কাজল নদীর জলে পর্ব-১০

0
1108

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

১০.

আই ইউ বি এর সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ স্থান হলো ক্যান্টিন। ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা এসে ভীড় জমায় এখানে। কেউ আসে খেতে, কেউ আড্ডা দিতে। চারদিকে হৈ-চৈ আর মানুষের ভীড় চোখে পড়ার মত। চারদিকটা যখন কোলাহলে পরিপূর্ণ তখনও ক্যান্টিনের মাঝের একটা টেবিলে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। তিনজন মানুষ নিরবতার আশ্রয় নিয়ে চুপটি করে বসে আছে টেবিলের তিন প্রান্তে। সমবয়সী দু’টো মেয়ে ও একটি ছেলে। পরনে ফর্মাল ড্রেস আপ। গলায় ঝুলানো, আইডি কার্ড। যাতে লেখা আছে এরা তিনজন আই ইউ বি-এর ম্যানেজমেন্ট এর ছাত্রছাত্রী। নাম- পিয়াম, রাশনা, সুরলা।

টেবিলের এক প্রান্তে মলিন মুখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সুরলা। তার বিপরীতমুখী চেয়ারটায় গালে হাত দিয়ে সুরলার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে বসে আছে রাশনা। সুরলার পাশ বরাবর চেয়ারে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে পিয়াম। খানিক পর পর মোবাইল থেকে চোখ ওঠিয়ে টেবিলের বাকি দুই মানবীকে পরখ করছে এক পলক। চোখ নামিয়ে আবার ও মন দিচ্ছে মোবাইলে। এই রীতি চলছে বিগত পনেরো মিনিট যাবত। এতে সুরলা আর রাশনার কোন আপত্তি না থাকলে ও, ঘোর আপত্তি পিয়ামের। এক রাশ বিরক্তি এসে ভীড় জমিয়েছে পিয়ামের চেহারায়। এত হৈচৈ এর মাঝে বসে থেকে ও এরা দুজন কিভাবে ধ্যানমগ্ন হতে পারে! ভেবে পায় না পিয়াম।

সুরলার সাথে পিয়ামের পরিচয়টা ভার্সিটির প্রথম দিনে। প্রথম দিন সুরলাকে দেখে সে ভেবেছিল, হতে পারে কারো ছোটবোন এসেছে। ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, “পিচ্ছি তুমি কার সাথে এসেছো?” সুরলা রেগে তার আইডি কার্ড দেখিয়েছে তখন। তাতে বেশ অবাক হয়েছে পিয়াম। তারপর হুটহাট কথাবার্তায় দিন কয়েকের মাঝেই পরিচয়টা বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। তাদের বন্ধুত্বের মাসখানেক পরেই রাশনাও বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। তারপর তারা তিনজনের একটা সার্কেল হয়ে যায়। পুরোনো সব কথা মনে মনে আওড়ায় পিয়াম। একটা ব্যাপার তাকে ভাবায়। তা হলো, সুরলার পরিবর্তন। সুরলাকে যতদিন ধরে চেনে তার একটা দিন ও সে সুরলার মলিন চেহারা দেখেনি। সবসময় হাসিখুশিই থাকতে দেখেছে। আজকাল সুরলার চেহারায় মলিনতা দেখা যায়, সাথে কেমন যেন উদাস ভাব! সারাদিন কী ভাবনায় ডুবে থাকে কে জানে! ক্লাসে ও অমনোযোগী ভীষণ। পিয়াম এই ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করছে প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে।
মাঝে বেশ কিছুদিন সুরলা ভার্সিটি আসেনি, খালার বাসায় ছিল। তাও সপ্তাহে দুই তিন দিন বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট আর ভিডিও কলের আড্ডা বাদ যায় নি। তখন সব কিছু নিয়মমাফিক ছিল। বাসায় ফেরার পরদিন যখন ভার্সিটি এল, সেদিন থেকেই সুরলার পরিবর্তনটা চোখে পড়েছে। বান্ধবীর এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না পিয়াম। সে চায় সুরলা আগের মত হোক। কী সমস্যা বলুক, সে সমাধান করার চেষ্টা করবে। আগে জানতে হবে। ফোন পকেটে রাখে সে।
গলা ঝেড়ে বলে,
“এই তোরা এই ভ্যাবলামার্কা ভাব নিয়ে বসে আছিস কেন! কাহিনী কী?”

পিয়ামের কথায় ধ্যান ভাঙে দুই বান্ধবীর। রাশনা হতাশ গলায় উত্তর দেয়,
“কাহিনী বুঝার চেষ্টা করছি, বাট পারছি না।”

পিয়াম ভেবেছিল সুরলার ব্যাপারে কিছুটা হলে এ জানে রাশনা। কিন্তু এখন দেখে ভিন্ন ব্যাপার। সে সুরলার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলে,
“সুরলা কী হয়েছে তোর? গত এক সপ্তাহ তুই ক্লাসে ছিলি ঠিকই,কিন্তু তোর মন ক্লাসে ছিল না । আজকাল সারাক্ষণ অন্যমনস্ক থাকিস । আর কী যেন ভাবিস সারাদিন, চুপচাপ থাকিস, কোন কথাও বলিস না। কারণটা বলবি?”

চয়নের ব্যাপারটা বন্ধুদের এখনো বলেনি সুরলা। সে দুই বন্ধুর দিকে তাকায়। দুজনের চোখে প্রশ্নের জোয়ার দেখে। সে দ্বিধায় পড়ে। বন্ধুদের জানাবে? নাকি জানাবে না? পরক্ষণেই ভাবে, বন্ধুরা তো তার পরিবারকে বলবে না, পারলে সাহায্য করবে, বুদ্ধি দিবে। এই আশায় জানাতে উদ্যত হয়। টেবিলে রাখা ব্যাগপ্যাক থেকে ফোন বের করে। সাইড বাটন চেপে স্ক্রিন অন করে। লক খুলে হোম স্ক্রিন ওয়ালপেপারে চোখ বুলায়। ফোনটা রাখে টেবিলের মাঝে। বলে,
“আমার পরিবর্তনের কারণ।”

পিয়াম ফোন হাতে নিয়ে দেখে হোম স্ক্রিনে শোভা পাচ্ছে একটা সুদর্শন যুবকের হাস্যজ্বল ছবি। ছেলেটাকে ইতিপূর্বে সে দেখেছে বলে মনে হয় না। ‘কে ছেলেটা?’ এই প্রশ্নটা চোখে ভর করে ভ্রু কুঁচকে তাকায় বান্ধবীর দিকে। সুরলা লাজুক হাসে। এতে পিয়ামের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে যায়। সে বলে,
“ছেলেটা কে? আর সে কিভাবে তোর মন খারাপের কারণ হতে পারে? ছেলেটার সাথে তোর পরিবর্তনের সুত্রপাত কোথায়?”

সুরলা কিছু বলতে নিবে তার আগেই পিয়ামের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে রাশনাও চোখ বুলায়। অবাক হয়ে বলে,
“বেশ সুন্দর তো! ছেলেটা কে রে?”

সুরলা ঠোঁট ভিজিয়ে চয়নের ব্যাপারটা খুলে বলে। সব শুনে পিয়াম আর রাশনা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের বান্ধবীর দিকে। যেন সুরলার প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না তারা। বিস্ময়ে রাশনা দাঁড়িয়ে এক চিৎকার দেয়। ক্যান্টিনে থাকা সবাই ঘুরে তাকায় তার দিকে। পিয়াম রাশনাকে ধরে বসায়। হুট করেই কী ভেবে রাশনা রেগে যায়। গম্ভীরমুখে বলে,
“এত কিছু হয়ে গেল, আর তুই আমাদের এখন জানাচ্ছিস!”

সুরলা আমতা আমতা করে,
“আসোলে, বলব বলব করে ও বলা হয় নি, কেমন যেন লজ্জা লাগছিল।” সুরলার চেহারার লাজুকলতা খেলে যায়। তা দেখে পিয়াম হেসে বলে,
“আমি ভাবতেই পারি নি, আমার পিচ্ছি বান্ধবী একদিন প্রেমে পড়বে, কারো কথা ভেবে দু’গাল লাল করবে! ভাবতেই অবাক লাগে!”

সুরলা লাজুক হাসে। ছন্দের মত করে বলে বলে,
” প্রেম হচ্ছে ঝড়ের মত। হুটহাট এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। ”

“দেখলি পিয়াম, প্রেমে পড়তে না পড়তেই কেমন কবি কবি ভাব এসে গেছে! অথচ প্রেমের পাঁচবছর পূর্ণ হলেও এখন অবধি কবি ভাব এল না আমার । কী নির্মমতা! ” রগড় করে বলে রাশনা। পিয়াম বলে,
” আমার ও এলো না আজ অবধি! ব্যাপারটা দুঃখজনক। যাই হোক, সুরলা ট্রিট চাই।বান্ধবী প্রেমে পড়েছে, ট্রিট তো পাওয়াই যায়। ”

সার্কেলে এমন একজন মানুষ থাকে, যে কিনা খাবারের কথা শুনলেই লুটিয়ে পড়ে। এই সার্কেলের পেটুক মানুষটা হলো রাশনা। তিনজন মানুষের খাবার একা সাবাড় করার ক্ষমতা রাখে সে। এত খেলেও মোটা হয় না। ট্রিটের কথা বলতে দেরি, রাশনার খাবার অর্ডার দিতে দেরি নেই। ক্যান্টিন সব ধরনের খাবার আজ টেস্ট করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা দেখে পিয়াম কপাল চাপড়ে বলে,
” এই মেয়ের খাবারের কথা শুনলেই হুশ থাকে না। সুরলা এখনো ট্রিট দিবে বলল না, অথচ রাশনার খাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। ”

এরি মাঝে খাবার নিয়ে ফিরে এল রাশনা। ওয়েটার আসার অপেক্ষা করেনি। নিজেই নিয়ে এসেছে। টেবিলের কাছে এসে বলে,
“পিয়াম তোর জন্য কিছু অর্ডার দিব?”
পিয়াম বিরক্তি ভঙ্গিতে বলে,
“সুরলা ট্রিট দিবে এখনো বলেনি।”
“আরে দিবে ট্রিট! তুই চিন্তা করিস না।” আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে রাশনা। তারপর সুরলার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কীরে সুর দিবি না?” সুরলাকে সুর ডাকে রাশনা।

সুরলা খানিক ভেবে বলে,
“দিব, যদি আমাকে সাহায্য করিস।”
রাশনা বসে খাওয়া আরম্ভ করেছে ইতিমধ্যে। খেতে খেতে পিয়ামকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি খাই, পিয়াম সাহায্য করবে।” পিয়াম আবার ও কপাল চাপড়ায়। বলে,
” তোর খাওয়া দেখলে আমার ভয় হয়, কোনদিন না জানি আমাকেই খেয়ে ফেলিস!”

“তোকে খেতে ভালো হবে না, জগন্য হবে। তাই সেই ভাবনা মাথায় আনব না। নিশ্চিন্তে থাক।” খেতে খেতেই বলে রাশনা। পিয়াম সুরলার দিকে তাকিয়ে বলে,
“পেটুকের অধ্যায় বাদ দে। বল, তুই এখন কী করতে চাইছিস?”

“প্রেমটা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত হই আমি। ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে, এত দূরত্ব ভালো লাগে না।” মলিন মুখে বলে সুরলা। পিয়াম খানিক ভেবে বলে,
“ফেসবুকে নক দে। টুকটাক কথাবার্তা বলে আগা বিষয়টা। কাছে আসার গল্পটা শুরু হোক। ”
“ফেসবুক একাউন্ট ডিয়েক্টিভ সম্ভবত। গত কয়েকদিন পেয়েছি, কাল থেকে আইডি পাচ্ছি না।”
“ইন্সটাগ্রাম চেক কর। একাউন্ট পেলে নক দে।”
“ইন্সটাগ্রাম ও নেই। এই কয়েকদিনে সব চেক দিয়েছি কাল। ”

সুরলার চেহারায় মলিনতা বাড়ে। পিয়াম ভাবতে বসে। রাশনা খেতে খেতে বলে,
“যেহেতু চয়ন তোর খালাদের পরিচিত। তাই নাম্বারটা তাদের কাছে থাকতে পারে। খালার বাসায় যা, নাম্বার জোগাড় করে কল দে। ”
“আর কল দিয়ে কী বলব?” তড়িৎ প্রশ্ন করে সুরলা।
“বলবি, পেইন্টিং-এর জন্য ধন্যবাদ দিতে কল দিয়েছিস।” আবার ও খাওয়ায় মন দেয় রাশনা। রাশনার বুদ্ধি পছন্দ হয় সুরলার। চোখে মুখে উৎফুল্লতা দেখা দেয়।

পিয়াম বলে,
“বাহ, পেটুকের মাথায় খাওয়া ছাড়া বুদ্ধির ও জায়গা আছে দেখি!”

রাশনা হেসে বলে,
” বুদ্ধি কাজে লাগলে আবার ও ট্রিট চাই কিন্তু!”

সুরলা সায় জানায়। টুকটাক আলোচনা শেষে বাসায় ফিরে সুরলা। বিকেলে বায়না ধরে খালার বাসায় যাবে। খালামণিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কালই ফিরবে আবার। সাবিনার আপত্তি থাকলেও মেয়ের জেদের কাছে হার মানে। সুরলা বিকেলে খালার বাসায় চলে আসে। এক ফাঁকে নিতু আর খালার ফোন চেক দেয় কিন্তু নাম্বার পায় না। রাতে ফোন লো ব্যালেন্স এর বাহানায় নিলয়ের ফোন নেয় মাকে ফোন দিবে বলে। বারান্দায় গিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট চেক করে। অবশেষে পায় চয়নের নাম্বার। সুরলার খুশি দেখে কে? পরদিন সকালে নাম্বার নিয়ে খুশি মনে খালার বাসা থেকে সরাসরি ভার্সিটি যায়। ক্লাস শেষে চলে যায় মাচাং রেস্টুরেন্টে। নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে। পিয়াম আর রাশনার উপস্থিতিতেই কল দেয়। দু’বার কল দিতেই রিসিভ হয়। অপাশ থেকে ভেসে আসে চয়নের মধূর গলা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here