কন্ট্রাক্ট অফ ম্যারেজ পর্ব-১

0
11293

ঠাস করে দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠল মৃধা। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চোখাচোখি হলো চারটি চোখ। তৎক্ষণাত আয়ানের রক্তিম ভয়ংকর দৃষ্টির স্বীকার হতে হলো মৃধাকে।মৃধা একটা ফাঁকা ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে ফেলল।ওই চোখে বেশিক্ষণ দৃষ্টি অব্যাহত রাখার দুঃসাহস তার নেই। মৃধা মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে আছে।দু’হাতে শাড়ি খামচে ধরে বসে আছে । আয়ান চৌধুরীর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে বিয়ে করাটা খুব একটা সুবিধাজনক ব্যাপার নয়। দাদুর কথায় বিয়েটা তো করে নিল কিন্তু এখন তার কী হবে। বাসর রাতে স্বামীর সোহাগের বদলে শাস্তি অপেক্ষা করছে না তো তারজন্য? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে মৃধার।আয়ান দরজা থেকে সরে ধীরে ধীরে মৃধার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আয়ান যত এগোচ্ছে মৃধার ভয় তত বাড়ছে।বর্তমানে আয়ান মৃধার একদম সামনে দাড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে রক্তিম আভা বিদ্যমান। মৃধা কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। শুধু এদিক ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছে। হঠাৎ গায়ে কিছুর স্পর্শ পেয়ে মৃধা নিজের কাঁধে,মাথায় দৃষ্টি দিল। দেখলো কিছু কাগজ উড়ে পড়ছে তার গায়ের ওপর। মৃধা আয়ানের দিকে প্রশ্নত্বক দৃষ্টি স্থাপন করে বলল,

-এগুলো কীসের পেপারস?

আয়ান একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,

-কন্ট্রাক্ট পেপারস

…………….

এই গল্পের শুরুটা হয়েছিল আরও সাত মাস আগে থেকে। এক বর্ষাবিকেলে ভেঁজা স্যাঁতস্যাতে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল মৃধা। হাতে ছিল তার ছোট ভাই মুগ্ধর জন্য কেনা কিছু ঔষধ। ভাইটার গাঁয়ে বড্ড জ্বর। টিউশন পড়িয়ে মাসিক বেতন হাতে পেয়েই সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে ঔষধ কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছে সে। বৃষ্টির বেগ বৃদ্ধির জন্য দৌড়ে দৌড়ে রাস্তা চলতে হচ্ছিল তাকে।রিকশা ভাড়া নিয়ে যাওয়ার মতো বিলাসবহুল জীবন তাদের নয়। এই একজোড়া পা ই তার নিত্যদিনের চলার পথের সঙ্গী।

বৃষ্টির মধ্যে ছুটতে ছুটতে প্রায় অনেকটাই ভিজে গেছে মৃধার শরীর। গাঁয়ের দিকে নজর দিতে গিয়ে একটু অন্যমনষ্ক হওয়ায় কোথাথেকে একটা বড় গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়ে দেয় তাকে। মৃধা ছিটকে গিয়ে পরে রাস্তার অপরপ্রান্তে। মাথায় আর পায়ে প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয় সে।কিন্তু এই এক্সিডেন্টে শরীরের ব্যথার চেয়ে আরও বড় ব্যথা পেয়েছে সে তার মনে। কারণ তার ভাইয়ের জন্য কেনা ঔষধগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। মৃধা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ঔষধ গুলো বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। সেই মুহূর্তে পেছন থেকে কেউ একজন রুষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,, এই যে মিস. দেখে চলতে পারেন না। রাস্তার মাঝখান দিয়ে কেন চলছিলেন? মরার শখ হয়েছিল বুঝি? এখন আবার বসে বসে ন্যাকা কান্না করে লোকের সিমপ্যাথি আদায়ের ট্রাই করছেন তাই না?

লোকটার তেঁতোবাক্যগুলি মৃধার কানে বিষের মতো গিয়ে পড়ল।মৃধা হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে পেছন ফিরে উঠে দাড়াল।তারপর চোখ তুলে সামনে দাড়ানো পুরুষ অবয়বটিকে পর্যবেক্ষণ করল। এ তো অল্পবয়সী এক সুদর্শন যুবক। গেট আপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই গাড়ির মালিক সে। চেহারা যতটা সুন্দর ঠিক ততটাই জঘন্য তার ব্যবহার। একটা মেয়ের সঙ্গে কেউ এমন করে কথা বলে নাকি? মৃধা মনে মনে ভাবছে, এই লোকের জন্মের সময় নিশ্চয়ই তার মুখে কেউ মধুর বদলে নিমপাতা ঘসে দিয়েছিল তাই তো তার ব্যবহার এমন নিমের মতো তেঁতো।

মৃধার এমন ভাবুক চাহনি দেখে আয়ান বিরক্তি নিয়ে বলল,,এই যে মিস এভাবে আর কতক্ষণ চলবে ? এমনভাবে দেখছেন মনে হচ্ছে আমাকে খেয়েই ফেলবেন। আচ্ছা আপনার কী খুব লেগেছে নয়তো এভাবে কাঁদছিলেন কেন?

মৃধা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,, নাহ আমার তেমন কিছুই হয়নি কিন্তু আমার এই ঔষধগুলো অনেক দরকারি ছিল।

আয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,, ওহ গড সামান্য কিছু ঔষধের জন্য এভাবে কাঁদছিলেন লাইক সিরিয়াসলি? আমি তো ভাবলাম…… ওকে বাই দি ওয়ে, এখন নিশ্চয়ই ক্ষতিপূরণ চাইবেন আপনার ঔষধ নষ্ট করার জন্য। দেখুন দোষটা কিন্তু আপনারই ছিল। আপনি নিজেই রাস্তার মাঝে চলে এসেছিলেন। এই আপনাদের মতো কিছু মানুষের জন্য কার ড্রাইভারদের বিপদে পরতে হয়। আপনারা দোষ করেন আর সাধারণ মানুষ ধরে গিয়ে ড্রাইভারকে।যত্তোসব(নাক ছিটকে)

মৃধা আয়ানের কথায় চরম অবাক হলো। একটা অচেনা, অজানা মেয়েকে কীসব বলে যাচ্ছে এই ছেলে।কতটুকু চেনে সে মৃধাকে? মৃধার মাথায় এবার রাগ চড়ে বসল। তার সততা নিয়ে কেউ কোনো কথা বললে তার খুব রাগ হয়ে যায়। মৃধা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,, হেই মি. আপনি কতটুকু চেনেন আমাকে যে এতসব বাজে বাজে কমেন্ট করছেন আমার নামে। কারো সম্পর্কে না জেনে কিছু বলাটা ঠিক নয়। আমরা গরীব হতে পারি কিন্তু আত্নসম্মান আছে প্রবল। আপনাদের মতো বড় লোকদের টাকার ভরসায় আমরা বসে নেই। আমরা গরীব। পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করি। সেই স্বল্প অর্থের মধ্য দিয়ে খুব হিসাব করে দিনাতিপাত করি। তাই তো একটু অর্থ অপচয় হলে এতটা কষ্ট হয়। আপনাদের মতো বড় লোকদের আমাদের মতো গরীবদের দুঃখ বোঝার ক্ষমতা নেই। আপনারা পারেন শুধু আমাদেরকে ছোট করে দেখতে, অপমান করতে। আপনাদের মতো বড় লোকদের আমি ঘৃণা করি, প্রচন্ড ঘৃণা করি, খুব বেশিই ঘৃণা করি। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগল মৃধা। চোখেমুখে এখনো তার ক্রোধ স্পষ্ট।

একটু আগে যেই মেয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিল এক মুহুর্তের মধ্যে তার এমন অগ্নিশর্মা রুপ দেখে আয়ান বেশ আশ্চর্য হলো।পরক্ষণেই আবার মৃধার বলা কথাগুলো স্মরণে আসতেই রাগের ফিনকি মাথায় উঠে গেল। একটা মিডেল ক্লাস রাস্তার মেয়ে হয়ে কীনা আয়ান চৌধুরীকে ঝাঁঝ দেখাচ্ছে। আয়ান চোয়াল শক্ত করে মৃধার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিবে ঠিক তখনই আশপাশ দিয়ে পাবলিক তাকে ঘিরে ধরে। পাবলিক প্লেসে এমন এক্সিডেন্ট তারওপর আবার বাজে মন্তব্য সবমিলিয়ে দোষের তীর আয়ানের ঘাঁড়ে। জনগণ তো সেই চটে আছে আয়ানের ওপর। পারলে গাঁয়ে হাতও তুলে দেয়। কেউ কেউ আবার বলছে পুলিশে খবর দিতে। আয়ান বেশ ঝামেলায় পড়ে গেছে। এসব পাবলিক তেমন একটা সুবিধার হয় না। একটা ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারাত্মক আকার ধারণ করানোই এদের কাজ। আয়ান না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে সে।

এদিকে পাবলিকের এমন হঠাৎ আক্রমণে স্তব্ধ মৃধা। এই এক্সিডেন্টে দোষটা যে মৃধারই তা সে খুব ভালো করেই জানে। আয়ানের দুর ব্যবহারের জন্য তাকে বেশি কথা শোনালেও পাবলিকের কাছে হেনস্তা করতে চায় না। অবস্থা বেগতিক দেখে মৃধা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,, প্লিজ প্লিজ প্লিজ সবাই এখান থেকে চলে যান। এটা আমাদের পারসোনাল ম্যাটার আমরাই সামলে নেব। আপনারা দয়া করে চলে যান।

মৃধার কথায় পাবলিক আরও চটে গেল এবার। পারসোনাল ম্যাটার বাহিরে আনার মানে কী? ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে মেটালেই তো হয়? পাবলিককে হেনস্তা করার কী আছে? এমনও অনেক মন্তব্য করতে করতে স্থান ফাঁকা করে সবাই চলে যেতে লাগল। পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হতেই আয়ান দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসল।আজ বড্ড দেড়ি হয়ে গেল দাদু ভীষণ বকবে তাকে।যাওয়ার আগে গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে এক আঙুল উচিয়ে মৃধাকে ওয়ার্নিং দিয়ে গেল, “আর কখনো হাতের কাছে পেলে এর শোধ আমি নিয়েই ছাড়ব নয়তো আমার নাম আয়ান চৌধুরী নয়”।এতটুকু বলে মৃধার পাশ ঘেঁষে সাঁই সাঁই করে গাড়ি টান দিয়ে চলে গেল আয়ান। গাড়ির বাতাসে রাস্তার ধুলো উড়ে এসে পরল মৃধার চোখে মুখে। মৃধা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিল।চোখ খুলতেই দেখল আয়ানের গাড়িটি দুরে মিলিয়ে গেছে। মৃধা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটা ধরল ঔষধ ফার্মেসির উদ্দেশ্যে। সঞ্চিত টাকা থেকে টাকা নিয়ে আবার ঔষধ কিনতে হবে। এ মাসে বড্ড টান পড়ে যাবে সংসার চালাতে। অনেকটা টাকা বেড়িয়ে গেল যে।

———————

এ গল্পের নাইকা মৃধার পুরো নাম মৃধা মেহরিন। মা আর ছোট ভাই মুগ্ধকে নিয়ে টানাটানির সংসার তার। বাবা মারা গেছে মৃধা যখন ক্লাস এসএসসি এক্সাম দিয়েছে তার পরপরই। তখন থেকেই মৃধার জীবনে কষ্টের দিন শুরু। ভাই মুগ্ধ তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। মা আর ভাইয়ের জীবন চালাতে মৃধা নিজেই তখন সংসারের হাল ধরে নেয়। সারাদিন টিউশন পরিয়ে নিজের পড়ার খরচ, ভাইয়ের পড়ার খরচ আর সংসার চালানোর যাবতীয় অর্থ সে ই উপার্জন করে। মৃধার মা আড়ালে মেয়ের কষ্ট দেখে চোখের পানি ফেলেন। এক পা অকেজো হওয়ায় ইচ্ছে থাকা সত্বেও কোনো বাহিরের কাজ সে করতে অক্ষম। সেই থেকে আজ আট বছর হতে চলছে মৃধার জীবন সংগ্রাম। বর্তমানে মৃধা অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট । অত্যন্ত দায়িত্বশীল, ভদ্র, সৌজন্যমূলক চরিত্রের অধিকারিণী সে।

এদিকে নামকরা ফ্যাশান ডিজাইনার আদ্র চৌধুরীর একমাত্র ছোট ভাই আয়ান চৌধুরী। ছোট ভাই আয়ান আর বৃদ্ধ দাদুকে নিয়ে স্বচ্ছল প্রাণবন্ত ফ্যামিলি আদ্র-র। আয়ান যেন তার চোখের মনি। দুইভাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের এত বড় বিজনেসের দেখা-শোনা করে। আগে এসবকিছুই তাদের দাদু সামলাতো কিন্তু দাদুর বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর এত ধকল সহ্য করতে পারেন না। এজন্য দুই নাতির ওপরে দায়িত্ব দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে দিনাতিপাত করছেন।
আয়ান-টা একটু বেশিই রগচটা স্বভাবের।খুব অল্পতেই রেগে যায়। তবে ভাইকে কন্ট্রোলে আনতে আদ্র-র জুড়ি মেলা ভার। সবসময় আয়ানের সকল রাগ,অভিযোগ আদ্র-র কাছেই সমাপ্ত হয়। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের সম্পর্ক তাদের।

চলবে,

#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ(রোম্যান্টিক লাভ)
Sadia afrin nishi
“পর্ব_১”

(নতুন গল্প নিয়ে চলে এলাম। মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। রেসপন্স ভালো হলে নিয়মিত গল্প দিবো।এই গল্পটা অনেকটা রোম্যান্টিক ধারার যা আমার অন্য গল্প থেকে ভিন্ন।সবাই আমাকে একটু অনুপ্রেরণা দেও রোম্যান্টিক গল্প লিখতে ভীষণ লজ্জা করে 🙈🙈)

হ্যাপি রিডিং….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here