কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-১০

0
265

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১০
__________________
২।
এবার পশ্চিমবাংলায় প্রায় অনেক দেরিতে বর্ষা ঢুকলো। সঠিকভাবে বর্ষা প্রবেশ করলেও তার অনিশ্চিয়তা চোখে পড়ার মতো। প্রত্যেক বছর আষাঢ়ের মাঝামাঝি যেখানে চারাগাছ রোপন করা শুরু হতো, এবার তা ভাদ্র মাসের মাঝামাঝিতেও শুরু হলো না। কৃষকদের মাথায় হাত, চাষের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আবার অন্যদিকে,যেটুকু জল পেয়েছে তা দিয়ে জমিকে চাষ যোগ্য করে তুলতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন কিছু কিছু কৃষক। কোমর বেঁধে নেমে পড়া কৃষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন অশোক বাবু। তাঁর সংসার সম্পূর্ণ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। জল নিকাশের ব্যবস্থা প্রথম থেকে করে রেখেছেন। বাড়িতে বড় বড় তিনটি পুকুর রয়েছে, জলের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বৃষ্টির অনিশ্চিয়তার উপর নির্ভর না করে ফসল ফলাতে প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বেলা বাড়তেই বৃষ্টি আরও বাড়লো। মাঠে একা কাজ করছেন অশোকবাবু। মন ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ। বাড়ির উদ্দেশ্যে জোরে হাঁক ছাড়লেন, স্ত্রীকে পলিথিন নিয়ে আসতে বললেন। সামান্য সময়ের ব্যবধানে অন্নপূর্ণা দেবী দুটো পলিথিন নিয়ে আসলেন। তারপর দুটো পলিথিন খুব সুন্দর ভাবে নৌকোর মত করে নিয়ে গায়ে পরে নিলেন। তারপর সরু দড়ি নিয়ে পলিথিনটিকে নিজের দেহের সঙ্গে বেঁধে নিলেন, আর বাতাসে উড়ে যাওয়ার ভয় নেই। দেহকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এইটুকু যথেষ্ট। কোনোভাবে বর্ষার জলে শরীর ভিজবে না। উভয় আবার চারা গাছ তোলায় মনোযোগী হলেন। একটা একটা চারা গাছ তুলে এক আঁটি হওয়ার পর, সেগুলোকে খড় দিয়ে সুন্দর ভাবে বেঁধে দিচ্ছেন। একটা একটা আঁটি সারিবদ্ধ ভাবে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। বেশ অনেকগুলো আঁটি বাঁধার পর অশোকবাবু উঠে দাঁড়ালেন। আকাশের দিকে তাকালেন, ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ । হালকা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে আকাশের বুক ফেটে মুষুলধারে বৃষ্টি নামল। ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল সঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ, তবুও মনের গভীর কোঠায় আহ্লাদ বজায় থাকলো। এমন বৃষ্টি ঘন্টা তিনেক হলে তাদের তিনটে পুকুর জলে ভর্তি হয়ে যাবে। আর বৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হবে না । খুশির সময় একা চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে না। কারোর সঙ্গে তার আনন্দের মুহূর্ত সামান্য শেয়ার করতে পারলেও ভালো হতো। স্ত্রীর দিকে তাকালেন, আপন মনে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন কোনো কিছুতে ভ্রুক্ষেপ আক্ষেপ নেই। সব সময় চুপচাপ থাকেন। কোনো কিছুতেই তেমন একটা মাথা গলায় না। আজ অশোকবাবু বড্ড মিস করছেন নিজের ছেলেকে।এমন বৃষ্টিতে সে কখনো বাড়িতে বসে থাকতো না, বাবার কাছে ছুটে চলে আসতো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাবাকে কাজে সাহায্য করত। না, তেমন একটা কাজ করতে পারতো না। বাবার কাজ কমানোর চাইতে বাড়িয়ে দিত, তবুও করতো সে। আশোক বাবু কখনো বাধা দেননি। কাজ চুলোয় যাক, পাশে তো রয়েছে। কত মানুষ পারে সব সময় পাশে থাকতে। ছেলে পাশে থাকলে একটা আলাদা বল পান তিনি। কঠোর পরিশ্রম কঠোর মনে হয় না। সব কিছু সহজ হয়ে যায়। আজ সহজ হচ্ছে না। আর্যর অনুপস্থিতি খুব ভালোভাবেই টের করতে পারছেন তিনি। ছেলেকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত। বর্তমানে কিছু কিছু খারাপ কাজ গুলোকে খুব সহজভাবে নিতে হয়। আর্য এগুলোকে সহজভাবে নিতে পারে না। হোস্টেলে মাত্র দেড় মাস থাকার পর তাকে হোস্টেল ছাড়তে হয়েছে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও পরে হোস্টেল জীবন তার কাছে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বর্ষের যখন ক্লাস শুরু হলো, তখন হোস্টেলে দ্বিতীয় বর্ষের সমস্ত ছাত্ররা চলে আসলো, আর্যর মধ্যে অতিষ্ঠ বাড়তে থাকলো। হোস্টেল লাইফ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল না। সে ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠে পড়ে, হোস্টেলে বেশিরভাগ ছেলেরা ভোর চারটের সময় ঘুমোতে যায়। ক্লাস শুরু না হলেও গল্প বই পড়তে ভীষন পছন্দ করে। যখন বই পড়তে বসে তখন কেউ এসে বিরক্ত করে। আবার কেউ গান-বাজনা করে। মোট কথা হল, নিজের মতো করে থাকা সম্ভব নয় সেখানে। মনে হতে থাকে, জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলছে। অনেক কিছু ভুল করে ফেলছে। সে নিজে ভুল,না হয় অন্যরা। যে কোনো একজন অবশ্যই ভুল। ভুলের মধ্যে থাকতে চায় না সে। সমস্যা নিজের, অন্য কারোর নয়। নিজে সমাধান করাটা যুক্তিসঙ্গত। সরাসরি বাবাকে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে হোস্টেলে থাকা সম্ভব নয়। বড্ড চিন্তায় পড়ে যান অশোকবাবু। হোস্টেলে না থেকে কোথায় থাকবে সেখানে? তিনি কোনোভাবেই চাইছিলেন না ছেলে হোস্টেল ছাড়ুক। জীবনে একটা একটা ধাপ পেরোতে শুরু করেছে। এবার অনেক বাধা বিপত্তি আসবে। এগুলোকে অতিক্রম করে যেতে হবে। সবকিছু মানিয়ে নিতে হবে, আরও কঠোর কঠোর পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। এটাতো সামান্য। ইচ্ছে করেই ছেলের জন্য কোনো কিছু ব্যবস্থা করছিলেন না। কিন্তু পরে নিজের সিদ্ধান্ত বদলালেন। ছেলের যদি পড়াশোনায় অসুবিধা হয় তাহলে তার পুরো ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। তাছাড়া তার রুমমেটরা মদ , সিগারেট সবকিছুতে অভ্যস্ত। তারা আর্যকে অফার করেছে, যদিও ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আর্য কতবার ফিরিয়ে দেবে তা জানা নেই। এমন পরিস্থিতিতে অশোকবাবু একটু নরম হলেন। আর্যকে নতুন বাসা দেখতে বলেন। পাঁচ-ছয় দিন ঘোরার পর সেও একটা বাসার সন্ধান পায়। হোস্টেলের চাইতে সামান্য টাকা বেশি নেবে, তবে থাকবে খুব শান্তিপূর্ণভাবে। আশোক বাবু মেনে নেন। মাত্র তিন-চারদিনের আগে হোস্টেল ছেড়ে নতুন বাসায় এসেছে আর্য, তারপর থেকে আর ফোন করেনি। মন ভীষণ খুঁতখুঁত করছে। আজ বাড়ি গেলে যে কোনোভাবেই হোক ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন।আরও কয়েকটা আঁটি বাঁধার পর আর বৃষ্টি সহ্য করতে পারলেন না। খুব জোরালো বৃষ্টি নেমেছে। অন্নপূর্ণা দেবীও পারছেন না। মাঠ থেকে উঠে গিয়ে গাছের তলায় আশ্রয় নিলেন। বাতাস খুব বেশি নয়, গাছের তলায় খুব কম জল পড়ছে। সেখানে বসে অপেক্ষা করলেন বৃষ্টি কমার। যারা পরিশ্রম ভালোবাসে তারা কখনো বসে থাকতে চায় না। আশোক বাবুর হাত-পা ছটফট করতে লাগল।বাড়িতে পুরনো মশারিকে সুন্দর ভাবে সেলাই করে লম্বা গোল জাল বানিয়েছেন। বর্ষাকালে এই জাল দিয়ে মাছ ধরা খুব সহজ। অতিরক্ত বর্ষা হলে জমির বাঁধ কোনো এক স্থানে সামান্য কেটে দিয়ে এই জাল বসিয়ে দেওয়া হয়।জলের স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে অনেক মাছের আগমন ঘটে। গোল জালের মধ্যে মাছ প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না। তিনি বাঁধের কিছু অংশ কেটে সুন্দরভাবে জালটি বসিয়ে দিলেন। ফিরে এসে স্ত্রীর পাশে বসলেন। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা। চারিদিকে তখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। থমথমে পরিবেশ। বৃষ্টির দাপট এত প্রবল যে দূরে গাছপালা রাস্তাঘাট অদৃশ্য হয়ে সাদা আস্তরণে ছেয়ে গেছে। আশোক বাবু অনেকক্ষণ পর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”অন্নপূর্ণা,আজ ছেলে ফোন করেনি?”
“আমি কেমন করে জানব!তোমার ছেলে কি করছে না করছে সেটা তুমি জানবে।” কড়া মেজাজে জবাব দিলেন তিনি।
“আহহ! সব সময় মেজাজ গরম রাখো কেন বলতো! স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারো না?”
“স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি, তোমার কাছে যদি অস্বাভাবিক লাগে তাহলে আমার কিছু করার নেই।”
“ভুল করছো অন্নপূর্ণা, অনেক বড় ভুল। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তুমি ছেলের প্রতি একটু বেশি উদাসীন। তুমি এমন টা কেন?”
“আমি যদি ছেলের প্রতি উদাসীন হই তাহলে তুমিও মেয়েদের প্রতি উদাসীন।”
“আমি কারোর প্রতি উদাসীন নয়। আমার সমস্ত সন্তান আমার কাছে সমান। তুমি নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো, তুমি যা করছো তা সঠিক কিনা! আজ পর্যন্ত ছেলের সঙ্গে ভালো মত দু’দণ্ড কথা বলেছো? তার পছন্দের কোন খাবার বানিয়েছো? ও তো তোমার ছেলে তাই না! মায়েরা মেয়ের তুলনায় ছেলেকে একটু বেশি ভালোবাসে। আর তুমি সম্পূর্ণ আলাদা। সে মাকে পেয়েও পায়নি। একটা মুহূর্তের জন্য ছেলের কথা ভেবে দেখো।” অশোকবাবু চুপ করতে অন্নপূর্ণা দেবী মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি যে সত্যি সত্যি ছেলের প্রতি সব উদাসীন হয়ে আসছেন। ছেলের প্রতি বারবার বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। এই বৃষ্টির মধ্যে স্ত্রীর চোখের জল দেখতে পেলেন না অশোকবাবু। স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বুঝতে পারলেন তিনি কষ্ট পেয়েছেন। কিছু বললেন না, খানিকক্ষণ নীরব থাকার চেষ্টা করলেন। তাতে অন্নপূর্ণা দেবীর মন ভালো হবে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্নপূর্ণা দেবী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,”কেন ভালোবাসবো বলো তো? আমার ছেলেকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি, অথচ সে সবাইকে বলে বেড়ায় সে মায়ের চাইতে পিসিকে বেশি ভালোবাসে। একজন মায়ের কাছে এটা কতটা কষ্ট তুমি বোঝো! তুমি সব কিছু ভুলে গেছো তাই না। মনে নেই,সে আদালতে দাঁড়িয়ে কি বলে…..।” কিছু বলে ওঠার আগেই অশোকবাবু স্ত্রীর মুখ চেপে ধরলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,”এই অন্নপূর্ণা! কি হচ্ছে কি? আজও তুমি পুরনো অতীত নিয়ে পড়ে আছো? তখনও ছোট ছিল, কিছু জানতো না, বুঝতো না। তুমি তাকে নয় মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছো। এতদিন ছেলের ভুলটাকে নিয়ে তুমি বেঁচে আছো। ক্ষমা করতে পারছো না? তুমি না মা…।” অশোক বাবু কেঁদে উঠলেন। কিছু বলতে পারছেন না। পুরনো অতীত সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। অন্নপূর্ণা দেবী স্বামীর চোখের কোণে জল মুছে দিলেন। মাথা নাড়িয়ে কান্না করতে বারণ করলেন। অশোক বাবুর ঠোঁটের কোণে চাপা কষ্টের হাসির আভা ফুটে উঠল। মেঘের মুখ আজ বড্ড ভারী, চারিদিকে থমথমে পরিবেশ,বৃষ্টি নেমেছে আজ অঝরে।শিরিষ গাছের নিচে বসে রয়েছে এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধ। মেঘের মতো তাদের মনও ভারী। তবুও ঠোঁটের কোণে তৃপ্তি হাসি; আগামীর স্বপ্ন।

নতুন বাসায় এসে পাঁচ-ছয় দিন কাটিয়ে ফেলেছে আর্য। সেখানে আর এখানের মধ্যে তেমন কিছু বৈসাদৃশ্য নেই। খাবার পুরোপুরি একরকম, শুধুমাত্র প্রত্যেক সকালে ধোসা ইডলি পরিবর্তে মাঝেমধ্যে মুড়ি আর লুচি পাওয়া যায়। তবে হোস্টেলের জীবনযাপন থেকে এখানকার জীবনযাপন অনেকটাই ভিন্ন। হোস্টেলের জীবন ছিল স্বাধীন আর এখানের জীবন সম্পূর্ণ স্বাধীন। হোস্টেল থেকে বাইরে কোথাও গেলে পারমিশনের প্রয়োজন ছিল, এখানে কোনো পারমিশনের প্রয়োজন নেই । যেখানে খুশি যাও, মাসের পর মাস চলে যাও তাতেও আপত্তি নেই, শুধুমাত্র যাওয়ার আগে একবার বলে যাও আর মাইনে সঠিক সময়ে মিটিয়ে দাও। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে থাকুক। কেউ বাধা দিতে নেই। একটা রুমের মধ্যে দুজন থাকে। রুমের মধ্যে এবার নেপালি ছেলের পরিবর্তে কাশ্মীরি ছেলে জুটেছে। তাকে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। ইঞ্জিনিয়ার কলেজের ছাত্র মিনহাজ উদ্দিন ভীষণ শান্তশিষ্ট, বেশি কথা বলতে তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। বাইরে ঘুরতে ফিরতে পছন্দ করে না,সবসময় রুমের মধ্যে বন্দি থাকে। মদ সিগারেটের নেশা না থাকলেও মোবাইলের প্রতি নেশা ভীষণ। প্রায় সময় হাতে মোবাইল নিয়ে বসে থাকে, তবে একদিনও কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেখেনি। মোবাইল নিয়ে কি করে কে জানে! নতুন বাসায় আসার পর থেকে ক্লাস শুরু হয়েছে আর্যর। বেশ কয়েকদিন ক্লাস করলেও এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে অতটা পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। এখনো সবকিছু আনকোরা। এইটুকু বুঝতে পেরেছে এখানকার ভাষা অত্যন্ত জটিল। লোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ না জানলে বড্ড অসুবিধায় পড়বে সে। আশেপাশে বেশিরভাগ মানুষই কর্নাটকা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষার মতো এখানকার ভাষা বৈচিত্রও চোখে পড়ার মতো। বাংলা একটিমাত্র ভাষা, কিন্তু পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবাংলা মধ্যে ভাষাগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। আবার পূর্ব বাংলার জাতীয় ভাষার সঙ্গে ময়মনসিংহ , চট্টগ্রামের ভাষার অনেক পার্থক্য আছে। এদিকে পশ্চিমবাংলায় জাতীয় ভাষার সঙ্গে সেখানকার মেদিনীপুর এবং পশ্চিমের জেলা গুলোর ভাষার মধ্যে পার্থক্য অনেক। বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক ভাষা বিভিন্ন। এখানকার আঞ্চলিক ভাষা খুব সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।পশ্চিমবাংলার মানুষগুলো বাংলা ভাষার পাশাপাশি যেমন হিন্দি উড়িয়া ভাষা গুলোকে খুব সহজে আয়ত্ত করে নিয়েছি। এমনই এখানকার মানুষ গুলো কার্নাটাকা ভাষার পাশাপাশি তামিল-তেলেগু,মালায়ালাম ভাষা গুলো সহজে আয়ত্ত করে ফেলেছে। তার কারণ পার্শ্ববর্তী এলাকার ভাষা গুলো এমন। এখানকার মানুষ গুলো হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারে না। কলেজ শুরু হওয়ার পর প্রথম সমস্যা শুরু হলো ভাষা। দক্ষিণ ভারতের কোনো ভাষাই জানে না সে, আবার ইংরেজিও খুব পারদর্শী নয়। খাতা-কলম নিয়ে খাটের উপর বসে ইংরেজি আর কর্নাটকা ভাষা কিছুটা শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার দেখে কেটে দিল। আবার ফোন বাজলো আবার কাটলো। পাঁচ ছয়বার এমন করার পর,যখন দেখল বিপরীত মানুষটি ফোন করা বন্ধ করছে না,তখন একটু অস্বস্তি শুরু হলো আর্যর মধ্যে। ফোন ধরা ভীষন জরুরী। কারোর একটা প্রয়োজন রয়েছে। আর সাত-পাঁচ না ভেবে ফোন ধরল। সম্মানসূচক মন্তব্য করার আগেই বিপরীত পাশ থেকে এক নারী কন্ঠ বলে উঠলো,”এই কুত্তা! আমার ফোন কেটে দিচ্ছিস। বড্ড সাহস হয়েছে তোর।” দীর্ঘদিনের পরিচিত এক নারী কন্ঠ। তার প্রথম প্রেম এবং আবেগ। ভীষন চঞ্চল হয়ে উঠল তার মন। বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না, স্নেহা তাকে ফোন করেছে। এতদিন তাকে মনে রেখেছে, কই এখানে আসার পর তার তো স্নেহাকে মনে পড়েনি। একপ্রকার ভুলে গেছিল। কিন্তু স্নেহা মনে রেখেছে। তার কাছে বন্ধুত্বের মানে অন্য কিছু -স্নেহা বারবার প্রমাণ দিয়েছে। আর্য একটু লজ্জা পেল। লজ্জা পাওয়ার কারণ জানা নেই। কোনো কথা বলতে পারল না। আবার উচ্চ স্বরে বলল,”আমি ভিডিও কল করছি, তাড়াতাড়ি ধর।” আর্য কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিল স্নেহা। আর্য দ্রুত বিছানা থেকে উঠে গিয়ে মাথায় চিরুনি দিল, একটা ভালো পোশাক পরল। অনেক দিনের পর যখন স্বামী বিদেশ থেকে ভিডিও কল করে স্ত্রীকে দেখতে চায়, তখন স্ত্রী নিজের বিবর্ণ ক্লান্ত মুখশ্রী স্বামীকে দেখাতে যায় না। একটা ভালো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে নেয়, মাথায় চিরুনি দেয়, হাত মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে স্বামীর সামনে আসে। এই ব্যাপারটি যে নিতান্ত একটি সাধারণ তা কিন্তু নয়, বিপরীত মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। বিপরীত মানুষটিকে কোনোভাবে বুঝতে দেয় না -সে কষ্টের মধ্যে রয়েছে ।তার দিনকাল ভালো মত কাটছে না। বিপরীত মানুষটি সবকিছু জানতে পারলে কষ্ট পাবে। তাদের সমস্ত কষ্টের ভাগীদার অন্য কেউ হোক তারা চায় না। জীবনে কিছু কিছু কষ্ট দুঃখ নিজস্ব একান্ত। আর্য ঠিক তেমনটা করল। একটা মেয়ের জন্য নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছে সে। এখনো করে চলছে। ফোনের সামনে উপস্থিত হতেই পুরনো দিনের এক মুখশ্রী ভেসে উঠল। এক মায়া ভরা মুখশ্রীর মধ্যে টিপটিপ করছে ছোট্ট দুটি চোখ, গলার কাছে কালো দাগ, কানের কাছে কাটা অংশ আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার মুখের উপর বসন্তের রাতের জ্যোৎস্নার মত একটা সহজ হাসির আভা দেখা গেল। কত দিনের পর মুখোমুখি হলো তারা। কত কথা বাকি আছে । কত পরিচিত অনুভূতি একে অপরের মধ্যিখানে শেয়ার করেনি। হাজারো কথা জমে রয়েছে মনের গোপন অন্ধকারে। আর্য মৃদু হাসলো। তার কত ভালো লাগছে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারল না।ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখে চোখ থেকে জল গড়িয়ে দিল।
“এই বোকা কেঁদে যাচ্ছিস কেন?” আর্য কিছু বলতে পারল না। শুধু দুচোখ মেলে স্নেহাকে দেখল। ইচ্ছে করছে সবকিছু বলে দিতে। কত বসন্ত এসেছে, আবার চলেও গেছে। মনের মানুষ মনে থেকে গেছে। তাকে আর বলা হয়নি মুখের কথা। এখানে আর ভালো লাগছে না। ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে গ্রামে। তারপর স্নেহার সঙ্গে ঘুরবে একের পর এক গ্রামে। সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে জীবনের আসল সত্য।
“এই! তুই এত ইমোশনাল কেন বলতো! কত আশা নিয়ে ফোন করলাম একটু কথা বলব। আর তুই কেঁদে যাচ্ছিস…..।”
“এমনি এমনি চোখে জল চলে আসলো, কি করব বল?” পরিচিত এক কণ্ঠস্বর, শুধু গলা একটু কাঁপা কাঁপা ।”
“ভালো আছিস তুই? বলেছিলাম না পৃথিবীটা গোল ঠিক দেখা হবে। বিশ্বাস হলো তো।”
“দেখা কই হল? শুধু কথা হল। তুই আমার নাম্বার কোথায় পেলি।”
“হনুমান, বাইরে পড়তে চলে গেছিস একবারও আমার খোঁজ নিস নি। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি তাও জানতে চাইলি না। আর এখন নাম্বার কোথায় পেয়েছি তাও বলতে হবে।”
“হ্যাঁ, বল কোথায় পেলি?”
“তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোর বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসেছি।”
“কীহহ! পাগল নাকি!”
“ভালো করে কথা বল। আমি পাগল হব কেন -পাগলি হব।” স্নেহা হো হো করে হেসে উঠল। আর্য তখনও অপলক দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মোটা ঠোঁটের হাসির ধরন লক্ষ করছে। শান্তি পায় তার চোখের দিকে তাকিয়ে, তাইতো তাকিয়ে আছে।চুল বারবার মুখের উপর পড়ে যাচ্ছে আবার হাত দিয়ে তুলে দিচ্ছে।
“সত্যি করে বল,নাম্বার কোথায় পেলি?”
“সত্যি বলছি, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না! নিজের বাবাকে জিজ্ঞেস করে নেয় একবার……।”
স্নেহা কথা বলতে থাকলো, সেদিকে মন দিতে পারল না আর্য। স্নেহা তাদের বাড়িতে গিয়েছিল অথচ বাবা কিছু জানায়নি তাকে। এমনটা কেন করলেন তিনি? স্নেহা তাদের বাড়িতে গেছে এটা কি মানতে পারেনি! তিনি রেগে গেছেন? রাগতে যাবেন কেন?একটা ছেলের একটা মেয়ে বন্ধু থাকা অস্বাভাবিক নয়। গ্রামবাংলায় এই জিনিসটি সহজ-সরল না হলেও অশোক বাবুর কাছে খুব সহজ। তিনি রাগ করার মানুষ নয়। তিনি যদি রাগ করতেন তাহলে কখনো নাম্বার দিতেন না। সম্ভবত ভুলক্রমে এড়িয়ে গেছেন।
দুজন আরো অনেকক্ষণ ভালো মন্দ কথা বলল। তাদের বাড়িতে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করলো। তার বাবাকে ভালো লেগেছে স্নেহার। আর্যর মুখে সবসময় বাবার প্রশংসা শোনা যেত, মানুষটিকে দেখার প্রবণতা প্রবল ছিল। নিজের চোখে দেখে আরও বেশি ভালো লেগেছে। মানুষটি সত্যিই অনেক আলাদা। হার না মানা এক যোদ্ধা। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন অশোকবাবু। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র, একদিন স্কুল থেকে ফিরে জানলেন বাবা আর নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছেন। চোখের জল ফেলতে পারেননি। বাবা হারানোর কষ্ট ঠিক বুঝতে পারেননি সেদিন। শুধু দেখেছিলেন, বাবার মৃতদেহের পাশে বসে পাঁচ বোন অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। ছোট ভাই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বাবা চলে গেলেন শান্তির জায়গায়, কিন্তু তার ছেলেমেয়েকে ফেলে দিয়ে গেলেন। তারা কি করে বাঁচবে? দুবেলা কি খাবেন -তার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন না। তিনি বাড়ির বড় সন্তান ছিলেন, দায়িত্ব অনেক। মায়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ শুরু করলেন। যে বয়সে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে কেটলির মধ্যে খাওয়া নিয়ে ক্ষেতের জমিতে গেলেন। মা ছেলে কঠোর পরিশ্রম করে পাঁচ বোন আর ভাইয়ের মুখে অন্ন তুলে দিলেন, তাদেরকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করলেন। স্বামী হারানোর কষ্ট বেশি দিন সহ্য করতে পারলেন না, তিনিও কয়েক বছরের মধ্যে বিদায় নিলেন। তাও সংসার ভাঙতে দিলেন না অশোক বাবু। একা লড়ে গেলেন। অন্নপূর্ণা দেবীকে ঘরে বউ বানিয়ে নিয়ে এলেন। বাবা-মা কেউ নেই, বাড়ির সবচেয়ে বড় সদস্য তিনি নিজেই। নিজের পছন্দের মত বিয়ে করলেন। অন্নপূর্ণা দেবী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ছিলেন না, বাড়ির সকল সদস্য মনোক্ষুন্ন হলেন। নিঁচু পরিবারের মেয়ে তাদের বাড়িতে এসে তাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া অন্নপূর্ণা দেবীর গায়ের রং কালো কুচকুচে, কেউ মেনে নিলেন না, আবার বাড়ি ছেড়ে যেতেও পারলেন না। কারণ, তারা তখন সম্পূর্ণ অশোকবাবুর উপর নির্ভরশীল। বিয়ের মাত্র দুমাস পরে অন্নপূর্ণা দেবী মাঠে নামলেন। স্বামীকে কাজে সাহায্য করলেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আবার লড়াই করতে শুরু করলেন। উনিশ শতকে পণপ্রথার প্রবণতা প্রবল ছিল। সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনি সমস্ত বোনকে পণ দিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর লড়াই খুব অল্প ছিল না। এই লড়াইয়ের মর্ম একজন সৎ মানুষ বুঝতে পারবেন। কিন্তু কখন আপন মানুষগুলো পর হয়ে গেলেন বুঝতে পারলেন না। যাদের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করে লড়াই করেছিলেন, যাদের জন্য ছোটবেলা বিসর্জন দিয়ে নরম হাত খুব সহজে বলিষ্ঠ হাতে পরিণত করেছিলেন, যাদের জন্য সুদর্শন শরীর কাদা মাখা করেছিলেন,আজ তারা একবারও ঘুরে তাকায় না। তাতেও কোনো আক্ষেপ নেই অশোক বাবুর। মানুষ মাত্রই ভুল করে, তাদেরকে ক্ষমা করা শ্রেয়। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবীর মানতে পারে না। তাইতো তিনি এত রাগ অভিমান বুকের মধ্যে পুষে রেখেছেন। গর্ভে ধারণ করার ছেলে নিজের মায়ের পরিশ্রমের মূল্য না দিয়ে পিসিদেরকে……..।
দীর্ঘদিনের পর দু’জনের কথা হচ্ছে। কথার কোনো শেষ নেই। সীমানা পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে তারা। অনেকক্ষণ পর স্নেহা বলল,”তুই অতদূর পড়তে চলে গেলি কেন?”
“গভর্নমেন্ট কলেজে সিট পেলাম না তাই!”
“আবার মিথ্যা!”
“সত্যি,আমি গভর্নমেন্ট…।”
“বিশ্বাস হচ্ছে না, তবুও মেনে নিলাম। কিন্তু বাংলায় তো প্রাইভেট কলেজ কম নেই, এইসব কলেজে না পড়ে একদম চলে গেলি দক্ষিণ ভারতে। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না? কি করে আছিস ওখানে? আমিতো একটা মুহূর্তও থাকতে পারতাম না।”
“আমি নিজেও জানি না -এখানে কেন এলাম। বাবার কথাতে আমি এখানে এসেছি। আরও আশ্চর্য বিষয় কি জানিস, কলেজ শুরু হওয়ার প্রায় দু’মাস আগে থেকে এখানে এসে বসে আছি। বাবার আসল উদ্দেশ্য কি আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।”
স্নেহা উত্তর দিল না। একটুখানি চুপ থেকে বলল,”আমিও তোর বাবাকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারি না। ফোন নাম্বার নিয়ে যখন নিজের বাড়ি ফেরার জন্য তোদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম, তখন আমার ভাই তোর বাবাকে প্রনাম করে নিল, ভাইয়ের দেখাদেখি আমিও আবার একবার প্রণাম করলাম। সেই সময় তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’জানিস মা, পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক সারা জীবন অটুট থাকে না।’ আর কিছু বললেন না -শুধু মৃদু হাসলো। পুরো রাস্তা সেই কথা ভেবে ভেবে বাড়ি ফিরেছি। সত্যিই কি পৃথিবীর কোন সম্পর্ক সারা জীবন অটুট হয় না? আমার তো তেমনটা মনে হয় না।”

পর্ব ১১ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here