#কেন এমন হয়
পর্ব – ১০
এত দিন পর আজ আদনান হাসলো। আদনানের ঠোঁটে হাসি দেখে হিয়ার খুব ভালো লাগছে।এত দিন আদনানের মুখের দিকে ঠিকভাবে তাকিয়ে ও দেখা হয়নি, আহারে অনেক রোগাটে হয়ে গেছে। সম্পর্কের নাম ভিন্ন কিন্তু প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট তো একই।যে কারণেই হোক হাসি ফুটলো তো মুখে। নিজের কষ্টকে লুকিয়ে রেখে, অন্য কারো সুখের কারণ হতে দোষ কি তাতে?
লিফট থেকে নামলো মায়া আর নিপা।হিয়া আর আহনাফ উপরে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল। হিয়ার সঙ্গে মায়া স্বাভাবিক কথা-বার্তা বললেও নিপা একটা কথাও বলল না। মায়া জানালেন ,নিপার হাতের ড্রেসিং করতে যাচ্ছেন, সেদিন গ্লাসে লেগে নিপার হাত কেটে গিয়ে কাঁচের টুকরা হাতে ঢুকে গিয়েছিল।
আহনাফকে ও কাছে টেনে আদর করে কথা বললেন।
হিয়া বিদায় নিয়ে লিফটে উঠতে যাবে তখন পিছন ঘুরে নিপা হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল-
—ভালোই আছ তাহলে,ছয় মাস হয়নি বোন মরেছে এর মধ্যেই দুলাভাইকে পটিয়ে বিয়ে করে সংসার পাতিয়ে বিরাট মজায় দিন কাটাচ্ছ! ছেলেকেও বশ করে ফেলেছ।
মায়া বললেন-
—এভাবে কথা বলছিস কেন,চুপ কর।
হিয়া একেবারে জমে গেল,এ সব কথা শুনে।
আহনাফ কি বুঝলো কে জানে সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে নিপাকে বলল-
—আমার খামমনি তো বাবাকে বিয়ে করতে চায়নি অনেক কেঁদেছে। তুমি খুব পঁচা,সবসময় পঁচা করে কথা বল খামমনির সাথে।
—এই বিচ্ছু একদম কথা বলবি না।
আরো কিছু নিপা বলতে চাচ্ছিল,মায়া টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।
বাসায় ঢুকতেই শাপলা হিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
—কি হইছে ভাবি?আপনারে কেমন জানি লাগতাছে।
নিপা কোন উত্তর না দিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল।
যা কিছু হয়েছে সব কিছু শাপলাকে বলল আহনাফ, তার নিজের মতো করে ।
শাপলা যা বোঝার বুঝতে পারলো। আহনাফকে চকবার খেতে দিয়ে বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে দিল। মফিজ গেছে বাজারে।
নূরজাহানকে কল করে বিস্তারিত জানালো শাপলা। নূরজাহান জানালেন খুব তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসছেন তারা।
শাপলা ওয়াসরুমের বাইরে থেকে হিয়াকে ডাকতে লাগল।
অনেকক্ষণ পর, লাল চোখ আর ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে দরজা খুলে বের হলো। শাপলা কিছু বলতে যাবে তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। শাপলা মোবাইল এনে হাতে দিয়ে বলল-
—ভাইজান ফোন দিছে,কথা বলেন।
রিসিভ করতেই আদনান বলতে লাগল-
—ঠিক ভাবে পৌঁছেছ ?কোন সমস্যা হয়নি তো?
আদনান এমন ভাবে বলছে, হিয়া যেন একটা বাচ্চা মেয়ে।
হিয়া এই কথায় রাগ হয়ে বলল-
—যেই ভাবে বলছেন,মনে হচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না,আমি একটা বাচ্চা মেয়ে !
দুষ্টুমি করে আদনান বলতে লাগল-
—তুমি কি বুড়ি হয়ে গেছ?মনে আছে রিয়ার সঙ্গে আমার বিয়ের সময় তুমি ক্লাস এইটে পড়তে।
রিয়ার প্রসঙ্গ চলে আসলে আর কথা আগানো যায় না।
আদনান আস্তে করে বলল-
—আচ্ছা রাখি তাহলে।
শাপলার কান এই দিকেই দিয়ে রেখেছে,হিয়া রাগে কথা বলছে শুনে একটু চিন্তিত হলো।সে তো আর আদনানের কথাগুলো শুনতে পায়নি।
সাইকিয়াট্রিস্ট এনামুল হক অনেকক্ষণ নিপাকে সামনে বসিয়ে রেখে নিজের কাজ করতে লাগলেন।
নিপা অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে।আসলে ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট এর অংশ এটা,আঢ় চোখে খেয়াল করতে লাগলেন নিপা কে।
এক সময় নিপা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল,আর এটা হয়েছে মাত্র ছয় মিনিটের মাথায়।নিপার মানুষিক অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।
—আপনি আমাকে বসিয়ে রেখে নিজের কাজ করছেন, আমি শুধু শুধু কেন বসে থাকবো? আজ যদি ব্যস্ত থাকেন বললেই তো হয় চলে যাই।
—তোমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে?
—আছে?
—কি কাজ?
অনেকক্ষণ চিন্তা করেও কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের নাম বলতে পারলো না নিপা।
—আচ্ছা ঠিক আছে। এবার আমরা কথা বলতে পারি, ঠিক আছে?
—হু
—সেদিন যে বাসায় ভাঙচুর করলে , কেন করলে ?আমাকে বলা যাবে?না বলতে চাইলে বলার দরকার নেই।তবে বললে তোমার হালকা লাগবে।বলা না বলা সম্পুর্ণ তোমার ব্যপার।
নিপা এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নখ খোটাতে লাগলো,একটু পরে এ দিক ওদিক তাকালো,পা নাচাতে লাগলো।
নিচের দিকে তাকিয়ে বলল-
— হিয়া কেন আদনান ভাইকে বিয়ে করতে গেল। বিয়ের কথাটা শুনে আমার কি যেন হয়ে গেল ,মনে হচ্ছিল সব কিছু ভেঙে ফেলি।
—এতে করে ওদের কোন লাভ হলো,উল্টো তোমার হাত কাটলো, জিনিস নষ্ট হলো, তোমার মা কষ্ট পেলেন।
—কেন বিয়ে করলো?
—আদনানকে তুমি পছন্দ কর?
এবার নিপার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
—পছন্দ করি, খুব পছন্দ করি।
—তোমার পছন্দের মানুষ তোমাকে রেখে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করলো কেন?
—আমি যে তাকে পছন্দ করি সেটা তো সে জানে না।
—ও তাই বল। তুমি এক তরফা ভাবে তাকে পছন্দ করতে।
এবার নিপা উত্তেজিত হয়ে গেল-
—রিয়া মরে গেছে,এখন আদনান আমাকেই শুধু পছন্দ করতো, মাঝখানে হিয়া কেন ঢুকলো।
—রিয়া কে?
—রিয়া আদনানের বৌ, কিছু দিন আগে গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে রিয়া আর মেয়ে মারা গেছে।
নিপা কথা বলছিল চোখ,মুখ শক্ত করে, ঝুলে ঝুলে,চেয়ারের দুই হাতল দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে।
আমি আর কিছু বলতে পারবো না, বাসায় যাবো।
—আচ্ছা ঠিক আছে,তুমি বাইরে গিয়ে বস। এসিস্ট্যান্টকে বললেন-
নিপার মাকে আসতে বল।
নিপার মাকে ডাক্তার বললেন-
—অনেক দিন গ্যাপ হয়ে গেল,সময় মত ওকে নিয়ে আসাটা খুব জরুরি ছিল। আচ্ছা আপা আদনান সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত বলুন তো।
মায়া যা ভয় পাচ্ছিলেন,সেটাই কি হচ্ছে,ভয়ে তার বুক শুকিয়ে গেল।
সব কিছু বললেন আদনান আর রিয়া সম্পর্কে।
ডাক্তার আস্তে আস্তে বললেন-
—এক সপ্তাহ পর আবার আসতে হবে, ঔষধ ঠিকমত খেতে হবে।পারসোনালিটি ডিজঅয়ার্ডার হেলাফেলা করার মত বিষয় না ও আবার প্রচন্ড ডিপ্রেশনের মধ্যে ও ডুবে থাকে। দু’টো সমস্যাই ওর মধ্যে প্রকট , দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন।এই কথা আগেও বলেছি।প্রয়োজন হলে হসপিটালে ভর্তি করে ট্রিটমেন্ট করতে হবে। আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে ভালো হবে।আমি যতটা ভেবেছিলাম নিপার অবস্থা আরো খারাপ।তবে আপনি কোন চিন্তা করবে না। ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।
নূরজাহানকে দেখেই মনু মিয়া দৌড়ে এসে বলল-
—খালাম্মা আপনে আসছেন?
—না না আমি তো আসি নাই, আমার ভুত আসছে।
—না মানে খালাম্মা আপনে আসবেন জানি না, হঠাৎ আসলেন?
—আমার ছেলের বাড়িতে যখন ইচ্ছা আসবো,ঢোলডক্কর বাজাইয়া সবাইরে জানান দিতে হইবো?
—প্রত্যেক বার আপনি আসার আগে স্যার বলে রাখেন আমাকে,এই বার বলেন নাই তো ,এই জন্য জিজ্ঞেস করি আর কি।
—এই বার তোমার স্যার নিজেই জানে না আমাদের আসার খবর। আচ্ছা মফিজরে একটু ফোন দেও। জিনিস পত্রগুলি নামাও গাড়ি থাইকা।তোমার খালুর হাতে ব্যথা ,উনারে হাত লাগাইতে দিও না।
এইবার আদনানের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
—এই যে তুমি চল আমার সাথে,পরে তো হাতের ব্যথায় আবার ও আ করতে থাকবা।
আদনানের বাবা ,সালাম সিকদার। খুব নম্র,নরম মনের মানুষ।ধমক দিয়ে কথা বলতে তিনি জানেন না।সেই কাজটা অবশ্য নূরজাহান পূরণ করে দেন।কোন অভিযোগ করার মত ব্যবহার কখনো স্ত্রীর সঙ্গে করেননি।সব সিদ্ধান্ত নূরজাহানের উপরেই ছেড়ে নিশ্চিন্তে আছেন।কথা বলেও যে খুব একটা লাভ হতো সেটাও না কিন্তু এই ব্যপারেই নূরজাহান সব সময় অভিযোগ করেন।’সব দায়িত্ব আমার ওপরই,আর কেউ দেখার নাই।’
নূরজাহান বেগম বললেন-
—মনু মিয়া তোমার সাথে জরুরি কথা আছে ,
এক ফাঁকে উপরে আইসো।
চলবে—
ফাহমিদা লাইজু
৯ম পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1204181843430174/