কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১৩
__________________
বয়সন্ধিকালে প্রেম, কিছুটা শরীরে বেরোনো ফোড়ার মত। যতদিন পর্যন্ত থাকবে ততদিন শরীর ব্যথায় টনটন করতে থাকবে। ফোড়া ফেটে যাওয়ার পরও শান্তি নেই, অনেকদিন পর্যন্ত একটা কালো দাগ থেকে যায়। সেই কালো দাগ থেকে মুক্ত হতে পারছে না বিক্রম। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। যার সঙ্গে অনেকগুলো দিন একসঙ্গে থেকেছে। খারাপ কিংবা ভালো যে কোনো বিষয় সবার প্রথম যে মানুষটিকে বলেছে। মানুষটির হাত ধরে খোলা আকাশের নিচে হেঁটেছে। মানুষটির অভিমানী দুটি চোখ দেখে ভুবন ভরা খুশি হৃদয়ে ভরে উঠে,খুব সহজে তাকে কি ভোলা সম্ভব? বাইরের দিক থেকে সম্পর্ক ভেঙে গেলেও মনের দিক দিয়ে আজও গভীর রয়ে গেছে। সম্পর্কে থাকাকালীন যেমন অস্বস্তি হতো,সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পরও অস্বস্তি থেকে গেছে। নিজের রাগ জেদ কমিয়ে তার কাছে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে না। যেখান থেকে একবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেখানে দ্বিতীয়বার ফিরে যাবে না। বাড়িতেও শান্তিতে থাকতে পারছে না। দিদি বারবার কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। সে যখন রাতের পর রাত জেগে স্নেহার সঙ্গে কথা বলতো,ঋতু বরাবরই বিরক্ত হতো। এইটুকু ছেলে প্রেম করছে। অনেক সময় ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন ছাড়িয়ে নিয়েছে। কখনো কখনো বড়দিদির মত বুঝিয়েছে। প্রেম করো অসুবিধা নেই, তবে তা যেন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। নিজের কাজ, পড়ালেখা বাদ দিয়ে অন্য কারোর ধ্যানে মগ্ন থাকা ভালো নয়। বাবা-মার অবাধ্য যেন না হয়। আবার কখনো মাকে সব কিছু বলে দিয়েছে। তারা যেন ভাইকে সাবধান করে দেয়। না হলে পরে পস্তাতে হবে। তাইতো দিদি আর ভাই এর মধ্যে সবসময় বাদানুবাদ লেগে থাকতো। ঋতু মন থেকে চাইত না অল্প বয়সে ভাই প্রেম করুক। তাছাড়া স্নেহাকে একদমই পছন্দ করতো না। স্নেহার কানের কাছে কাটা অংশ একদম বিচ্ছিরি দেখাতো, তার হাসি কেমন একটা জংলির মতো। বড় বড় দাঁত বের করে উচ্চস্বরে হাসে স্নেহা। ধীরেসুস্থে কথা বলতে জানে না, তাদের পরিবারের সঙ্গে মানানসই নয়। তাই বারবার স্নেহার প্রতি বিরূপ আচরণ করে এসেছে ঋতু।
কিন্তু ভাইয়ের হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। যতই হোক সে একটা মেয়ে। একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের কষ্ট বুঝবে না তা হতে পারে না। একজন মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়ে তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া হয়তো বিপরীত মানুষটির কাছে সহজ কিন্তু মেয়েটির বুকের যন্ত্রণা কতটা গভীর তা বোঝা সম্ভব নয়। ঋতু ভাইয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছে। স্নেহাকে পছন্দ করতো না ঠিকই, তবে সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়াটা মানতে পারছে না। ভাইকে উঠতে-বসতে কথা শোনিয়ে যাচ্ছে। কোনো উত্তর দেয়নি বিক্রম। মুখ বন্ধ করে সবকিছু সহ্য করছে। বন্ধুদের কাছেও যেতে পারছে না। তারাও দাবি করেছে, সম্পূর্ণ ভুল বিক্রমের। তার উচিত স্নেহার কাছে ফিরে যাওয়া আর ক্ষমা চাওয়া। তবে সম্পূর্ণ ভুল নিজের তা মানতে পারছে না বিক্রম। ভুল দুজনের। যে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে সেই সম্পর্ক নতুন করে গড়তে চায় না। ফিরে গেলে হয়তো কয়েকদিনের জন্য ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু পরে আবার একই রাস্তায় গড়বে। আবার অন্য এক মানুষের কৃতজ্ঞতায় বাঁচতে হবে। পারবে না কারোর কৃতজ্ঞতায় বাঁচতে। জীবনে আর যাই হয়ে যাক মাথা নিচু করবে না। ভালোবাসা মানে শুধু কৃতজ্ঞতা নয়। ভালবাসা মানে সম্মান, শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস। এগুলো একটিও নেই স্নেহার মধ্যে। সবাই তাকে ভুল বুঝছে মানে সে ভুল -তা নয়। সব সময় ভিড়ে ভরা রাস্তা সঠিক হয় না।
এক মাসের মত ক্লাস করার পর আর্য বুঝতে পারলো, তার পুরনো স্কুল আর বর্তমান কলেজের মধ্যে তেমন একটা বৈসাদৃশ্য নেই। সকাল এগারোটা থেকে স্কুল শুরু হয়ে যেত আর শেষ হতো সাড়ে চারটায়। মাঝখানে এক ঘন্টা টিফিন থাকতো। কলেজের সময় প্রায় অনুরূপ। সকাল নয়টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল চারটে পর্যন্ত ক্লাস হয়। মাঝখানে মাত্র এক ঘণ্টা টিফিন থাকে। পশ্চিমবাংলায় বেশিরভাগ স্কুল এবং কলেজে শিক্ষিকার তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা বেশি, আর এখানে ঠিক তার বিপরীত। এক মাসের মধ্যে তার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। সেদিন লাইব্রেরিতে চুপচাপ বসে থাকা ছেলেটির সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। আসলে, সে নিজেও বাঙালি, তবে তার বাড়ি পশ্চিমবাংলায় নয়, পূর্ব বাংলায়। এমন ভিন রাজ্যে দুজন বাঙালি হওয়ায় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব খুব গভীরভাবে গড়ে উঠেছে। তবে পূর্ব বাংলা থেকে শুধু আরিফুল একা নয়, তার সঙ্গে ইয়াসমিনও এসেছে। ইয়াসমিনের সাথেও কথা হয়েছে আর্যর। অবাঙ্গালীদের মধ্যে দুজন বাঙালিকে কাছে পেয়ে খুব খুশি সে। টিফিনের সময় একটু বিরক্ত হতে হয়। অধিকাংশ ক্লাসমেট কলেজের হোস্টেলে থাকে। টিফিন হওয়া মাত্রই নিজেদের রুমে ফিরে যায় আহার সম্পন্ন করার জন্য। আর্যর পক্ষে নিজের বাসায় ফেরা সম্ভব নয়। এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে হয়। আবার কখনো দাঁড়িয়ে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই সময়টা কিছুতেই পার করতে পারে না। এক একটা প্রহর তার কাছে এক একটা সপ্তাহ লাগে। একাকিত্বের সময় বহু স্মৃতি মনে পড়ে যায়। মনের কোনো গভীর স্থান কখনো কখনো টনটন করে ওঠে আবার কখনো আহ্লাদে ভরে ওঠে। কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন ছিল আর্য। হঠাৎ লক্সমির ডাকে তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। পেছনে ঘুরে দেখল, পরিচিত দুটো মুখ। সোয়াতি আর লক্সমি। সেদিন লাইব্রেরীর মধ্যে থাকা ফর্সা মেয়েটি সোয়াতি ছিল, -লক্সমির মুখ থেকে পরে জানতে পেরেছে।
“একা দাঁড়িয়ে কি করছো? আমাদের সঙ্গে যাবে?” আকস্মিক ঘটনায় থতমত খেয়ে গেল আর্য। মুখের মধ্যে জড়তা কাটিয়ে বলল,”কোথায়?”
“কোথায় আবার! হাই রোডের উপর। এখানে একা দাঁড়িয়ে বোর হবার চাইতে আমাদের সঙ্গে চলো। একটু হাঁটা যাক।” আর্য মাথা নাড়িয়ে তাদের সঙ্গে চলল। কলেজ ক্যাম্পাস পেরিয়ে হাই রোডের কাছে পৌঁছল। ফুটপাত ধরে তিনজন হাঁটতে লাগলো। লক্সমি আর সোয়াতি নিজেদের মধ্যে হালকা কথাবার্তা চালিয়ে গেল। আবার কখনো ঠোঁট টিপে হাসলো, আবার গুনগুন করে গান করল।আর্য মুগ্ধ হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারল না। তাদের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা তাদের ভাষাই বুঝতে পারল না। বড্ড অস্বস্তি লাগছে। সেখানে একা দাঁড়িয়ে বরং ভালোই ছিল। সেখানে শুধুমাত্র একাকীত্ব ছিল আর এখানে একাকিত্বের পাশাপাশি অস্বস্তি রয়েছে। অস্বস্তি নিয়ে হাঁটতে লাগল। অনেকটা পথ চলে এসেছে। সূর্যমামা মাথার উপর তীক্ষ্ণ ভাবে কিরণ দিচ্ছে। সকালের হালকা শীতল ভাব কমে গেছে, তবুও সোয়াতি পাতলা জ্যাকেট পরে রয়েছে। সম্ভবত তার একটু বেশি ঠান্ডা লাগে। ঝাঁ-চকচকে তকতকে রাস্তায় গাড়ি দ্রুত ছুটে চলেছে। বড্ড ব্যস্ত শহর। কেউ কারোর দিকে একবারও মুখ ফিরে দেখছে না।আরও কিছুদূর যাওয়ার পর দুজন থমকে দাঁড়ালো। বুঝতে পারে তাদের সঙ্গে একজন রয়েছে, যে তাদের ভাষা একটুও জানে না। আর্যকে দেখে লক্সমি মাথায় হাত চাপড়ালো। মৃদু হেসে উঠল।
“তুমি কিছু বলছো না কেন? তোমার উপস্থিতি টের করতে পারিনি। একবার তো অন্তত সাড়া দিতে পারতে।”
“নিজেরাই তো গল্প করে যাচ্ছ। আমি তো তোমাদের ভাষা বুঝতে পারি না।” লক্সমি একটু লজ্জা পেল। আর্যকে নিজেরাই নিয়ে এসেছিল আবার নিজেরাই তার উপস্থিতি ভুলে গেছে। একটু সংকোচিত হয়ে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে, চলো কিছু খাই।”
“তোমাদের খাবার! মানে কর্নাটকে তৈরি করা খাবার।”
“হ্যাঁ। কর্নাটকে থাকো কর্নাটকের খাবারই খেতে হবে। এখানে বাঙালি খাবার কোথায় পাবো?”
“তা তো ঠিক। আমরা নারকেল তেল মাথায় মাখি আর তোমরা সেই তেলে রান্না করে খাও। কেমন করে খাও তোমরা? তোমরা যদি একবার বাঙালি খাবার খাও তাহলে এখানে আর থাকবে না সোজা বাংলায় চলে যাবে। কখনও আসতে চাইবে না।”
“বোঝো না কেন বলতো! পূর্বে এক কথা তোমায় বার বার বলেছি। তোমাদের নারকেল তেল আর আমাদের নারকেল তেলের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ওটা বোঝার চেষ্টা করো। আর তোমাদের বাঙালি খাবার যতই ভালো হোক না কেন আমাদের কাছে প্রথমে খারাপ লাগবে।” আর্য আর কোনো উত্তর দিল না। অযথা তর্ক করা উচিত নয়। যদিও লক্সমির কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তার কথার মধ্যে নিজের রাজ্যের প্রতি গভীর ভালোবাসাও প্রকাশ পেল। তবে তাদের খাবার খাওয়া আর হলো না। আর্যকে খুশি করার জন্য তারা তিনটি আইসক্রিম কিনল। তারপর কলেজ ফেরার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। এবার আর্যকে পেছনে রাখল না। সামনে রেখেই কথা বলল। সোয়াতিও খুব সহজে আর্যর সাথে মিশে গেল।
কলেজ শেষ হওয়ার পর আরিফুল,ইয়াসমিন এবং আর্য একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করল। অবাঙালিদের ভিড়ে বাঙালি কথাবার্তা কিছু ছাত্রছাত্রীকে চরম কৌতুহলী করে তুলেছে। আগ্রহের সাথে তাদের কথা কেউ কেউ দাঁড়িয়ে শোনল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। বিষয়টি বুঝতে পেরে আর্য হাসলো। এতক্ষণ তাদের কথা শোনার জন্য সে আগ্রহে তাকিয়ে থাকতো, এবার তারা তাদের কথা শোনার জন্য তাকিয়ে রয়েছে। হোস্টেলে থাকায় তারা বেশিক্ষণ সময় দিতে পারল না আর্যকে, একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইনস মানতে বাধ্য দুইজন। দুজনকে বিদায় দিয়ে গেটের কাছে এসে অবাক হলো সে। লক্সমি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। দূর থেকে ডাকল। ভালো লাগল না আর্যর। তবুও কাছে গেল। লক্সমি আর্যকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলল। আর্য সঙ্গে সঙ্গে ‘না’ বলল। এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না মেয়েটি। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তবে কিছু বলল না। পুরনো হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল। ‘ঠিক আছে’ বলে স্কুটার স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল আর্য। প্রথম দিন পরিচয় থেকে লক্সমি আর্যর সাথে বেশ ভালোভাবে মেলামেশা করছে। অনেকবার তার স্কুটারে বসে কলেজে এসেছে,আবার বাড়ি ফিরেছে। তবে বারবার এমনটা হোক আর্য চায় না। কারোর উপর নির্ভর হতে চায় না। তাছাড়া সে একবছরের সিনিয়র। তার সাথে হঠাৎ করে এতটা সহজ কি করে হলো জানে না। আবার পরক্ষণেই ভাবে, লক্সমিকে এই ভাবে ‘না’ বলা কি উচিত হল? সে অনেকটা আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একসঙ্গে বাড়ি ফিরতে চাইছিল। তার এমন ব্যবহারে নিশ্চয়ই মনোক্ষুন্ন হয়েছে। নিজেকে প্রশ্ন করল, কেন সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারছে না? বারবার কেন একাকীত্ব বেছে নিচ্ছে? কেউ আপন হতে চাইলে তাকে কেন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? এগুলো কি একটা মানুষের ভালো গুণ ? সবার সঙ্গে মিশতে না পারা মানুষের কখনো ভালো গুণ হতে পারে না। দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায় আর্য।
খুব ধীরগতিতে আর্য হাই রোডের উপরে পৌঁছল।ওভারব্রিজ ক্রস করে একটা সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে রইল। কিছুটা দূরে একটা ডাকঘর রয়েছে। ওইখানে পৌঁছে ব্যাগ থেকে চিঠি বের করে ডাকঘরের মধ্যে ফেলে দিল। এই ডাকঘরের সন্ধান লক্সমি দিয়েছিল। এই শহরে অনেক কিছুর পরিচয় মেয়েটির মাধ্যমে হয়েছে। অথচ তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আর্য আজ স্নেহার জন্য চিঠি লিখেছে।তার কাছে স্মার্টফোন আছে তবুও চিঠি লিখেছে। আসলে, স্মার্টফোন থেকে চিঠিতে অনুভূতিগুলো নিখুঁত ভাবে প্রকাশ করা যায়। স্মার্টফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে কথা বলে যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, তার থেকে এক টুকরো চিঠি লিখে কিংবা পড়ে দ্বিগুণ তৃপ্তি পাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ আগে শেষ দূরপাল্লার ট্রেন ঘন অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে গেছে। কয়েকদিন হল ট্রেন দেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে না স্নেহা। ট্রেনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। দীপক বাবু নিচ থেকে বারবার মেয়েকে ডেকে চলেছেন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। ভাইও একবার ডেকে গেছে, তবুও হুঁশ ফেরেনি। কোনো এক গভীর ভাবনায় মগ্ন আছে। সেদিন সন্ধ্যায় কিভাবে বাড়িতে ফিরেছিল তা মনে নেই। মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হলে বারবার চাওয়ার পরও চলে যেতে পারে তার জানা নেই। বাড়িতে ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিক্রমকে অনেকবার ফোন করে কিন্তু ফোন ধরেনি সে। বুঝে গেছে, মানুষটি আর কখনো ফিরবে না। যে মানুষটি স্যারকে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়, সে মানুষটি যে তার জীবনে দ্বিতীয় বার ফিরে আসবে না ভালো করে জানে। বিক্রমের কথাগুলো তাকে শক্ত পাথর দিয়ে আঘাত করার মতো আঘাত দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে স্নেহার শরীর শ্রাবণের ঘন কালো মেঘের মত হয়ে আছে।তার যৌবনের সমবয়সী প্রথম বন্ধু ছিল আর্য। কোনো কিছুতেই স্বার্থ ছিল না। ওই দুজন নারী পুরুষের মধ্যে যে কখনো প্রেম ভালোবাসা আসতে পারে ভাবেনি সে। যৌবনের প্রথম ধাপে সমবয়সী ছেলেদের চোখের দিকে তাকাতে পারত না, অথচ সেই বয়সে আর্যর চোখের দিকে তাকাতে ভালো লাগতো। ওর চোখের মধ্যে শুধু বন্ধুত্ব দেখে এসেছে। কিন্তু কখনো বুঝে উঠতে পারেনি তার মধ্যে কোথাও ভালোবাসা লুকিয়ে রয়েছে। রিম্পি একবার বলেছিল তার দাদা তাকে খুব ভালোবাসে। তার কথায় বেশি আমল দেয়নি স্নেহা। বিক্রমও বলেছিল। কারোর কথা শোনেনি। খুব সহজভাবে তার সঙ্গে মিশে গেছে।
বাবা আবার একবার মেয়েকে ডাকলেন। এবার স্নেহা নিজেকে স্থির রাখল না।চোখের কোণে জমে থাকা জল ওড়না দিয়ে মুছে নিচে নেমে আসলো। সবার সঙ্গে খেতে বসল। দু’মুঠো ভাত খাওয়ার পর আর খেতে পারল না।
“কি হল মা! খাচ্ছিস না কেন? কয়েকদিন ধরে দেখছি বড্ড আনমনা? কেউ কিছু বলেছে?”সে কোনো উত্তর দিল না। বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। ঋষি আর কবিতা দেবী মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হলেন। বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দীপক বাবু আবার বললেন,”কলেজে কিছু সমস্যা হয়েছে? এক্সাম নিয়ে টেনশন হচ্ছে?”
“না, তেমন কোনো সমস্যা নেই। এমনি এমনি ভালো লাগছে না।” স্নেহার কণ্ঠস্বরে কেমন একটা চটচটে ব্যাপার রয়েছে। খাবার না খেয়ে ছটফট উঠে গেল। কবিতা দেবী কিছু বলতে চাইছিলেন, তাঁকে বাঁধা দিয়ে দীপক বাবু বললেন,”ওকে যেতে দাও। আমি দেখছি কি করা যায়।”
“বেশি মাথায় তুলো না,পরে পস্তাতে হবে। এত অল্প বয়সে এত রাগ অভিমান ডিপ্রেশন কোথা থেকে আসে? এই বয়সে হেসেখেলে কাটানোর কথা, আর সে নিজেকে একটা অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছে। ব্যাপারটি মোটেও কাকতালীয় নয়।”
“আমাদের সময়ে, এই বয়সে ডিপ্রেশন শব্দটি বড্ড বেমানান ছিল। তবে বর্তমান জেনারেশনের ক্লাস সেভেন এইট এর ছেলে মেয়েদের কাছেও শব্দটি খুব পরিচিত। বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে এত পরিবর্তন কি করে হলো? বাবা হিসেবে যতটুকু কর্তব্য সেটুকু করব। তার একটা সঠিক সময় রয়েছে, অযথা মেয়েকে বকো না। তাকে কিছুদিন নিজের মত থাকতে দাও।”
অন্ধকার রাত। গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঋসি আর স্নেহা বরাবরই একসঙ্গে ঘুমোয়। সে কখনো দিদি কোমরের উপর পা তুলে দেয় আবার কখনো দিদিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যায়। আজ দিদিকে সামান্য জড়িয়ে ধরতেই খিটখিট করে ওঠে। তার ভীষণ গরম লাগছে। অথচ বৈশাখ মাসে প্রচন্ড গরমে কখনো সে এমন করেনি। আসলে, স্নেহার সবকিছুতে অস্বস্তি চলে এসেছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পড়েছে ঋষি। স্নেহার কিছুতেই ঘুম আসছে না। উসখুস করতে থাকে। এই সময় কোনো এক মানুষের সাথে মগ্ন থাকার কথা ছিল। কোনো এক মানুষের সঙ্গে স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। পরিচিত মানুষকে সারা দিনের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করার কথা ছিল। ভালোলাগা খারাপ লাগা মুহূর্তগুলো ফ্রেমে বন্দী করার কথা ছিল। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তেমনটা হয়ে এসেছে। হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের কোণে জল জমেছে।অল্প সময়ের পর কেউ একজন দরজা সরিয়ে স্নেহার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। ভয় পেলো না। সে কোনো কিছুতে কষ্ট পেলে বাবা ঠিক বুঝতে পেরে যান। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তিনি অবশ্যই আসবেন। স্নেহা আশাহত হল না। দীপক বাবু এসেছেন। বাবা তার মাথার কাছে বসলো। স্নেহা বাবার কোলে মাথা রেখে বলল,”তুমি ঘুমাওনি?”
“এক বুক কষ্ট নিয়ে নিজের সন্তান ছটফট করছে। বাবার চোখে কি করে ঘুম আসবে? কি হয়েছে মা?”
“কিছু হয় নি তো। আমি ভালো আছি।” কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার জিভ নড়ছে না। থরথর করে কেঁপে উঠছে। বাবাকে আর কত মিথ্যে কথা বলবে? সেই প্রেমে পড়া থেকে পরিবারের সবাইকে মিথ্যে কথা বলে চলেছে। আর কত? যে মানুষগুলো দিনরাত এক করে তাদেরকে মানুষ করছে, আর সে তাদেরকে মিথ্যা বলছে। তারা সবকিছু জানতে পারলে কত কষ্ট পাবেন, সেই কথাগুলো কখনো ভাবেনি।
“বাবা-মার কাছে লুকিয়ে পারবি তো যন্ত্রনা গুলো এড়িয়ে যেতে। বন্ধুদের ওপর নির্ভর করে নিজের দুঃখ-যন্ত্রণার লুকিয়ে রাখা যায় না। আমরা তো বেঁচে আছি শুধুমাত্র তোদের দুজনের দিকে তাকিয়ে, আর তোরা যদি আমাদেরকে সব কথা না বলিস তাহলে…..।”
“সত্যি, আমার কিছু হয়নি বাবা। তোমরা মিছামিছি চিন্তা করছো।” বাবার হাত শক্ত করে ধরে বলল স্নেহা। দীপক বাবু বুঝতে পারলেন মেয়ে সমস্ত সত্যি কথা কিছুতেই বলবে না। বারবার কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। আশাহত হলেন তিনি। বারবার বলা সত্ত্বেও মেয়ে বাবার কথা রাখল না। মনোক্ষুন্ন হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। তার মন আবার খারাপ হয়ে গেল। থরথর করে আবার একবার পুরো শরীর কেঁপে উঠল। গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। দু-চোখ থেকে শুধু জল ঝরে পড়ছে। একটা মানুষের জন্য সে সবাই কে অবহেলা করছে। কিছুক্ষণ আগে ভাইকে কথা শোনিয়েছে। বাবাকে সঠিক কথা বলল না। তিনি মনোক্ষুন্ন হয়েছেন। গতকাল আকাশ আর নিলেশকে খুব বকেছে। সবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে। সবার থেকে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে। ভাইকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল। আলতো করে হাত বোলিয়ে দিল মাথায়।
“তুই কাঁদছিস কেন, দিদি?” চমকে ওঠে স্নেহা।
“তুই ঘুমোস নি?”
“ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওই ছেলেটার জন্য কাঁদছিস।”
“কোন ছেলে?” না জানার ভান করে বলল।
“যার সঙ্গে রাতে গল্প করতিস।” স্নেহা ভীষণ অবাক হয়। তার ভাই সবকিছু জানতে পেরে গেছে। জানারই কথা। একসঙ্গে ঘুমোয়। রাতের পর রাত কথা বলেছে, পাশের ব্যক্তি কিছু তো জানবে -স্বাভাবিক।
“না না। অন্য ছেলের জন্য কাঁদতে যাব কেন?”
“জানিস দিদি, আমাদের মাস্টারমশাই বলেন, কোনো মানুষ যদি কাউকে কষ্ট দেয়, তাহলে তাকেও একদিন ঠিক শাস্তি পেতে হবে। সৃষ্টিকর্তা কোনদিন কাউকে ছাড় দেয় না। নিজের কর্মের ফল অবশ্যই পেতে হবে।” ভাইয়ের যুক্তিপূর্ণ কথা শোনে হালকা হাসলো। তবে নিজেকে খুশি করতে পারল না। ভাইয়ের মাথায় আবার হাত বোলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলল। অনেক রাত হয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ পর ঋসি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। স্নেহার চোখে কিছুতেই ঘুম আসলো না। তখনো তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে শরীর ঝড়ের বেগে কেঁপে উঠছে। গভীর রাতের দিকে স্নেহার গায়ে জ্বর উঠল। মুখ ফুটে কাউকে ডাকতে সাহস পেল না। চোখ বন্ধ করে সবকিছু সহ্য করল।বন্ধ চোখ থেকেও জলের রেখা কানের গোড়ার দিকে গড়িয়ে গেল। বিক্রম সাগরের মত বিশাল,কিন্তু ওই সাগরে স্নেহার এক ফোঁটা চোখের জল ধারণ ক্ষমতা নেই। তা ঠিক, কাউকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখী হতে পারবে না। কিন্তু, কাউকে কষ্ট না দিয়েও কি আদৌ সুখী হওয়া যায়?
পর্ব ১৪ আসছে