কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২৬
______________
আলিপুরদুয়ারে প্রায় সময় অঝোরে বৃষ্টি হতে থাকে। বেশ কয়েকদিন হল ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক জায়গায় ধস নেমেছে। নদীর জল বেড়েছে। বন্যার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পার্বত্য অঞ্চল। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি যেন আরও বেড়ে গেছে। এত ঝড়ঝঞ্জা অতিক্রম করে অফিসে যেতে মন চাইল না উৎপলের। বাড়িতে রয়ে গেল। তেমন কোনো কাজ নেই। ঢিলে ভাবে কাটিয়ে ফেলল সকালবেলা। বাড়ির অগোছালো জিনিস গুলো নতুন করে গোছালো। গোছানো জিনিসগুলোর কিভাবে সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি করা যায়? -তা নিয়ে নতুন প্রণালী তৈরি করল। নতুন ভাবে সাজালো। পাহাড় থেকে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ, মৃদু বাতাস, মাঝেমধ্যে মেঘের গর্জন এবং বাড়ির ছাদ থেকে পড়া জলের শব্দ মিলে এক বিরচিত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। চারিদিকে নিঝুম ভাবে কালো মেঘে ঢাকা রয়েছে। দূরদূরান্তের তেমন কোনো পশুপাখি কিংবা মানুষজনকে দেখতে পাওয়া গেল না। বাড়ির উঠোনে গাছগুলো নেতিয়ে পড়েছে। উৎপল রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দূরের আকাশ দেখার চেষ্টা করল। চারিদিকে কুহেলিকা মত সাদা অংশে ঢাকা। বিশেষ কিছু চোখে পড়লো না। ছোট-বড় গাছ গুলো বাতাসে ভয়ংকরভাবে কাঁপছে। আশেপাশে অনেক জায়গায় জল দাঁড়িয়ে গেছে। বোন পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ গল্প করল।বৃষ্টির দু-একটা ফোঁটা গায়ে পড়তেই ঠান্ডা অনুভব করল। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। প্রকৃতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে।বেশিক্ষণ বাইরে রইল না। নিজেদের রুমে ফিরে গেল। দুপুর পর্যন্ত অলস ভাবে কেটে গেল।দুপুরে খাবার খাওয়ার পর উৎপল উপরে চলে আসলো ঘুমোনোর জন্য। বৃষ্টি হচ্ছে ঘুম খুব ভালো হবে। সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর স্নেহা এঁটো থালা গোছাতে গোছাতে মনে পড়ল উৎপলের কথা। সে ঘুমাতে গেছে, কিন্তু বিছানা এলোমেলো রয়েছে। সে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে উপরে চলে আসলো। উৎপল তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল,”কি হলো? এত তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ হয়ে গেল?” স্নেহা তাড়াতাড়ি বিছানা করতে শুরু করলো। স্নেহাকে বিছানা সাজাতে দেখে বুঝতে পেরে গেল তার মনোভাব। বলল,”আমি কি একদম অকেজো? আমি করে নিতাম। এত দায়িত্ব কে নিতে বলেছে তোমায়? অন্যকে তো বেশ অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দাও, কিন্তু নিজের বেলা খামখেয়ালি কেন?” স্নেহা তথাপি কোনো জবাব দিল না। বিছানা করা শেষ হতেই বলল,”তোমাকে এত বকবক করতে কে বলেছে? ঘুমাও, আমি আসছি।” আবার হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে চলে গেল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে উঠলো। বড্ড দায়িত্ব প্রেমী নারী! আবার ভাবলো, স্নেহা সত্যি কি দায়িত্ববান প্রেমী? না, অতিরিক্ত কিছু করছে? তার অতীতে কিছু ঘটনা রয়েছে যা উৎপলকে বারবার ভাবিয়ে তুলতে পারে। সন্দেহ করতে পারে ভালোবাসার নিষ্ঠা নিয়ে। তাই স্বামীর মন জয় করার চেষ্টা করছে। কোনোভাবে বুঝতে দিতে চাইছে না তার ভালোবাসার মধ্যে অকৃত্রিম কিছু মেশানো রয়েছে। মনের মধ্যে সূক্ষ্ম একটি সংকোচন তৈরি হলেও তা প্রকাশ করতে চাইল না। তাতে স্নেহা মনঃক্ষুন্ন হবে। একটা বাসন পরিষ্কার করতেই বাথরুমের দরজা খুলে উৎপল প্রবেশ করল। স্নেহা কিছু বলার আগেই একটা পিঁড়ি নিয়ে কাছে বসলো। অবাক হয়ে স্নেহা বলল,”এখানে আসলে কেন? ঘুমোবে না?”
“তুমি একা বসে বসে বাসন মাজবে আর আমি ঘুমাবো। দুজন মিলে বাসন মাজবো। তারপর এক সঙ্গে ঘুমাবো।”
“এগুলো তুমি করতে যাবে কেন? এগুলো তো আমার কাজ?”
“ছাড়ো তো তোমার কাজ। সারাদিন তো আমি কিছুই করিনি।বসে বসে কাটিয়েছি। এখন তোমায় একটু সাহায্য করলে অসুবিধা হবে না।”
“আজকেই মনে হলো আমি শুধু পরিশ্রম করছি। এর আগে মনে হয়নি?”
“অনেকবার মনে হয়েছে। তখন তো নিজের কাজ ছিল তাই তোমায় সাহায্য করতে পারিনি। এখন কোনো কাজ নেই তাই সাহায্য করতে চলে এসেছি।” স্নেহা হালকা হাসলো। খুশি হলো। তার মনের উজ্জলতা,প্রাণবন্ত হাসি এবং উচ্ছ্বাস দেখে উৎপল ব্যথিত হলো। বুঝলো, কিছুক্ষণের আগে নিজের মনে তৈরি হওয়া সংকীর্ণতা অযথা বৃথাই গেছে। স্নেহা অতিরিক্ত কিছুই করেনি। সে চাইছিল, সে যেমন অন্যর কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাহায্য করে, তেমনি তার কাজে কেউ এসে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাহায্য করুক। অন্তত পাশে বসলেও চলবে। তাতে সে মনের তৃপ্তি পাবে। স্নেহার সঙ্গে সঙ্গে সেও বাসন মাজতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর স্ত্রীকে লক্ষ করল। মাথার চুলের মত শাড়িও বড্ড এলোমেলো হয়ে রয়েছে। স্ত্রীকে অগোছালো দেখে বড্ড বিরক্ত বোধ করলো। অপ্রতিভ ভাবে বলল,”ঠিকঠাক শাড়ি গোছাতে জানো না? নিজেকে তো একটু দেখবে,-কি অবস্থা দেখো। ঠিকঠাক কেমন ভাবে বসতে হয় তা-ও শেখাতে হবে দেখছি।” নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো স্নেহা। কাজের ফাঁকে পরনে থাকা শাড়ি কখন এলোমেলো হয়েছে বুঝতে পারেনি। হাসিমুখে বলল,”এখানে কেউ নেই যে আমায় দেখবে। এটা একটি বদ্ধ রুম।”
“আমি তো রয়েছি।”
“তোমার কাছে তো আমার কোনো গোপনীয়তা নেই।” হেসে উঠল স্নেহা।
“তা বলে যেমন খুশি থাকবে। যতই স্বামী হই না কেন আমিতো দ্বিতীয় কোনো মানুষ। নিজেকে সব সময় ঠিকঠাক রাখা নিজের কর্তব্য। যতই যা বলো, মেয়েরা বিয়ের কয়েক মাস পর কিছুটা হলেও অগোছালো হয়ে যায়। আর যেন কখনো এমনটা না দেখি।” উৎপল রাগ করছে। সে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের শাড়ি ঠিক করল। বলল,”এবার তো হয়েছে? খুশি!” হাসিমুখে মাথা নাড়ালো উৎপল। স্নেহা কিছু একটা ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,”কিন্তু তুমি কি করে জানলে বিয়ের-পর-মেয়েরা অগোছালো হয়ে যায়?এর আগে কারোর সঙ্গে ছিলে না কি?আমায় মিথ্যা বলেছো?”
“হ্যাঁ, আমার জীবনেও বসন্ত এসেছিল।” বিক্রমের খুব স্বাভাবিক কণ্ঠ স্নেহার বুক হঠাৎ করে কেমন করে হয়ে উঠল। শান্ত গলায় বলল,”তাহলে সেবার মিথ্যা কথা বলেছিলে?”
“পুরো কথাটা তো শোনো। তারপর না হয় রাগ করবে।”
“কি শোনাবে আর… কি আর বাকি আছে?” স্নেহাকে রাগতে দেখে ভালোই লাগলো। এটাই চাইছিল। হাসিমুখে বলল,”আমার জীবনে বসন্ত এসেছিল। কিন্তু আমার বাবা-মা তো ইংলিশের টিচার। তাঁরা বললেন, এটা বসন্ত নয় চিকেন পক্স। তাই কুড়ি দিনের অধিক সময় আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি।” স্নেহা হা হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,”ফাজলামি করতে জায়গা পাওনা? সবসময় ইয়ার্কি না?”
বাসন মাজা শেষ হওয়ার পর উৎপল বুঝলো, বাসন মাজা ততটা সহজ কাজ নয়। যতটা সহজ ভাবে ততটা জন্মেও নয়। সবসময় ভাবতে থাকে, বাড়ির বউ বাড়ির কয়েকটা কাজই করে। তাদের আবার এতেই কত আদিখ্যেতা। কিন্তু এই সামান্য কাজের মধ্যে কতটা পরিশ্রম লেগে থাকে তা বুঝল আজ।সামান্য বাসন মাজতে হাঁপিয়ে উঠেছে। আরও কত কাজ সংসারে পড়ে রয়েছে। কিভাবে এতকিছু সামলায়? এ যে অফিসে কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মাঝেমধ্যে তার কাজে একটু দেরি করলে স্নেহার উপর রাগ দেখায়। দু-একটা কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু তার কষ্ট বোঝার চেষ্টা করে না। আজ যেন কিছুটা হলেও বুঝতে পারল। বলল,”তুমি এত কিছু কি করে করো? কষ্ট হয় না?”
“সহ্য করে নি। মানিয়ে নিতে শিখে গেছি।”
“তুমি তো আমায় একবার বলতে পারতে। আমি তোমায় সাহায্য করতাম।”
“অফিসে এত কাজের পর তোমার সময় কোথায়, আমাকে সাহায্য করার? সবদিক সামলাতে আমার কষ্ট হয় না। কষ্ট কখন হয় জানো? যখন সারাদিন ধরে আমি কাজ করে যাচ্ছি অথচ বাড়িতে আরও দুটো মানুষ থাকা সত্ত্বেও বাইরে থেকে কেউ এলে এগিয়ে গিয়ে সামান্য বাড়ির দরজা পর্যন্ত খোলে না। একটা কিছু করে না। তখনই কষ্ট হয়। মানতে পারি না। কথা শুনিয়ে দি। আর উল্টে আমি খারাপ হয়ে যাই।” উৎপল বুঝতে পারলো স্নেহা কাদের কথা বলছে। এই বাড়িতে দুটো মানুষ বলতে তার বোন আর মা। বাবা অসুস্থ তিনি কিছু করতে পারবেন না। সত্যি তো! বাড়িতে সারাদিন একজন কাজ করে যাবে। আর দুজন সারাদিন ঘুরবে বসবে তা হতে পারে না। সামান্য কাজে সাহায্য করলে কি ক্ষতি হয়ে যাবে?তবুও সবার মন রাখতে চাইল। বলল,”মার বয়স হয়েছে,তাই কিছু করতে চায় না। সব দায়িত্ব ছেলে মেয়ের উপর দিয়ে একটু সুখে থাকতে চায়। আর বোনের উঠতি বয়স। তাই কিছু করতে চায় না সেও।”
“আমি সব কিছুই বুঝতে পারি। কিন্তু সকাল-সন্ধ্যা নিজের বাড়িতে একটু ঝাঁট দেওয়া, ছাদ থেকে জামা কাপড় তুলে নিয়ে আসা।কিংবা সন্ধ্যাবেলায় নিজেরা সামান্য মুড়ি মেখে খেতে পারে না?এই কথাগুলো যখন আমি তাদের মুখের উপর বলে দেই তখনই আমি খারাপ হয়ে যাই। বেশ কয়েকদিন ধরে তো আমার সঙ্গে কথাই বলে না।” উৎপল স্নেহার দুটো বাহু শক্ত করে ধরল। বলল,”আমি এ ব্যাপারে সবার সঙ্গে কথা বলব। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কথায় আছে,কাজ করার সময় ঘুম পায়। কিন্তু ঘুমাতে চাইলে ঘুম আসে না সহজে। বেশ অনেক সময় ধরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে উৎপল আর স্নেহা। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না। স্নেহা পাশ ঘুরে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অতীতের কথা মনে করলো। ছোটবেলা কত সুন্দর ছিল। হাসিখুশিতে কাটিয়েছে। কত স্মৃতি রয়েছে।ছোটো থাকাকালীন সে ভাবতো, বড় হলে কোনো বর্ষার রাত্রে কিংবা দুপুরে একাকিত্বের সময় ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়বে। কষ্ট হবে। আজ ঠিক তাই হলো। ছোটবেলার বহু স্মৃতি চিন্তা করতে করতে একটু চোখ বুজে আসছিল, তখনই উৎপল তাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরল। তার চোখেও ঘুম নেই। কোনোরূপ বাধা দিল না। গুটিসুটি ভাবে ওর পিঠ ও মাথা উৎপলের বুকের মধ্যে আষ্টেপিষ্টে রয়ে গেল। উৎপলের একটা হাত স্নেহার মখমলে পেটের উপর অর্পিত হয়ে আছে। দীর্ঘ সময় স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরার পর রোমান্টিক কণ্ঠে বলল,”এ ভাবে আর একটু জড়িয়ে থাকি? ভালো লাগছে এইভাবে জড়িয়ে ধরতে।”
“গরম লাগছে তো।”
“ওহ, তাহলে ছেড়ে দিচ্ছি।”
“না না, ছাড়তে হবে না। এভাবে থাকো। আমারও ভালো লাগছে।”
অনেক সময় ধরে খুব ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে। একে অপরের তীব্র ঘ্রান অনুভব করল। আদুরে কন্ঠে উৎপল বলল,”এই শোন না?”
“বল?”
“কিছু না।” স্নেহা আর কোনো জবাব দিল না। দীর্ঘ ক্লান্তির পর আবার একবার চোখ বুজে আসলো। ঠিক তখনই উৎপল তাকে নাড়িয়ে আবার বলল,”এই শোন না।”
“বল?”
“কিছু না।”
“উফ!” বলেই উৎপলের দিকে মুখ ঘুরালো। স্বামীর শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”মেয়ের মত লজ্জা পাচ্ছো কেন? মুখ ফুটে কিছু বলতে জানো না। এতদিন ধরে আমি আমার সমস্ত দামি এবং গোপনীয় যা লালন পালন করেছি সব তোমার জন্য। এতে ভয় কিংবা লজ্জা কিসের? তুমি না আমার স্বামী। বুদ্ধু কোথাকার।” স্বামীর শরীর আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরলো। তার বুকে মুখ গুঁজে দিল। খুঁজে পেল স্বর্গীয় সুখ। উৎপল নিজের মুখ স্নেহার মাথার কাছে নিয়ে গেল। চুলের মধ্যে আঙুল ভরে দিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে টান দিন। দুজন চরম ভাবে উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। কেউ বেশি কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কথা আটকে যাচ্ছে। সুখের পূর্ববর্তী মুহূর্ত আরও সুখের হয়।কান থেকে চুল সরিয়ে উৎপল বলল,”তোমার এই কানের কাছে কাটা দাগটা ছোটবেলা থেকে রয়েছে। তাই না?” এই একটা প্রশ্ন-ই স্নেহাকে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলে দেয় বারবার। বিরক্ত হয়। ভগবানের সৃষ্টি। তার কিছু করার নেই। তবুও মানুষ কেন বারবার এই বিষয়ে প্রশ্ন করে, তাকে বিব্রত করে! অপ্রতিভ হয়ে বলল,”জন্মগত। কেন কোনো সমস্যা?”
“না। এমনি বললাম।”
“সত্য বলতে এত ভয় পাও কেন? বলতেই তো পারো ওই দাগটা দেখা গেলে আমার মুখটা বিচ্ছিরি লাগে।”
“ওই দাগটা তো দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় ঢাকা থাকে। অগোছালো থাকলে বোঝা যায়। তুমি এমনিতেই অনেক সুন্দর।” স্নেহা বুঝলো, উৎপল কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। নিজের কথার ফাঁকে কখন নিজেই জব্দ হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। খুব খারাপ লাগলো স্নেহার। শুধু এমন মুহূর্ত নয়, সে কখনো উৎপলের মুখে এমন কথা শুনতে চাই ছিল না। কিন্তু শুনতে হলো। মন থেকে চাইলে সবকিছু পাওয়া যায়। অজান্তে চলে আসা চোখের জল নিজেই মুছে ফেলল। উৎপলকে বুঝতে দিল না। উৎপল যথেষ্ট ভালো মানুষ। পারফেক্ট স্বামী। ভালোবাসার কমতি নেই। প্রিয় মানুষকে আগলে রাখতে জানে। কিন্তু ‘কিন্তু’ এই শব্দ টা অনেক সময় উহ্য হয়ে থেকে যায়। এই শব্দের সঠিক অর্থ খুঁজতে গেলে জীবনে খুব কম সম্পর্ক সারাজীবন টিকে থাকবে।
“কষ্ট পেলে?” করুন স্বরে বলল উৎপল।
“না তো। খুব সহজে কষ্ট পাই না।”
“এই যে তোমায় আগলে রেখেছি, তোমার ভালো লাগছে?”
“প্রিয় মানুষকে সবাই তো আগলে রাখে। কিন্তু আগলে রাখার নৈপুন্যতা কতজন বোঝে?” স্নেহার কথায় কেমন একটা ঝাঁজালো ব্যাপার রয়েছে। তার কথার সঠিক মানে উৎপল বুঝতে পারল না। বলল,”মানে?”
“অত সব জেনে লাভ নেই। আদর করো তো আমায়।” সহজ-সরল উৎপল কথা বাড়ালো না। হেসে উঠলো।
ছোট্ট একটা কাগজে সই করতেই চোখ দুটো জলে ভিজে গেল অশোকবাবুর। দীর্ঘসময় কাগজের দিকে তাকানোর পর কাঁপা কাঁপা হাতে সই করে ফেললেন। রুগ্ন পান্ডুর শরীর একা একা কেঁপে উঠল। পাশে লতা বসে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর আগন্তুক লোকটি কাগজ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। চাষির কাছে তার উর্বর চাষযোগ্য জমি সন্তানের মত। কোনো কিছুর বিনিময়ে ওই জমি হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু সম্মুখে যখন কঠিন সময় দাঁড়ায়, তখন সবকিছু মানতে হয়। তিন-চার বছর আগে তিনি এক বিঘা জমি বিক্রি করেছিলেন। সেই ঘা সামলে উঠতে না উঠতে আবার এক বিঘা জমি বিক্রি করে ফেললেন। তিনি আর পারছেন না। ছেলেকে বাইরে কলেজে পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ খরচ হয়ে গেছে। তার ওপর রয়েছে সংসারের খরচ। সবকিছু সামলাতে পেরে ওঠেননি। গত এক বছর থেকে তিনি কোনো কাজ করতে পারছেন না। যে মানুষটি রাতদিন এক করে কাজ করতেন, তিনি এখন দুটো কোপ কোদাল মাটিতে বসাতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। পুরো শরীর ঘেমে যায়। মাথা ঘুরে পড়ে যান। সংসারের অনটন শুরু হয়েছে। ব্যাংকে ধার দেনা শোধ করতে পারলেও সুদখোরদের থেকে আনা টাকা কিছুতেই শোধ করতে পারছিলেন না। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ছিল।চেনা অচেনা মানুষের গঞ্জনা সহ্য করতে পারলেন না। শেষমেষ তিনি আর এক সন্তানের বিদায় দিলেন। শরীরের ঘাম বিলিয়ে একটা একটা করে জমি কিনেছিলেন। তাদের আগলে ধরে এতদিন বেঁচেছেন। সেগুলো বিক্রি করতে হৃদয় কেঁপে উঠছে। লতা বাবার চোখের জল দেখে অবাক হলো। সে কখনো বাবকে কাঁদতে দেখিনি। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেই কেঁদে ফেলল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,”বাবা, তুমি কাঁদছো?” তিনি কোনো জবাব দিলেন না। চুপচাপ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলেন। অন্নপূর্ণা দেবী কাছে এসে বললেন। স্বামীর দুঃখে তিনিও দুঃখী। লতা আবার বলল,”বাবা! ও বাবা! খাবে না? স্নান করে এসো?” এতক্ষণে হুঁস ফিরলো অশোকবাবুর। লতা এতক্ষণে কি বলছিল পাশে বসেও শুনতে পাননি। বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। বিপন্ন মুখে বললেন,”কি বলছিস, মা?”
“তুমি এত চিন্তা করছো কেন? বাবা? সেদিন এমন চিন্তা করতে করতে ফাঁকা রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গেলে। ভাগ্যিস কাকু ছিল। না হলে কি হত কে জানে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা কীভাবে থাকবো বলো তো!”
“আরে বোকা! আমার কি হবে? আমি এত সহজে মরছি না। একটা ভালো পাত্র দেখে তোর বিয়ে দেবো। স্নেহা মাকে বাড়িতে বউ করে আনব। তারপর আমার বিদায়।” বাবার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল লতা। বাবার কোলে গিয়ে বসলো।
“মরার কথা একদম বলবে না। আরও অনেক বছর বাঁচবে।” মেয়ের কথা শুনে হেসে উঠলেন অশোকবাবু। বড় হয়েছে ঠিকই তবে কষ্ট পেলে বাবার কোলই তার কাছে প্রিয়।বাবা মেয়ের আদর যত্ন হাসিখুশি মুখ দেখে না হেসে থাকতে পারলেন না অন্নপূর্ণা দেবী। তিনি আরও কাছে এসে বসলেন। হাসিমুখে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,”ছেলের তো অনেক বয়স হলো। এবার তো বিয়ের ব্যবস্থা করো। স্নেহার বাড়িতে গিয়ে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলো একবার।”
“অন্নপূর্ণা, আমি ওর বাড়ির ঠিকানা জানি না। জানলে নিশ্চয়ই কথা বলতাম। তাছাড়া এটাতো ছেলের ব্যাপার। ওর সিদ্ধান্তটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে অন্নপূর্ণা দেবী বললেন,”ছেলেকে একটা ফোন করো। অনেকদিন হল কোনো কল করছে না।”
“কোনো কাজে হয়তো ব্যস্ত রয়েছে। তাই করছো না। সময় পেলে নিশ্চয়ই করবে। তোমার ছেলে দায়িত্বহীন নয়।”
“তা আমি ভালো করে জানি। কিন্তু টাকাপয়সা পেয়ে বদলে যাবে না তো সে। এই যে আমরা এত কিছু করছি। এত খেটে কুটে মরেছি। জমি বিক্রি করেছি। এর প্রতিদানে শেষ বয়সে একটু সুখ পাবো তো?”
অশোক বাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই লতা বলল,”অত পড়ে কি হবে? পাঁচ বছর তো ডক্টর করল। এ টুকু কি যথেষ্ট নয়? দাদাকে তো একটা ভালো চাকরি করতে বললেই হয়। আমাদের আর এত অভাব অনটন থাকবে না। তোমাকেও আর কাজ করতে হবে না।”
“আমিও তাই বলতে যাচ্ছিলাম। এত পড়ে কি হবে? এ মাসের টাকাও তো পাঠালো না। বুঝতে পারছি না তার কি হল?” স্ত্রী আর মেয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনলেন। তারপর বললেন,”আর্য হয়তো কোনো অসুবিধায় পড়েছে।তাই টাকা পাঠাতে পারছে না। সে তো সামান্য একটা চাকরি করে।তাতেই নিজের পড়াশুনার সামলাচ্ছে আবার বাড়িতে কম পারুক বেশি পারুক টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে । ওইটুকুই তো ছেলে আর কত সামলাবে ? এই বয়সে বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে নিজের পোশাক আশাক হাইফাই জীবন যাপন করে টাকা উড়িয়ে দেয়। আর সেখানে আমাদের আর্য যেটুক রোজগার করে তাতে নিজের পড়াশুনা সংসার দুটো সামলাচ্ছে। এটা কি কম স্বার্থ ত্যাগ?”
কেউ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মোবাইলে টিং টিং শব্দ হলো। মোবাইলের কাছে ছুটে গিয়ে স্ক্রীন দেখামাত্র লতা হেসে ফেললো। হাসিখুশিতে বাবা-মার উদ্দেশ্যে বলল,”তোমাদের ছেলে তোমাদের চাইতে অনেক দায়িত্ববান। টাকা ঠিক পাঠিয়ে দিয়েছে।” অশোক বাবু হেসে উঠলেন। হাসি মাখা কন্ঠে বললেন,”চিন্তা করো না অন্নপূর্ণা। তোমার ছেলে কখনো বদলাবে না নিশ্চিন্তে থেকো। ওটা আমার একমাত্র অহংকার। জীবনে যাই হয়ে যাক সে তার বাবা মাকে ফেলে কোথাও যাবে না। তুমি সব সময় অভিযোগ করো না, তোমার ছেলে তোমায় একটু কম ভালোবাসে। একবার তার চোখের দিকে তাকাবে, বুঝে যাবে সে তোমায় কতটা ভালবাসে।”
পর্ব ২৭ আসছে