কাননে_এত_ফুল (পর্ব-৭)

#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-৭)
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১০.
কিছুক্ষণ পরপরই হো হো করে হয়তো হাসির শব্দ হচ্ছে নয়তো চিৎকার। আমার একদম ভালো লাগছেনা এসব কিছু। আমি বসে আছি নিতুন আপু আর মৈত্রী আপুর মাঝখানে। মৈত্রী আপুর ছোট ছেলে মায়ানের কান্নাকাটি বেড়ে যাওয়ায় মৈত্রী আপু তাকে কোলে নিয়েই এখান থেকে উঠে বাহিরে চলে গেছে। আমার পাশে একটু ফাকা হতেই মিফতা ভাই এসে বসলেন। আমার ডানপাশেই বসেছেন তিনি। মৃদু স্বরে বলল,
-“কীরে! খারাপ লাগছে?”

আমি একবার আবারো পরিবেশটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। ছোট করেই বললাম,
-“না।”
-“তো এমন মুখ গোমড়া করে রাখছিস কেন?”
-“কোথায় ঠিকই আছি তো। তুমি এমনিতেও বেশি বেশি কর।”
-“কী বেশি বেশি করি?”
-“উফফ! চুপ করবা? এত কথা কেন বলছ?”
-“তোর কী আমাকে বিরক্ত লাগছে?”
-“লাগছে। অনেক বেশি বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে তোমাকে…
-“আমাকে কী?”
-“তোমাকে আমি চুপ করতে বলছি?”
-“বলছিস নাকি!”
-“মিফতা ভাই!”

শেষের কথাটা এত জোরে হলো যে পুরো হল রুমের দৃষ্টি আমার দিকে। আমার সামনে বরাবর সোফায় বসে আছে ডাক্তার অভ্র আর মৃদুল ভাই। তাদের থেকে দুইজন বাদে আছে তিয়াস ভাইয়া। আমার আপা নিতুন আপার পাশেই। আরেকটু ভালো করে খেয়াল করলাম আপার সাথে অবন্তী আপু। আরো কয়েকজন আছে এদের চোখের দেখায় চিনি তবে এমনিতে নাম পরিচয় জানিনা। মিফতা ভাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নেওয়ার জন্য হেসে বললেন,
-“আজব! সব এদিকে তাকিয়ে আছিস কেন? অর্নি এমনিতেই মাঝে মাঝে চেঁচায়। এটা কমন প্রবলেম ওর।”

আমি পুরো দমে অবাক হয়ে গেলাম। মিফতা ভাই কী আমাকে মেন্টালি সিক বলছেন? রাগ আরো মাথায় উঠে গেল। মিফতা ভাইকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। পেছন থেকে শুনছিলাম তিয়াস ভাই ডাকছেন,
-“অর্নি? কোথায় যাচ্ছো? কি হয়েছে!”

এত পাত্তা দিলাম না। চলে এলাম সোজা ছাদে। এদের ছাদটা দেখা হয়নি কখনো। আজ একটু জোছনা বিলাশ করি। চাঁদের আলো প্রকট না হলেও ছাদে কৃত্তিম আলোয় ভরপুর। আমি গিয়ে রেলিং ঘেসে দাঁড়ালাম। ক্ষণকাল বাদেই কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। জানি! এটা মিফতা ভাই। মিফতা ভাই ছাড়া আর কেই বা হবে? এখন তো সেই আমার রাগ ভাঙাতে আসবে। হুহ! যত্তসব!

আমার পাশেই এসে দাঁড়ালেন। আমি ফিরেও তাঁকালাম না। হঠাৎ করেই একটা ভরাট গলা শুনলাম। গলার স্বর টা আমি চিনি। উহু! মিফতা ভাই না। ডাক্তার অভ্র। তিনি বললেন,
-“কী ব্যাপার অর্নি? তোমার কি মুড অফ নাকি?”
আমার বিরক্ত লাগে। তবুও বললাম,
-“না আমি ঠিক আছি। এমনেই এত মানুষের ভীড় ভালো লাগেনা।”
-“তোমার নাকি গেট টুগেদার জিনিসটা দারুন লাগে! তাহলে আজ কেন বলছ ভালো লাগছেনা?”
-“আপনাকে কে বলল এই কথা?”
-“মিফতাহুল বলেছে সেদিন।”
-“কোনদিন?”
-“ঐ যেদিন তুমি রেস্টরন্টে ইফতার করতে গেলে।”
-“আমার রেস্টরন্টে ইফতার করাটা কী সেদিন ব্রেকিং নিউজে ছিল? সবাই এত লাফাচ্ছে কেন সেটা নিয়ে? রেস্টরন্টে খাওয়া কী অপরাধ? আমি কী বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি? এখন কী ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে মরতে হবে?”
-“রিল্যাক্স! একসাথে এত প্রশ্ন? তুমি কী সত্যিই পাগল?”
-“কী! আমি পাগল! কে বলেছে আমি পাগল?”
-“মৃদুল বলেছে।”
-“কী! এরা দুইভাই আমার এত কথা আপনাকে কেন বলল? শেষে কিনা বাহিরের মানুষের কাছে বলছে তাদের বোন পাগল?”
-“বাহিরের মানুষ?”
-“হ্যাঁ। আপনি ঘরের মানুষ?”
-“হতে কতক্ষণ?”
-“মৃদুল ভাইদের আর বোন নাই।”
-“তুমি কী তাহলে?”
-“আমি খালাতো বোন। বুঝেছেন! খা-লা-তো বোন।”
-“সেটা তো ঘরের ধরাই যায়।”
-“এই! সমস্যা কী? এসব কী কথা বলতেছেন?”
-“কিছু না। নিচে চলো।”
-“কেন যাব? আপনার কথা শুনবো কেন?”
-“মিফতাহুল মন খারাপ করে বসে আছে। চলো।”
-“সে মন খারাপ করে বসে আছে? থাকুক। আমার কী?”
-“তোমার ভাই না?”
-“আমার কোনো ভাই নেই। মায়ের পেটের তো নেই আর এখন থেকে কোনো সম্পর্কের ভাই নেই। আমি মানিনা।”
-“আচ্ছা তবুও নিচে চলো। তিয়াসদের ছাদে জ্বিন আছে। তোমার ভালোর জন্যই বলছি।এখন তুমি যেতে না চাইলে আমি আর কী করব?”

ডাক্তারটা চলে গেল। কিন্তু আমার মনে ভালোই ভয় ঢুকিয়ে গেল। জ্বিনের ভয় টা আমার ছোটবেলা থেকেই। দাদী, নানীরা রসিয়ে রসিয়ে গল্প গুলো বলতো। শুনতে ভালো লাগলেও ভয়ও পেতাম খুব। হঠাৎ করেই ছাদের লেবু গাছটা নড়ে উঠে। এটা যে বাতাসে নড়েছে আমার মস্তিষ্কে তা এসেও ঢুকেনি তখন। ভয়ের চোটে সব ভুলে গেলাম। দৌঁড়ে সিঁড়িঘরে আসতেই দেখলাম ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সত্যিই স্বস্তি পেলাম। তার কাছে গিয়ে বললাম,
-“আমাকে একা রেখে চলে এলেন কেন? আমি ভয় পাইনা?”
-“তুমি ভয় পাও?”
-“হ্যাঁ!”
-“আচ্ছা আমার হাত ধরে রাখো। সুন্দর মেয়েদের জ্বিনরা বেশি পছন্দ করে জানোই তো? পরে দেখা যাবে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে। আমার হাত ধরে দাঁড়ালে আর কিচ্ছু হবেনা। নিতান্তই সংকোচ নিয়ে তার শক্তপোক্ত হাতটা ধরলাম। তিনি এমন ভাবে ধরলেন যেন ছাড়লেই সত্যি সত্যি জ্বিন নিয়ে যাবে। লিফ্টে ঢুকতেই তিনি বললেন,
-“অর্নি? তুমি আমার উপর রাগ করেই কী মিফতাহুল দের বাসায় যাওয়া বন্ধ করেছো?”
-“জানিনা।”
-“কেন?”
-“জানিনা।”
-“আচ্ছা! তবে তোমার মনটাকে একটু বোঝাও। এই বয়সে এমন ইমফ্যাচুয়েশন হয়েই থাকে। এসবকে তেমন পাত্তা দিলে চলেনা।”

তার কথা শুনে আমার হাত আলগা হয়ে গেল। সে আরো শক্ত করে ধরলে আমি বললাম,
-“আমার ভয় লাগছেনা আর। হাতটা ছাড়ুন। আর একতলা বাকি আছে। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
তিনি তখনও ছাড়েনি। আমি মোচড়ামুচড়িও করলাম। তার এক কথা,
-“জ্বিন নিয়ে যাবে তো!”
আমিও বারবার বললাম,
-“নিলে নিয়ে যাক। আপনি ছাড়ুন।”
অসভ্য লোকটা হাতের বাধনে ততক্ষণ আটকে রাখলেন যতক্ষণ না ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসেছি। দেখলাম মিফতা ভাই উদাস মনে হাত বুকে ভাজ করে বসে আছেন। আড্ডা চলছে। তবে তার হুশ নেই। আমার কেন যেন খুব মায়া লাগে। আমি তার সাথে কখনও এমন ব্যবহার করিনি। কান্নাগুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। এটা আরো বেশি কষ্টের! আমি মিফতা ভাইয়ের পাশেই বসলাম। সে ততক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে আমার হাতের দিকে তাঁকিয়ে ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত ডাক্তার আমার হাত ধরে রেখেছিল। আমি পাশে বসতেই সে চমকে গেল। হয়তো ভাবেনি যে আমি এখন তার পাশে বসব কথা বলব। আমি বসতেই সে একটু সরে গেল। আমি আর কিছু বললাম না। তিয়াস ভাইয়া বললেন,
-“আজ যদি তুমি বাসায় চলে যেতে অর্নি তাহলে আমি, আম্মু আমরা সবাই খুব কষ্ট পেতাম।”
-“না। আমার ভালো লাগছিল না, তাই ছাদে গিয়েছিলাম।”
-“আর ইউ সিক?”
-“নো নো। নাথিং লাইক দ্যাট!”
-“গুড।”

১১.
রাতে সবাই একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করলাম। আন্টি অনেক আয়োজন করেছেন। আমার প্রিয় রুই মাছের একটা প্রিপারেশন করা হয়েছিল। আমি সেটা দিয়েই পুরো ভাত খেলাম। আন্টি বললেন,
-“আরে অর্নি? এতকিছু থাকা সত্ত্বে তুমি শুধু এক পদ দিয়ে খেলে! খাবার ভালো হয়নি?”
-“ভালো হয়নি কে বলেছে? এই যে আমার কাছে এইটা এত পছন্দ হয়েছে যে আমি এটাই বেশি খেলাম। বাকিগুলো মুখে দেওয়ার কথাও ভুলে গেছি। তবে সবগুলোই দেখতে দারুন লাগছে।”
-“মুরগী আর গরুর আইটেম গুলো নিবেনা? আমি এত শখ করে রাঁধলাম।”
-“নিতাম যদি পেটে জায়গা থাকত। কিন্তু আমার পেট একদম ফুল!”
-“আমার খারাপ লাগছে! তুমি মাত্র একটা আইটেম খেলে?”

আমার আপা আন্টির মন খারাপ মুখ দেখে বললেন,
-“মন খারাপ করবেন না আন্টি! ওর পছন্দের মাছের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রুই মাছ। রুই মাছ থাকলে আর কিছু লাগেনা। ঐটা দিয়েই খাওয়া শেষ করবে। আর আপনি পেঁয়াজের ঝোল ঝোল করে এমন প্রিপারেশন করেছেন যেটা ওর আরো বেশি পছন্দ হয়েছে। দেখেই বোঝা গেছিল কতটা তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিল।”
-“রুই ওর প্রিয়?”
-“হ্যাঁ।”

মাঝখানে মৃদুল ভাই বললেন,
-“আরে না আন্টি। ওরা দুইবোন এখন ব্যাপারটা শাক দিয়ে ঢাকতে চাইছে। আসলে অর্নি হলো কাজের বেটি রহিমা টাইপ। কষ্ট করে ওর কপালে সবসময় এক পদই জোটে। তাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এখন সামনে দশ পদ থাকলেও সেই একপদই খাবে। আমাদের গোষ্ঠীর সবচেয়ে গরীব মানুষটা হলো অর্নি নামক প্রাণী।”

খাবার টেবিলে ধুম করে হাসির রোল পড়ে গেল। মিফতা ভাইও হাসছে মিটিমিটি। যাক! এই সুবাদে মিফতা ভাই একটু তো হাসলো!

——————————-
মা খালামণিদের জোর করে আমাদের বাসায় নিয়ে এলেন। মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাই কিছুক্ষণের জন্য আছেন। তারা নিজেদের বাসায় চলে যাবেন। মা চা করতে গেছে তাদের জন্য। তাই দুইজনে ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছে আপা আর মৈত্রী আপুর সাথে। বাবা গেছেন আমার ফুফির বাসায়। আসতে দেরি হবে। মা আর খালামণি কিচেনে। আমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাইট স্যুট পরে নিলাম। এখন একটু আরাম লাগছে। ড্রয়িং রুমের সেই লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে বেতের সোফায় বসে রইলাম। হঠাৎ করেই মৃদুল ভাই এসে আমার পাশে বসলেন। আমি বললাম,
-“আপনার এই হুটহাট আগমন আমার একদম অপছন্দ।”
-“হোক তোর অপছন্দ। তুই আমার পছন্দ অপছন্দের ধার ধারিস? তাহলে আমি কেন তোরটা বুঝব?”
-“আপনার আবার কীসে পছন্দ আর অপছন্দ? আর এমনিতেও আমার সবকিছুই আপনি অপছন্দ করেন।”
-“ভুল বললি। সব না! শুধু তোর আচার-আচরণটা আমার অপছন্দ। তুই আমাদের বাসার দাওয়াতে গেলিনা কিন্তু তিয়াস ভাইদের বাসার দাওয়াতে নাঁচতে নাঁচতে গেলি। তাও একেবারে সেজেগুজে। এই! তোর তিয়াস ভাইয়ের সাথে কিছু চলছে? পাশাপাশি থাকিস, বারান্দায় দাঁড়ালে দুইজন দুইজনকে স্পষ্ট দেখিস। নিশ্চয়ই কথাও বলিস।”
-“হ্যাঁ বলি। আপনার কোনো সমস্যা?”
মৃদুল ভাই রেগে গেলেন। আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
-“আমার সমস্যা মানে? তুই জিজ্ঞেস করছিস?”
তার হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে বললাম,
-“হ্যাঁ করছি! আপনি কে? কে হোন আপনি? আমার সব ব্যাপারে এত কেন নাক গলান? খালাতো ভাই আপনি আমার। আপন ভাইও না। তার চেয়ে বড় কথা আপনি কী অর্নি? না! আপনি অর্নি না। তাহলে অর্নির লাইফের ডিসিশন আপনি নেওয়ার কে? বেশি অধিকার দেখাতে আসবেন না।”

আমি রুমে চলে এলাম। এসে দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে ঘুমালাম না। একটু পরেই শুনলাম মা বলছেন,
-“এই মিফতা মৃদুল! সেহেরী এখানে এসে খাবি। তিয়াসের আম্মু অর্নির জন্য অনেক খাবার বক্স ভরে দিয়েছেন। বাসায়ও অনেক রান্না আছে। তোরা কষ্ট করে আর বাসায় রাঁধিস না। তোর মা বলল নাকি কিছু রান্না করা হয়নাই। চলে আসবি কিন্তু।”
মিফতা ভাইয়ের গলা শুনলাম। কি বলল বুঝলাম না। আবার সেহেরীতে আরেক প্যারা খেতে চলেছি! ধুররর ভাল লাগেনা!

#চলব।
(আপনারা পড়েই চলে যান। তবে কোনো রেসপন্স করেন না। আপনাদের গুরুত্বপূর্ন মতামত আশা করছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here