কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ পর্ব-১৯

0
5313

#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi

“পর্ব-১৯”

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল মৃধা।এতো লেট তার কখনো হয় না। কেউ তাকে একটি বার ডাক পর্যন্ত দিল না। আজ আর তার মা সেই ছোট্ট টিনের ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে দেননি। আজ কোনো স্নিগ্ধ আলো মৃধাকে আলিঙ্গন করতে পারে নি। কোথায় সেই টিনের ঘর? মৃধা যে ভীষণ মিস করছে তার আগের জীবনটাকে। এমন বিলাসবহুল জীবন তার একদমই পছন্দ নয়। অফিসেরও লেট হয়ে যাচ্ছে। ঘরের চারদিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল মৃধা। নাহ, কোথাও আয়ান নেই। তারমানে মৃধা এখন নিশ্চিন্ত উঠে ওয়াশরুমে যেতে পারে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ল মৃধা। তারপর চলে গেল ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে।

ফ্রেশ হয়ে একটা কালো রঙের থ্রি-পিস পড়ে নিল মৃধা। তারপর সোজা চলে গেল নিচে। নিচে নেমে দেখল সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছে হয়তো তারজন্যই অপেক্ষা করছে। মৃধাকে দেখে আফরোজ চৌধুরী একগাল হেসে বললেন,

–” এসো এসো দিদিভাই তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই।”

মৃধা অপরাধীর ন্যায় জবাব দিল,

–” সরি, আমার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হলো। আসলে জায়গা পরিবর্তনে এমনটা হয়েছে। নয়তো আমি ভোরেই উঠে যেতাম ”

আফরোজ চৌধুরী বললেন,

–‘ ইট’স ওকে দিদিভাই। কোনো সমস্যা নেই। তোমার যখন ইচ্ছে তুমি তখনই উঠবে।’

মৃধা আফরোজ চৌধুরীর কথায় সায় দিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল। তারপর মুগ্ধর পাশের চেয়ারটায় বসে পরল। মৃধা খেয়াল করল মুগ্ধ মিটমিটিয়ে হাসছে। মৃধা সন্দিহান চোখে মুগ্ধকে বলল,

–” কী রে এভাবে হাসছিস কেন?”

মুগ্ধ ততক্ষণাৎ চুপ হয়ে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, কই হাসছি নাতো।

মৃধা রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

–‘ বলবি নাকি মার খাবি।’

মুগ্ধ আমতা আমতা করতে করতে বলল,

–‘ আয়ান ভাইয়া তো তোমাকে চোখে হারাচ্ছে দেখছি। সেই থেকে দেখছি খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে তোমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।’

কথাটা বলেই মুগ্ধ জোরপূর্বক হেসে ফেলল। মৃধা রাগি দৃষ্টিতে মুগ্ধকে ইশারাতে চোখ রাঙাল।
মৃধার চোখের ইশারায় মুগ্ধ চুপ করে খেতে শুরু করল। মুগ্ধকে খাওয়ায় ব্যস্ত দেখে মৃধা দৃষ্টি দিল এবার আয়ানের দিকে। আয়ান এতক্ষণ মৃধার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মৃধা তাকাতেই আয়ান চটজলদি তার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে খাবারে মনযোগ দিল। মৃধা লক্ষ্য করল ব্যাপারটি কিন্তু কিছু বলল না। সে খুব ভালো করেই জানে আয়ানের সঙ্গে কথায় পারবে না। আর আপাতত তার আয়ানের সঙ্গে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই।অগত্যা মৃধাও খেতে আরম্ভ করল।

এদিকে আয়ান ভেতর ভেতর ভীষণ অস্থির লাগছে। মৃধার সেই উন্মুক্ত শরীরের অংশবিশেষ তার কল্পনায় এখনো দৃশ্যমান। ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছে না সে। আর এখন এই কালো ড্রেসে মৃধাকে কোনো স্নিগ্ধ অপ্সরীর সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করছে তার। ভালবাসার মানুষকে এতো কাছে পেয়েও তার থেকে দুরে থাকার কষ্ট টা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আয়ান। খাবারও যেন আজ গলা দিয়ে নামতে চাইছে না তার। তবুও অল্প অল্প করে মুখে তুলছে।

নিরবতা বিরাজ করছে খাবার টেবিলে। সবাই যে যার মতো খাবার খেতে ব্যস্ত। হঠাৎ আয়েশা চৌধুরী মৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

–‘ কী রে তুই মনে হচ্ছে কোথাও বের হবি?একেবারে তৈরি হয়ে নেমেছিস?’

মৃধার সাবলীল উত্তর,
–‘ হুম, অফিসে যেতে হবে না। ‘

মৃধার কথায় উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। মৃধা এখনো চাকরি করবে তাও আবার নিজেদের অফিসে এটা কেউ মানতেই পারছে না। চমকিত্য কাটিয়ে আদ্র বলল,

–‘ এসব তুই কী বলছিস বোন। নিজেদের অফিসে ওই সামান্য কর্মচারীর চাকরি কেউ করে?’

আদ্রের কথায় আফরোজ চৌধুরী সায় জানিয়ে বললেন,

— ‘ দাদুভাই ঠিকই বলেছে দিদিভাই। তোমার এখন ওই চাকরি করা টা মানায় না। তুমি বরং বাড়িতেই থাকো।’

এবার আয়েশা চৌধুরীও মুখ খুললেন,
–‘ হ্যাঁ মা, তুই তো জীবনে অনেক পরিশ্রম করেছিস এবার অন্তত এসব চাকরি- বাকরি ছেড়ে সংসারে মন দে।’

মৃধা সবার কথার প্রতিবাদে বলল,

–‘ নাহ এটা হয় না। আমি নিজের দ্বায়িত্ব নিজে নিতে জানি। কেউ আমাকে দয়া করবে এটা আমার সহ্য হবে না। তার থেকে বরং আমি চাকরি টা চালিয়ে যাই। ‘

আয়েশা চৌধুরী অবাকের সহিত বললেন,

–‘ কে তোকে দয়া করবে মৃধা? এটা তোর বাড়ি। এখানে সবাই তোর আপন। তাহলে কে তোকে দয়া করছে? ‘

মৃধা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আয়ানের বিষয়টা সে এই মুহুর্তে সবাইকে জানাতে চায় না। ওসব কথা জানলে সবাই খুব কষ্ট পাবে। মৃধাকে থেমে যেতে দেখে আফরোজ চৌধুরী বললেন,

–‘ বেশ তবে তাই হবে। চাকরি টা তুমি করবে তবে সেটা ওই সামান্য কর্মচারীর পোস্টে নয়। এখন থেকে তুমি আয়ানের পি.এ. এর পোস্টে কাজ করবে। আশা করি এতে আর তোমার কোনো আপত্তি থাকবে না?’

মৃধা এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল। আয়ানের পি.এ ? এটা একদম অসম্ভব ব্যাপার তার জন্য। মৃধা উত্তেজনায় গলা দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। মৃধার উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে আয়ান এবার মুখ খুলল। সে আফরোজ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলল,

–‘ একদম না দাদুভাই। আমার পি.এ তো ন্যায়রা
ওকে বাদ দিয়ে মৃধাকে ওই পোস্টে দেওয়াটা আমার জন্য ভেরি টাফ। হ্যাঁ জানি ন্যায়রা একটু মিসবিহেভ করেছে তারজন্য সে গতকাল আমার থেকে সরি ও বলে নিয়েছে। এখন এই মুহুর্তে ওর পোস্ট চেঞ্জ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ন্যায়রা সেই কলেজ লাইফ থেকে আমার প্রতিটি পদক্ষেপে আমার সঙ্গে রয়েছে। ওর এই জবটা করার একমাত্র কারণ হলো আমি। সেখানে ওকে এভাবে অবজ্ঞা করাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

আয়ানের কথা শুনে মৃধার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। আফরোজ চৌধুরী আয়ানকে কিছু বলার আগেই সে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়াল। তারপর রেগেমেগে আয়ানের চোখে চোখ রেখে বলল,

–‘ এতই যখন দরদ তখন ওকে বিয়েটা করে নিলেই তো পারতেন। তাহলে শুধু বাহিরে না ঘরেও আপনার সঙ্গে আইকার মতো লেগে থাকতে পারত।’

এতটুকু বলে মৃধা কপট রাগ দেখিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। তারপর দরজা দিয়ে বেরনোর সময় আফরোজ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলল,

–‘ নানাভাই আমার কোনো পোস্ট পরিবর্তনের দরকার নেই। ওসব স্পেশাল পোস্ট স্পেশাল মানুষদের জন্যই থাক।’

অগত্যা মৃধা চলে গেল অফিসে। পেছন থেকে আদ্র অনেক বার ডাকল তার সঙ্গে যাবার জন্য কিন্তু মৃধা শুনল না। হনহনিয়ে চলে গেল। মৃধা যেতেই আফরোজ চৌধুরী আয়ানের ওপর কিছুটা রাগ নিয়ে বললেন,

–‘ কাজটা হয়তো ঠিক করলে না দাদুভাই। পরে আবার তোমাকেই পস্তাতে না হয়।’

তারপর তিনিও উঠে চলে গেল ওপরে মন খারাপ করে। একে একে সবাই নিজেদের কাজে চলে গেল। শুধু বাকি আছে আয়ান। সবাই চলে যেতে সে মৃদু হেসে নিন্মস্বরে বলল,

–‘ বাব্বাহহহ এতো তেজ। হুম তুমি আবার জেলাস নও তো মিসেস আয়ান চৌধুরী?’

আয়ানের ঠোঁটের কোণে দেখা মিলল সুক্ষ্ম হাসির রেখা। হয়তো তৃপ্তির হাসি।

————————–

অফিসে ঢুকতেই নয়নের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মৃধার। তার প্রচন্ড রাগ হলো।এমনিতেই মন ভালো নেই তারওপর আবার এইটা সামনে পরছে। এবার নিশ্চিত ইতিহাস শুরু করে দিবে? কিন্তু মৃধাকে অবাক করে দিয়ে নয়ন একগাল হেসে মৃধার উদ্দেশ্য বলল,

–‘ আ’ম এক্সট্রিমলি সরি মৃধা। আমার কাল এভাবে বলাটা উচিত হয়নি। আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। বাই দি ওয়ে, তোমাদের আগামী দিনগুলোর জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা।’

মৃধার রাগ নিমেষেই অবাকে পরিণত হলো। একটা মানুষ কীভাবে এত তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে? এই কালই তো কেমন পাগলের মতো আচরণ করছিল আর আজ কীভাবে ঠিক আছে? কীছুই ঢুকল না মৃধার মস্তিষ্কে। সে নয়নের কথায় বোকার মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নয়নও মৃধার জবাব পাওয়া মাত্র নিজের কাজে চলে গেল।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here