কন্ট্রাক্ট অফ ম্যারেজ পর্ব-২

0
7934

#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi

“পর্ব-২ ”

ফার্মেসি থেকে আবার ঔষধগুলো সংগ্রহ করে বাড়িতে চলে গেল মৃধা। বাড়িতে যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এলো। মৃধার মা তখন অসুস্থ ছেলের পাশে বসে মৃধার আগমনের অপেক্ষা করছে। মৃধা ঘরে প্রবেশ করতেই তার মা উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,

-কী রে মা এতো দেড়ি করলি কেন বাসায় ফিরতে? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো?

মৃধা ওর মায়ের কাছে আয়ানের বিষয়টা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। মাকে এসব বললে অযথাই টেনশনে করে প্রসার হাইপার করে ফেলবে। এটা ভেবে সে কথা আড়াল করে বলল,

-আরে নাহ মা আমার কোনই সমস্যা হয়নি।ওই আজকে টিউশন থেকে আসতে লেট হয়ে গেছে।

-ওহ তাই বল। আমার তো প্রচুর চিন্তা হচ্ছিল তোর জন্য। আচ্ছা দেখ না ছেলেটার জ্বর তো কমছেই না। কী করি বল তো?

-তুমি টেনশন কোরো না মা। এই নাও ঔষধ। ওকে খাইয়ে দেও ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠবে।

-আচ্ছা তুই তাহলে হাত-মুখ ধুয়ে আয় আমি ততক্ষণে মুগ্ধকে ঔষধ টা খাইয়ে দেই।

-আচ্ছা মা

কথা শেষ করে মৃধা চলে গেল ফ্রেশ হতে। সারাদিন কিচ্ছু খায়নি সে। কলেজ থেকে টিউশন পড়িয়ে বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাহির থেকে আলাদা কিছু কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। টিউশন বাড়িতে যদিও চা নাস্তার অফার করে কিন্তু মৃধা হাসিমুখে সেটা নাকজ করে দেয়। টাকার বিনিময়ে পড়ায় সে এর বাহিরে আবার নাস্তার আয়োজন তার কাছে অপছন্দনীয়।

মৃধা ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকে দেখে মুগ্ধ ঘুমিয়ে আছে। তার মা হয়তো তারজন্য খাবার বাড়তে গেছে। মৃধা গামছা দিয়ে হাত মুখ মুছে নিয়ে সোজা মুগ্ধর কাছে গিয়ে বসল।গলায়, কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর কমেছে কি না। ভাইটা তার বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। জ্বর না থাকলে ঠিকই প্রতিদিনের মতো আজও মৃধাকে টিউশন থেকে আনতে যেত। মৃধা এতো করে নিষেধ করে তবুও মুগ্ধ শোনে না। রোজ মৃধাকে আনতে যাওয়াটা নাকি তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। দু-ভাই বোন গল্প করতে করতেই বাড়িতে চলে আসে। মৃধার সেই মুহূর্তে মনে হয় হাজারো গাড়ি,বাইক,রিক্সায় চড়া মানবগুলোর থেকে সে হাজার গুণ বেশি সুখী। মুগ্ধ যে মৃধার থেকে বয়সে অনেক ছোট মুগ্ধর চালচলনে সেটা বোঝাই দ্বায়।সবসময় মৃধার পাশে পাশে থেকে তাকে আগলে রাখে ছায়ার মতো। অনেক পরিবারে বড় বড় ভাইয়েরাও ব্যর্থ মুগ্ধর মতো করে বোনকে ভালবাসতে, কেয়ার করতে।

-কী রে খেতে আয়। সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি। কী এতো ভাবছিস?

মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে মৃধার। সে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

-কই কিছু ভাবছি না তো। শুধু দেখছিলাম সেই ছোট্ট মুগ্ধ কতো বড় হয়ে গেছে।

-হুম তোরা দুজনেই অনেক বড় হয়ে গেছিস। আজ যদি তোদের বাবা বেঁচে থাকত তাহলে তোদের এতো কষ্ট কখনোই করতে হতো না।

মৃধার মা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কেঁদে দিলেন। মৃধা মায়ের চোখের পানি দু’হাতে মুছে নিয়ে বলল,

-এভাবে বলছ কেন মা? আমরা যেভাবে আছি খুব ভালো আছি। অনেকে হয়তো এর থেকেও খারাপ অবস্থায় আছে। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া আমাদেরকে এটুকু দয়া করসর জন্য।

মৃধার মা মৃধাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-নিশ্চয়ই অতীতে আমি কোনো পুণ্য করেছিলাম যার ফলস্বরূপ আল্লাহ আমার কোলে তোকে কন্যা হিসেবে পাঠিয়েছেন।

তারপর মৃধা খেতে শুরু করল। আলু ভর্তা আর ভাত। খুব তৃপ্তি করে খাবারটা শেষ করল মৃধা। সারাদিনের অনাহারী পেটে যা পরছে তাই-ই অমৃতের সমতুল্য। খাওয়া শেষ করে মৃধা ওর মাকে বলল,

-মা তুমি খেয়েছ?

– অ্যা হ্যাঁ খেয়েছি তো খেয়েছি

-আবার মিথ্যে বলছ মা তুমি ? আমি জানি তো তুমি খাওনি। কতবার করে তোমাকে বলেছি মা তোমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে খাবারে অনিয়ম করা একদম উচিত নয়। তবুও তুমি আমার কোনো কথাই শোনো না। তোমাকে নিয়ে আর পাড়া যাচ্ছে না।

মা কে বকতে বকতে এক প্ল্যাট ভাত আলু ভর্তা দিয়ে মাখিয়ে মায়ের মুখের সামনে লোকমা তুলে ধরল মৃধা। মৃধার মা আবারও কেঁদে দিলেন। মৃধা বিরক্ত হয়ে বলল,

-এভাবে বার বার কাঁদছ কেন মা? শরীর খারাপ করবে তো। এবার কান্নাকাটি বাদ দিয়ে হা করো তো দেখি।

মৃধা ওর মাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর উনি পরম তৃপ্তিতে মেয়ের হাত থেকে খাবার শেষ করছেন। খাওয়ানোর মাঝেই মৃধা মুখটা মলিন করে ওর মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

-আচ্ছা মা মুগ্ধ ঠিক মতো খেয়েছে তো? জ্বরের মুখে এসব ভর্তা ভাত খেতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে? আমি তোমাদের ঠিক মতো দেখাশোনা করতে পারছি না তাই না মা? তোমরা খুব কষ্ট আছো তাই না?

মৃধার প্রশ্নে সালেহা বেগম অবাক দৃষ্টিতে মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,

-এসব তুই কী বলছিস মা? আমরা সত্যিই খুব ভালো আছি।আল্লাহর রহমতে আমরা যেমন আছি আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা তোকে এসব কথা কে বলে শুনি?

-কেউ বলেনি মা আমি নিজেই বলছি। আচ্ছা ঠিক আছে মা তুমি এবার ঔষধ টা খেয়ে নাও। তারপর শুয়ে পড়ো।

মৃধা তার মাকে শুয়ে পড়তে বলে নিজে চলে গেল বারান্দায়। আকাশে প্রচন্ড মেঘ জমেছে। বিকেলে বৃষ্টি কমে রোদ উঠলেও সন্ধ্যা হতে না হতেই আবার মেঘে ঢেকে গেছে বিস্তৃত আকাশ। এই সিজন টাই এমন। কখনো মেঘ করে আসে তো কখনো বৃষ্টি হয় আবার কখনো রোদ্র ঝলমল করে। মৃধার মনটা আজ খুব খারাপ। শুধু খারাপ নয় ভীষণ ভাবে খারাপ। আকাশের ওই কালো মেঘের মতো মৃধার মনেও মেঘ জমেছে রাশি রাশি। মা, ভাইকে আর একটু ভালো জীবন উপহার দেওয়ার আশা প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।বারান্দার গ্রিল ধরে আনমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে মৃধা। মনে মনে ভাবছে এভাবে আর কতোদিন। এই ব্যয়বহুল সমাজে দিনকে দিন ব্যয় শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে যা শুধু টিউশনি করে উশুল করা সম্ভব নয়। মৃধা সিদ্ধান্ত নিল সে একটা চাকরি খুঁজবে। যদিও বর্তমান যুগে টাকা ছাড়া চাকরি পাওয়া মিথ্যে মরিচীকার সমতুল্য তবুও সে একটা চেষ্টা করে দেখতে চায়। ‘যদি আল্লাহ মুখ তুলে চান,’ সেই আশায়। মৃধার ছোট থেকেই শখ ছিল একজন বড় ফ্যাশান ডিজাইনার হবে কিন্তু বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিসর্জন দিতে হয় সেই স্বপ্ন।তবুও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত তার কপালে কী আছে?

হঠাৎ করে কারেন্ট চলে গেল। দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাহিরে। হয়তো ঝড় বৃষ্টি হবে এখন। মৃধাদের বাড়িটি টিনের কামরা বিশিষ্ট। দুটো ঘর,একটি বারান্দা,একটি রান্নাঘর আর একটি বাথরুম বিদ্যমান এই বাড়িটিতে। এই বাড়িটা দু হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছে তারা। কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হয়ে গেল ঝড় বৃষ্টি। টিনের চালে টুপটাপ শব্দে মুখরিত চারিদিক। মৃধার মা শুয়ে শুয়ে বার বার মৃধাকে ঘরে আসার জন্য বলছে কিন্তু সে তার মায়ের কথা অবগ্যা করে ওখানেই ঠায় দাড়িয়ে আছে। পরিবেশ টা তার কাছে ভীষণ ভালো লাগছে। থেকে মেঘ ডাকছে কড়া ভাবে। বিজলিও চমকাচ্ছে মাঝে মাঝেই।মৃধা চোখ বুজে উপভোগ করছে এই মুহুর্তটাকে। পরিবেশ উপলব্ধি করতে করতে একটা সময় মৃধা কী যেন মনে পড়তেই এক ঝটকায় চোখ খুলে সামনে তাকালো। মনে মনে আওড়াতে লাগল,

-ওই বাজে লোকটার কথা আমার এই অবেলায় মনে পড়ল কেন? কেন আমার চোখের বন্ধ দৃষ্টিতে তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম? তাকে দ্বিতীয় বার দেখার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই। ধুর ভাল্লাগে না লোকটা আমার মুডটাই নষ্ট করে দিল।

চোখ বুঝতেই আয়ানের মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চোখ খুলে ফেলেছিল মৃধা। আয়ানের সাথে কাটানো তিক্ত সৃতি মনে পড়তেই রাগে, বিরক্তিতে বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেল সে। ঘুমতে পারবে কী না জানে না তবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। ইদানীং এমন প্রায় হয় সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে চোখ লেগে ধরে।

…………………………

এদিকে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে আয়ান। গাড়ি পার্ক করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই কারো কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই থেমে গেল সে। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে বলে উঠল,

-দাদুভাই তুমি এখনো ঘুমোওনি?

-কী করে ঘুমোবো? তুমি কী এই বুড়ো দাদুটার কথা একটি বার চিন্তা করো কখনো। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে তুমি বাহিরে। আমার তো বিন্দু মাত্র টেনশন হয় বৈকি। এখন আছি তাই বুঝতে পারছ না যখন থাকব না তখন দুনিয়া তোলপাড় করে ফেললেও এই মানুষটিকে আর খুঁজে পাবে না।

আয়ান দৌড়ে এসে দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-এসব তুমি কী বলছো দাদু? এমন কথা আর কখনো বলবে না। তোমার কিছু হলে আমি মরেই যাবো। তুমি আর ভাইয়া ছাড়া আর কে আছে বলো আমার? খুব ভালবাসি তোমাদের।

-শুধু ভালবাসলেই চলবে আমাদের সুখ- দুঃখ, চিন্তা-ভাবনার কথাও তো তোমাকে চিন্তা করতে হবে। এখন বাড়িতে একটা মেয়ে মানুষের খুব দরকার। আমি বুড়ো হয়ে গেছি তোমরা আর আমার কথা গ্রায্য করো না। তোমাদের দু ভাইকেই বিয়ে দিয়ে নাত-বৌ ঘরে তুলব আমি। তারপর দেখি কেমন জব্দ হও তোমরা। রাত অনেক হয়েছে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও এবার।

-আমি খেয়ে এসেছি দাদু।

-তাহলে আর কী নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো

আয়ানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আফরোজ চৌধুরী হনহন করে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে তিনি ভীষণ রেগে গেছেন।

আয়ান একটা হতাশার নিশ্বাস ফেলে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে বেলকনির ডিভানে গিয়ে বসে পরল গিটার হাতে। এমন পরিবেশে গিটারে সুর তুললে মন্দ হয় না। টুংটাং আওয়াজে সুর উঠছে গিটারে। সাথে আয়ানের মৃদু স্বরে তোলা গান। বেশ জমে গেছে ব্যাপারটা। গান গাওয়ার ফলে বারংবার চোখ বুজে আসছে তার। গানের মাঝেই বিকেলের সেই মেয়েটির মুখটি ভেসে উঠল আয়ানের সামনে। সাথে সাথে সে গান বন্ধ করে চোখ খুলে দাড়িয়ে পরল। আপনমনেই চিন্তা করতে লাগল,

-ওই থার্ডক্লাশ মেয়েটির ফেস কেন আমার সামনে ভেসে আসছে বারবার। ঝগড়ুটে মেয়ে একটা। ওর ওপরে আমার অনেক প্রতিশোধ নেওয়া বাকি আছে। একবার পাই হাতের কাছে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিবো এই আয়ান কী জিনিস।

গিটারটা ঠাস করে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বেলকনি থেকে হনহনিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল আয়ান। তারপর এক লাফে বিছানায় শুয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। উদ্দেশ্য ঘুমের রাজ্য।

চলবে,

(প্রথম পর্বের রেসপন্স আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। আমি অনেক খুশি হয়েছি 😊

পাঠকদের সুবিধার্থে কিছু কথা বলে দেই –
★প্রথম কথা হলো, পর্ব ১- এর প্রথম অংশটুকু ছিল ট্রেলার। পরের অংশ থেকে কাহিনী শুরু।

★দ্বিতীয় কথা হলো, একজন পাঠক প্রশ্ন করেছিল বৃষ্টির দিন হলে গাড়ির ধুলো কীভাবে উড়ল?
উত্তরঃ বৃষ্টি হয়েছিল সকালে বিকেলে বৃষ্টি কমে এসে শেষবেলায় কিছুটা রোদের আবির্ভাব হয়েছিল। আর জনবহুল রাস্তায় লোকজনের কোলাহলে এমনিতেই রাস্তা গরম থাকে। সেক্ষেত্রে ধুলো উড়তেই পারে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here