কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১২
___________________
মেধাহালিতে মিষ্টি সূর্যি মামা তার মিষ্টি সূর্যালোক চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। হালকা উষ্ণ হতে শুরু করেছে শহর। চতুর্দিকে একটা গনগনে পরিবেশ। কর্মযোগী মানুষ ছুটে চলেছে কর্মক্ষেত্রে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা পাখি কিচির মিচির করতে করতে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাসস্ট্যান্ডের একটা কোণে দাঁড়িয়ে মিষ্টি সূর্যালোক মাখছে আর্য। পাশে অনেকগুলো খাবারের দোকান, দোকানের রাঁধুনি ইডলি আর ধোসা বানাতে ভীষণ ব্যস্ত। দোকানের সামনে রয়েছে খদ্দেরের একটা বড় লাইন। কেউ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে আবার কেউ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রান্নার সুগন্ধি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের ভাব প্রকাশের ভঙ্গি এবং খুব সহজ সরল ভাষা আর্য কিছুই বুঝতে পারছে না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর চলাফেরা লক্ষ্য করছে সে। এক দেশ অথচ পার্থক্য বিশাল। তারা কি বলছে সামান্য সেটুকু বুঝতে পারছে না। বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারছে না। আর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওই লোকগুলোকে ভালোভাবে দেখতে লাগলো। তাদের খুঁটিনাটি সবকিছু ধৈর্য সহকারে লক্ষ্য করল।
“কি ব্যাপার! ওইভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছো? কলেজ যাবে না?” পরিচিত কণ্ঠস্বরে হুঁশ ফিরল আর্যর। সামনে ঘুরে দেখল গত পরশু দিনের পরিচিত সেই মেয়েটি। ঠোঁটে হালকা চাপা আনন্দের হাসি বজায় আছে। মেয়েটিকে দেখার সাথে সাথে মুহূর্তটি বদলে গেল। আবার কেমন একটা স্নিগ্ধতা চারিদিকে ছড়িয়ে পরল।
“হ্যাঁ..না… মানে যাব…।” হঠাৎ করে মুখের মধ্যে জড়তা আসলো কেন বুঝতে পারল না আর্য। মেয়েটিকে দেখলে এত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় কেন? সে তো কোনো বাঘ ভাল্লুক নয় যে তাকে খেয়ে নেবে। জাস্ট একবছরের সিনিয়র আর কিছু নয়। সেও আর চারটি মানুষের মত মানুষ। তার মুখের জড়তা মেয়েটিকে আরও বেশি রোমাঞ্চিত করল। নিজের প্রিয় হাসিটি ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল। বলল,”আমার স্কুটারের পেছনে বসো। একসঙ্গে যাওয়া যাক।” আস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হলো সে। মাথায় নতুন কোনো ভাবনা আসছে না। মেয়েটির স্কুটারে বসলো। রোজই এই পথে বাসে যাতায়াত করে। হোস্টেল থেকে কলেজের দূরত্ব সামান্য, সহজে হেঁটে কলেজে যাওয়া যেত। কিন্তু হোস্টেল ছাড়ার পর কলেজ থেকে নতুন ভাড়া বাড়ির মধ্যে ব্যবধান প্রায় আট কিলোমিটার বেড়ে গেছে। প্রত্যেকদিন একই বাসস্ট্যান্ডে বাস ধরে কলেজে যায় আবার ফিরে আসে। এতগুলো দিনের মধ্যে মেয়েটির সম্মুখীন কখনো হতে হয়নি। হয়তো সেও নিয়মিত এই পথে যাতায়াত করে। সময়ের বিভিন্নতার কারণে পরিচয় হয়নি; কিংবা মেয়েটি আর্যকে দেখলেও এড়িয়ে গেছে। গত পরশু কথা বলার পর সহজ সরল হওয়ার চেষ্টা করছে। মেধাহালির মসৃণ রাস্তায় সমস্ত গাড়ি যেখানে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে সেখানে মেয়েটির স্কুটার খুব ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীরেসুস্থে ধৈর্যের সঙ্গে স্কুটার চালাচ্ছে সে। ক্ষণিকের নীরবতায় আর্যর মাথার মধ্যে অনেক ভাবনা জেগে উঠল। স্কুটারে ওঠা আদৌ কি ঠিক হয়েছে? না না টাকার কথা কখনো চিন্তা করেনি সে।বাসে নিয়মিত যাতায়াত করলেও কলেজের স্টুডেন্ট হওয়ায় তার কাছ থেকে একটি টাকাও নেয় না। আইডি কার্ড দেখালেই ছাড়পত্র মেলে। এই জিনিসটা তার বেশ ভালো লেগেছে। আবার পরক্ষণেই ভাবে, তারা এক কলেজের স্টুডেন্ট। একটু মেলামেশা করলে অসুবিধা নেই। মেয়েটিকে নিশ্চুপ দেখে আর্য মুখ এদিক ওদিক ঘুরে মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করল। মেয়েটিকে যতবার দেখে ততবারই রিম্পির কথা মনে পড়ে। কত শান্তশিষ্ট স্নিগ্ধতায় ভরপুর। হালকা বাতাসে মেয়েটির চুলের খোপায় বাঁধা রজনীগন্ধার মালা উড়ে এসে আর্যর মুখে লাগছে।ফুলের নিজস্ব একটা মোহ আর মেয়েটির চুলের ঘ্রাণ মিশে একটি নতুন গন্ধের সৃষ্টি করেছে।এই কয়েকদিন ধরে এখানকার মানুষের খাদ্যাভাস,আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক,ভাষার অমিল দেখে আসছে, আর এখন আবিষ্কার করল এদের মধ্যে গন্ধটুকুও আলাদা। এই গন্ধ পরিচিত নয়। এদের চুলের ঘ্রাণ ও সামান্য আলাদা। এক বিচিত্র মুহূর্ত আর এক বিচিত্র দৃশ্য। নতুন জিনিস গুলো চিনতে এবং অনুভব করতে ভালোই লাগছে। চারিদিকে শুধু স্নিগ্ধতা উজ্জ্বলতা আর প্রাণবন্ত ভালোবাসা। কিছুটা দূরে এগিয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি বলল,”তুমি মেধাহালিতে থাকো? এখানে পরিচিত কেউ আছে বুঝি?”
“পরিচিত কেউ নেই। আমি প্রথমে হোস্টেলে থাকতাম, ওখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলাম না,তাই এখন ভাড়া বাড়িতে থাকি।”
“তাহলে তো নিজেকে রান্না করতে হয়।”
“তাও করতে হয় না। ওই বাড়ির মালিকিনী করে দেন।”
“তাহলে নিজের বাড়ির মতই আছো। কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।”
“কোনো অসুবিধা হয় না, তবে টাকার অংক একটু বেশি এই আর কি।”
আবার কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে আর্য মেয়েটিকে প্রশ্ন করল,”তুমিও কি মেধাহালিতে থাকো?”
“না, আমি মেধাহালির পাশের বাটারহালিতে থাকি।”
মেয়েটির মুখের কথা শেষ হতেই আর্য হা হা করে হেসে উঠলো। তার হাসির কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারল না বিপরীত মানুষটি।
“হাসছো কেন?”
“এমনি। তোমাদের শহর গুলোর নাম বড্ড সুন্দর। মেধাহালি! বাটারহালি!আর কি কি হালি আছে?” আবার হাসি বিনিময় করল।
“এমন গৌণ বিষয়ে হাসতে হয় নাকি?” আর্য মাথা নাড়ালো। তার মাথা নাড়া দেখতে পেলো না মেয়েটি। বুঝতে পারল, এরা সমস্ত কিছুকে সিরিয়াস নিয়ে নেয়। বিশেষ করে তাদের কালচার, কিংবা শহরকে নিয়ে খিল্লি করলে। বাঙ্গালিদের মতো এত ইয়ার্কি-ফাজলামি পছন্দ করে না।
“এই ছেলে, তোমার পুরো নাম কি?এতক্ষণ ধরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি অথচ তুমি আমার নাম জানতে চাইলে না।” আর্য লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মাথা নিচু করে নিজের নামটি বলল। স্নেহার কথা মনে পড়ল। একবার বলেছিল অমিশুক ছেলেদের সবাই এভোয়েট করে। মেয়েটির সঙ্গে মিশুক আর না মিশুক অন্তত সোহার্দ্য খাতিরের মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। একটু আমতা আমতা করে মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করল আর্য। ভেবেছিল মেয়েটি কথা ঘোরাবে। নিজের নাম বলবে না। তেমন কিছু না করে সে বলল,”লক্সমি, লক্সমি সুলোচনা।” আর্য মনে মনে বার তিন একবার মেয়েটির নাম উচ্চারণ করার চেষ্টা করল। এত কঠিন নাম! ঠোঁট টিপে হাসল। পূর্বে শুধুমাত্র রিম্পির সাইকেলের পিছনে বসে ঘুরেছে। কখনো অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে স্কুটারে কিংবা সাইকেলে চেপে একসঙ্গে ঘোরাঘুরি হয়নি। এমন মুহূর্ত গুলোর সঙ্গে অপরিচিত সে। এমন একটা মুহূর্তের সাক্ষী না হলে কখনো জানতে পারত না এই মুহূর্তগুলো অনেক প্রিয় হয়। তার জীবনে এমন একটা মুহূর্ত আসলো, আর এই মুহূর্তের সঙ্গী হলো এক অপরিচিতা ভিনদেশী। কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পর তারা একসঙ্গে হেঁটে চলল। হাঁটতে হাঁটতে লাক্সমি বলল,”দেশে এত কলেজ থাকতে তুমি এই কলেজে আসলে কেন?”
“গভমেন্ট কলেজে চান্স হয়নি, তাই এখানে চলে এসেছি।”
“প্রাইভেট কলেজ তোমাদের রাজ্যও রয়েছে। আমার মনে হয় এখানে আসার প্রয়োজন ছিল না।”
“প্রয়োজন থাকবে না কেন? দেশের বড় বড় ইউনিভার্সিটিগুলো এখানে রয়েছে। কত ছাত্র ছাত্রী পড়াশোনা করছে। সবাই একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে।”
“বড় ইউনিভার্সিটি মানে সবকিছু ভালো এমনটা নয়। ওর মধ্যে কত ঘাপলা থাকে বুঝে উঠতে পারবে না। যতই অগোছালো হোক না কেন নিজের মা কিন্তু সবসময় প্রিয়। যতই খারাপ হোক না কেন নিজের মাতৃভূমি সবসময় প্রিয় । আর তেমনিই নিজের দেশে ইউনিভার্সিটি যত ছোট আর বড় হোক না কেন সেগুলো সব সময় প্রিয়।” কথা বলতে বলতে তারা ক্লাসরুমের কাছে পৌঁছে যায়। হঠাৎ করে লাক্সমি কাউকে দেখে ঠোঁটের স্মাইল দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। একটু খেয়াল করে দেখল আগের দিন লাইব্রেরীর মধ্যে আলপনা দেওয়া ফর্সা মেয়েটি। লক্সমি আর আর্যর সঙ্গে কথা বলল না -ফর্সা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলল। তাতে কোনো আক্ষেপ থাকল না আর্যর। শুধু লক্সমির বলা শেষ কথাগুলো ভাবল। কথার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করল।
অহনা নদীর তীরে পরপর তিনটি কফি হাউস রয়েছে। কফি হাউসগুলোতে সব সময় আড্ডায় ভরপুর থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের একটা দারুন জায়গাও বটে। কফি হাউস গুলো যেমন বছরের পর বছর ধরে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর ইতিহাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি অনেক বিচ্ছেদের সাক্ষীও আছে তারা। কত প্রেমিক প্রেমিকা এখানে এসে নিজেদের মধ্যে ডুবে গেছে। আবার কত প্রেমিক প্রেমিকা এখানে এসে শুধু ভালোবেসে গেছে। মাঝখানের কফি হাউসের একদম সাইডে টেবিলের কাছে বসে আছে স্নেহা। খুব শান্ত পরিবেশ থাকলে অহনা নদীর কলকল জলের ধ্বনি কানে পৌঁছায়। শেষ সূর্যের রশ্মি নদীর জলে এসে পড়েছে। হালকা জলের ঢেউ আর সূর্যরশ্মি মিলে সোনালী আভা তৈরি হয়েছে।এক জেলে নদীতে জল ফেলতে ব্যস্ত।তার আবছা ছায়া নদীর উপর বৃহৎ আকারে পড়েছে। এমন সৌন্দর্য মনে দাগ কাটতে পারছে না স্নেহার। আজ অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে বিক্রমের সঙ্গে কথা হয়নি। যে মানুষটিকে একদিন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিল ভালোবেসে ছিল সেই মানুষটি আজ তাকে অবহেলা করছে। অবহেলা কতটা কঠিন, যে পেয়েছে কেবল সেই বোঝে।কাউকে এক বুক ভালোবাসার পরেও যখন সেই মানুষটা অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন বুকটা ফেটে যায়। ভুবনময় সবকিছুই বিরক্তকর হয়ে ওঠে। জীবনের চাকা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। স্নেহা জানে এর পেছনে শুধু বিক্রম নয় নিজেও সমান দায়ী। সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকে। সেগুলো মানিয়ে নিতে হয়। আর যদি না মানিয়ে নিতে পারে তাহলে মনের আনাচে কানাচে কোথাও না একটা খারাপ লাগা থেকে যায়। আর খারাপ লাগা থেকে শুরু হয় অস্বস্তি। অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে মানুষ কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হয় না। এমন কথা বহুবার ভেবেছে স্নেহা। আজ তেমন একটা সমস্যার সম্মুক্ষিনে দাঁড়িয়ে আছে। ভুল না থাকার সত্বেও একটা মানুষের কাছে বারবার ক্ষমা চেয়েছে,সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য। আর বিপরীত মানুষটি শুধুই ইগো দেখিয়ে গেছে। তার কাছে ইগোই সবকিছু। যে মানুষের প্রচুর ইগো রয়েছে সে মানুষের শত্রুর প্রয়োজন হয় না, এটুকুই যথেষ্ট।বিক্রম বুঝতে পারেনি, হয়তো, কোনোদিন বুঝতে পারবেও না। অনেকদিন কথা না হওয়ায় স্নেহার মন বারবার কেঁপে উঠেছে। চোখের জল মাটিতে ফেলেছে। কখনো বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে। আবার কখনো উদ্দেশ্যবিহীন একাকীত্ব পথে হেঁটে বেরিয়েছে। বারবার ঝগড়ার পর ক্ষমা চেয়েছে, আজও চেয়ে নেবে। মনের মধ্যে কোনো রুপ আক্ষেপ না রেখে তাদের প্রিয় জায়গাটিতে চলে এসেছে। অনেক স্মৃতি রয়েছে এখানে। এক জায়গায় বসে কত গল্প করেছে -তা শুধুমাত্র ঈশ্বরই জানেন।বিক্রম এখনো আসেনি। তবে খুব শীঘ্রই আসবে আশাবাদী স্নেহা। আশানুরূপ হলো। বিক্রম উপস্থিত হলো। তার পাশে এসে বসল। স্নেহার দুটো চোখ ছল ছল করছে। সে এতক্ষণ ধরে ভাবছিল, আজ কতগুলো দিন শুধুমাত্র নিজে কষ্ট পেয়ে এসেছে। সে সম্পূর্ণ ভুল। বিক্রমের উজ্জল মুখশ্রী হারিয়ে গেছে, অভিমানী চোখের নিচে কালি জমেছে। কতগুলো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে জানা নেই। স্নেহার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ভাবল, বিক্রম প্রত্যেক দিনের মতো আজও তার চোখের জল মুছে দেবে। এমনটা কিছুই করল না বিক্রম। খুব নিবৃত্ত ভাবে বসে রইল। পরিবেশ আরও শান্ত হয়ে উঠল। এবার নদীর কল কল জলের ধ্বনি কানে পৌঁছলো। এক বৃদ্ধ এসে দুজনের সামনে দুকাপ কফি রেখে গেল। উভয়ই একবারের জন্যও চুমুক দিল না। বিক্রম মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,”সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাস পড়েছো?” মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। হঠাৎ করে উপন্যাসের মধ্যে চলে যাওয়ার হেতু বুঝল না স্নেহা। হয়তো একজন বই প্রেমিকের কাছে এটাই স্বাভাবিক। যার কাছে যেটা ভালো লাগে সে সব সময় চেষ্টা করে তার ভালোলাগার জিনিসটিকে উদাহরণ বানিয়ে উক্ত ঘটনাটির সমাধান করার।
“দীপাবলি আর অলোকের বিচ্ছেদের কথা মনে আছে তোমার? বিচ্ছেদের কারণ কি ছিল জানো?তারা একে অপরকে মানিয়ে নিতে পারেনি। একে অপরের কাজে ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল। তারা মনে করেছিল,তাদের ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরকে অপমানিত করেছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেদের ভুল শোধরাতে পারেনি। দীপাবলি একটা দামী কথা বলেছিল,’ভুল তুমি নয়, ভুল আমিও নয়, ভুল আমরা’।”
“হঠাৎ করে তুমি উপন্যাসের মধ্যে চলে গেলে কেন? উপন্যাস তো উপন্যাসই হয়। বাস্তব জীবনে তা কতটা গ্রহণযোগ্য?”
“এতদিন আমিও ঠিক এই কথা ভেবে এসেছিলাম। গল্প গল্পই হয়, বাস্তবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার ভুল ভেঙেছে। সব গল্প গল্প নয়, একটা জীবনও। মানুষের জীবন নিয়ে তো গল্প তৈরি হয়। আজকে আমরা তেমন একটা পরিস্থিতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দিনের পর দিন এই অস্বস্তি ভালো লাগছে না। আমি অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে চাই?” স্নেহা ভেজা গলায় হালকা হাসলো। তার হাসি অবশ্য অবাক করল বিক্রমকে। স্নেহা কল্পনা প্রেমিক। খুব সহজে সিরিয়াস হয় না। তবে এমন পরিস্থিতিতে সিরিয়াস হবে না,-তা প্রায় অসম্ভব। তার হাসিতে তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপ প্রকাশ করছে।
“কি হলো? ওই ভাবে হাসছো কেন?” স্নেহার হাসি মোটেও পছন্দ হলো না বিক্রমের। রেগে চোখ দুটো লাল করে ফেলল।
“নতুন কাউকে পেয়ে গেছো আমার কাছে আর থাকতে চাও না সোজাসুজি বললেই হলো, -এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি আছে!” স্নেহার কন্ঠস্বর অভিমানে পরিপূর্ণ।
“ঠিকই ধরেছো, আমি আর তোমার সঙ্গে থাকতে চাই না। তবে নতুন কাউকে পেয়েছি বলে আমি চলে যাচ্ছি না। আমি তোমাকে মন থেকে গ্রহণ করেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম। তুমি ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারনি। এই দুটো বছর শুধু কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে এসেছো। এছাড়া আর কিছু নয়।”
“চমৎকার! হাততালি দেবো?” বিক্রম মাথা নিচু করে ফেলে। স্নেহা এই ভাবে তাকে আঘাত করবে বুঝতে পারেনি। তবুও নিজেকে শান্ত রাখল। স্নেহার ক্ষতবিক্ষত দেহ সবকিছু মেনে নিতে পারছে না। মনের গভীর থেকে ক্ষোভ রাগ বেরিয়ে আসছে।দোষ শুধু স্নেহার নয়, নিজেরও। নিজেই স্বপ্ন দেখিয়েছিল আবার নিজেই সেই স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। বিপরীত মানুষটির কষ্ট অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা এখনও জন্মায়নি। বিক্রমকে কোনো কথা বলতে না দেখে স্নেহা বলল,”আচ্ছা মেনে নিলাম নতুন কাউকে পাওনি? তাহলে চলে যাচ্ছ কেন?” বিক্রম কোনো উত্তর দিল না। এক প্রশ্ন দ্বিতীয় বার করলো স্নেহা।
“প্রশ্ন আমাকে করে লাভ নেই। তুমি নিজেকে করো ?”
” উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না বলে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।”
“ওই যে একটা কথা বললাম….।তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসনি। এই দুটো বছর শুধু কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছো।তুমি সামান্য সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য অনেকটা নিচে নেমে যাও। নিজের বাবা-মাকে রোগী বানিয়ে দাও। সব সময় কল্পনায় ভাসতে থাকো। নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করে ফেলছ। তুমি কি ভাবো,সারাদিন কোনো কাজ না করে, পড়াশোনা বন্ধ করে আমার সঙ্গে কথা বললে আমি খুশি হয়ে যাই। আমি কখনো খুশি হয়নি। যে নিজেকে ভালবাসতে পারে না সে কখনো অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না। এই এক কথা তোমাকে আমি সবসময় বলেছি কিন্তু তুমি কখনো শোনোনি। তুমি নিজে হাতে সব কিছু শেষ করছ, আর একদিন তুমি নিজেই আবার আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে তোমার জন্য আমার সবকিছু শেষ হয়েছে। কারোর অতৃপ্ততা আর অসহিষ্ণুতায় আমি বাঁচতে চাই না।এসব বাদ দিলাম। তুমি আমায় ভালোবাসো অথচ একটা ছেলের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কথা বল….।”
“আর্য আমার বন্ধু বিক্রম! আমার ভালো বন্ধু।” বিক্রমের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে খুব দ্রুত বলল স্নেহা।
“আমি জানি, আমি কিন্তু কখনো বাধা দেইনি। আমারও বান্ধবী আছে আমিও তাদের সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা নয়। আমি মেনেও নিলাম তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলছো। কিন্তু কার সঙ্গে বলছো? যে মানুষটা তোমায় ভালোবাসে? তুমি সব কিছু জানো। আর্য তোমায় কতটা ভালোবাসে? তুমি কখনো আর্যকে ভালোবাসবে না, তারপরেও কি করে তার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলছো? তুমি তাকে ঠকাচ্ছ, তাই না! নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখো -তুমি সঠিক কি না! আমরা যদি দুজন ঠিক থাকতাম তাহলে তৃতীয়জন শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখে যেতো -কিছু করতে পারত না। আমরা দুজনেই ঠিক নেই। আমরা দুজনেই ভুল।” বিক্রম কথা শেষ করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ বসে থেকে স্নেহা কে লক্ষ্য করল। কেঁদে চোখ মুখ জলে ভাসিয়ে ফেলেছে। নিশ্চুপ এক পাথর বসে রয়েছে সামনে। বিক্রমের এমন দূশ্য ভালো লাগলো না। সে উঠে চলে যাচ্ছিল, তখনই ভরাট কণ্ঠস্বরে স্নেহা বিক্রমকে কাছে ডাকলো। ফিরে এসে আবার কাছে বসল।
“বাদ দাও পুরনো সব কথা। আবার নতুন করে
সবকিছু শুরু করি। আমি কথা দিচ্ছি আর কক্ষনো আর্যর সঙ্গে কথা বলবো না। আমি তোমার মতো করে চলবো।”
“বললাম না আমার প্রতি তোমার শুধু কৃতজ্ঞতা রয়েছে ভালোবাসা নেই। তুমি আবার একবার প্রমাণ করে দিলে। আমি কখনো তোমাকে মানা করেছি আর্যর সঙ্গে কথা বলতে। না কখনো বলেছি আমার সব কথা শোনতে। তুমি শুধু শুধুই আমার কাছে বন্দী হতে চাও। আর আমি কাউকে বন্দী করতে চাই না। জেলে বন্দী থাকা কয়েদির সঙ্গে যখন নিজের আত্মীয়-স্বজন দেখা করতে আসে, নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখি, নিজেকে আত্মীয়-স্বজনের সামনে স্বচ্ছ উজ্জ্বল নমনীয়তা প্রকাশ করে, মুক্তি না পেলেও তার চলবে। কিন্তু তার ভেতরে কষ্ট কেবল নিজে বুঝে।সে সেখান থেকে মুক্তি পেতে চায়, কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। নিজের জীবন শেষ হয়ে গেছে, তাই সে চায় না তার কথা ভেবে অন্য কেউ নিজের জীবন শেষ করে ফেলুক। তোমার আমার ভালোবাসা জেলের কয়েদি আর আত্মীয়স্বজনের মত।”
বিক্রম আবার হাসল। এই হাসির মধ্যে কোনরূপ তাচ্ছিল্য কিংবা ঘৃণা নেই, স্বাভাবিক হাসি। স্নেহার চুল এতক্ষণে এলোমেলো হয়ে গেছে। ঘামে চুলগুলো ভিজে গেছে। চোখের ধারা চিবুক বেয়ে নিচে পড়তে শুরু করেছে। গালদুটো চটচট করছে। তবুও সম্পর্ক বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করল। বলল “তবুও একবার ভেবে দেখো না! সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখবে!”
“আচ্ছা মেনে নিলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। আমরা বিয়েও করে নিলাম। তারপর কি হবে?”
“দুজনে সুখে শান্তিতে সংসার করবো।”
“তারপর?”
“তারপর আর কি! আমাদের সন্তান হবে। তাদেরকে বড় করব। সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করব।”
“তারপর তারাও পছন্দের মত কাউকে বিয়ে করে নেবে। আর আমরা মেনে নেব।”
“না, তা কি করে হয়? তারা তো তখন ছোট থাকবে। সঠিক আর ভুলের মধ্যে পার্থক্য বুঝে উঠতে পারবে না।” স্নেহা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বিক্রম হাসতে রইল। হাসতে হাসতে বলল,”আমরাও ছোট আছি। এখনো আমরা সঠিক আর ভুলের মধ্যে পার্থক্য বুঝি না। আমাদের উচিত বাবা-মার কথা শোনা। তাদের পছন্দের মত জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়া।” স্নেহা থতমত খেয়ে গেল। তার কথায় কখন তাকে হারিয়ে দিল বুঝতে পারল না। সে আর কিছু বলল না। বিক্রম উঠে দাঁড়ালো। বলল,”ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো। ঠিকমতো ওষুধ খাবে। একদম কাঁদবে না। রাত জাগবে না। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। পড়াশোনায় মন দাও।” শুধু মাথা নড়িয়ে গেল স্নেহা। কিছু বলতে পারলো না। বিক্রম চেয়ার নাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আবার বলল,”কাঁদবে না তো!”স্নেহা মাথা নাড়িয়ে না বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল ঝড়ের মত তার শরীর কাঁপছে। ঠোঁট কামড়ালো। তার দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছে না। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মানুষটি হন হন করে বেরিয়ে গেল। কফি কাপ দুটো সামনে পড়ে রইল। এখনো পর্যন্ত কেউ এক চুমুক দেয় নি। এই মানুষটি এক সময় এক মুহূর্ত কথা বলার জন্য কতটা পাগল হয়ে থাকতো। আর আজ তার কাছে সময় নেই। ছুট্টে বেরিয়ে গেল। নদীর দিকে তাকালো স্নেহা। জ্যোৎস্নার আলো নদীর জলে পড়ছে। ঢেউ এর মধ্যে চাঁদ মামাকে অনেক বড় আর কাটা কাটা দেখাচ্ছে। নদীর জল কলকল ধ্বনিতে বয়ে যাচ্ছে কোন এক সাগরে। জেলেটি বাড়ি ফিরে গেছে। শান্ত স্নিগ্ধ নদী। এই নদী কোনো এক পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে। উৎপত্তিস্থলে নদীর জল যতটা স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার ছিল এখানে কি ততটা স্বচ্ছ পরিষ্কার আছে? একটি নদীর জল উৎপত্তিস্থলে যতটা স্বচ্ছ উজ্জ্বল পরিষ্কার থাকে, সেই নদী মোহনা পর্যন্ত যে অতটা স্বচ্ছ উজ্জ্বল নমনীয় থাকবে তার কোনো মানে নেই। একটা সম্পর্ক ঠিক এমন। প্রথমের দিকে যত পরিমাণ স্বচ্ছ উজ্জ্বল নমনীয় থাকে শেষের দিকেও তেমনটিই থাকবে তার কোনো গ্যারেন্টি নেই। বিভিন্ন আঘাত প্রত্যাঘাতে উজ্জলতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
পর্ব ১৩ আসছে