কল্পনার_কলমদানি ৩
#চন্দ্রা
গল্প: রঙ মিশেলে সেই দশমীর বিকেল—০৩
আরেহ্! আমার হাতে লাগছে তো!…..এই কুশল!
আমি ব্যাথাতুর গলায় বললেও কুশলের কোনো ভাবান্তর হল না। ও সেই রাক্ষসের মতোই আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। এদিকে হাতের চুড়িতে লাগছে আমার। এবার তো মনে হচ্ছে কেঁদেই ফেলব।
কুশল আমাকে দাঁড় করালো একদম মন্ডপের পেছনের দিকে। ঠিক দাঁড় করালো না একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলল। আমি নিজের হাতটা দেখেই কেঁদে ফেললাম। কি ভাবে লাল হয়ে গেছে! শুধু কেটে যায় নি। পুরো দাগ বসে গেছে। কুশল কিছু বলতে গিয়েও আমার অবস্থা দেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল।
– সরি ….প্লিজ সরি।
ওর নরম আওয়াজে আমার কান্নার রেশ যেন বেড়ে গেল।
– ঠিক আছে । ঠিক আছে। আর কাঁদে না!
আমি কাঁদতে কাঁদতেই ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
– দেখো কি করেছ?!…..আমার লাগে না তাই না?!
ওর দিকে হাতটা এগিয়ে দিলাম। ওর মুখটা সত্যিই চুপসে গেছে। আর এ দিকে আমার শয়তানি বুদ্ধি! আমার কান্না দেখে বেচারা কিছু বলতেই পারছে না। তাই এখন একদম কান্না থামানো যাবে না। কিন্তু আমার অসভ্য চোখের জল গুলোও পড়ছে না। কি বিরক্তিকর?!
কুশল কিছুক্ষণ দেখে বলল, হয়েছে! আর কাঁদতে হবে না। এমন করছে যেন হাতটা কেটে ফেলেছি?!
কুশল অন্যদিকে ফিরে গেল। আমি মুখ ভেংচি দিয়ে চোখ মুখ মুছে ফেললাম।
– শোনো না!
আমি কথা টা বলার সাথে সাথেই কুশল এবার ঠিক একটু আগের রাগী লুকে আমার দিকে তাকালো। আমিও একটু ভয় পেলাম। কুশল দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
– এই মেয়ে ইয়ার্কি চলছে? কি চাই?
– তোমাকে!
আমি ঝপ করে উত্তর দিতেই কুশল চোখ বুঁজে রাগ কনট্রোল করার চেষ্টা করছে।
– শুধু তোমাকেই চাই। দিয়ে দাও, আর ঝামেলা করব না।
– আমার সম্বন্ধে কিছু জানো? কোথাকার কে না কে?
– হ্যাঁ তোমার সম্বন্ধে কালকেই সব খোঁজ খবর করে ফেলেছি। আমি গড়গড় করে কালকের সব কথা গুলো ওকে বলে ফেললাম।
কুশল ঠিক কি পরিমাণ বিরক্ত হল ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমি তো নাছোড়।
– দেখো। তোমাকে আমি চিনি না….
– তো চিনে ফেলো। আমি মিথিলা। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আমার বাড়ি…..
আমি শেষ করার আগেই কুশল ধমকে উঠল।
– বাঁচাল মেয়ে কোথাকার….?! চুপ একদম!
তবুও আমার যেন হেলদোল নেই। ওর বাকি গুলো বেশ ভালোই লাগছে। আমি মিটিমিটি হাসতেই ও বলে উঠল,
– তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও। আজকেই তোমার বাবা মায়ের কাছে তাদের মেয়ের সব কীর্তি বলে আসব।
আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আর ও নিজের মত বকবক করেই যাচ্ছে। আমি হঠাৎ করেই বললাম, খিদে পেয়েছে। আগে খেয়ে নিই। তারপর যত ইচ্ছে বকাবকি করো।
কুশল চুপ করে গেল। সাথে সাথেই আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এল। আমি ঠায় ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
– শুনে রাখো। এখান থেকে সোজা বাড়িতে যাবে। …..আর ভুলেও আমাকে বিরক্ত করবে না।
কথাটা শেষ করেই কুশল গটগট করে হাঁটা ধরল। কিন্তু আমি কি দাঁড়িয়ে থাকব?! নাহ্, আজ চেষ্টা যখন করতেই এসেছি তখন তো চেষ্টা করবই। আমিও কুশল কে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। কি জোরে হাঁটে রে বাবা! আমি ওর সাথে হাঁটা তো দূর ওকে দেখে দেখে হাঁটতেই হিমসিম খাচ্ছি। আমাকে প্রায় দৌড়াতে হচ্ছে। কুশল সোজা ওর বাড়িতে ঢুকে পড়ল। এবার আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। কি করব এবার?! হঠাৎ ওর বাড়িতে চলে যাব?!…..এতদূর যখন এগিয়েই গেছি তখন যা হয় হবে। কথা মনে করেই শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করেই ওর বাড়ির দরজায় দাঁড়ালাম। কলিং বেল বাজাতেই কয়েক মিনিট পর এক মাঝ বয়সী মহিলা দরজা খুলে দিলেন। আমি মিষ্টি হেসে বললাম, কুশল আছে…..?!
উনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ আছে। কিন্তু তোমাকে তো ঠিক…
– আমি কুশলের বন্ধু।
উনি আমার দিকে ভালো করে দেখে বললেন, ওহ! এসো এসো।
আমিও হাসি মুখে ভিতরে গেলাম। বাড়িটা খুব একটা বড় নয়। একতলা ছোট্ট একটা বাড়ি। ছোটো একটা বারান্দা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে কুশলের রয়্যাল এনফিল্ড। বারান্দা পেরিয়ে একটা ড্রয়িং রুম। আর এই ড্রয়িং রুম সংলগ্ন আরো দুটো রুম, সাথে একটা কিচেন ও চোখে পড়ছে। আমি চারিদিকে বেশ ভালো করেই দেখে নিচ্ছি। তিন বিধাতার কারসাজিতে যদি এটাই আমার ভবিষ্যত ঠিকানা হয়। তাই একটু যাচাই করা আর কি!
– বাবান! দেখ কে এসেছে…..?!
কুশলের মায়ের কথায় আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সামনের রুম থেকেই বেরিয়ে আসছে কুশল। আমাকে দেখেই থেমে গেল। নিমেষেই ওর চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। কিন্তু আমি মুচকি হাসলাম।
– কি’রে তুই তো বলিস নি যে তোর বন্ধু আসবে?! আর মেয়েটা একা একা এল!
কুশলের রাগের চোটে কিছুই বলতে পারছে না। কিন্তু আমার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। আমি প্রাণপন চেষ্টা করছি হাসি আটকে রাখার।
– হ্যাঁ রে , তোদের বাড়ি কোথায় ?! পাশেই কোথাও? একা একা চলে এলি।
আমি ও ওনার প্রশ্নে হেসেই উত্তর দিলাম। কুশলের মা বেশ মিশুকে। আমিও বেশ ভালোই ওনার সাথে কথা বলছি। কুশল গম্ভীর হয়ে ড্রয়িং রুমের এককোনে রাখা ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। আমি আর কুশলের মা হেসে হেসেই গল্প করছি। আর কুশল ডাইনিং টেবিলের উপরে ক্রমশ আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে চলেছে। ও যে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ও ওর মায়ের সামনে কিছুই বলতে পারছে না। আর আমি পুরো বিষয়টা উপভোগ করে যাচ্ছি।
– মা! ও মা!…..খেতে কি দেবে?!
কুশলের চিৎকার করে উঠল। আমি আর কুশলের মা দুজনেই চমকে উঠলাম।
– হ্যাঁ হ্যাঁ….আসছি।
– দেখেছিস মিথিলা….এই ছেলে মানেই শুধু হুকুম করবে। একটা মেয়ে থাকলে আমার কষ্ট বুঝতে পারত। আর ছেলেটাকে বলি বিয়ে কর। নাহ্, সে আমার কথা শুনবে কেন?!….তবে এবার মনে হয় ভগবান আমার কষ্ট বুঝতে পেরেছে।
কথা গুলো বলতে বলতেই উনি রান্না ঘরে উঠে গেল। আমিও শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে ওনার পিছু পিছু উঠলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই কুশল উঠে এসে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, তোমার সাহস দেখে অবাক লাগছে। এখুনি এখান থেকে বেরোও!…..আমি তখনই…..
কুশলের শেষ করার আগেই একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ ভেসে এল, কি হচ্ছে এখানে?!
কুশলের চট করে আমার হাত ছেড়ে দিল। আমরা দুজনেই দরজার দিকে তাকালাম। সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে একজন মাঝবয়সী বয়সী লোক।
– কুশল ! এসব কি?!
উনি গম্ভীর গলায় বলতে বলতেই এগিয়ে এলেন।
– আসলে…বাবা….
কুশলের মুখে বাবা শুনেই বুঝে গেলাম এই হলেন আমার হবু শশুর মশাই। তাই নিজে থেকেই মৃদু গলায় বললাম, নমস্কার, আমি কুশলের বন্ধু।
উনি কেমন যেন থমকে গেলেন। আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বললেন, তোমার নাম কি মা?!
– মিথিলা।
আমিও হেসে উত্তর দিলাম। উনি এবার বেস হাসি হাসি মুখে আমার সাথে কথা বলছেন। আর আমিও হাসি মুখেই উত্তর দিচ্ছি। আর কুশল গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই আমার হবু শাশুড়ি মা, মানে কুশলের মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কুশলের বাবা আমাকেও নিয়ে বসালেন ডাইনিং টেবিলে। আমরা তিনজনেই বেশ ভালোই গল্পে মত্ত। কিন্তু কুশল বিরক্তিকর মুখে চুপচাপ বসে আছে। ওর রাগ যে সীমা ছাড়িয়ে গেছে তা বেশ ভালোই আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু এবার তো তুমি ফেঁসে গেছ বাচ্চু! শশুর মশাই আর শাশুড়ি মা তো আমার দলেই আছে। আমি মনে মনেই হেসে যাচ্ছি। আর শাশুড়ি মায়ের হাতের লুচি আলুর দম সাবাড় করছি। ইশ! ভেবেছিলাম বিয়ের আগে মায়ের হাতের টেস্টি খাবার গুলো খেয়ে ফেলি। বিয়ের পর যদি শাশুড়ি না খেতে দেয়….?! কিন্তু এত টেস্টি রান্না হলে বিয়ের পরেও আমার পঞ্চান্ন কেজি ওজনের স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে। নিজেকেই নিজে বললাম, মিথিলা রে, তোর আর জিরো ফিগার হল না। যাক্, তবে শশুর শাশুড়ি আমার একদম মনের মত হয়েছে। এখন এই গাম্বাট বর টা একটু রোমান্টিক হলেই লাইফ সেট!
– মা আমার হয়ে গেছে।
কুশলের উঠে পড়ল।
– শোন। তুই এখন বেরোবি তো?!
– হ্যাঁ। বন্ধুদের সাথেই যাব।
– আরেহ্, সারা বছর ওই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াস। আজকে মিথি কে নিয়ে বেরো। মেয়েটা এতদূর থেকে এসেছে!….আর দুপুরের আগেই ফিরবি। ও এখানেই দুপুরে খেয়ে তারপর বাড়িতে ফিরবে।
কুশল বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই ওর বাবা ধমকে উঠলেন, এভাবে তাকাচ্ছ কেন?! সারা বছর ওই বাঁদর সেনা নিয়েই তো থাকো। আজ পুজোর দিনে মেয়েটা কি বাড়িতে বসে থাকবে?!
কুশলের কিছু বলছে না। আমি শান্ত ভাবে নিজের প্লেটে লুচি শেষ করছি।
খাওয়া শেষে কুশলের বাইকে করেই বেরোলাম। কুশলের মা বারবার করে বলে দিয়েছে দুপুরের আগেই যেন ফিরে আসি। কুশলদের বাড়ি থেকে বেরোতেই আমি ইচ্ছে করেই একহাতে কুশলের কোমড় জড়িয়ে ধরলাম।
– হাতটা সরাও….!
কুশলের ধমকে উঠলেই হল নাকি….?! আমি শুনলে তো! হুহ! আজকে ক্ষয়েরি লাল পাঞ্জাবিতে বেশ লাগছে কুশল কে । অনেক আগেই খেয়াল করেছি। বেশ কিউট ছেলেটা! ইশ! এত কথা আমি কবের থেকে বলতে শুরু করলাম?! কে জানে? আমি হুট করেই কারোর সাথে কথা বলতে পারি না। সেই আমি হঠাৎ করেই কুশলের বাবা মায়ের সাথে কত কথা বলে এলাম। এমনকি এত সাহস আমার কবে থেকে হল?! এত কিছু একা একাই করে যাচ্ছি! উফ! নিজেকেই নিজে বাহবা দিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ বাইকটা থেমে গেল। আর আমি সামনে তাকিয়ে থমকে গেলাম। স্টেশন! অস্ফুটে বললাম।
– নামো। বাইক থেকে!
আমি ও নেমে এলাম। মনটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেল। কুশল বাইক পার্ক করে সোজা এসে আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে চলল। নিজে থেকেই টিকিট কেটে সোজা প্ল্যাটফর্মে এনে দাঁড় করালো। এদিকে আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরেই ট্রেন এসে হাজির। কুশল কিছু করার আগেই নিজে থেকেই ওর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। ওর হাত থেকে টিকিট টা নিয়ে সোজা ওর দিকে তাকালাম। ও হয়ত আমার ভেজা চোখ দেখে একটু অবাক হয়েছে। আশেপাশে মোটামুটি ভালোই লোকজন আছে। কিন্তু আমি অতটা পাত্তা দিলাম না। আলতো করে ওর গালে হাত রাখলাম, শক্ত গলায় বললাম, বিশ্বাস করো আর নাই করো, সত্যিই ভালোবাসি। জীবনে প্রথমবার কারোর জন্য এমন পাগলামি করেছি। সরি, খুব বিরক্ত করেছি।
আমি আর কিছুই বললাম না। আসলেই বলতে পারলাম না। উঠে পড়লাম ট্রেনে। আর কুশলের দিকে ফিরে তাকালাম না। ট্রেন ছুটে চলেছে। বেশ ফাঁকাই কম্পার্টমেন্ট। জানলার ধারেই বসেছি। এতক্ষণে কেঁদে ফেলেছি। আর কখোনোই যাব না তাকে বিরক্ত করতে। মনে মনে আওড়ে নিলাম,
“যাও, ভুললাম তোমায়।
বাঁধব না আর মিথ্যে কল্পনায়।”
ক্রমশ………