন রকমের খাবার বেরিয়েছে কিন্তু একবার পান্তা ভাত খেয়ে দেখবে মন্দ হবে না। পুরোনো জিনিস গুলো একটু বেশি প্রিয় হয়। বর্তমানে নতুন জিনিস গুলো যে খারাপ তা নয়, তবে পুরনো মত অতটা সুন্দর হতে পারে না।”
আর্য নিজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বক্তব্যের মাধ্যমে কি বোঝাতে চাইছে লাক্সমি সব বুঝতে পারল। নিজের বিচক্ষনতা দিয়ে সবকিছু বিচার করল। টুল ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ওর সঙ্গে বসে গল্প করতে মন সায় দিচ্ছে। থাকুক না এমনটা সারা জীবন। এভাবে না হয় গল্প করে কাটিয়ে ফেলবে দুপুর থেকে বিকেল। এইতো কয়েকদিন আগে একজন পুরুষ মানুষের রুমে থাকতে কেমন একটা লাগছিল। কিন্তু আজ কিচ্ছু মনে হচ্ছে না। থাকতে ভালো লাগছে। আরও অনেকক্ষণ বসে গল্প করল। আর্য এই শহর ছেড়ে চলে যাবে, এই নিয়ে ততটা দুঃখী নয় সে। ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। দীর্ঘসময় গল্প করায় ফাঁকে ফাঁকে কখন আর্যর কাজে হাত লাগিয়ে ফেলেছে বুঝতে পারেনি লক্সমি। একজন কাজ করছে আর সে বসে থাকতে পারে না। এমনিতেই প্রচণ্ড পরিশ্রমী মেয়ে তার উপর আর্য তো নিজের মনের মানুষ। তাকে সাহায্য করতে শুরু করেছে। কিছুটা সময় পর আর্য আবার বলল,”তুমি একবার চোখ বন্ধ করো।”
“কেন?”
“করবে তো।” হাতে ধরা বই টা পাশে রেখে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে হেসে ফেললো। চুপচাপ চোখ বন্ধ করতে পারল না। সময় লাগলো স্থির হতে। লক্সমি স্থির হতেই আর্য বলল,”এবার কল্পনা করো তুমি এক মাসের মধ্যেই মারা যাচ্ছ। মারা যাওয়ার পর তুমি কেমন থাকবে ভাবো? গভীরভাবে চিন্তা করো। তোমার আশেপাশে কি রয়েছে সবকিছু ভুলে গভীরভাবে মৃত্যুটাই চিন্তা করো।” বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবে চোখ বন্ধ করার পর চোখ থেকে আপনাআপনি জল গড়িয়ে পরলো। ভয়ে আঁতকে উঠল লক্সমি। চোখ খুলে ফেলল।
“কি হলো? চোখ খুলে ফেললে কেন?”
“কেমন একটা ভয় করছে। সবকিছু অন্ধকার লাগছে। মৃত্যুর পর মনে হচ্ছে পৃথিবী বলেও কিছু নেই। সবটা শূন্য।”
“তোমায় শুধু কল্পনা করতে বলেছি, তাতেই এতটা ভয় পেলে।কিন্তু একজন বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা জীবনের শেষ মুহূর্তে পৌঁছানোর পর সে নিশ্চিত হয়ে যায়, তাঁর মৃত্যু বেশি দিন বাকি নেই। তখন সে কতটা ভয় পায় বলতো? তাঁকে ওই বয়সে কখনও একা রাখা উচিত নয়। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে দিতে হবে। তবেই সে সুখে থাকবে। হাঁটাচলা করতে পারবে। কোনো কিছুতেই ভয় পাবে না। খুব সহজে মৃত্যু হবে না। আর মৃত্যু হলেও অনেক সুখের হবে। মৃত্যু যন্ত্রণা কি জিনিস বুঝতে পারবে না। শান্তিতে চলে যাবে। আমাদের বাবা-মা ছোটবেলায় আমাদের সুখে রাখার জন্য কত কিছুই না করে, আর আমরা তাদেরকে বার্ধক্য অবস্থায় সুখে রাখার জন্য এইটুকু করতে পারব না? পারবো না, তাঁদের শেষ বয়সে তাঁদের পাশে বসে তাঁদের অগোছালো কথা শুনতে!”
সমস্ত কিছু গোছানো শেষ হওয়ার পর আর্য উঠে দাঁড়ালো। মেঝেতে বসে রইল লক্সমি। আর্যর দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,”কবে ট্রেন রয়েছে?”
“পরশু দিন রাতে। আমায় প্ল্যাটফর্মে একটু পৌঁছে দেবে? এতগুলো ব্যাগ নিয়ে যেতে অসুবিধা হবে।”
“ওইগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব ঠিক করে দেবো।”
“জানতাম।” আর্য হেসে জবাব দিল। মুখটা আবার কালো করে ফেলল লক্সমি। অন্ধকার মুখে বলল,”না গেলে কি হয় না? থেকে যাও না এখানে? বাবা-মাকে এখানে নিয়ে চলে আসো। একসঙ্গে থাকতে আমার সঙ্গেও দেখা হতো। রোজ কত মজা হত বল।”
“তুমি আবার বাচ্চা কবে হলে? সব কিছু মনের মত হয় না লক্সমি।” লক্সমি নিরুত্তর রইল। জবাব দিল না। ভালো লাগছে না কিছুই। যখন থেকেই শুনেছে, আর্য নিজের বাড়ি ফিরে যাবে, তখন থেকেই হৃদয়ে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা শুরু হয়েছে। নিজের জীবনে এই ছেলেটিকে অনেকটা জড়িয়ে ফেলেছে। উঠতে-বসতে ছেলেটিকে নিয়ে স্মৃতি গড়ে ফেলেছে। সবকিছু কি ভোলা যায়? একটা নয় দুটো নয় দশ দশটা বছর এই ছেলের সঙ্গে কাটিয়েছে। অথচ দুটো দিনের পর কে কোথায় থাকবে তা কেউই জানে না।কখন কি করবে কেউ বলতে পারবে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজেকে একা মনে হচ্ছে। অগোছালো জীবনে কেউ একটা এসেছিল। তাকে খুশি করেছিল। সুখ দিয়েছিল। নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিল। তার বিদায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিভাবে তার জীবনে জড়িয়ে গেছে জানে না। তবুও মন পাগলের মত হতে থাকলো। বেশিক্ষণ রুমের মধ্যে থাকলো না। দু’চারটা কথা বলে নিজের বাড়ি ফিরে আসলো। তারপরে একটা দিন কেমন ভাবে কাটালো নিজেও বুঝতে পারল না। সবকিছু শূন্য শূন্য অনুভব করছে। সব কিছু যেনো হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রীষ্মে ধুধু মাঠে খোলা বাতাসের মত একা লাগছে। কেউ নেই। সবটাই শূন্য। সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে।

আন্টিকে প্রণাম করতেই তিনি কেঁদে ফেললেন। আর্যকে বুকে জড়িয়ে ফেললেন। কপালে চুমু খেলেন। আন্টির জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে আর্য। যারা এখানে এসে থেকেছে তারা বেশিরভাগই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে প্রথম কলেজের শুরুতে। তাদের মধ্যে ছেলেমানুষিকতা বেশিই ছিল। আন্টি বাড়িওয়ালা ছিলেন, নিজের স্বার্থের কথা একটু বেশি ভেবেছেন, তবুও অবজ্ঞা করতে পারেননি। শাসন করেছেন, বকুনি দিয়েছেন। আবার কখনো রেগে অনেককে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। জীবনের অনেক মুহূর্তে খুব কঠোর হতে হয়। তিনিও তাই হয়েছেন। সেই ছেলেগুলো কখন নিজের জীবনে জড়িয়ে গেছে ঠিক বুঝতে পারেননি। আর্য যেন একটু বেশি তাঁর জীবনকে দুলিয়ে দিয়েছে। আর্যর মত কেউ এতগুলো বছর এখানে থাকেনি। একটু বেশি মায়া পড়ে গেছে তার ওপর। অজান্তেই আর্যর চোখেও জল জমলো। নিজেকে সামলানোর জন্য তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়ার চেষ্টা করল। আন্টিকে শেষ মাসের ভাড়া দিল। কিন্তু তিনি কিছুতেই নিলেন না। হাত কাঁপছে। আর্য বেশি জোর করলো না। তিনি খুশি হয়ে একটা মাসের টাকা উপহার দিচ্ছেন, আর সেই উপহার কি করে ফিরিয়ে দিতে পারে? হাসিমুখে গ্রহণ করল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল জিমি বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো কথা বলছে না। হাত নাড়িয়ে টা টা করল। স্কুটারে বসে মসৃণ রাস্তায় গাড়ি গড়িয়ে গেল। কিছুটা যাওয়ার পর আর্য পিছনে ঘুরে দেখল, আন্টি মুখে আঁচল চাপিয়ে ভীষণ কাঁদছেন। আর্য কিছু করতে পারল না। চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে চুপ করে গেল। বুকে কিছু একটার অভাবে হাহাকার করছে। এই শহরের প্রতিটি কোণ তার চেনা। প্রতিটা মানুষের কথাবার্তার ধরন সংস্কার ঐতিহ্য সবকিছু জেনে গেছে। প্রতিদিনের পরিচিত মুখ গাছপালা ঘরবাড়ি গুলো আর দেখতে পাবে না। কারোর সাথে মন ভরে কর্নাটকা ভাষায় কথা বলতে পারবে না। চেনা রাস্তাগুলো আর হাঁটা হবে না। চেনা দোকানগুলোর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রিয় খাবার গুলো আর খাওয়া হবে না।
প্লাটফর্মে ট্রেন পৌঁছতে আরও অনেকটা সময় বাকি। লক্সমি এবং আর্য পাশাপাশি কিছুক্ষণ ধরে বসে রয়েছে। কেউ কারোর দিকে তাকাতে পারছে না। তাকালেই বুকটা কেমন করে ওঠে। নিস্তব্দে যাত্রী এবং কুলিদের কোলাহল দেখছে। মাঝেমধ্যে কিছু ট্রেন আসছে, কিছু যাত্রী নামছে আর কিছু যাত্রী ট্রেনে উঠে চলে যাচ্ছে দূর-দূরান্তে। সামান্য কিছুক্ষণ পর বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে লম্বা হাই তুলল আর্য। এইভাবে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগছে না। মনটা ভালো নেই। চেনা-পরিচিত বহু মানুষকে ছেড়ে যেতে ভালো লাগছে না। প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিন এই শহরকে ততটা পছন্দ হয়েছিল না। অথচ আজ এই শহরকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূতি হচ্ছে। কত মানুষ জীবনে কত সুন্দর ভাবে জড়িয়ে গেছে। তাদেরকে ছেড়ে যেতে একটু তো কষ্ট হবেই। লক্সমির দিকে তাকালো। লক্সমি সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর্য পাশে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়ল। তার কাঁধে উপর হাত রাখল। লক্সমি এই প্রথম দেখলো আর্য তার কাঁধে হাত রেখেছে। উতলা হয়ে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছে না। তার দিকে তাকিয়ে চাপা আনন্দের হাসি হেসে ফেললো। আর্য মৃদু কণ্ঠে বলল,”মনে পড়বে আমায়? ভুলে যাবে না তো এই ছোট ভাইটাকে? মাঝেমধ্যে ফোন করে খোঁজ নেবে তো?”
“কখনো ভুলবো না তোমায়। আমার জীবনে তুমি কতটা জড়িয়ে গেছো তুমি কখনও বুঝবে না…।” থেমে গেল লক্সমি। টপটপ করে চোখ থেকে জল ঝরে পরলো। আর্য বাম হাত দিয়ে লক্সমির চোখের জল মুছে দিল। বলল,”কাঁদে না পাগলি। সবাইকে একদিন নিজের গন্তব্যে ফিরতে হয়। জীবনে অনেকের সঙ্গে স্মৃতি তৈরি হয়ে যায় তবে সব সময় কাছে থাকা হয় না। এটাই জীবন। যখন মিনাজ বাড়ি ফিরে গেছিল তখন অজান্তেই আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে ছিল। চোখের জল এসেছিল কেন তার সঠিক কারণ বলতে পারবো না। আজ তোমারও তাই হচ্ছে। দেখবে কয়েকটা দিনের পর সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ যেখানে বেশিদিন থাকে ওই স্থানের সঙ্গে নিজের একটা আত্নিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। মানুষকে যদি জেলে রাখা হয় না,সে ওই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিবে। যখন জেল থেকে ফিরে আসবে তখন জেলকে মিস করবে। ওই জায়গার সাথে এক অদ্ভুত ভাবে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।” আর্য থামল। লক্সমি জবাব না দিয়ে ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল। স্তব্ধতা ভেঙ্গে আর্য বলল,”আমি খুব কম মহিলা দেখেছি যারা তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত রয়েছে। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভেবেছে। তুমি তার মধ্যে একজন। তোমার ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগে। কিন্তু আর কতদিন একা থাকবে। জানি না তোমার কোনো প্রেমিক আছে কিনা। যদি থেকে থাকে ভালো। যদি না থেকে থাকে তাহলে বাবা-মা এবং তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নাও। সংসার করো। আর একা থেকো না।”
“তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে বিয়ে করবে, তাই না! তোমার তো আবার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। কতকিছুই আমায় বলেছো। আমায় বিয়েতে ইনভাইট করবে তো?” ম্লান হাসলো আর্য। একটা তাচ্ছিল্য ভাবও রয়েছে এই হাসির মধ্যে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“কি হলো? হাসলে কেন?”
“আমি আমার বিয়ের স্বপ্নটা অনেক আগেই ত্যাগ করেছি। আমার জন্ম হয়েছিল শুধুমাত্র একটা নারীর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। তাকে যখন পায়নি তখন অন্য কোনো নারীকেই চাই না। কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে চাই না।” আর্যর কথা শুনে চমকে উঠল লক্সমি। বিয়ের মত একটা পবিত্র সম্পর্ককে অবৈধ বলছে সে। খারাপ লাগলো। তাড়াতাড়ি বলল,”কি সব বকছো? বিয়ের মত পবিত্র বন্ধনকে অবৈধ সম্পর্ক বলছো?” আর্য দাঁতে জিভ কাটল। বলল,”তুমি ভুল বুঝছো। বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্ককে অপমান করতে যাব কেন? কিন্তু আমি কাউকে মন থেকে ভালবাসতে পারব না। ভালোবাসার অভিনয় করবো। তাকে বুঝতে দেব না আমার ভালোবাসাটা মিথ্যা কিনা। সারা জীবন তাকে কাছে রেখে দেব। এটা কে তুমি কি সম্পর্ক বলবে?”
“একজন কে ভালবাসলে বুঝি আর কাউকে ভালোবাসা যায় না? নতুন করে কোনো কিছু তৈরি করা যায় না?”
“অবশ্যই করা যায়। ভালোবাসার সংজ্ঞা বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন। কেউ ভালোবেসে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। কেউ জামা পরিবর্তনের মত মানুষ পরিবর্তন করছে। কেউ ভালবাসার নামে শরীরকে উৎফুল্লতায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। আবার কেউ সারা জীবন প্রিয় মানুষের অপেক্ষায় থেকে যাচ্ছে। তুমি বলতে পারবে এদের মধ্যে কোনটি সত্য ভালোবাসা? সারা জীবন ধরে কোনো মানুষ কোনো একটি নির্দিষ্ট মানুষের জন্য অপেক্ষা করলেও অনেক সময় তার ভালোবাসা মিথ্যা হয়ে যায়। আবার অনেক সময় যে ব্যক্তি পুরনো মানুষটিকে ভুলে নতুন মানুষটাকে নিয়ে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করে তার ভালোবাসাটা অনেক সময় সত্য হয়ে যায়। সবার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা আলাদা হতে পারে কিন্তু ভালবাসার মধ্যে সম্মান বিশ্বাস শ্রদ্ধা এই তিনটি শব্দ যতক্ষণ পর্যন্ত না থাকছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভালোবাসা পূর্ণতা পাচ্ছে না। একজন মানুষ সারা জীবন প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করে আছে, আমরা তাকে দেখে বাহবা দিচ্ছি। বলছি,মানুষটা সত্যিই তার প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসে। কিন্তু তার মনের মধ্যে কি রয়েছে আমরা কি জানি? মানুষ লোক দেখানো অনেক কিছুই করতে পারে। মনের বিশুদ্ধতাই সত্য ভালোবাসা। মনে যদি বিশুদ্ধতা না থেকে থাকে তাহলে সে যতই অপেক্ষা করুক না কেন, তার ভালোবাসাটা মিথ্যা হিসেবে বিবেচনা হবে।” কথা বলতে বলতে বারবার আটকে গেল আর্য।কিছুটা নিস্তব্ধ হয়ে একটা ঢোক গিলে আবার বলল,”আমাদের সমাজে বহু মানুষ বলে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক ভেঙে গেলে ভোলা যায় কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে গেলে ভোলা যায় না। আমি এই কথাটা একদম বিশ্বাস করি না। যদি সত্যি কেউ কাউকে ভালোবেসে থাকে তাহলে তাকে কখনো ভোলা যায় না। হয়তো,পুরনো ভালোবাসার মানুষটির থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে নতুন মানুষটাকে ভালোবাসা যায়, ভালো থাকা যায়,সংসার করা যায় কিন্তু পুরনো মানুষটাকে ভোলা যায় না।”
“তুমি সত্যিই বিয়ে করবে না?” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল লক্সমি। আর্য মাথা নেড়ে না বলল। তারপর বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে পকেটের মধ্যে হাত পুরে তার দিকে মুখ করে বলল,”আমি কোনো মেয়েকে বিয়ে করে নিলাম। স্ত্রী বানিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলাম। অতীতের সমস্ত কথা তাকে বলে ফেললাম। সে মেনেও নিল। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কি রয়েছে সে কি কখনো জানতে পারবে? পারবে না। আর আমি মন থেকে কখনো স্নেহা ছাড়া অন্য কাউকে গ্রহণ করতে পারবো না। আমি যেখানে কাউকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারব না, সেখানে কেন তাকে জীবনে টেনে আনব? সে আমার ছোট ছোট আবদার যত্ন স্নেহ পেয়ে খুশি থাকবে। ভাববে তার স্বামী তাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু সত্যি কি তাই হবে? কিন্তু ওই মেয়েটা যদি আমায় বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করত তাহলে সে শুধুমাত্র দেখানো ভালোবাসা নয় সত্যিকারের ভালোবাসাটাও পেতো। আমার কৃতজ্ঞতায় সারাটা জীবন বেঁচে থাকবে না। কোনো অন্যায় না করে সারাজীবন ঠকে যাবে সে। আমি হয়তো নিজের স্ত্রীকে ফাঁকি দিতে পারি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে ফাঁকি দিতে পারি না। ওনার কাছে ঠিক ধরা পড়ে যাবো। সারা জীবন ধরে একটা নারীকে ঠকিয়ে যাবো, -সৃষ্টিকর্তা কি আমায় কখনো ক্ষমা করবেন? কাউকে সারা জীবন ধরে ঠকিয়ে যাওয়ার মত পাপ কাজ কি পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো বড় পাপ কাজ আছে? তোমরা আমায় বলো না, -আমি খুব শান্তশিষ্ট ধৈর্যশীল ভালো মানুষ। অন্যায় যেমন করি না তেমন সহ্যও করি না। তাহলে এত বড় একটা অন্যায় কি করে করতে পারি?”
লক্সমি নীরবে শুধু আর্যর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কি ভালোবাসা? জীবনে যে মানুষটা তার কথা একবারের জন্যও ভাবেনি আজ সে তার কথা ভেবে জীবনে একা থাকার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আর যুক্তি হিসেবে কত অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো যুক্তি সাজিয়েছি। এই যুক্তিকে কে হারাবে? তবুও লক্সমি বলল,”এই পৃথিবীতে বহু মানুষ তো একজনকে ভালোবাসার পর অন্যজনকে ভালোবাসে। তার সঙ্গে সুখে থাকে। তাহলে তারা কি সবাই দ্বিতীয় মানুষটাকে ঠকিয়ে যায়?”
“না,ঠকায় না। ভালবাসতে সাহস লাগে। তারা যদি সত্যিই মন থেকে দ্বিতীয় মানুষটিকে ভালবাসতে পারে তাহলে ঠকায় না। যদি মন থেকে না ভালোবাসতে পারে তাহলে অবশ্যই দ্বিতীয় মানুষটিকে তারা ঠকায়। আমার মত সাধারন এক মানুষের মন দিয়ে তো সবার মন বিচার করাটা বোকামি। একই বইয়ের যে অধ্যায় আমার কাছে সহজ লাগে তোমার কাছে কি তা সহজ লাগে? লাগে না। আবার উল্টোটাও হয়। আমারও যদি কোনোদিন মনে হয় আমি স্নেহা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারবো। তাহলে সেদিন অবশ্যই বিয়ে করব। কিন্তু এই কাজটি আমি কখনই পারব না। এটা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। সম্পূর্ণ অসম্ভব।”
“এখন না হয় তোমার বাবা-মা রয়েছে তাদের সঙ্গে হেসে খেলে দিন কাটিয়ে ফেললে; কিন্তু শেষ বয়সে কি করবে? তখন তো সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে।”
“আমার চারটে বোন রয়েছে একটা দিদি রয়েছে তাদের কাছে থাকবো।”
“যদি তারা তোমায় গ্রহণ না করে! তাহলে কি হবে?”
“আমার বাবা আমাকে সব দিক দিয়ে লড়াই করতে শিখিয়েছেন। আমি ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। ছোটবেলা থেকে পূজা-অর্চনা করতে পারি। শেষ বয়সে না হয় কোনো মন্দিরে কাটিয়ে দেবো। আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না।”
লক্সমি আর কোনো প্রশ্ন করল না। সমস্ত উত্তর পেয়ে গেছে। আর্য দুটো ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। আর দুটো ব্যাগ নিচে পড়ে রইল। লক্সমি দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হঠাৎ করে লক্সমির চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পরলো। কোনো বাধা আর মানলো না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,”আর কখনো আসবে না, এই শহরে?”
“না আসার সম্ভাবনাই প্রবল। তবে একবার আসবো?”
“কবে?”
“যখন তুমি বুড়ি হয়ে যাবে। মৃত্যুর অপেক্ষা করবে। তখন আমি ফলমূল আর হরলিক্স নিয়ে দেখা করতে আসবো। এই চেনা শহরের গন্ধ উপভোগ করব আবার নতুন করে সেদিন।” লক্সমি হেসে ফেললো। অদ্ভুত রহস্যময় রঙ্গে রাঙ্গিয়ে উঠল হৃদয়। চাপা আনন্দে একটু অভিমান প্রকাশ করে বলল,”তখন ভুলেও এসো না। তুমি সামনে থাকলে আমার প্রাণটা বের হবে না। থাকতে চাইবে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করবে…..।” শেষ কথাগুলো আর্যর কানে পৌঁছলো না। ট্রেন চলে আসায় কথার সুতো ছিঁড়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ পত্র নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল সে। তারপর লক্সমির দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল,”আমায় কিছু বলছিলে?”
“কিছু না পাগল প্রেমিক। সাবধানে বাড়ি যাও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আর তুমি বেশি ভারী পোশাক পরিও না। একটু হালকা পোশাক পরবে ভালো লাগবে।”
“আবার মেয়েদের পোশাক নিয়ে চর্চা শুরু করেছো?” হেসে ফেললো দুজন। লাল সিগন্যাল নীল হলো। ট্রেন ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম থেকে বের হতে লাগলো। তারপর সম্পূর্ণ বেরিয়ে গেল। হারিয়ে গেল দূর-দূরান্তে। চোখ থেকে জল মুছে নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিলো লক্সমি। খোলা আকাশের নিচে স্কুটার চালাতে চালাতে নিজেই নিজের মনকে বলল,”তুমি বলেছিলে না আর্য, যাকে ভালবাসবে তাকে ভালো রাখার দায়িত্বটাও নিতে হবে। সে তোমার না হলেও তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব টা তোমায় নিতে হবে। আমি না হয় তাই করলাম। তোমার প্রথম প্রেমের কাহিনী শুনেই বুঝে ছিলাম তুমি কখনো স্নেহাকে ভুলে যাবে না। তাই আর বেশি দূর পা বাড়ায়নি। সবটা যদি আমি তোমায় বলে দিতাম তাহলে তুমি সারাটা জীবন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে যেতে। তোমার মনে কোনো রকম সংকোচন তৈরি হোক আমি চাইনি। আমি যদি আমার মনের কথা বলে দিতাম তাহলে আমাদের যোগাযোগটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত। এত সুন্দর মুহূর্ত তৈরি হতো না। তুমি তো বলেছিলে, জীবনের চাইতেও দামী জিনিস মুহূর্ত। আমি দামি জিনিসকে গুরুত্ব দিয়ে কি অন্যায় করেছি? আজ তুমি চলে যাওয়ার পরও আমাদের যোগাযোগটা থেকে যাবে। সারা জীবন বেঁচে যাবে আমাদের সম্পর্ক। এবার নিশ্চয়ই ভাবছো, আমি কি করে তোমার মন বুঝলাম? মনে আছে, আমি একবার শরৎচন্দ্রের নাম উচ্চারণ করতে পারছিলাম না বলে কত হেসেছিলে তুমি। তিনি নাকি তোমার প্রিয় লেখক। তার নামের ভুল উচ্চারণ মানতে পারছিলে না। তিনি একটা কথা বলে গেছেন,’মানুষ মানুষের মন বুঝে অভিজ্ঞতা কিংবা সহানুভূতি দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে।’ বুঝতে পারলে তো আমি কি করে তোমার মন বুঝেছি।” লক্সমি নিজেই নিজেকে বলে হেসে ফেললো। আর্যর তার জীবনে আসার প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বহু স্মৃতি রয়েছে। স্মৃতিগুলো বড্ড প্রিয় তার। কাল থেকে জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু হবে। যে অধ্যায়ে প্রিয় মানুষটি অনেক দূরে থাকবে, তবে পর হয়ে নয়, আপন হয়ে। আর এখানেই লক্সমির ভালোবাসা জিতে যাবে। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না ঠিকই, তবে কিছু অপূর্ণতার মধ্যেও পূর্ণতা পায়।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল আর্যর। ট্রেন নিজেদের এলাকার সীমানায় চলে এসেছে। উৎফুল্লতায় ফেটে পড়ল সে। জানালা খুলে বাইরে চোখ রাখলো। কত দিনের পর নিজের গ্রামে ফিরছে। একটা আলাদা অনুভুতি হচ্ছে। আর কিছুটা পর অহনা নদীর ব্রিজ পার হবে। তারপর স্নেহার বাড়ি… নিজেদের ক্ষেতের জমি..। তারপর আবার দূরে চলে যাবে। যদি আশেপাশে কোনো স্টেশন থাকতো তাহলে আর অতদূর যেতে হতো না। এখানেই নেমে পড়ত। জানালায় চোখ রেখে সব কিছু দেখতে পেল। চারিদিকে সবুজের মোহ ছড়িয়ে রয়েছে। ছোটবেলায় চেনা-পরিচিত বহু অলিগলি চোখের সামনে ভাসতে রইল। খুশিতে হৃদয় রাঙ্গিয়ে উঠলো। এখানেই ভালোবাসা রয়েছে। এখানেই বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছা সুপ্ত হয়ে রয়েছে। ছোটবেলা কেটেছে। বহু স্মৃতি রয়েছে। সেগুলো নিয়ে বেঁচে থাকতে অসুবিধা হবে না। এই গ্রাম আর নিজের পরিবারকে ভালোবেসে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। এখানেই বেঁচে থাকার রসদ লুকিয়ে রয়েছে। শুধু একটু খুঁজতে হবে। নিজের পরিবারের চাইতে বড় কিছু নেই এই পৃথিবীতে। নিজের পরিবার স্বর্গের সমান। বাড়িতে পৌঁছানোর পর আর্য আনন্দ আর ধরে রাখতে পারলো না। ছোট ছোট বোনরা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। একটু বুঝতে শিখে গেছে। কত আবদার তাদের। সারাটা সকাল কিছুতেই দাদাকে ছাড়লো না। সে আনন্দে কেঁদে ফেলল। এদেরকে ছেড়ে বাইরে পড়ে না থাকার সিদ্ধান্তটা বৃথা যায়নি। এদের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে অসুবিধা হবে না। প্রয়োজন নেই কোনো জীবনসঙ্গী। এরাই যথেষ্ট। খুশির রঙ্গিন আভা ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। দুপুরের দিকে সে কয়েকটা ফটো সংগ্রহ করলো। নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে চুপটি করে বসে রইলো। কিছুটা সময় নিজেকে দিল। বইয়ের একটা তাক বেশ ভালো করে পরিষ্কার করল। রংবেরংয়ের কাগজ দিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করল। তারপর বিছানা থেকে একটা ফটো তুলল, নিজের বাবা-মার। ফটোটা দেখে হেসে ফেললো। তাঁদের চোখে-মুখে মখমলে হাসিতে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। সাদামাটা পোশাকে এক কৃষক আর কৃষক-বধূ। বইয়ের তাকে সবার উপরে ফটোটি রেখে নিজেই নিজেকে বলল,”এই দুজন মানুষ আমাকে শিখিয়েছেন জীবনের আসল মানে কি? কতটা কঠিন হতে পারে এই জীবন? কিভাবে লড়াই করতে হয়,এই দুজন মানুষ তা শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন, কিভাবে সুখ-শান্তি খুঁজতে হয়।” তারপর দ্বিতীয় ফটোটা তুললো। যেখানে ছোটবেলায় নিজের সমস্ত বোনদের সঙ্গে নিজে খোলামেলা পোশাকে রয়েছে। বাবা-মার ফটোর পাশে ওই ফটোটা রাখল। তারপর নিজেই নিজেকে বলল,”এই মানুষগুলো আমায় শিখিয়েছে জীবনের মুহূর্তগুলো কত দামি হয়। নাড়ির সম্পর্ক গুলো কতটা প্রিয় হয়! ছোট ছোট আবদার গুলোর মধ্যে কতটা ভালোবাসা আর স্নেহ লুকিয়ে থাকে!” তারপর তৃতীয় ফটোটা তুললো। স্নেহার ছবি। স্নেহা মাথায় কালো রঙ্গের ফিতে দিয়ে চুল বেঁধেছে আর স্কুলের শাড়ি পরে রয়েছে। কত উজ্জ্বল নমনীয় লাগছে তাকে। ছবিটা দেখে দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। চোখের জল মুছে ছবিটা ঠিক বাবা মার ছবির নিচে রাখলো। ছবি রেখে নিজেই নিজেকে বলল,”এই মানুষটা আমায় শিখিয়েছে সত্যি কারের ভালোবাসা আসলে কি? এই মানুষটা যদি জীবনে কখনো না আসতো এবং চলে না যেত তাহলে জানতেই পারতাম না সত্যি কারের ভালোবাসাটা আসলে কি?” তারপর চতুর্থ ফটোটা তুললো। যেখানে মিনাজের ছবি রয়েছে। সেই ছবিটা স্নেহার পাশে রেখে বলল,”এই মানুষটা শিখিয়েছে নাড়ির সম্পর্কের বাইরেও ভালো সম্পর্ক হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ এগুলো কখনো বন্ধুত্বের মধ্যে আসে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।” আর কোনো ফটো নেই। মনটা একটু খারাপ হলো। তার জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়ে লক্সমি জড়িয়ে রয়েছে। অথচ তার কোনো ফটো নেই। সে কখনো ফটো তুলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো না। একটাও ফটো তুলেনি। তাহলে থাকবে কি করে? একটু খেয়াল করে দেখল বইয়ের তাকে একটা সাদা চাদর রয়েছে। আর্য কর্ণাটক থেকে প্রথম নিজের বাড়ি ফেরার সময় ঠান্ডা নিবারণের জন্য লক্সমি নিজের গায়ের চাদরটা খুলে দিয়েছিল। কোনো কারনে সেটা আজও থেকে গেছে। তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। আর্য চাদরটি ভালো করে ঝেড়ে গুছিয়ে মিনাজের ফটোর পাশে রাখলো। তারপর নিজেকে বলল,”এই মানুষটা আমায় শিখিয়েছে একাকীত্ব আসলে কি? একা কিভাবে বাঁচা যায়? কাউকে পাশে না পেয়েও লড়াই করা যায়। একা ভালো থাকা যায়। তাই এখন আর একা থাকতে অসুবিধা হবে না।” সবকিছু গুছিয়ে রাখার পর হেসে ফেললো। সুন্দর করে ঘরটাকে সাজানোর পর হৃদয়টাও যেন সেজে উঠল। জীবনের প্রতিটি পদে কোনো না কোনো মানুষ এসেছে আর সেই মানুষগুলো জীবনে কিছু না কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে। সবাই কে যথাযথ স্থানে রেখে সম্মান দিল।

সন্ধ্যার কিছুটা পূর্বে ঠিক গোধূলিলগ্নে একটি ট্রেন খুব ধীরগতিতে বেরিয়ে গেল। জানালা দিয়ে ট্রেনটি দেখেই মনটা প্রসন্নতায় ভরে উঠলো স্নেহার। ছোটবেলা থেকেই ট্রেনের চলাফেরা দেখতে ভালোবাসে। এতগুলো বছর পর আবার সেগুলোই নিত্য দিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রকৃতির লীলা খেলা দেখতে ভালো লাগে। ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে, স্নেহা বাড়ি থেকে বের হয়নি। সেই যে লাগেজ নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশে করেছিল আর বের হয়নি। প্রকৃতির নরম বাতাস শরীরে লাগতে দেয়নি। দিনের-পর-দিন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। কোনো কাজকর্ম না করার সত্বেও শরীর অনেক ক্ষয়ে গেছে। রুগ্ন হয়ে উঠেছে। এর জন্যই হয়তো কবিরা বলেছেন, পরিশ্রমের তুলনায় মানসিক অবসাদ ভীষন যন্ত্রণাদায়ক। কয়েকদিন আগে আকাশ বিয়ে করেছে। বউকে দেখা হয়নি। অথচ ছোটবেলা থেকে কত স্বপ্ন ছিল, বন্ধুদের বিয়েতে কত আনন্দ করবে। কিন্তু কি সব হয়ে গেল। বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল ঠিকই তবে আকাশ নিজে এসে স্নেহাকে একবারের জন্যও ডাকেনি। মন ভীষন ভেঙে পড়েছে। কিছুই ভালো লাগছে না। সবাই তাকে ভুল বুঝছে। এখন নিজেই নিজেকে অপরাধী মনে করে। নিজে এতটাই অযোগ্য যে কারোর কাছে থাকতে পারলো না। এই যন্ত্রণা তাকে দগ্ধে দগ্ধে মারছে। এমন কি অন্যায় করেছিল যে এত শাস্তি পেতে হচ্ছে? কিছুই ভেবে পেল না। মুখ শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে চুপ করে গেল। ব্যথা পেল। আজকাল ব্যথা-যন্ত্রণা পেলেও কাউকে বলতে পারে না। কেউ যে আপন নয়। সবাই পর। নিজেকে বড় নিঃস্ব লাগে। সবাইকে স্বার্থপর আর বেঈমান মনে হয়। একটা রুমের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে কীভাবে কঠোর জীবন অতিবাহিত করছে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না সে। দুঃখ যন্ত্রণা যেন জীবন থেকে বিদায় নিতে চাইছে না। ছোটবেলার বন্ধুরাও ঘুরে ফিরে তাকায় না। কিছুটা সময় পর দেখলো দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে প্রবেশ করছে। হালকা অন্ধকার নামলেও মুখটি চিনতে অসুবিধা হলো না। নিলেশকে দেখে একটু আপ্লুত হয়ে উঠল। হঠাৎ কী জন্য তার রুমে? নিশ্চয়ই নিজের বিয়ের খবর বন্ধুকে দিতে এসেছে। একটু রাগী বটে তবে ভীষন দয়ালু। রাগ করলেও খুব তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যায়। কোনো কথা না বলে সে সোজা স্নেহার বিছানার উপর উঠে বসলো।
” আজকে মনে পড়ল বন্ধুর কথা?” স্নেহা স্বাভাবিকভাবে নিলেশকে প্রশ্ন করল। নিলেশ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,”ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস কেন? আলো জ্বালা।”
“এমনি ঠিক আছে। অন্ধকারই আমার ভালো লাগে।”
“উফ! তুই একটা হয়েছিস সত্যি।”
“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে?”
“কি প্রশ্ন?” স্নেহা প্রথম প্রশ্নটা আবার করল। একটু হেসে নিলেশ বললো,”আমার তো তবুও মনে পড়ল। তোর তো আদৌ মনে পড়েনি। আমি না হয় কথা বলিনি তোর সঙ্গে; কিন্তু তুই কি নিজে আমার সঙ্গে একবারের জন্য কথা বলার চেষ্টা করেছিস?” স্নেহা তার দিকে তাকিয়ে রইল। দোষ শুধু তাদের দিলে হবে না। দোষ নিজেরও। নিজে থেকে একবারও তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেনি। ওদের ফোন নাম্বার কাছে রয়েছে। চাইলে একটা এসএমএস করতে পারত। কিন্তু করেনি। দোষ তাহলে কি শুধু তাদের?
“আচ্ছা মেনে নিলাম দোষ আমার। কিন্তু হঠাৎ আমার বাড়িতে আগমনের কারণ জানতে পারি কী?”
“তুই তো জানিস, আকাশ কয়েকদিন আগে বিয়ে করেছে। এখন আমার বাড়িতে আমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে।”
“ভালো তো। বিয়ে করে নে। বিয়ের বয়স তো অনেক আগেই হয়ে গেছে।”
“আমায় বিয়ে করবি তুই?”
“আবার বদমাশ শুরু করেছিস?”
“সিরিয়াসলি বলছি। বিয়ে করবি আমায়?” স্নেহা এবার নড়েচড়ে বসল। নিলেশের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো না সে মজা করছে। চরম কৌতুহলী হয়ে পরলো। বলল,”কি সব বকে যাচ্ছিস তুই।”
“বাড়িতে বিয়ের কথা বলছে। মেয়ে দেখা চলছে।বাড়ির পাশে নিজের একটা ভালো বন্ধু থাকতে আমি অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাবো কেন?”
“বুঝলাম, কিন্তু আমি একটা বিবাহিত মেয়ে। আর তোর চাইতে বয়সে বড়। এটা কি করে সম্ভব হতে পারে?”
“অতীত তো সবারই থাকে। অতীত নিয়ে পড়ে থাকবি নাকি! আর আমি তো সবকিছু জানি। কেউ কাউকে ঠকায়নি একটু ভুল বোঝাবুঝি আরেকটু পরিস্থিতির শিকার হয়েছিস। তা বলে কি সারা জীবন নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখবি?”
স্নেহা হাসলো। হাসতে হাসতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজকাল হাসিটাও বেহায়া হয়ে গেছে। দুঃখের সময়ও হাসতে ইচ্ছে করে। তবে চোখের জল গড়লো না। বলল,”বিচ্ছেদের কথা শুনে কেঁদে ওঠা মনটা আজ সম্পর্কের কথা শুনে কেঁপে উঠে। আর নতুন করে কোনো সম্পর্কে যেতে চাই না। এমনিই বেশ আছে। শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে মনে হয় না বেশি দিন বাঁচবো বলে।”
“কিন্তু এখন তোর বয়স কত বল? তিরিশ থেকে সামান্য বেশি,এই তো? জীবনের অর্ধেকটা সময় এখনও পার করিসনি। আর এখন থেকেই তুই একটা ঘরে বন্দী থাকবি। একটাই তো জীবন এই ভাবে নষ্ট করার কি কোনো মানে আছে? তুই মরে গেলে কেউ কি মনে রাখবে, যে একটা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর তুই সারাটা জীবন একা কাটিয়েছিস। কষ্ট পেয়ে হারিয়ে গেছিস। সেদিন টিকলিকে তো অনেক কথা বুঝিয়ে ছিলিস, তাহলে নিজের বেলায় নয় কেন? অন্যের জন্য অনেক তো কাঁদলি এবার অন্তত নিজের জন্য একটু হাস। দেখবি মন্দ লাগবে না।”
“কেন রে? মেয়েরা কি একা হাঁটতে পারে না? মেয়েদের নিজেদের অভিভাবক নিজেরা হতে পারে না? ছোটবেলায় বাবা আর বড় বেলায় স্বামীর উপর নির্ভর করতে হবে? মেয়েরাও তো একা চলতে পারে। একা থাকতে পারে।”
“অবশ্যই পারে। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী নয়, বিয়ের পরও নিজের অভিভাবক নিজেই হতে পারে। ওটা নির্ভর করে দুটো মানুষের ওপর। একটা মেয়ে লতানো কোনো গাছ নয়,যে কিছুটা বড় হওয়ার পর সারাটা জীবন অন্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে। মেয়েরা শক্ত শিকড় যুক্ত একটা উদ্ভিদ। একা একার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মেয়েরা নিজের অধিকারের জন্য যদি ভাবে বিয়ে করবে না, তাহলে ওটা কেমন দেখায় বল তো? একজন তিরিশ বছর বয়সী মহিলা ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর সারাটা জীবন একা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যেমন অন্যায় নয়, তেমনই ওই বয়সে নতুন করে স্বপ্ন দেখাটাও অন্যায় নয়।” একটু নীরব রইল স্নেহা। নিলেশের কথাগুলো ভাবলো। যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে তার কথার মধ্যে। ফেলে দেওয়ার মতো কোনো কথা বলেনি। অভিজ্ঞ মানুষের মতো বক্তব্য রেখেছে। স্নেহা ঠোঁট টিপে বলল,”তুই হঠাৎ করে আমায় বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে উঠলি কেন? আগে থেকে কি পছন্দ ছিল?”
“এমনটা কখনই নয়। আমাকে যখন বাড়িতে বিয়ের কথা বলল তখন ভাবলাম আমারও একটা বন্ধু রয়েছে। সে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। একা রয়েছে। নিজের জীবন শেষ করে ফেলেছে। আমি যদি তাকে বিয়ে করতে পারি, তাহলে সে নতুন একটা জীবন ফিরে পাবে। খুশি হবে সঙ্গে আমিও। তোকে কোনো মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যতটা বুঝবে আমি অনেক কম সময় তা বুঝে যাব। কারন তোর সাথে পরিচয়টা আমার ছোটবেলার। কোনটা সঠিক কোনটা ভুল তা আমি জানি। আর তুইও আমার ব্যাপারে সবকিছু সহজে বুঝতে পারবি। এই আর কি.…. এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।”
“তার মানে তুই আমাকে কৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছিস?” একটু ঈর্ষা প্রকাশ পেল স্নেহার কথার মধ্যে।
“তুই যদি ভাবিস বিয়ের প্রস্তাব টা শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা তাহলে আমার কিছু করার নেই। তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার তুই ভেবেই সিদ্ধান্ত নিবি। জোর করছি না।”
স্নেহা কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল। এলোমেলো ভাবনা গুলো সাজিয়ে বলল,”তুই যে সমস্ত কথা বলছিস ওই গুলো মন্দ নয়। যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। আসলে কি জানিস তো? আমি জীবনে কি চেয়েছি আমি নিজেই জানি না। তাই আমার জীবনটা এতটা এলোমেলো। যখন যার কাছে থেকেছি তখন তাকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছি। তাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেছি। কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু পায়নি। ভগবান সবাইকে সুযোগ দেয় নিজেকে চেনার জন্য। আমাকেও হয়তো এই রোগটা দিয়ে চিনিয়েছে নিজেকে। রোগ যদি না থাকতো তাহলে আমি কখনোই জানতে পারতাম না জীবনের আসল মর্ম! কাছের মানুষগুলোর মধ্যে কতটা ভয়ঙ্কর রূপ থাকে -তাও কখনো বুঝতাম না। ভাগ্যিস রোগটা জন্মগত ছিল। না হলে অনেক কিছু জানতে পারতাম না। তোর কি মনে হয় আমার এই ভাবে একা থাকতে ভালো লাগছে? কখনোই না। পৃথিবীর কোনো মানুষেরই একা থাকতে ভালো লাগে না। খুব বেশি হলে এক দু’বছর থাকা যায় তার বেশি নয়। তাইতো মানুষকে সামাজিক জীব বলা হয়। আমি এটাও বিশ্বাস করি জীবনে প্রথম আর দ্বিতীয় মানুষ ভুল ছিল বলে তৃতীয় মানুষ যে ভুল হবে,এমনটা নয়। কিন্তু মনে সাহস জোগাতে পারছি না। নতুন করে আর সম্পর্কে গড়তে ইচ্ছে করছে না।” একটু থেমে আবার বলল,”জীবনে ভালোবাসার মানুষটার কাছে থাকাটাই শ্রেয়। পরবর্তী সময়ে একটা নতুন কিছু পাব না বলে সম্পর্ক ভেঙে ফেলাটা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কত সুন্দর একটা সম্পর্ক ভেঙে ফেলল উৎপল। চাইলে কিন্তু আমরা থাকতে পারতাম।”
“কিন্তু তুই চাইলে আর্য দাদার সঙ্গেও থাকতে পারতিস। থাকলি না কেন?”
“তখন বয়স অল্প ছিল। এতকিছু বুঝতাম না। আবেগ প্রাধান্য পেয়েছিল ভালোবাসা নয়। যদি বুঝতাম তাহলে কখনো ছেড়ে আসতাম না।”
“আচ্ছা,ওই সব বাদ দে। তুই রাজি কিনা বল তো।” তথাপি চুপ করে রইলো স্নেহা। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানো উচিত কিনা! সেই আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তুলবে আবার ভেঙ্গে যাবে। যদিও সম্পর্ক তৈরি হয় ভাঙ্গার জন্যই। কিছুক্ষণ ভাবার পর খুব স্পষ্ট করে বলল,”আমি আর তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আমার সময় লাগবে। আমায় ভাবতে দে। নতুন সম্পর্ক গড়ার জন্য আমায় একটু প্রস্তুতি নিতে হবে।” নিলেশের চোখেমুখে হাস্য উজ্জ্বলে ভরে উঠলো। সে জানে, স্নেহা প্রত্যাখ্যান করবে না। নতুন সম্পর্কে জড়াতে হয়তো একটা সময় নিবে তবে ঠিক জড়িয়ে যাবে। তাকে ভালবাসবে। একটু পর স্নেহা আবার চাপা কন্ঠে বলল,”কিন্তু তোর পরিবার কি আমায় মেনে নিবে? লোকে কি বলবে বল তো‌! এমনিতেই আমি বিবাহিত। আবার তোর থেকে বড়। লোকে কি ভাববে….।” স্নেহের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিলেশ তাড়াতাড়ি বলল,”তুই তো আমার বাবা-মাকে জানিস। ওরা ঠিক রাজি হয়ে যাবে। ওরা এখনো তোকে খারাপ বোঝেনি। তোর প্রশংসা করে। বাবা-মাকে রাজি করাতে বেশি দেরি হবে না। আর সমাজের কথা বলছিস তো! তাদের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রন নেই। তারা অনেক কিছু কথা বলবে। আর তুই তো সমাজকে ভয় পাস না। তাহলে এত চিন্তা করছিস কেন?”
“কিন্তু? তবুও…।”
“আমাদের সমাজে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া কত মহিলাই বিয়ে করছে। আবার তো অনেকের সন্তান থাকে, তারপরও তারা নতুন সম্পর্কে জড়ায়। আর তুই তো সেখানে অনেক ব্যতিক্রম।”
একটু থামল। একটা ঢোক গিলে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে আবার বলল,”একটা মেয়ে সুখে সংসার করছিল। কিন্তু কোনো কারণেই তার ডিভোর্স হয়ে গেল। তারপর সে কি আর নতুন করে, কিছু শুরু করতে পারবে না? সেখানেই তার সমস্ত কিছু শেষ? কিন্তু সেখানে সমস্ত কিছুর শেষ না করে,সে যদি ফিরে এসে তার ছোটবেলার বন্ধুকে বিয়ে করে, তাহলে অন্যায় কোথায়? আর এখানে আমি না হয় তোর চাইতে একটু ছোট। তো কি হয়েছে?” নিলেশের কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো স্নেহার। অনেক দিনের পর আনন্দ অনুভব করল। উঠে গিয়ে আলো জ্বালালো। আবার কাছে এসে বসলো। বলল,”তবুও,আমি তো একটা বিবাহিত মহিলা। আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গে কোনো এক পুরুষ স্পর্শ করেছে। তারপর….।”
“ওই সব কথা বাদ দে না রে। আমার কাছে কোনো কিছু তো অজানা নয়। আমি ওইসব কিছু মনে রাখতে চাই না। তুই তো বাড়িতে থেকে দুপুরে রান্না করবি। তারপর বাবা-মাকে খেতে দিবি। কিন্তু নিজে খাবি না। আমার জন্য অপেক্ষা করবি। আমি স্কুল থেকে ফিরলে দুজন একসঙ্গে খাবো। পারফেক্ট গ্রাম্য বধূ। তাছাড়া তুই যদি চাস, কোনো কাজ করবি, করতে পারিস। কেউ বাধা দেবে না।”
স্নেহা মাথা নাড়ালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মজা করে বলল ,”আচ্ছা বিকালে ভাত খেয়ে নিলাম তারপর কি করব?”
“আর তো কোনো কাজ থাকবে না। দুজনে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাব। তোর আর আমার কোনো কথায় মিল নেই। সারাদিন ঝগড়া করব। দেখবি একটু একটু করে কখন নিজের সমস্ত অতীত ভুলে যাবি বুঝতেই পারবি না। নিজে থেকেই একদিন ওই সব কথা মনে রাখতে চাইবি না।”
“তুই যা বদমাশ। আমায় ঘুমাতে দিবি বুঝি? ঠিক আমায় জ্বালাতে থাকবি।” স্নেহা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অনেক দিনের পর বুক ফেটে হাসলো। বুকের তৃপ্তি অনুভব করল। ভালো লাগলো। একরাশ উচ্ছ্বাস জেগে উঠলো। নিলেশ লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। স্নেহা নিলেশের থুতনি তুলে চোখের দিকে তাকাল। হেসে ওঠে স্নেহা বলল,”জীবনে কত প্রেম করলাম। আর কি আমার মধ্যে প্রেম আছে রে?”
“প্রেম তো কখনো শেষ হয় না। আর যদি শেষ হয়েও যায়, তাহলে যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে ওইটুকু দিয়ে না হয় আবার একবার শুরু করবো নতুন প্রেম। যে প্রেমের নাম হবে ‘কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ’।”
__________________ সমাপ্ত ________________

যারা এই দীর্ঘ সময় ধরে পাশে ছিলেন তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভালোবাসা নিবেন। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি কেমন (ভালো+ খারাপ)
লেগেছে জানাবেন। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছেন, যারা অনেকে গল্পটি পড়তে সাজেস্ট করেন। তা ভালো; কিন্তু দয়া করে সেখানে গল্পের স্পয়লার বলবেন না। তাতে গল্প পড়ার আগ্রহ কমে যায়।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here