রঙ মিশেলে সেই দশমীর বিকেল—০৪

#কল্পনার_কলমদানি
#চন্দ্রা
গল্প : রঙ মিশেলে সেই দশমীর বিকেল—০৪

আজ নবমী। সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছি। কিন্তু আজ আর ব্যস্ততা নেই। চুপচাপ ঘরেই আছি। এমন কি পাড়ার পূজো প্যান্ডেলেও যাই নি। কাল অত তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে এসেছি দেখে মা ও জিজ্ঞাসা করছিল কিছু হয়েছে কি’না। কোনো রকমে কাটিয়ে দিয়েছি। ভালো লাগছে না। আজ চারিদিকে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাবা মা পূজো প্যান্ডেলে গেছে। আমাকেও বলেছিল, কিন্তু ইচ্ছে করেই যাই নি। আজ শরৎচন্দ্রের “পরিণিতা” পড়ছি। কি সুন্দর শেখর ফিরে এসেছিল অপ্রত্যাশিত ভাবে। কিন্তু আমার কুশল তো……
হঠাৎ ফোনটা বেজে ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের উপরে ভাসছে নামটা, সাসু মা। কালকেই কুশলের মায়ের সাথে ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করেছি। কথাটা মনেই ছিল না। এসব ভাবতে ভাবতেই একবার পুরো রিং হয়ে কলটা কেটে গেল। আবার ফোনটা বেজে উঠতেই এবার আর রিসিভ করতে দেরি করলাম না।
– হ্যালো!
– মিথিলা…?! আমি কুশলের মা বলছি।
– হ্যাঁ, বলো। আমিই বলছি।
– কাল এলি না কেন মা…. ?! আমি রান্না করে বসে ছিলাম।
হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। কোনো রকমে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
– তোমার ছেলেই তো নিয়ে গেল না….!
– ছেলে নিয়ে গেল না। তা তুই জোর করে এলি না কেন?!
– হুহ! তোমার রাক্ষস ছেলে সোজা ট্রেনের টিকিট কেটে আমাকে ট্রেনে তুলে দিল।
এবার নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলাম। কিন্তু উনি কি করে যেন বুঝে ফেলল।
– কাঁদিস না রে মা। ভালোবাসিস না আমার ছেলেটাকে….?!
– তোমার ছেলে বাসে না। অসভ্য রাক্ষস! সবসময় ঝারি মারে আমাকে।
উনি হেসে উঠলেন। আমি রেগে বললাম, হেসো না’তো!
– তা কবে থেকে চিনিস বাবান কে?! এসব কবে হল?! আমার যা ছেলে! ও তো এসব প্রেম ভালোবাসা তে বিশ্বাস করে না।
– তোমার ছেলে কেন বিশ্বাস করবে?! বেশি ভাব দেখাবে তাহলে কখন?! হুহ!
– আচ্ছা! আচ্ছা! এবার তো বল।
আমি এবার সেই পঞ্চমী থেকে সব বলতে শুরু করলাম।
– ওরে মেয়ে!…..তোর দেখছি খুব সাহস?!….হ্যাঁ রে যদি খারাপ ছেলের খপ্পরে পড়তি?! একটু ভেবে চিন্তে কাজ করবি তো! দিনকাল তো মোটেও ভালো নয়।
আমি উত্তর করলাম না। কথাগুলো সত্যি। এত কিছু করে ফেলেছি। ঠিক অতীব বোকার মত।
– শোন! নিজের মা’কে সব বল। এভাবে লুকিয়ে যাওয়াটা ঠিক না’রে মা।
– বলে কি হবে?! তোমার রাক্ষস ছেলে তো আর পটবে না!
উনি এবার হেসে ফেললেন।
– সে আমিই বুঝব! তুই তোর মা’কে সব বল। তারপর আমার সাথে কথা বলাবি। বুঝলি…?!
– হুম।
– আর এত মনমরা থাকিস না। পূজোর দিনে। বাবা মায়ের ভালো লাগে তোকে এরকম দেখে?!
– হ্যাঁ তুমি তো বলবেই। শশুর মশাই তোমার সাথে এমন করলে তুমি কি করতে শুনি….?!
– কি বাঁদর মেয়ে…?! তোর জন্য মার তোলা রইল। একবার সামনে পাই। তারপর দেখবি?!
আমি হেসে ফেললাম। উনিও আরো একবার মা’কে সব বলতে বলে কল কাট করলেন। এবার শান্তি লাগছে। উফ! এবার দেখি বাচ্চু তুমি কি করে বাঁচো……?!
বিকেলে বাবা বাড়িতে নেই। মা আর আমি টিভি দেখছি। কিন্তু আমার বুকের মধ্যে হাতুরি পেটা চলছে। মা’কে কি ভাবে বলব?! এত কিছু করে ফেলেছি। এবার মা তো রেগে যাবেই। আমি শুয়ে শুয়েই উশখুশ করছি। কিভাবে শুরু করব কিছুই মাথায় আসছে না। বাইরে এত সাহস দেখিয়ে এলাম। আর এখন মায়ের সামনে সব শেষ। কিন্তু শুরু যখন করতেই হবে আর দেরি করে লাভ কি?!
উঠে সরে গেলাম। না জানি মা কখন মেরে পেরে দেয়!
– মা…শোনো না!
– কি হয়েছে …?!
– আরেহ্, আমার দিকে দেখো টিভির দিকে না।
– উফ! ভালো সময়ে তোর যত ফালতু বকবক। কি হয়েছে কি…?!
– আসলে….
– ঢং না করে তাড়াতাড়ি বল!
মা টিভির দিকেই তাকিয়ে আছে।
আমি গড়গড় করে বলে ফেললাম, আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি। নাম কুশল।
মা অবাক হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এটাই মোক্ষম সময়। আমি গড়গড়িয়ে সেই পঞ্চমী থেকে অষ্টমী। এমন কি আজ দুপুরে কুশলের মায়ের ফোন করা সব বলে দিয়েছি।
মা থমথমে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কথা শেষ করে মুহূর্ত দাঁড়ালাম না। দৌড়ে একটা জলের বোতল নিয়ে সোজা ছাদে। সিঁড়ির দরজা আটকে বসে রইলাম। এখন কোনো মতেই মায়ের সামনে পড়তে চাই না। নীচের দিকেও খেয়াল করছি। নাহ্, মায়ের কোনো চিৎকার শোনা যাচ্ছে না।

আমি অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখোনো মা আমাকে ডাকে নি। এদিকে আমার খিদে পাচ্ছে। দুপুরে টেনশনে খেতে পারিনি। উফ! হায় রে প্রেম এ কোথায় এনে দাঁড় করালো আমাকে…..?! এত কষ্ট করছি , আর ওই ত্যাদোড় ছেলে….! এরপর নীচে গেলে মায়ের কাছে মার না খেতে হয়…?! ধূর!

– মিথি!..মিথি!
আরেহ্, এটা তো বাবার গলার আওয়াজ। উফ! এবার শান্তি। বাবার সামনে মা অন্তত মারতে পারবে না। যাক্ বাবা এবার নীচে যেতে পারব। কিন্তু ….মা যদি বাবাকে সব বলে দেয়?! তাহলে….?!
বাবা এর মধ্যেই সিঁড়ির দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। আমিও তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিলাম।
– আয় ….নীচে আয়।
বাবা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। আচ্ছা! বাবা কি রেগে ছিল?! কে জানে?! এখন তো ভয় লাগছে। বাবার একমাত্র মেয়ে তো। তাই কখোনোই জোর গলায় বাবা আমার সাথে কথা বলেনি। এছাড়া ও আমি কখোনোই তেমন কোনো কাজ করিনি। কিন্তু এই কুশলের জন্য আমার যে কি হয়েছে…..?! যাই হোক বাবা ডেকেছে মানে আমাকে নীচে যেতেই হবে।
ড্রয়িং রুমে চুপচাপ এসে দাঁড়ালাম। বাবা মা দুজনেই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই বাবা কাছে ডাকল। আমি বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।
– দে…. কুশলের মায়ের নম্বর টা দে।
আমি বাবার দিকে অবাক চোখে তাকালাম। বাবা মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
নিজের ঘরে বসে থাকলেও কান আমার ড্রয়িং রুমের দিকেই। আমার বাবা মা কুশলের মায়ের সাথে কথা বলছে। আর এদিকে আমি টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি। দাঁড়াও কুশল বাবু দিন আমার ও আসবে। তখন তোমার অবস্থা ও আমার থেকেও খারাপ হবে। হুহ!

আজ বিজয়া দশমী। সকাল সকাল পাড়ার মন্ডপে একচোট সিঁদুর খেলা হয়ে গেছে। আমার মা ও সকাল সকাল মা দুর্গা কে সিঁদুর ছুঁইয়ে এসেছে। এখন তিনি ব্যস্ত হাতে রান্না করছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। কাল রাত্রে কুশলের মায়ের সাথে কি কথা হয়েছে জানি না। লজ্জায় আমি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। বাবাও সকাল সকাল বাজার সেরে আবার কোথায় যেন বেরোলো। এদিকে মা অথবা বাবা কেউ আমাকে কুশল কে নিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। কে জানে ?! বুঝতে পারছি না। আমি তড়িঘড়ি স্নান সেরে নিয়েছি। এমনিতেও কখোনো স্নান করা নিয়ে আমাকে বলতে হয় না। তবুও আজকে মা যেন একটু তাড়াহুড়ো করছে। বুঝিনা বাবা! মা’দের মুড বলে কথা! আবহাওয়ার থেকেও খারাপ।
যাই হোক ডিপ ব্লু আর হালকা খোলা রঙের চুড়িদার পড়েছি। একটু মন্ডপ থেকে ঘুরে আসাই যায়। আবার তো সেই পরের বছর! রেডি হয়ে রান্না ঘরে মা’কে বলার জন্য এলাম। এর মধ্যেই কলিং বেলটা বাজছে। আমি নিজে থেকেই গেলাম দরজা খুলতে। কিন্তু এ’কি?! বাবার সাথে দাঁড়িয়ে কুশলের বাবা মা। আর ওদের একটু পেছনেই কুশল। ও আমার দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
– কি’রে মা কেমন আছিস….?!
– ভালো । তোমরা…?! এসো এসো।
আমি সরে দাঁড়াতেই ওরা ভিতরে চলে এল।
আমি ড্রয়িং রুমের এককোনে দাঁড়িয়ে আছি। আর সোফাতে বসে চার বাবা মা আড্ডা দিচ্ছে। কুশল কোথায় জানিনা। আর এরা আমাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। নিজেই বিরক্ত হচ্ছি। মানে টা কি…..?! কাল রাত্রে কি এমন কথা হল যে আজ সকালেই এরা একসাথে গল্প করছে….?! তার সাথে আমাকে যেন কেউ দেখতেই পারছে না। ধ্যাত….! আমি চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলাম। ছাদেই আমার লাগানো সব গাছগুলোর মাঝেই আমার শান্তি। আর ওই ঢাকার শিউলি গাছটা। এক দম ছাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভোর বেলায় শিউলি ফুল ছাদের একপাশে জুড়ে বিছিয়ে থাকে। আর একটু রাতের বেলা শিউলির মন মাতানো সুবাস।
আমি ছাদে উঠতেই চমকে গেলাম। এ’কি কুশল এখানেই দাঁড়িয়ে আছে!
আমি মুচকি হাসলাম। বাচ্চু তুমি এখন পালাবে কোথায়…?!
– উঁহু …উঁহু ….কি ব্যাপার এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?!
কুশল একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে ফিরল।
– আজ তোমার বাড়িতে আসার কথা তুমি জানতে তাই না….?!
কুশল গজগজ করতে করতে বললেও আমি পাত্তা দিলাম না।
– আমার বাবা মায়ের সাথে তোমার বাবা মায়ের পরিচয় হল কি করে….?!
– আমি আমার বাবাকে তোমার মায়ের নম্বর দিয়েছিলাম।
আমি বেশ ভাব নিয়ে বললাম।
– তুমি জানো তোমাকে আমার পছন্দ নয় ….
– কেন পছন্দ নয়….?! উত্তর দাও।
আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। ও ছাদের রেলিং এর সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি একদম ওর সামনে। দুজনের দূরত্ব আধ আঙুল।
– কি হচ্ছে কি…..?! দূরে যাও!
ধূর আমি ওর কথা শুনলে তো!
– আগে বলো। আমাকে কেন পছন্দ নয়?! আমি টেরা…?! কানা…?! নাকি দেখতে খারাপ…?! কোনটা…?!
কুশলের রেগে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, দূরে যাও। সরো বলছি!
– উফ! আগে আমার উত্তর দাও।
– তুমি কি মেয়ে….?! লজ্জা নেই?! এভাবে কেউ একটা ছেলের গায়ে পড়ে আসে…?!
কুশলের আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিন্তু আমিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী তো নই।
– আমি মেয়ে কি’না সেটা পরে জেনে নিও। এখন আগে উত্তর দাও।
– আমি কিছু জানি না! তুমি আমার থেকে দূরে সরো!
কুশল আরো সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দুপুরে তেজী রোদের তাতে ওর মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কিন্তু আমি অসভ্যের মত ওর ঠোঁট জোড়া দিকে তাকিয়ে আছি। ওর কথা বলার সময় ঠোঁট নাড়ানো দেখছি।….আমার শয়তানি মন আবার নিষিদ্ধ ইঙ্গিত করছে। কে জানে….?! কুশলের ব্যাপারে আমি কেন যে বেপরোয়া?! নিজেকেই নিজে বুঝি না বাপু!
ও আরো সরে যেতে চাইলেই আমি একহাতে ওর সবুজ রঙের পাঞ্জাবীর কলার টেনে ধরলাম। আজকেও বাবু পাঞ্জাবি পড়েছে। গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবির বুকের কাছটায় আর হাতের রিস্টে লাল সুতোর কাজ।
– উঁহু! সেই প্রথম দিন থেকে তোমার পেছনে পড়ে আছি। আর তুমি ন্যাকামো করছ!….খুব বেশি ভাব তাই না….?!
– কি হচ্ছে এসব..?!…..তুমি….
কুশলের শেষ করার আগেই ওর পাঞ্জাবি কলার ধরে টেনে নিলাম আর সাথে সাথেই ওর মাথার পেছন থেকে হাত দিয়ে আমার ঠোঁট জোড়া ওর ঠোঁটে বসিয়ে দিলাম। আমি নিজেই আবেশে চোখ বুজে নিলাম। নিজেই কেঁপে উঠছি। একটু পরে ইচ্ছে করেই জোরে একটা কামড় বসিয়ে ওর থেকে সরে আসতেই দেখি কুশল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
আমি নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বললাম, স্ট্যাপ লাগিয়ে দিলাম। তুমি শুধুই আমার।
আমার কথা শেষ হতেই কুশল এগিয়ে এসে ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল আমার গালে। আমি ছিটকে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত লাগল নিজেকে সামলে নিতে। চড় মারা গাল টাতে হাত দিয়েই ওর দিকে তাকালাম। নিমেষেই আমার চোখ জোড়া ভারী হয়ে এল।

ক্রমশ……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here