কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১৪
_________________
বহতা নদীর মতো এগিয়ে চলে জীবন। নতুন ঘটনা, নতুন অভিজ্ঞতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা বাঁকে বাঁকে জীবন নিজেকে সম্পন্ন করে। একটা রাত একটা দিন গড়তে গড়তে কখন কতগুলো মাস গড়িয়ে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারল না আর্য। এতগুলো মাসের মধ্যে নিজের অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক নতুন বন্ধু-বান্ধবী পেয়েছে। তবে এত বন্ধুবান্ধবীর মধ্যে লক্সমি খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে। তাকে সমস্ত কাজে সাহায্য থেকে শুরু করে নতুন পথ দেখানোর প্রথম কাজটি লক্সমি করেছে। তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো বসন্তের মত সুন্দর এবং জীবনের মতো দীর্ঘ। পুরো শহর তাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। আরও অনেক ঘোরার জায়গা আছে, সবগুলো ঘুরতে চায় লক্সমির সাথে। তার চোখের মধ্যে স্বার্থ, তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই। একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। এই ভিন রাজ্যে আর্য যেমন লক্সমির মত একটি ভালো বন্ধু পেয়ে পুলকিত, তেমনি লক্সমিও একটা ভালো বাঙালি বন্ধু পেয়ে পুলকিত। এখানে আসার পর প্রথম ভাষাগত সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এখন সেই সমস্যা অনেকটা দূর হয়েছে। এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে কিছু ভাষা আপনা আপনি শিখে গেছে। আবার লক্সমি খুব সহজভাবে তাকে এখানকার ভাষা শিখিয়েছে। কখনো খাতা কলম ধরে লিখে দিয়েছে আবার কখনো মুখে বলে উচ্চারণ করিয়ে দিয়েছে। কার্নাটকা ভাষা শেখার পেছনে পুরো প্রশংসার যোগ্য লক্সমির। তার সঙ্গে পরিচয় না হলে এই শহরকে মানিয়ে নিতে অনেক অসুবিধা হতো। খুব সহজে সবকিছু জানতে পারতো না। লক্সমির স্নেহাদ্র এবং কোমল স্বর খুব তাড়াতাড়ি আর্যর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। সেদিনের পর থেকে আর কখনো আর্য তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। সেদিনের কথা ভেবে ব্যথিত হয়েছে। লক্সমির কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। সে উদারতার পরিচয় দিয়েছে। মন যা চায় তাই করবে। তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার কি আছে? মনের বিরুদ্ধে মানুষ কখনো কিছু করতে পারেনি। করলেও ক্ষণিকের জন্য। লক্সমির খুব সহজ-সরল স্বভাব ভালো লাগে তার। আর যাই হোক মানুষটা খারাপ হতে পারে না। নিজের স্বার্থের জন্য তাকে কখনো ব্যবহার করবে না।তাই আর্য খুব সহজে নিজের পরিবার,বন্ধুবান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা কোনো কথাই লুকোয়নি তার কাছে। আর্য নিজের সমস্ত কথা লক্সমিকে বললেও লক্সমি বারবার নিজের পরিবারের কথা এড়িয়ে গেছে। কেন এড়িয়ে গেছে তা জানে না। তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলে ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি এঁকে তোলে, তারপর খুব সহজে কথা এড়িয়ে যায়। বারবার একই প্রশ্ন করে লাক্সমিকে কখনো অস্বস্তিতে ফেলার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। তার মন চাইলে নিজে থেকে একদিন সব কিছু বলবে। আর্যর মতো লাক্সমিও নিজেকে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করে,হঠাৎ কি করে আর্য সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠ হলো? তারা তো একই ব্যাজের স্টুডেন্ট নয়। তাহলে? হয়তো, আর্যর একান্ত স্নিগ্ধ শান্ত স্বভাব এবং সুনির্মল চরিত্র তাকে মুগ্ধ করেছে। আর্যর শান্ত স্বভাব তাকে কাছে টেনে এনেছে। ছেলেটির নির্মল ভরা মুখ দেখলে তার হৃদয় কম্পিত হয়ে ওঠে। বারবার কোনো বাধা ছাড়াই তার কাছে ছুটে চলে যায়। তার নির্মল চোখ দুটি দেখলে বুকের মধ্যে শীতল স্রোত বয়ে যায়। অবচেতন মন খড়কুটো খুঁজে বেড়ায়। আজ দুমাস মতো হলো লক্সমির সাথে কোনো কথা নেই আর্যর। কয়েকদিন পর প্রথম বর্ষের পরীক্ষা। বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। স্বপ্ন পূরণের জন্য এই শহরে পাড়ি দিয়েছিল। ভালো-মন্দ সবকিছু আসবে কিন্তু ক্যারিয়ার গড়ার সময় চলে গেলে এই সময় আর কখনো ফিরে আসবে না। সবকিছু বাদ দিয়ে এখন নিজেকে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছে। সারাদিন বই-খাতা -পেন ছাড়া অন্য কিছু মাথার মধ্যে আসতে দেয় না। খুব কঠিন পরিশ্রম করছে। নিজের নোটস,বই বাদে লাক্সমির পুরনো বইগুলো নিয়েও পড়ছে। একটুও ফাঁকি রাখতে চায় না। জীবনের লক্ষ্য পুরোপুরি স্থির। ওই জায়গায় পৌঁছতে বদ্ধপরিকর। দুমাস নিজের বাবা ছাড়া কারোর সঙ্গে কথা বলেনি। তবে, এর মধ্যে বিশাল একটা ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। স্কুলে পড়াকালীন টিভির পর্দায় বারবার দেখেছে কলেজের ছাত্রদের বিক্ষোভ বিদ্রোহ। এতদিন সব সময় মনে হয়ে এসেছে, এর পেছনে শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীরা দায়ী। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, কলেজে বিদ্রোহ-বিক্ষোভের জন্য শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীরা দায়ী নয়,কলেজ ম্যানেজমেন্টেও সমানভাবে দায়ী। কলেজের আর স্কুলের জীবন যে এক নয় বুঝতে পেরেছে। কলেজে দারুণভাবে পলিটিক্স হয়। এই পলিটিক্স-এর শিকার হয়েছে আর্য নিজে। সে যে কলেজে পড়াশোনা করছে তার ওই কলেজের নামে রেজিস্ট্রেশন না এসে অন্য কলেজের নামে রেজিস্ট্রেশন এসেছে। এটা কি করে সম্ভব হতে পারে? প্রথমে ভেবেছিল ঘটনাটি কাকতালীয় ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু পরে জানতে পারে এটা কোনো কাকতালীয় নয়, সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। শুধু তাই নয় এমন অনেকেই খারাপ পলিটিক্সের শিকার হয়েছে। এমন কি অনেক ছাত্র ছাত্রীর রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত বের হয়নি। তাদের একটা বছর সম্পূর্ণ ধুলায় মিশে গেছে। এই ব্যাপারে যখন প্রিন্সিপালের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তখন তিনি কিছুই জানালেন না। এই ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না, সমস্ত দোষ কলেজ মানেজমেন্টর। আবার কলেজ ম্যানেজমেন্ট কোনো ছাত্র ছাত্রীর কথা শোনতে চাইল না।শেষমেষ ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হলো কলেজ কর্তৃপক্ষকে। অনেক খড়কুটো পোড়ানোর পর কলেজ কর্তৃপক্ষ মুখ খুললেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কিছুটা শান্ত করলেন। যাদের রেজিস্ট্রেশন বের হয়নি তাদের কিছু করার নেই। তাদেরকে আবার এক বছর প্রথম বর্ষে পড়তে হবে। আর যাদের নাম অন্য কলেজে বেরিয়েছে তাদের কোনো সমস্যা হবে না। তারা যে কলেজে পড়ছে ওই কলেজে পড়বে। শুধু সার্টিফিকেটে অন্য কলেজের নাম থাকবে। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে ব্যাপারটি না মানলেও পরে মানতে বাধ্য হয়। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। আর্য আরও অনেকের কাছে এই ব্যাপারটি জানার চেষ্টা করল। এক কলেজে পড়ছে অথচ রেজিস্ট্রেশন আসছে অন্য কলেজের নামে, -কি করে সম্ভব? পরে এর সম্বন্ধে কিছুটা অবগত হয়। এখানকার বেশিরভাগ প্রাইভেট কলেজ গুলোতে বিষয়টি সাধারণ। কলেজ মানেজমেন্ট শুধুমাত্র টাকার লোভে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করে। গভমেন্ট কলেজ হোক কিংবা প্রাইভেট কলেজ প্রত্যেক কলেজের জন্য একটা নির্দিষ্ট সিট থাকে। প্রাইভেট কলেজ গুলো নির্দিষ্ট সিট পূরণ হয়ে যাওয়ার পরও শুধুমাত্র টাকার লোভে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি নিতে থাকে। রেজিস্ট্রেশনের সময় দেখে নেয় ইউনিভার্সিটির মধ্যে কোথায় কোথায় সিট ফাঁকা রয়েছে। তাদের কলেজে বাড়তি স্টুডেন্ট অন্য কলেজে ফাঁকা থাকা সিটের মধ্যে নাম নথিভুক্ত করে দেয়। একদম শেষে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের কপাল খারাপ। তাদের জন্য কোনো সিট থাকে না। এমন ঘটনার পর বেশ কয়েক দিন মনমরা হয়ে যায় আর্য। মনে পড়ে, লক্সমির বলা প্রথম দিনের কথাগুলো। বড় ইউনিভার্সিটি মানে সবকিছু সুন্দর -তা নয়। তার মধ্যে কত ঘাপলা থাকে বোঝার উপায় নেই।
বাবাকে সমস্ত ঘটনা বলতে পারেনি আর্য। তিনি রোজ কঠোর পরিশ্রম করে একটা একটা টাকা জমিয়ে ছেলেকে এতদূর পড়তে পাঠিয়েছেন। আর এখানে কিছু মানুষের স্বার্থ সিদ্ধিতে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে। ভাবতে কতটা খারাপ লাগে। গা ঘিনঘিন করে ওঠে।এখানকার পরিস্থিতি জানতে পারলে কষ্ট পাবেন। তাই সবকিছু লুকিয়ে রেখেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে আর্য লক্ষ্য করল, মিনাজের বেশ কিছু পরিবর্তন। আর্যর পরীক্ষা যত এগিয়ে আসছে, ততই নমনীয় হয়ে উঠছে মিনাজ। তার পরীক্ষা বেশ কয়েক মাস আগে শেষ হয়ে গেছে। সে এখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর্যর পড়ার যাতে ক্ষতি না হয়,ওই জন্য নিজের ফোন বেশিরভাগ সময় এভোয়েড করে চলছে।একজন পড়াশোনা করছে আর একজন মোবাইল চালাচ্ছে, দৃশ্যটি মোটেও শোভনীয় নয়।এতে পড়াশোনা করা ব্যক্তিটির মনোযোগ নষ্ট হবে। সে চায় না বন্ধুর অস্বস্তি হোক। একা বাইরে বেরিয়ে আসে। গভীর রাত পর্যন্ত লাইট জ্বললেও বন্ধ করার জন্য চাপ দেয় না। আবার কখনো আর্যকে পড়াশোনায় সাহায্য করে। কোনো শব্দের মিনিং বের করে দেয়, আবার কখনো তার অ্যাসাইনমেন্ট লিখে দেয়। বাইরে বেরোলে আর্যর জন্য খাবার কিনে আনে। আন্টি খেতে ডাকলে মিনাজ নিজেই দুটো থালা নিয়ে গিয়ে দুজনের খাবার নিয়ে চলে আসে। মিনাজের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোবাসাগুলো আর্যকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে। তার প্রতি ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তারা দুজন ভাই। একে অপরের দুঃখ সহ্য করতে পারে না। এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে না, অনুভূতি গুলো মনের কোঠায় অনুভব করে। পড়াশোনা নিয়ে বরাবরই চিন্তিত আর্য। মিনাজ সব সময় শান্ত থাকতে বলে। অতিরিক্ত চিন্তা করতে বারণ করে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অন্য কলেজের নামে রেজিস্ট্রেশন বের হওয়ায়, সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে আর্য। তখন তাকে আশ্বস্ত শুধুমাত্র মিনাজই করেছিল। অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে না। জীবনে লড়াই এত সহজ নয়। আরও অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। আগামীকাল থেকে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আর্য আজ আর বই খুলল না। রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে নিজের পড়া গুলো মনে করল।কিছুক্ষণ এমনটা করার পর মিনাজ দরজা ধাক্কা দিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। একে অপরের চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসি বিনিময় করল। মিনাজ কলেজে গেছিল, টিফিনে ফিরে আসলো কেন বুঝতে পারল না। মনে কৌতুহল জাগলো। কৌতুহল দূর করার জন্য মিনাজকে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার! এত তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে ফিরে আসলে যে?”
“তেমন কিছু নয়। কাল তোমার কয়টায় পরীক্ষা শুরু হচ্ছে?”
“নয়টায়।” হঠাৎ এমন প্রশ্ন করল কেন বুঝতে পারল না আর্য। মিনাজ মাথা নাড়িয়ে বলল,”আমি ঠিক ধরেছিলাম। সকালেই পরীক্ষা হবে।” কথা বলতে বলতে মিনাজ নিজের জামা গুলো জলে ভেজালো। হঠাৎ জামা পরিষ্কার করার জন্য মগ্ন হলো কেন বুঝতে পারল না। রবিবার ছাড়া তাকে কখনো নিজের জামা পরিষ্কার করতে দেখা যায়নি। আর্য কৌতুহল ক্রমশ বাড়তে রইল। আবার প্রশ্ন করল,”তোমাকে এত উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন? কিছু সমস্যা হয়েছে? না, কারোর সঙ্গে দেখা করতে যাবে?”
“আপাতত তেমন কোনো সমস্যা নেই, কাল তোমার সঙ্গেই যাবো। একদম নার্ভাস ফিল করবে না।” আর্য নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। মিনাজ তার সঙ্গে কাল পরীক্ষা হল পর্যন্ত যাবে।এই ভিন রাজ্যে প্রথম পরীক্ষা তার। একটু নার্ভাস ফিল করছিল। মিনাজ ঠিক বুঝতে পেরে গেছে। সে যথেষ্ট সিনিয়ার। প্রথম দিন কেউ একটু পাশে থাকলে ভালোই হয়। আনন্দে চোখে জল চলে আসলো আর্যর। হঠাৎ মুখ থেকে কোনো কথা বেরিয়ে আসলো না। মনের কোনো এক স্থানে ভালোলাগার ফুল ফুটে উঠলো। কখনো কখনো অচেনা মানুষ গুলো খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। ইচ্ছে করছে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেতে। কত ভালো ছেলে। এই শহরে যেমন কিছু অপ্রিয় রয়েছে, তেমন প্রচুর প্রিয় জিনিস রয়েছে। এ পৃথিবীতে প্রত্যেক জিনিসের জন্মই হয় প্রিয় হয়ে, কিন্তু পরে বিভিন্ন কারণে অপ্রিয় হয়ে ওঠে। অপ্রিয় জিনিস গুলোর মধ্য থেকে যদি কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস ছেঁটে ফেলা যায় তাহলে সেগুলোও প্রিয় হয়ে উঠবে। মিনাজ ভেজানো জামা নিয়ে ছাদে চলে গেল। সেগুলো এখন পরিষ্কার করবে। আর্য আর রুমের মধ্যে থাকলো না। রুমে তালা লাগিয়ে সেও ছাদে চলে গেল। একটা ইটের উপর বসে খুব সুন্দর ভাবে জামা পরিষ্কার করতে লাগলো মিনাজ। তার পাশে আরও একটি ইট পাতিয়ে বসল আর্য। জামা প্যান্ট পরিষ্কার করায় বেশ দক্ষ পারদর্শী মিনাজ। নিশ্চয়ই বাড়িতে থাকাকালীন মা জামা প্যান্ট পরিষ্কার করে দিতেন। এখানে এসে তাকে সমস্ত কাজ একা করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন একই কাজ করার ফলে ওই কাজের প্রতি পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আর্য মিনাজের মায়ের কথা ভাবতে গিয়ে, তাদের পুরো পরিবারের কথা মনে পড়ে গেল। মিনাজের কি কোন পরিবারের সদস্য নেই? সে কি অনাথ? আর্যর মাথায় এমন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। কারণ, আজ পর্যন্ত একদিনও তাকে তার পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেখেনি। এই একটা বছরে তাকে মাত্র বার কয়েকবার ফোনে কথা বলতে দেখা গেছে, শুধুমাত্র তার কলেজ ফ্রেন্ডদের সাথে। তার পরিবারের কথা জানার আগ্রহ এতদিন মনের মধ্যে জাগেনি। আজ হঠাৎ করে জেগে বসলো।
“মিনাজ, তোমায় একটা কথা বলি! রাগ করবে না তো?”
“রাগ করতে যাব কেন? কি বলতে চাও বলো?”
“না,মানে!”
“আমতা আমতা করছ কেন? আমি তোমার সিনিয়ার এই জন্য জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছো?”
” না, আসলে আমি তোমাকে কখনো তোমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম না। তোমার পরিবারে কি কেউ নেই।”
“না না, আমার পরিবারে সবাই আছে। মা-বাবা ভাই-বোন সবাই। আসলে,কি জানো, আমাদের বাড়ি একদম বর্ডারের পাশে। ওইখানে সব সময় নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকে। চাইলেও যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। আমি এখানে আছি তাই মোবাইল ব্যবহার করছি, বাড়িতে থাকলে আদৌ ব্যবহার করতে পারি না।” মিনাজ থামল। এতক্ষণে তার নাকের ডগায় একটা মশা জোরে কামড় বসিয়েছে। বাহু দিয়ে আলতো করে নাক নাড়ালো। তবুও নাকের ডগায় চুলকানো বন্ধ হলো না। বাধ্য হয়ে সাবান মাখা হাত দিয়ে নাকের ডগা চুলকালো। খুব তীক্ষ্মভাবেই প্রখর করল আর্য। মনটা দুঃখে ভরে গেল মিনাজের কথা ভেবে। কতটা কষ্টে রয়েছে তারা? তাদের জীবন বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের চারপাশে বহু ছেলে মেয়ে রয়েছে, যাদের ফোনে দু-তিনদিন চার্জ না থাকলে ডিপ্রেশন ফিল করে। অথচ এরা ফোন ছাড়াই দিন অতিবাহিত করে। আত্মীয়স্বজনদের থেকে বহু দূরে থেকেও যোগাযোগ রাখতে পারে না। এদের কষ্ট গুলো কি কষ্ট নয়? আসলে এদের চাহিদা কম। এরা অল্পতে খুশি। খুব সহজ ভাবে ওই জিনিস গুলোকে মেনে নিয়েছে। আর্য এতদিনের পর বুঝতে পারলো, মিনাজ সব সময় চুপ থাকে কেন! তার শরীরের মধ্যে দিয়ে সব সময় উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ স্রোতে শরীরের ভেতর প্রতিটি অঙ্গ ঝলসে গেছে। আত্মীয় স্বজন হারানোর খবর তার কাছে এসে পৌঁছায় না। পৌঁছালেও অনেক দেরি হয়ে যায়। শেষ দেখা হয় না।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর আর্যর মন আহ্লাদে ভরে ওঠে। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানে সে। আনন্দে নেচে ওঠে। একটা প্রশ্নও ছাড়বে না। ধীরে ধীরে করে সব লিখবে। মিনাজ সঠিক কথা বলেছিল, মাথা ঠান্ডা রাখলে যা পড়েছে তা আপনা আপনি মাথায় চলে আসবে। লিখতে গিয়ে তাই অনুভব করল। প্রথমে এত কড়া সিকিউরিটি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল। একটা রুমে মাত্র কুড়ি জন ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিতে বসেছে। তার মধ্যে তিনটি সিসিটিভি ক্যামেরা এবং তিনজন ম্যাডাম রয়েছে। আস্তে আস্তে নিজের ভয় কাটিয়ে তুলল। মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় পরীক্ষা হলের বাইরে বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ বাবা নেই, তবে কেউ একজন রয়েছে,তাকে যে নিজের ভাইয়ের মত ভালোবাসে। যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। আর্যর মনের খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকলো না। দু-পেইজ মতো লেখার পর একটা তাজ্জব অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকলো। সিসিটিভি ক্যামেরার আড়ালে একজন ম্যাডাম অনেকগুলো কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আর তিনি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুব ধীরে সুস্থে বলে যাচ্ছেন। আর্য কিছুই বুঝতে পারলো না। একজন ম্যাডাম উত্তর বলে যাচ্ছে কেন? যারা গার্ড দিচ্ছেন তারাই বা কেন কোনো কিছু বলছে না। বিষয়টি মোটেও ভালো লাগলো না। সে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেল। তার আগেই একজন ম্যাডাম শাসিয়ে বসিয়ে দিল। ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে সবকিছু রেকর্ড হচ্ছে। ভেবেছিল, হয়তো এক দুটো প্রশ্নের উত্তর বলবেন। কিন্তু না…। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বললেন। আর্য আবার একবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করল। ম্যাডাম কোনো কথা শুনলেন না। দ্বিতীয়বার শাসিয়ে বসিয়ে দিলেন। সে যদি তৃতীয়বার তেমনটা করে তাহলে তার খাতা নিয়ে নেওয়া হবে। আর্য তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারল না। এ কেমন পরীক্ষা? যেখানে কড়া সিকিউরিটি ব্যবস্থা রয়েছে, অথচ সমস্ত উত্তর বলে দিচ্ছে। প্রথম দিন পরীক্ষা কোনো ভাবে কেটে গেল। বিবর্ণ মুখে মিনাজকে বলতে হলো পরীক্ষা ভালো হয়েছে। ভেতর থেকে ভেঙ্গে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে সে। মিনাজকে কিছুতেই সত্য কথা বলতে পারল না। হয়তো তাতে মজা ওড়াতে পারে সে। মিনাজ তেমন ছেলে নয় তবুও। আর্য রুমে ফিরে লক্সমিকে ফোন করে সবকিছু জানার চেষ্টা করল। লক্সমির মুখ থেকে সবকিছু জানার পর সম্পূর্ণ হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল। গলা শুকিয়ে গেল। জিভ অসাড় হয়ে আসলো। নিঃশ্বাস নিতে সামান্য কষ্ট হলো।এখানকার বেশিরভাগ প্রাইভেট কলেজ গুলো এমনই। যতই পড়াশোনা কর না কেন, -পরীক্ষার দিন সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বলে দেবে। তাহলে পড়ে লাভ কি?ভালো ছেলে খারাপ ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই? যারা সারা বছর খুঁটিনাটি পড়ল, তারাও একই নাম্বার পাবে, আর যারা সারা বছর একবারের জন্যও বই খুলে দেখল না তারাও এক নাম্বার পাবে। এ কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা? আর্যর চোখ ভিজে ওঠে। ধিক্কার জানাতে থাকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। আবার পরে নিজেরও খারাপ লাগে, কয়েকটা কলেজের জন্য পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্নাম করা উচিত নয়। এগুলো তো শুধু মাত্র কয়েকজন মানুষের স্বার্থসিদ্ধি।এখানে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করা হয়। এই অন্যায়ের কি কোনোদিন শাস্তি হবে না। আজ আর্য ঠকেছে। আর্যর মতো বহু ছাত্র-ছাত্রী ঠকছে।আজ যারা তাদের ঠকাচ্ছে পরশু তাদের ছেলে মেয়েও ঠকতে পারে। এই গৌণ ব্যাপারটি তাদের মাথায় কেন আসছে না! কোন কলেজে এসে পড়ল সে? স্নেহা বারবার বলেছিল, কোনো প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ওই কলেজের সমস্ত ডিটেলস ভালো করে জেনে নিবি, না হলে খুব ভালো করে ঠকে যাবি। আজ বুঝতে পারছে সে কত বড় ভুল করেছে। মাত্র চার নাম্বারের জন্য গভমেন্ট কলেজে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল। আজ তার মাশুল দিতে হচ্ছে। ঘরবাড়ি সব কিছু ছেড়ে এতদূর পড়তে চলে আসা আজ অপ্রাসঙ্গিক লাগছে। নিজের রাজ্যের প্রাইভেট কলেজে পড়লে হয়তো এতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না। কিংবা গভমেন্ট কলেজের সুযোগ না হওয়ার পর কোনো বিশেষ সাবজেক্টে অনার্স নিয়ে পড়লেও হতো। আজ মাথার মধ্যে অনেক ভাবনাই আসছে, কিন্তু সেদিন মাথার মধ্যে কিছু আসেনি।
দ্বিতীয়,তৃতীয় সমস্ত পরীক্ষা সমান ভাবেই কাটলো। কোনো রূপ পরিবর্তন আসলো না। কোনো ছেলে-মেয়েকে দেখা গেল না প্রতিবাদ করতে। প্রত্যেকদিন বিবর্ণ মুখে পরীক্ষা দিতে যায়, আবার বিবর্ণ মুখে ফিরে আসে আর্য। হাসি মাখা মুখটি হারিয়ে গেছে। পরীক্ষার প্রশ্ন পেলে খুব আনন্দিত হয় -কোনো প্রশ্ন অজানা নয়। প্রশ্নগুলো জানা না জানা এখন দুটোই সমান হয়ে গেছে। এতদিনের পরিশ্রম পরিশ্রম থেকে গেল। নিজেকে সবার সামনে প্রমাণ করতে পারল না। দুঃখ কষ্টে জরাজীর্ণ হয়ে উঠেছে। বিধাতা কোন খেলা তার সঙ্গে খেলছে? সমস্ত কিছু যদি অশোকবাবু জানতে পারেন, তাহলে কেমন হবে? তিনি কী করবেন? ছেলেকে বাড়ি ফিরে নিয়ে আসবেন?
আর্য সমস্ত ঘটনা বাবাকে বলতে পারল না। লুকিয়ে গেল। জীবনে প্রথমবার বাবার কাছ থেকে কিছু লুকালো। মন বিষাদে ভরে গেছে। এই জায়গাটা আর ভালো লাগছে না। গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে মানুষ টাকা ছাড়া কিছু জানে না।
ধীরে ধীরে সূর্যের উপর পাতলা অন্ধকারের ছায়া নেমে আসলো। একটু একটু করে সন্ধ্যা হতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অবাক হলো মিনাজ। অন্ধকারের মধ্যে আর্য বসে রয়েছে।আজ প্রথম দেখলো, সন্ধ্যায় প্রদীপ না জ্বালিয়ে বসে থাকতে আর্যকে।প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বালায় সে।আবার কখনো ধুপ হাতে গুনগুন করে মন্ত্র পড়তে দেখা যেতো। আজ এগুলোর মধ্যে একটাও দেখা গেল না। মনের মধ্যে খটকা লাগলো। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেখল, আর্য হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে। তার পাশে গিয়ে তার শরীরে স্পর্শ করতেই চমকে উঠল। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তার।
“কি হয়েছে তোর অবস্থা! আমাকে একটি বারও বলিস নি তো -জ্বর হয়েছে?” আর্য কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে রইল। চোখের কোণে জল টিপটিপ করছে।
“কি হয়েছে বল তো? কয়েকদিন ধরে দেখছি বড্ড মনমরা। পরীক্ষা ভালো হয়নি।” আর্য এবার মাথা নাড়ালো। নরম চোখে মিনাজের দিকে তাকালো। নরম গাল দুটো খুব ভারী লাগছে। চোখ গুলো ফুলে গেছে। বড্ড জরাজীর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,”পরীক্ষা ভালো হয়েছে, কিন্তু জানো, সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়েছে। আমার সমস্ত পরিশ্রম জলে মিশে গেছে।” হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল আর্য। তাকে খপ করে ধরে মাথায় আলতো করে হাত বোলালো। তবে মিনাজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসলো না। এই বিষয়টি সম্পর্কে খুব পরিচিত সে। মিনাজের কোনো পরিবর্তন না দেখে একটু অবাক হলো আর্য। তবে কি তাদের কলেজেও ….। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিনাজ নম্রভাবে বলল,”তোদের তো উত্তর বলে দিয়েছে কিন্তু আমাদের বই ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে আমারও তোর মত অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু যে গর্তে ঢুকেছি সে গর্ত থেকে বেরোনো সহজ নয়। একটা বছর পর এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছি, কিন্তু ফিরে গিয়েও তেমন কোনো লাভ হতো না। তাই থেকে গেছি।”
“কোন ছেলে মেয়ে কিন্তু কিছু বললো না! একবারের জন্যও প্রতিবাদ করল না। মাথা নিচু করে সব মেনে নিল।”
মিনাজ হালকা হাসলো।
“আরে বোকা! ওরা কিছু বলবে কেন? দোষ শুধুমাত্র কলেজ ম্যানেজমেন্টের নয় ছাত্র-ছাত্রীরাও সমানভাবে দায়ী।এখানকার মানুষেরা ভেবে নেয় যারা গভমেন্ট কলেজে চান্স পায় না তারা মূর্খ। তারা পাশ করতে পারবে না। তারা এটাও জানে যে কলেজের মধ্যে কিছু ভালো ছেলে-মেয়ে রয়েছে কিন্তু সামান্য। সামান্য কয়েকজন ছেলে মেয়ের জন্য তারা সবার কথা ভাবে না। প্রাইভেট কলেজে বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে পড়তে নয় ঘুরতে আসে। তাদেরকে যদি পাশ না করিয়ে দেয় তাহলে তাদের কলেজের নামে বদনাম হবে। পরবর্তীতে তাদের কলেজে কেউ ভর্তি হবে না। আবার পরীক্ষা হলে উত্তর বলে দিয়ে একটা মোটা অংকের টাকাও ইনকাম হয়। এরা একটা ঢিলে দুটো পাখি মারে। একটু খেয়াল করে দেখবি আমাদের চারপাশে এমন প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। স্কুলে ফেইল করা ছাত্র ছাত্রীও প্রাইভেট কলেজে পাশ করে যায়। তবে কি জানিস তো, সমস্ত প্রাইভেট কলেজ কিন্তু এমন নয়। কিছু কিছু কলেজ অসভ্যতামি করে। পরীক্ষার সময় কিন্তু বোর্ড থেকে ইনচার্জ করতে আসে, তাই কলেজগুলো কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা রেখেছে। তাঁরা কখনো বুঝতে পারেন না,কলেজের মধ্যে আসলে কি চলছে? আবার কখনো বোর্ড সিসিটিভি ফুটেজ চেয়ে বসে। তাই প্রতিটি রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। কোনো ছাত্রকে উশৃংখল হতে দেয় না।” আর্য খুব মনোযোগ সহকারে মিনাজের কথা শোনলো। বোঝার চেষ্টা করল।কলেজের প্রথম দিন থেকে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা একটা একটা করে সাজিয়ে দেখল, মিনাজ ভুল নয়। তার প্রতিটা কথা সঠিক। এমনটা প্রমাণ বারবার পেয়ে এসেছে।
“তাহলে সারা বছর পড়ে কোন লাভ নেই, বল? নিজেকে প্রমাণ করার মত কোন সুযোগই আসবে না। আমার ভালো লাগছে না। আমার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।” মিনাজ খাট থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাথার টুপি খুলে পাশে রাখল। সন্ধ্যায় মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। হালকা জল পান করে আবার আর্যর পাশে এসে বসল। তার পিঠে হাত চাপড়ে বলল,”পার্থক্য অনেক আছে, ভাই! তারা শিক্ষাটাকে টাকা দিয়ে কিনছে, আর তুই পরিশ্রম এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন করছিস। খুব সহজে ভেঙ্গে পড়িস না। আমি তোকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম, কোন পরিবার থেকে বড় হয়েছিস তুই? এক টাকা রোজগার করতে অনেক কষ্ট হয়। তুই একবার ভেবে দেখ গ্রামে ফিরে গিয়ে কি করবি? কলেজের অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে দিয়েছিস। ওই টাকা নিশ্চয়ই তোকে ফেরত দেবে না। বড় হয়েছিস নিজের বুদ্ধি দিয়ে বোঝার চেষ্টা কর। অন্যের কথায় বিচলিত হবি না। চারপাশে পরিস্থিতি ভালো করে বোঝার চেষ্টা কর।” মিনাজ থামল। আর্যর চোখের কোণে জমে থাকা জল হাত দিয়ে মুছে দিল। কাঁদতে বারণ করল। অনেক বড় হয়েছে। এই বয়সে চোখের জল বেমানান। বুকের মধ্যে চাপা অনেক কষ্ট থাকলেও সেই সমস্ত কষ্ট লুকিয়ে রাখতে হবে। সবাইকে নিজের কষ্ট বুঝতে দেওয়া যাবে না। মিনাজ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”এই শহরে প্রথম এসে দেখলি শহরটি আবর্জনায় ভর্তি। তাহলে শহরটিকে ছেড়ে চলে যাবি? আবর্জনা পরিস্কার করবি না! সবাই যদি আবর্জনা দেখে পালিয়ে যায় তাহলে এই শহরটা সব সময় আবর্জনায় ভর্তি থাকবে। আবর্জনা পরিস্কার করে এই শহরটিকে ভালবাসবি না।”
“ভালোবাসবো, অনেক ভালোবাসবো।” মিনাজেরও চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠল। আর্য সামনে নিজের চোখের জল দেখাতে সাহস পেল না। রুম থেকে বেরিয়ে গেল আর্যর জন্য ওষুধ আনতে। গায়ে জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। কিছুক্ষণ বালিশে মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। আর সহজে ঘুম আসবে না বুঝতে পারছে।মাথা যন্ত্রণায় টনটন করছে। পাণ্ডববর্জিত জায়গায় নিজেকে কতটুকু মানিয়ে নেওয়া সম্ভব বুঝে উঠতে পারছে না। গা ঘিনঘিন করছে। পুরনো অনেক অভিজ্ঞতা গভীর অন্ধকারের বুক চিরে স্মৃতির অন্তরে জেগে উঠছে। চোখ বন্ধ করতেই বাবার মুখ ভেসে উঠলো। বাবার বলা একটি কথা মনে পড়লো,’The flowing river reaches the sea. The standing water dries up.’
পর্ব ১৫ আসছে