কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২৯
_________________
স্নেহা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে মানুষ গিরগিটির মত রং বদলায়। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পূর্বে কখনো পরিচিত হয়নি। বর্তমানে তা নিজের চোখের সামনে দেখছে। মানুষ দ্রুত বদলায়। যবে থেকে উৎপল জেনেটিক কাউন্সেলিং এর কথা বলেছে, সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দু সপ্তাহ পরও সেই উৎকণ্ঠার সমাপ্তি ঘটেনি। বরং ঘন হয়েছে। জানতে পেরেছে, উৎপল থ্যালাসেমিয়ার বাহক। দুজনের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত নামক এক শব্দের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিজ্ঞান বলে, এই বংশগত রোগ এক লাখ মানুষের মধ্যে একজনের হয়। সঠিক কথায়ই বলে। কিন্তু এই মুখ্য বিষয়টি সাধারণ মানুষ গৌণ বিষয় হিসেবে নেয়।কখনো বোঝার চেষ্টা করে না, দুজন বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়ে উঠতে পারে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পাড়ি জমাতে পারে।প্রথম থেকেই বাড়ির সদস্যরা স্নেহার উপর অত বেশি খুশি ছিল না।মুখের উপর কথা বলায়, সামান্য কিছুতে খিটখিট করে উঠায় স্বামী ছাড়া সবার অপছন্দের চরিত্র হয়ে ছিল।রোগ ধরা পড়ার পর সে সকলের কাছে আরও বেশি খারাপ হয়ে ওঠে। তাদের পরিবারের সদস্যরা নাকি ইচ্ছে করে রোগ লুকিয়েছে। ইচ্ছে করে লুকিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হয়তো আরও অনেক কিছু রোগ রয়েছে। একটা রোগ ধরতে গেলে অনেকগুলো রোগ বেরিয়ে আসবে,এগুলোই এড়ানোর জন্য সবকিছু এড়িয়ে গেছে।তা না হলে এত উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন ভুল কি করে সম্ভব হয়? স্নেহা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থেকেছে। জবাব দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। দোষ নিজেদের। কথা তো শুনতেই হবে। ছোটবেলা থেকেই জানতো থ্যালাসেমিয়া বাহক সে। তারপরের ভুলটাকে নিছক ভুল বলা যায় না, ওটা এক ধরনের বোকামি। তবুও স্নেহা জলে ভেসে থাকা কিছু খড় কুটো কুড়োনোর চেষ্টা করছিল। একটা ভুল তো হয়ে গেছে। কিন্তু ভুলের সমাধানও রয়েছে। সেই ভুলকে নিয়ে না পড়ে থেকে, ভুলের সমাধান খোঁজা উচিত। কিন্তু স্নেহা কাকে নিয়ে লড়বে? কাকে বলবে সব কিছু? মানুষের জীবনের একটা ভুল সবকিছু শেষ করে দেয় না। ভুল থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। কিন্তু বড্ড অসহায় সে। প্রিয় মানুষটাও যে বদলে গেছে। তার কথা শুনছে না। গিরগিটির মত রং বদলে ফেলেছে। সেও সমস্ত দোষ স্নেহার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণ করছে। স্নেহা মন থেকে মেনেও নিয়েছে, অর্ধেকের বেশি দোষ নিজের এবং নিজের পরিবারে। কিন্তু তা বলে এই পরিবারে কি কারোর দোষ নেই? তারা আজ জেনেটিক কাউন্সেলিং এর কথা ভেবেছে, কিন্তু বিয়ের আগে কেন ভাবলো না? স্নেহা ছোটবেলা থেকে জানতে পেরে গেছিল তার একটা রোগ রয়েছে। কিন্তু যদি জানতে না পারতো, তাহলে আজ সমস্ত দোষ কার ঘাড়ে চাপাতো?এই পরিবারের সকলে কি স্নেহার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারত?
রাতে দুচোখ বুজে ব্যর্থ ঘুমানোর চেষ্টা করলো স্নেহা। বেশ কয়েকদিন হল কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। সবকিছু যেন শেষ হয়ে যেতে বসেছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। চোখগুলো গভীরভাবে কোঠরে ঢুকে গেছে। চোখে মুখে একরাশ স্তব্ধতা নেমে এসেছে। কিছুতেই মন খারাপের গল্পের অন্তিমে পৌঁছতে পারছে না। কোনো কিছুতে মনোযোগী হয়ে উঠতে পারছে না। উৎশৃংখল বদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিছানা থেকে উঠে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে রইল। শিরদাঁড়ায় প্রচন্ড ব্যথা করছে। কোনো কারণ ছাড়া ব্যথায় দাঁতের গোড়াও টনটন করছে। ভগবান কেন এমনটা করছেন? সে তো কখনো কারোর খারাপ চায়নি। কারোর প্রতি কোনো রকম বিরূপ আচরণ করেনি। তবে কেন নিজেকে অসহায় লাগছে? কেন নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠছে? যেখানে দুদন্ড শান্তির খোঁজে যায় সেখানেই অশান্ত শুরু হয়। তাকে ঘিরেই সব জায়গায় অশান্ত। চারদিক থেকে অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে।
রুমের মধ্যে একটা গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল উৎপলের। কম্বল সরিয়ে স্নেহার পাশে বসলো। স্নেহা কিছুতেই স্বামীর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া টের করতে পারল না। কেঁদেই গেলো। উৎপল নিজের নরম হাত স্নেহার কাঁধে রাখল। তার শীতল হাতের স্পর্শ শাড়ির আঁচল বেয়ে শরীরকে কাঁপিয়ে তুলতে পারল না। ব্যথিত মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। স্ত্রীর চোখের জল মুছে দিয়ে উৎপল বলল,”কেঁদো না প্লিজ। আমার খারাপ লাগছে।” স্নেহা কিছু বলল না। কিছুক্ষণ মৌন রইল। নিঝুম ভাবে বিছানার দিকে তাকিয়ে রইল উভয়ই। একটু পর স্নেহা কাঁপা কাঁপা গলাতে বললো,”একটা তো সমাধান দাও। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। এভাবে চলতে পারে না। আমি কখনো কোনো মানুষের অপমান কিংবা অবজ্ঞা সহ্য করতে পারি না। যখনই মনে হয় কেউ অন্যায় করছে তখন আমি তার মুখের উপর জবাব দিতে দ্বিধাবোধ করি না।কিন্তু কয়েক দিন ধরে কিছুই বলতে পারছি না। সমস্ত দোষ যে আমাদের। একটা কিছু উপায় বলো যাতে ওই মানুষগুলোর মুখের উপর জবাব দিতে পারি। বলতে পারি দোষ শুধু আমার নয় তোমাদেরও।”
“একটা উপায় আছে, তবে ভয়ানক।”
“কি উপায়?” আগ্রহী হয়ে উঠল স্নেহা।
“আমরা দু-জন আলাদা হয়ে যাই। নতুন করে নতুন মানুষকে নিয়ে সবকিছু শুরু করি। তাতে দুজনের মঙ্গল হবে।”
“কি?” আঁতকে উঠল স্নেহা। স্বামীর বুক আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,”পারবো না আমি তোমায় ছাড়তে। তুমি তো সবকিছুই জানো।আমার যদি আবার একবার বিচ্ছেদ হয় তাহলে আমার কাছে মৃত্যু ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো উপায় থাকবে না।” স্ত্রীকে বুকের মধ্যে আগলে নিল উৎপল। মাথায় বলিষ্ঠ হাত বুলালো। কিছুতেই স্ত্রীকে ঠান্ডা করতে পারল না। হু হু করে কেঁদে গেল। প্রিয় মানুষটির চোখের জলে আর আর্তনাদ নিজের চোখে জমতে থাকা জল আর ধরে রাখতে পারলো না। গাল বেয়ে থুতনি হয়ে স্নেহার মাথায় পরলো। দুজন কেঁদেই গেলো। একজন আর্তনাদ করে কাঁদলো আর একজন নীরবে। দীর্ঘ সময় পর স্নেহা একটু শান্ত হতে শক্ত করে ধরে বলল,”বোঝার চেষ্টা করো একটু। আমাদের আর কোনো উপায় নেই।পড়াশোনা করেও যদি বাস্তবটা না বোঝার চেষ্টা করি তাহলে লোকে তো বোকা বলবে আমাদের। আমাদের ভুলের শাস্তি আমাদের সন্তান কেন পাবে? আমাদের সন্তান জন্ম নিল; কিন্তু কতদিন বাঁচবে তা জানি না। কিন্তু ও প্রত্যেকদিন প্রত্যেকটা সেকেন্ড মৃত্যুর কঠোর যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করবে।আমরা বাবা-মা হয়ে কি সহ্য করতে পারবো? পারবো না সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে।” উৎপল থামল। স্নেহা মুখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাতেই মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। স্ত্রীর শুকনো মুখশ্রীর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।অন্ধকার ঘরের মধ্যে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্ত্রীর উজ্জ্বল মুখশ্রী খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছে।
“তাকাও আমার দিকে?” বলেই আবার একবার জোরে কেঁদে ফেলল স্নেহা। তবুও তাকালো না উৎপল। কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো তারপর বলল,”আমাদের সন্তান চাই না। আমার সারাজীবন না হয় এমন ভাবেই থেকে যাব।”
“এমনটা হয় না স্নেহা। পাগলামো করো না। আজকে মনে হচ্ছে সারাটা জীবন এভাবে থেকে যাব। কিন্তু পাঁচ বছর পর যখন সমাজ আর পরিবারের গঞ্জনা দুজনকে শুনতে হবে তখন অশান্তি শুরু হবে। দুজনের মধ্যে এই ভালোবাসা টাও চলে যাবে। তখন নিজে থেকেই চাইবে আলাদা হতে। কিন্তু তখন আর আলাদা হয়ে লাভ নেই।জীবনের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে যাবে। নতুন করে আর কিছু শুরু করা যাবে না। এখন আমাদের বয়স অল্প।আমরা নতুন করে নতুন মানুষের সঙ্গে সবকিছু শুরু করতে পারি। আমাদের সমাজে কত ডিভোর্স হওয়া পুরুষ মহিলা রয়েছে বলতো? অনেকের তো আবার সন্তান রয়েছে। সন্তান নিয়েও তারা আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চায়। সবকিছু শুরু করাও যায়।”
“তোমার ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস নেই তাই এমন কথা বলছো।” কোনো জবাব দিল না। স্নেহা কাঁদা বন্ধ করে দিল। চুপ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো। অল্প সময়ের পর উৎপল বলল,”তুমি তো বিক্রমকে ভুলে আমার সঙ্গে নতুন করে সব কিছু শুরু করেছিলে। তাহলে আমাকে ভুলে অন্য কারোর সঙ্গে কেন নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারবে না? অবশ্যই পারবে।” ছিটকে উঠলো স্নেহা। এই একটা কথাই যেন এখানে থাকার সমস্ত ইচ্ছাটাই মেরে ফেলল। ব্যঙ্গ করে বলা কথাটি কিছুতেই মানতে পারল না। হেসে উঠলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,”ঠিক কথাই বলেছো। আমি অবশ্যই সবকিছু নতুন করে শুরু করব।”
নিরবে চুপচাপ স্বামীর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিছানায় উল্টোদিকে পাশ ঘুরে ঘুমিয়ে পরল। অযথা আর কথা বাড়ালো না উৎপল।কি কারণে স্ত্রী রাগ করল তাও বুঝতে পারল না? সে যে আর উত্তর দেবে না তা জানে। এক বছর সংসার করে অন্তত এটুকু বুঝেছে, নিজে থেকে কিছু বলতে না চাইলে, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েও তার মুখ থেকে কথা বের করানো সম্ভব নয়।কি কারনে রাগ করলো ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরল উৎপল। কিন্তু চোখে ঘুম আসলো না স্নেহার। উৎপলের শেষ কথাটি মনে করলো আর কেঁদে গেল। সত্যি মানুষ বড় আজব!পৃথিবীতে কোনো মানুষ প্রথম কোনো প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর পর ওই সম্পর্ক ভেঙে গেলে,আবার কি নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করা যায় না?নতুন সম্পর্কে জড়ালে যদি ওই মানুষটাকে খারাপ হতে হয়, তাহলে তো পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই খারাপ। এই বৃহৎ জীবনে অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে। প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত স্থান এবং যথাযথ সম্মান থাকে।তাদেরকে উপযুক্ত স্থানে রেখে সম্মান প্রদান করে এগিয়ে যেতে হয়। যারা এমনটা পারে না কিংবা পুরনো সম্পর্ক টেনে এনে অভিযোগ করে, খোঁটা দেয় তারাই খারাপ মানুষ হয়। কোনো সম্পর্ক ভেঙে গেছে মানে সম্পর্কটা খারাপ ছিল এমন নয়। ভালো সম্পর্কও ভেঙ্গে যায়।খারাপ সম্পর্ক গুলো ভেঙ্গে যাওয়ার পর খারাপই থাকে আর ভালো সম্পর্ক গুলো ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভালো থাকে। বিক্রম আর স্নেহার সম্পর্ক ভালো ছিল। তাই ভেঙ্গে যাওয়ার পরও ভালো আছে। কেউ কাউকে একবারের জন্যও কলঙ্কিত করেনি। এখানেই সম্পর্কের জয়। দু’বছরে আবেগপ্রবণ অনুভূতিগুলির জয়।
ঘুম ভাঙার পর উৎপল দেখল স্ত্রী অঘোরে ঘুমাচ্ছে।খুব ভোরে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল। আগের দিনে রাত্রির কথা ভেবে কেঁপে উঠল। স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করে দেখলো গায়ে জ্বর এসেছে কিনা? জ্বর নেই। সুস্থ রয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। দুটো গালে দুটো হাত রেখে অদ্ভুতভাবে চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। কয়েকদিন হলো কোনো কাজে মন দিতে পারছে না। অফিসে অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। বাবা-মা সমস্ত কিছু নিজের উপর ছেড়ে দিয়েছে। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিজেই নিবে। তারা এই পৃথিবীতে মাত্র আর কয়েক দিনের অতিথি। তাকেই সারা জীবন থাকতে হবে। সে কেমন থাকবে তার ব্যাপার। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না।একদিকে নিজের ভবিষ্যৎ অন্যদিকে স্নেহার দুঃখ কষ্ট। কিছুই সহ্য করতে পারছে না।এক বছরের বেশি বিবাহিত সম্পর্ক ছেড়ে নিজেও কিছুতে বেরিয়ে আসতে পারছে না। স্নেহার ছোট ছোট দুষ্টুমি, পাগলামো, ভালোবাসার মোহ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সম্ভব নয়। এই ভরা সংসারে হঠাৎ কার নজর পড়লো কে জানে। স্নেহার ঘুম ভাঙার পর স্বামীকে চিন্তিত দেখে অবাক হলো। নড়েচড়ে বসল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল,”তোমায় এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? চিন্তা করো না তোমাকে বেঁধে রাখবো না।” স্নেহার নিলজ্জ হাসি এবং কদয্ পরিহাসে উৎপলের হৃদয় কম্পিত হলো। এই মেয়েটার হঠাৎ করে কি হলো? কাল রাত থেকেই বেশ কঠোর কঠোর কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। তথাপি কোনো জবাব দিল না। স্নেহা আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
“উৎপল, আরেকটু ঘুমাও না পাশে।” স্ত্রীর দিকে তাকাতেই চোখ দুটো কেঁপে উঠল। মুখ দ্রুত ফিরিয়ে নিল। চুপচাপ বসে রইল। তারপর অনিচ্ছাকৃত সত্ত্বেও স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লো। স্নেহা খপ করে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকালো।কত রাগ কত মান অভিমান জমা হয়ে রয়েছে তবুও সেগুলো প্রকাশ করতে চাইল না। করেও লাভ নেই।স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,”তুমি আমায় খারাপ ভাবছো তাই না! ভাবছো, আমি কাপুরুষ। একদিন দায়িত্ব নিয়ে ছিলাম আর আজ দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি।”
“না উৎপল, আমি এমনটা ভাবছি না। আমি বাস্তবটা বুঝে গেছি। আর যতই আমাদের বিচ্ছেদ হোক কিংবা তুমি আমাকে যতই খারাপ কথা বলো না কেন আমি তোমাকে কখনো কলঙ্কিত করবো না। কেন কলঙ্কিত করবো না, জানো?”
“কেন?”
“কারণ, একটা সময় আমার হাত তোমার হাতের উপর ছিল। দুটো হাত মিলিয়ে অনেক স্মৃতি গড়েছি। একে অপরের সেবা সুস্থতা করেছি। আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। ভালো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরও ভালো থাকে।” উৎপল নিরুত্তর রইল। স্নেহা আবার বলল,”আমাদের সমাজে বেশিরভাগ নারী তার স্বামীকে খুব সহজে অতিমাত্রায় ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু বহু পুরুষ তার মর্যাদা রাখতে পারে না। হয়তো পরিস্থিতি নয়তো লোভ লালসার কাছে হেরে যায় সত্যিকারের ভালোবাসাও।” স্নেহার এই কটু কথা যেন উৎপলকে ইঙ্গিত করল। সমস্ত পুরুষ জাতিকে অপমান করছে না ঠিকই,তবে আড়ালে নিজের স্বামীকে যে অপমান করছে তা বুঝতে বাকি রইল না। স্ত্রীর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইল। দ্বিরুক্তি হীন হাসি হেসে স্নেহা বলল,”খুব সহজে মুক্তি পেতে চাইছো না আমার কাছ থেকে? যদি মুক্তি না দিই তাহলে পারবে আমার কাছ থেকে মুক্ত হতে? দেশের আইন কিভাবে ঘোরাতে পেঁচাতে হয় তা জানি। কিন্তু যেখানে অধিকার নেই সেখান থেকে লাভ কি? তোমার কাছে আমার গায়ের গন্ধটা এখন বিচ্ছিরি হয়ে গেছে। আমার রূপ যৌবনের প্রতি তোমার আর লোভ নেই। নতুন রূপ যৌবন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছো। এই ঘর দুয়ার আমি নিজের মত করে সাজিয়েছি।কয়েকদিন পরেই সাজানো-গোছানো ঘরে অন্য কেউ আসবে। তুমি পারবে তাকে ভালোবাসতে? আমার মতো আদর করতে?আমার কথা মনে পড়বে না?” উৎপল কোনো জবাব না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার এ সব ভালো লাগছে না। অপমান আর সহ্য করতে পারছে না।
রোজ সকালে অফিসে যায় উৎপল। অন্তত শেষবারের জন্য উৎপলকে খাবার তৈরি করার জন্য উঠে পড়ল স্নেহা। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে অবাক হলো। আজ শাশুড়ি নিজে থেকে রান্না করতে শুরু করছে। স্নেহা শাশুড়িকে দেখে হেসে ফেলে। শাশুড়ির রাগে গনগন করতে থাকে। তাও হাসি চেপে রাখতে পারেনি। এ এক বিদ্রুপের হাসি। তাকে যে এ বাড়িতে আর প্রয়োজন নেই তা যেন সবাই বুঝিয়ে দিতে চাইছে। রান্নাঘরের দিকে পা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমে ফিরে এসে বসে রইল। নির্দিষ্ট সময়ে উৎপল অফিস চলে গেলো। স্নেহাকে কিছু বলল না। টিফিন দিতেও বলল না। টিফিন না নিয়েই চলে গেল।সাবধানে থাকতে বললোও না। যা প্রত্যেক দিন অফিস যাওয়ার সময় বলে যায়। বেলা বাড়তেই শাশুড়ি এসে খেতে ডাকলেন। সে উঠে গেল না। খাবার খেতে ইচ্ছে-ই নেই। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ফেললো। এই বাড়িতে আর থাকার কোনো মানে হয় না। যেখানে বুক উঁচু করে দুটো কথা বলতে পারবে না, যার কথার গ্রহণযোগ্যতা খুব কম, সেখানে না থাকাটাই ভালো। জিনিসগুলো গোছাতে গোছাতে একধাপ কেঁদে ফেলল।নিজের মতো করে সবকিছু সাজিয়েছিল আজ নিজের মতো করে সবকিছু ভেঙে ফেলছে। সারা জীবন এই ঘরে থাকবে ভেবেছিল।এইতো কয়দিন আগে আলমারি সরিয়ে একটা নতুন পালঙ্ক রাখবে ভেবেছিল। সেখানে তার সন্তানরা ঘুমোবে। কিন্তু আজ!কি আজব জীবন!এ জীবন যেন নদীর মত। নদী যেমন এক কুল ভাঙে আর এক কূল গড়ে। জীবন নদীর অনুরূপ। একদিকে ভাঙে তো একদিকে গড়ে।সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল,এবং বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। দুপুরে দুমুঠো ভাত ছাড়া আর কিছু খায়নি। এ ঘর ও ঘর ঘুরে বারবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। নিজের হাতে বানানো কিছু জিনিস নাড়িয়ে দেখেছে। এই তো শেষ। আর কক্ষনোই ফিরবে না এ বাড়িতে। শেষবারের মতো না হয় একটু ভালো করে দেখে নিল। ছাদে গিয়ে একা একা বসেছিল। দুটো হাঁটু জড়ো করে তাতে থুতনি রেখে দূরের আকাশ পাহাড় পর্বত নদী দেখেছে। এগুলো কাল থেকে আর দেখতে পাবে না। প্রতিদিনের রুটিন পরিবর্তন হবে। ছাদে এসে দড়িতে আর কাপড় শুকাবে না। কারোর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে না। অতিথির মত যেন উত্তরবঙ্গে এসেছিল। এখন সময় হয়েছে ফেরার। কাল থেকে জীবন কেমন হবে জানে না। তবুও হাঁটতে হবে। সন্ধ্যার সময় উৎপল অফিস থেকে ফিরে স্নেহাকে সবকিছু গোছাতে দেখে অবাক হলো। পোশাক পরিবর্তন না করেই বললো,”কি হলো? সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছো কেন?”
“এমনটা তো তুমি চাইছিলে।”
“তা বলে হঠাৎ করে? কিছুতো নিয়ম কানুন রয়েছে।”
“সম্পর্ক ভাঙ্গা কিংবা গড়া কোনোটাতেই কোনোরকম নিয়ম লাগে না। এমনিতেই হয়ে যায়।”
“তাও?”
“তুমি ডিভোর্সের পেপার পাঠিয়ে দেবে আমি সাইন করে দেবো। কোর্টে কবে আসতে হবে বলবে আমি ঠিক চলে আসব। তোমায় বেশি ছুটাবো না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।” বেশি কথা বাড়াতে চাইলো না উৎপল। তর্ক করে লাভ নেই। সে আর কিছু বুঝবে না। বোঝানোর মতোই বা কি আর আছে? ঠান্ডা মস্তিষ্কে বলল,”কখন যাবে?”
“আজকেই, রাতের ট্রেনে।”
“ট্রেনে তোমায় যেতে হবে না। আমি তোমায় পৌছে দিচ্ছি।”
“লাগবে না। আমি একা যেতে পারবো।”
“কি পাগলামো করছো? লোকে কি ভাববে বলতো?”
“এটুকু না হয় সহ্য করে নাও। আমার জন্য এটুকু করতে পারবে না?” উৎপল ধপ করে পালঙ্কের উপর বসে পড়ল। আর কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। দ্বিরুক্তি হীন চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকালো। পায়ে ঝিঝি ধরেছে। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর পাশে স্ত্রী এসে বসে বলল,”আমার শেষ একটা আবদার রাখবে?”
“বল?” কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল উৎপল।
“শেষবারের মত আমার পায়ে একবার আলতা লাগিয়ে দাও। মাথার খোপা করে চুল বেঁধে দাও।”
“পারবো না।সব কিছু যখন নিজে থেকে করে নিয়েছো তখন এই দুটো আর বাকি রেখেছো কেন?” উচ্চস্বরে জবাব দিলো উৎপল।চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল তার। স্নেহা আর কিছু বলল না। নিজে গিয়ে মাথায় খোপা করে চুল বেঁধে ফেলল। আলতা লাগিয়ে নিলো। উৎপল ভাবছিল,হয়তো স্নেহা জোর করবে।কিন্তু সে কিছুই করলো না। শেষবারের মত স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারল না। উৎপলের আক্ষেপ আরও বাড়লো। বুকের কোনো স্থানে হঠাৎ করে বীভৎসভাবে যন্ত্রনা শুরু হলো। জিভ নড়লো না।মুখ তুলে দেখল, স্নেহা দুটো লাগেজ টানতে টানতে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেক আগেই সিথী থেকে সিঁদুর মুছে ফেলেছে। শাখা পলাও খুলে ফেলেছে। নির্জীবের মত পালঙ্কের উপর বসে রইল। একবারের জন্যও স্ত্রীকে বাধা দিল না।পায়ে ঝিঝি ধারায় সামান্য উঠে যেতেও পারলো না। সে নিরুপায়। উৎপল ভেবে রেখেছিল, অন্তত আরও কয়েকটা মাস স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে পারবে।দুজনের মন শক্ত হয়ে গেলে একে অপরের প্রতি কোনো অভিযোগ না রেখেই দূরে সরে যাবে। তা আর হলো না। স্নেহা বড্ড অভিমানী। কালকের রাতে কোনো এক কথায় তার ইচ্ছে শক্তি সম্পূর্ণ বদলে গেছে।নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করেছে। বেশি কিছু ভাবেনি। অল্প ভাবনায় সন্তুষ্ট হয়েছে। উৎপল রুমের মধ্যে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠল। চোখ দুটো ধক্ ধক্ করে কেঁপে উঠলো। নিজেই নিজেকে বলল,”তুমি কি কখনো বুঝবে না আমি তোমায় কত ভালবাসি। ইচ্ছে করে তোমায় বিদায় দিতে চায়নি।সারা জীবন পাশে থাকবো বলে সাত পাকে বাঁধা পড়ে এ বাড়িতে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে নিয়ে এসেছিলাম । তোমার সমস্ত অতীত জেনে তোমায় ভালোবেসেছিলাম। তোমার কিছুটা অভিনয় আর কিছুটা অতিরিক্ত দেখানো ভালোবাসা বুঝতে পেরেও চুপ ছিলাম। তাও তুমি আমায় বুঝলে না।এতদিনের ভালোবাসায় কোনোরূপ অভিনয় ছিল না। পরিবার আত্মীয়-স্বজন ভবিষ্যতের কথা ভেবে কঠোর একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। সত্যি সত্যি আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সারা জীবন তোমায় ভালো রাখার।যতদিন কাছে ছিলে ততদিন অন্তত মুখ ফুটে কেউ বলতে পারবে না,আমি স্ত্রীকে সুখ দিতে পারিনি। কেউ গায়ের জোরে বললে আলাদা কথা। নিজের সমস্ত দায়িত্বও কর্তব্য নির্বিধায় পালন করে গেছি। জানি না, তুমি আমায় কখনো ক্ষমা করতে পারবে কিনা! তবে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি কী? হ্যাঁ পারছি। কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি। যদি অন্যায় করে থাকি তাহলে এর বিচার সৃষ্টিকর্তা করবেন।”
নিজের বেডরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর শেষবারের মত শাশুড়ি আর শ্বশুরকে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাঁরা প্রথমে বাধা দিচ্ছিলেন একা যেতে। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে তারপর না হয় ফিরুক। কিন্তু কারোর কথা শোনেনি স্নেহা। পশ্চিম আকাশে সূর্যদেব বিদায় বেলা সূচিত করেছে আর পূর্বাকাশ চাঁদমামা ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গোধূলি লগ্ন। মৃদু শুদ্ধ বাতাস বইছে। বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে আসার পর আবার সেই পুরনো বাড়ির দিকে ঘুরে দেখল। চোখ দুটো জলে ভিজে গেল। কেউ বারান্দায় এসে তার দিকে তাকিয়ে নেই। শুধু ওই বাড়িটা তাকিয়ে রয়েছে। ছাদে এখনো তার একটা লাল রঙের শাড়ি,পেটিকোট,আর একটা লাল রঙের ব্লাউজ রোদে পড়ে রয়েছে। দুপুরে স্নান করার পর ধুয়ে শুকাতে দিয়েছিল। তোলা হয়নি। ওই গুলো দেখে মৃদু হেসে ফেলল স্নেহা। হয়তো, উৎপল সেগুলো তুলে গুছিয়ে রেখে দেবে। বাড়িতে আবার একটা নতুন মানুষ আসবে। হয়তো বৃষ্টি স্নাত কোনো সকাল,কিংবা দুপুর,কিংবা সন্ধ্যায় প্রতিদিনের পরা শুকনো শাড়ির অভাবে, নতুন মানুষটি অগোচরে পুরনো অগোছালো শাড়িটা পরে ফেলবে। জানতেই পারবে না ওই শাড়িটা কার ছিল? উৎপল নতুন মানুষটিকে পুরনোর শাড়ি পরিধান করতে দেখে হয়তো অবাক হবে। নতুন করে বিছানা উষ্ণ হয়ে উঠবে। উৎফুল্লতায় ভরে উঠবে দুটি হৃদয়। সেদিন উৎপলের ঠিক স্নেহাকে মনে পড়বে। মনে পড়বে এই শাড়ি তার প্রাক্তনের।এই শাড়ি পরা অবস্থায় কত আদর যত্ন কত মায়া কত লোভ লালসায় মুগ্ধ হয়েছিল একসময়। কত তৃষ্ণায় ঘেরা ছিল ওই শাড়িটি। ওই শাড়ির আঁচলে কখনো মুখ লুকিয়েছে। কখনো ওই শাড়ির আঁচল সরিয়ে অট্টহাসি হেসেছে, লাজুকতায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আবার কখনো চরম তৃপ্তির সুখ খুঁজে পেয়েছে। মানুষটি হারিয়ে গেছে অজানার দেশে। আজ সেই শাড়িটার অধিকার অন্য কারোর হয়ে গেছে। শাড়িটা থেকে গেছে, শাড়ির গন্ধও রয়ে গেছে -শুধু বদলে গেছে মানুষটা। স্নেহা হাঁটতে রইল। দু পা এগিয়ে যায় আবার একবার পিছনে তাকায়। দু পা এগিয়ে যায় আবার একবার পিছনে ঘুরে তাকায়। যতক্ষণ না পর্যন্ত বাড়িটি সম্পূর্ণ চোখের আড়াল হলো ততক্ষণ পর্যন্ত বারবার ঘুরে তাকালো। হালকা মৃদু বাতাসে শাড়িটা তখনও দুলছে।
কবিতা দেবী সকাল বেলা পুকুর ঘাটে বাসনপত্র ধুয়ে বাড়ি ফেরার পথে নিজের মেয়েকে লাগেজ হাতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাপা আনন্দে হৃদয়ে পরিপূর্ণতা পেল।বেশ কয়েকটি মাসের পর নিজের কন্যাকে দেখতে পেলেন। ছুটে গিয়ে বাসনপত্র রেখে দিয়ে মেয়ের কাছে আসলেন। স্নেহার হাত থেকে লাগেজ ছাড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে বললেন,”ভোরের ট্রেনে এলি? না জানিয়ে হঠাৎ করে যে?”
“নিজের বাড়িতে আসার জন্য পারমিশন লাগে বুঝি?”
“তোর পুরনো খিটখিটে স্বভাব এখনো যায়নি দেখছি। জামাই কই? দেখতে পাচ্ছি না কেন? তুই একা এসেছিস?”
“অত প্রশ্ন করো না। আমায় আগে ঘরে যেতে দাও।”
কবিতা দেবী চুপ করে গেলেন। তিনি মা,বুঝতে পারলেন, মেয়ের কিছু একটা হয়েছে।চোখ দুটো দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকগুলো রাত ঠিকমতো খায়নি ঘুমোইনি।স্নেহা ঘরে প্রবেশ করে সোজা সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে রইল। মেয়েকে অন্য মনস্ক দেখে প্রশ্ন করলেন,”কি রে? এসেই নিজের রুমে চলে যাচ্ছিস? মার সঙ্গে কথা বলবি না?” তথাপি স্নেহা মুখ ফিরে দেখল না। হনহন করে এগিয়ে গেল। পিছনে পিছনে কবিতা দেবীও গেলেন। নিজের রুমে গিয়ে গোটানো বিছানা বিছিয়ে চুপ করে বসে পড়ল। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরলো। মেয়েকে কাঁদতে দেখে আশ্চর্য হয়ে উঠলেন। বড় কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারলেন। মেয়ের পাশে বসে সবকিছু জানতে চাইলেন। স্নেহা একটু একটু করে অগোছালোভাবে সবকিছু বলল…।
সবকিছু শুনে নীরব হয়ে বসে রইলেন কবিতা দেবী। বিয়ের পর এমন একটা আশঙ্কা করেছিলেন। তা যে সত্যি সত্যি হবে স্বপ্নেও ভাবেননি। হঠাৎ করে নিজেরা সব কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে তাও কল্পনার অতীত ছিল। কোথাও তিনি মেয়ের দোষ খুঁজে পেলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,”চলে এলি কেন, তুই? কিছুতো একটা উপায় হতো। এভাবে চলে এসে ঠিক করিসনি। আমাদের বলতে পারতিস। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতো। টাকা-পয়সা গয়নাগাটির তো একটা ব্যাপার রয়েছে।” মায়ের শেষ বাক্যটি শুনে স্নেহা না হেসে পারলো না। এমন পরিস্থিতিতে মেয়েকে হাসতে দেখে চরম বিরক্তি হলেন।
“হাসছিস কেন?”
“আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেতে বসেছে।আর তুমি টাকা পয়সার কথা ভাবছো?”
“আমি এমন ভাবে বলিনি। এই ভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা কোনো ভদ্রতা দেখায় না। সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে এই মুখ নিয়ে ওই বাড়িতে যেতে পারবি তো?”
“আমি তো আর যাব না।”
“যাবি না মানে?”
“তোমার মেয়ে মাথা নিচু করতে জানে। তবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। আমি অতটা মাথা কক্ষনোই নিচু করবো না,যাতে ওই মাথা আর কখনো তুলতে না পারি। আমার যতটুকু করার কথা ততটুকুই করেছি। এরপর সবাই মিলে হাজারবার চেষ্টা করলেও আমি ওই বাড়িতে ফিরে যাব না।”
মেয়েকে কি জবাব দেবে খুঁজে পেলেন না। জলে ভেজা চোখে এদিক ওদিক দেখে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,” সব দোষ আমাদের। আমাদের ছোটো একটা ভুল তোকে আজ…..।” কথা শেষ করতে পারলেন না কেঁদে গেলেন। অনেকক্ষণ ধরে মা-মেয়ে মৌল রইল। তারপর স্নেহা বলল,”যা হওয়ার হয়ে গেছে। নিজেদের দোষ দিয়ে আর কি হবে। তুমি একটু রুম থেকে যাও। আমি ঘুমাবো।” কবিতা দেবী মেয়ের চোখের দিকে তাকালেন। তিনি যেন কিছু একটা ইঙ্গিত করেছেন। মেয়েকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না। মায়ের চোখের চাহনি দেখে ফিক করে হেসে ফেললো স্নেহা। হাসির মধ্যে কত মধুর বুক ভাঙ্গা কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে একমাত্র সেই জানে। কি দয়ালু, কি নিষ্পাপ হাসি!মাকে আশ্বস্ত করে বলল,”চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে গলায় দড়ি দেবে না। অতটা বোকা নই আমি।” মেয়ের কঠিন সত্য কথা গুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না। রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। বিছানায় গা এলিয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়ল স্নেহা। বেশ কয়েকদিনের ক্লান্ত শরীর পুরনো বিছানার গুমোট গন্ধ নিজেকে স্বস্তি দিল। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। চোখের জলের ধারা কানের গোড়ায় দিকে বয়ে গেল। অতীত হাতরে বেড়ালো। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলে ফেলল, এমনটা কেন করলে উৎপল? সবকিছু তো জানতে। তারপরও ছেড়ে দিলে! পারবে আমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে? পারবে অন্য কারোর শরীরের গন্ধ অনুভব করতে? আমার চুলের গন্ধ আর অনুভব করবে না? তাকে সুখ দিতে পারবে? যদিও তোমার কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তুমি তো সব পারো। হয়তো আমার জীবনে বেশ কয়েকটা প্রেমিক ছিল, এইতো সেদিন অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিলে। ওই একটা কথাই তোমার সমস্ত ভালো ব্যবহার মলিন হয়ে গেছে, তা তুমি বুঝতেই পারোনি। কেন উৎপল?আমরা সন্তান না নিয়ে কি সারা জীবন দুজন একসঙ্গে থাকতে পারতাম না? কত অনাথ ছেলে আশ্রমে বড় হচ্ছে। আমরা তো দত্তক নিয়ে একজনকে রাখতে পারতাম। পারতাম না বল? ঠিকই পারতাম। -কথাগুলো ভেবে খিল খিল করে হেসে উঠল স্নেহা। আবার কেঁদেও ফেলল। সে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছে না। মাথা যন্ত্রণা করছে। সহ্যের সীমানা অনেক আগে অতিক্রম করে ফেলেছে। গা হাত ব্যাথা টনটন করছে। হীন মমতায় দগ্ধে মরছে।একবার হাসে তো একবার কাঁদে। আজ সে উৎপলকে দোষ দিচ্ছে। সত্যি কি উৎপল দোষী? যদি দোষী হয় তাহলে সে নিজেও তো দোষী। আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে আর্য ঠিক এমন একটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। তখন সে নিশ্চয়ই,স্নেহার মত কথাগুলো ভেবেছিল।সন্তান দত্তক নিয়ে নেবে কিন্তু ভালোবাসা বিসর্জন দেবে না। সত্যিই যদি স্নেহা আর্যকে ভালবাসতো তাহলে কখনো ছেড়ে যেত না। শরীরের রোগ বলে বাস্তবতা বোঝো। ভালোবাসা বলে বাস্তবতা ভেঙ্গে ফেলো। বাস্তবতার চাইতে বড় ভালোবাসা। সেদিন তো স্নেহা দ্বিতীয় কোনো উপায় খুঁজে নি। কোনো আলোচনা করেনি। সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলে। আজ উৎপলও কোনো উপায় খোঁজে নি। সম্পর্ক ভেঙে ফেলেছে। সেদিন যদি স্নেহা কোনো দোষ না করে থাকে তাহলে আজ উৎপল-ও কোনো দোষ করেনি। সেদিন সে বাস্তবতা বুঝে কোনো অন্যায় করেনি আজ উৎপল-ও বাস্তবতা বুঝে কোনো অন্যায় করেনি। কথাগুলো যতই ভাবছে স্নেহার মাথার যন্ত্রণা ততোই বাড়ছে। সহ্য করতে পারছে না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে আর্যকে ঠকিয়েছে। তাকে কাঁদিয়েছে। নিষ্পাপ কিশোরকে স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। তার ক্ষমা কি কখনো হয়?কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল বুঝতে পারল না।নিজেকে যে রুমের মধ্যে বন্দী করল তারপর প্রায় আট মাস কেটে গেল। রুম থেকে আর বাইরে বের হলো না। ইতোমধ্যে, ডিভোর্সে পেপারে সাইন করা হয়ে গেছে। খাতা-কলমের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন আর স্নেহা কাঁদে না। শক্ত পাথর হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের একটা জগত গড়ে তুলেছে। সারাদিন চুপচাপ রুমের মধ্যে বসে থাকে। স্নান করার সময় স্নান করে খাবারের সময় দুমুঠো ভাত খায় ব্যাস এটুকুই। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ঠিকমতো সূর্যালোক দেখে না।অনেকগুলো মাস হল প্রকৃতির নির্মল বাতাস গায়ে লাগাতে পারিনি। সাজগোজ করা হয় না। কারোর কাছে কোনো আবদার করে না। যেন জীবন থেকে শত মাইল দূরে রয়েছে সে। কোনো কিছুতে সহজে আঘাত পায় না আর। যে কয়টা হাতের কাজ শিখেছিল সেগুলোই সারাদিন করতে থাকে। নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। বাবা অনেক গল্পের বই এনে দিয়েছেন। সেগুলো পড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। তবুও অতীত ভুলতে পারে না। বারবার কারোর গায়ের গন্ধ পায়। স্বামীর আদর যত্ন পেতে ইচ্ছে করে। সেই সুখে ভরা পদ্মের মতো সুন্দর উত্তেজিত মুহূর্ত তাকে কাঁপিয়ে তোলে। চোখ থেকে জল বের হয় না তবু বুকটা কেমন করে ওঠে। মনে হয় ছুটে আসুক না ওই মানুষটা। একটু আদর যত্ন করুক। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। সে জানেও না তার স্বামী বিয়ে করেছে কিনা! সবকিছু থেকে ব্লক করে দিয়েছে তাকে। কোনো নতুন তথ্য জানতে পারে না। হয়তো বিয়ে করে নিয়েছে। সুখে সংসার করছে। ভুলে গেছে এই মানুষটিকে। আজকাল মাঝেমধ্যে স্নেহার আর্যর কথা মনে পড়ে। তার ছোট ছোট দুষ্টুমি গুলো বেশ পুড়িয়ে মারে। সে বরাবর মনে করে এসেছে আর্য বোকা। কিন্তু এখন উল্টো মনে হয়। সে নিজেই বোকা। তাই তো আর্যর মত ছেলেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। সে মনে করতো আর্য সমাজকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু এখন উল্টোটা মনে হয়। সে নিজেই সমাজকে ভয় পায়। সমাজকে ভয় পায় বলেই আজ শত মানুষের কটু কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না। বাইরে বের হতে পারে না। কিন্তু আর্য যদি সত্যি সমাজকে ভয় পেত, তাহলে সে সেদিন সমাজের ঊর্ধ্বে গিয়েও কেন তাকে বিয়ে করতে চাইছিল?আগে থেকেই তো জানতো তাদের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। থাকলেও ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বহু মানুষের বহু কথা শুনতে হবে। তাও সমাজকে ভয় পায়নি। তাকে স্ত্রী বানাতে চাই ছিল। তার পাশে তাকে সারা জীবন দেখতে চাইছিল। তার মত কেউই যে ভালোবাসতে পারলো না তাকে। ভালবাসাই তার কাছে সবকিছু। জানে না আজ কোথায় আছে সে? তবুও মনে মনে প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে, যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক সুস্থ থাকুক।
আজকাল বাবা-মা স্নেহাকে নতুন বিয়ে করার কথা বলছে। নতুন পাত্র দেখাও শুরু হয়েছে। কোনো কিছুতে হুশ নেই স্নেহার। সম্পর্কের কথা শুনে হাসি পায় তার। এই পৃথিবীতে তার কাছে সম্পর্কটা শুধুমাত্র একটি অজুহাত হয়ে গেছে। সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই। চাহিদা ফুরিয়ে গেলে দূরে ঠেলে ফেলে দেবে। অনেক শিক্ষা হয়ে গেছে। আর ওই দিকে পা বাড়াতে চায় না। দিনগুলো কোনো রকম ভাবে কাটতে রইল। রাতের বেলা জানালা খুলে বসে থাকলে দূরের ট্রেনের ছুটে চলা আজও দেখা যায়। আজও সময় মতো ট্রেন চলে। কিন্তু ট্রেন সৃষ্টিকারী মানুষ গুলো মুছে গেছে। হারিয়ে গেছে অজানা শহরে। কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু ফুল কুড়ানোর মানুষটা আজ ঘরে বন্দী হয়ে গেছে।সে প্রথম যেদিন বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিল, সেদিনই নিলেশ তার বাড়িতে এসে সব কিছু জানতে চেয়েছিল। তার বকবকানি ওই মুহূর্তে শুনতে ভালো লাগছিলো না। কটু কথা বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে সে আর এ বাড়িতে আসে না। জানালায় বসে দেখে, আকাশ আর নিলেশ বিকেলবেলা সাইকেল করে কোথাও যায়। বাড়ির দিকে তাকায় কিন্তু ভেতরে আসে না।সকাল বেলা কোথাও গেলেও তারা বাড়ির দিকে একবার হলেও তাকায় কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে না। তারা এখন পর হয়ে গেছে। স্নেহার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে তাদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের সঙ্গে একটু ঘুরতে। কিন্তু পেরে উঠে না। আজকাল ভাইটাও কেমন হয়ে উঠেছে। বড় হয়েছে এখন আর দিদির কাছে ঘুমায় না। আলাদা রুমে থাকে।দিদি তাদের বাড়িতে রয়েছে তাই সেও একটু বিরক্ত হচ্ছে। সবকিছু বুঝতে শিখেছে। সমাজের বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কথা শোনাচ্ছে। তারপর দিদি যদি এখানে থাকে তাহলে সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে। সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এইজন্য হয়তো দিদির প্রতি সে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। যে ভাই দশ টাকার জন্য দিদিকে কত আদর করতো, দুপুরে ঠিকমত ঘুমাতে দিত না, যে বলেছিল সবসময় দিদির পাশে থাকবে, বিয়ের দিন যে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছিল আজ সেও বদলে গেছে। বাবা-মাও কেমন একটা আচরণ করেন। মেয়ের ওপর একটু বিরক্ত ঠিকই তবে মেয়েকে ফেলে দিতে পারেননি। মেয়ের প্রতি ভালোবাসা যে কমে গেছে তা নয়, তবে মেয়ের কঠোর সিদ্ধান্ত গুলো মানতে পারছেন না। বেঁচে থাকার উৎস জাগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু স্নেহা একটাও গ্রহণ করছে না। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে স্নেহার বারবার মনে পড়ল আর্যর বাড়িতে যাওয়া প্রথম এবং শেষ দিন। বাড়ি ফেরার সময় তার বাবা বলেছিলেন,’পৃথিবীর কোনো সম্পর্কই সারাজীবন অটুক হয় না।’ সেদিন স্নেহা কথাটি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছিল না। ভেবেছিলো, পৃথিবীর সব সম্পর্ক বদলে গেলেও পরিবারের সম্পর্ক গুলো অটুক থেকে যায়। কিন্তু আজ কি হলো? ওই বৃদ্ধ মানুষটির কথা সত্য হিসেবে প্রমাণিত হলো। তিনি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। তাঁর কথা কি অমূলক হতে পারে?
পর্ব ৩০ আসছে