কেন এমন হয় পর্ব – ১১

#কেন এমন হয়

পর্ব – ১১

আহনাফ তার দাদুর মোবাইল থেকে আদনানকে কল দিল। দাদা- দাদু এসেছে এই খবরটা সে খুশিতে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাবাকে জানালো-
—বাবা, দাদা- দাদু এসেছে তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো।বাড়ি থেকে অনেক অনেক কিছু এনেছে।
নূরজাহান ও ছেলের সঙ্গে কথা বললেন-
—হঠাৎ কইরা আইসা পরলাম।রহিম রেন্ট এ কার থাইকাই মাইক্রোবাস ভাড়া করছি।কোন সমস্যা হয় নাই।আব্বা তাড়াহুড়া কইরা অফিস থাইকা আসার দরকার নাই, আমরা তো আছিই। কাজ সাইরা আস্তে- ধীরে বাসায় আস।

মোবাইল রেখে আদনান খুব অবাক হলো।আম্মা তো না জানিয়ে কখনো আসেন না। নিশ্চয়ই এবার বিশেষ কোনো কাজ সম্পন্ন করতে এসেছেন।যেসব চিন্তা অন্য কারো মাথায় সহজে আসবেনা, আম্মার মাথায় সেগুলো সব সময় ঘোরাফেরা করে, কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান বের করে ফেলেন এক নিমেষে।
আদনান ভাবে তার আম্মা এখনকার সময়ে জন্মালে এবং সুযোগ সুবিধা পেলে জীবনে সংসার ধর্ম পালন করা ছাড়াও কোন না কোন বিষয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারতেন। তবে আম্মা খুব ভালো আছেন, তার নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। আর সেই সাম্রাজ্যের তিনিই একমাত্র অধিপতি।

মনু মিয়া আসলো,নূরজাহান তাকে সব কিছু বুঝিয়ে বললেন, আগামী শুক্রবার বিকেলে কমিউনিটি স্পেসে, বিল্ডিং এর সবাইকে নিয়ে মিলাদের ব্যবস্থা এবং কয়েকজন হাফেজ কে বলে কোরআন খতমের ব্যবস্থা করতে ।
মনু মিয়া এ সব দায়িত্ব পালন করতে পারবে কিনা বারবার জিজ্ঞেস করলেন। মনু মিয়া তাঁকে আশ্বস্ত করল। তার ভাস্যমতে-
—খালাম্মা কোন চিন্তা করবেন না,এইটা কোন ব্যাপারই না।মনে করেন যে আপনার কাজ হয়ে গেছে।বিল্ডিয়ের সবার কাজ তো আমাকেই করতে হয়।সব সমস্যার সমাধান তো এই মনু মিয়াই করে।
—ঠিক আছে,কোন কিছুর যেন উল্টাপাল্টা না হয়।

নূরজাহান, মফিজ আর শাপলাকে বললেন-সবগুলো বস্তা খুলতে-ফল,সবজি,মাছ যা কিছু এনেছেন বিল্ডিয়ের সবার বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। তিনি যখনই আসেন এটা করেন।

হিয়া অভ্যাসবসত বলল-
—খালাম্মা আগে খেয়ে নেন।
—হায় হায় বেটি আমি কি এখনো তোমার খালাম্মা লাগি?আম্মা ডাকবা,বুঝলা আম্মা।
হিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো।
হিয়া আগে থেকেই নূরজাহানকে ভয় পায়। তাঁর সামনে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না।মনে মনে বলতে লাগল,’আল্লাহ রক্ষা করো।’

রাতে নূরজাহান উঠে দেখেন আদনান সোফায় শুয়ে আছে। খুব স্বাভাবিক গলায় নুরজাহান জিজ্ঞেস করলেন-
—আব্বা এইখানে শুইছ কেন? রুম গিয়া ঘুমাও।
—আম্মা সমস্যা হবে না,এখানেই ঘুমাতে পারব।

আদনান যেই রুমে ঘুমাতো সেখানে আম্মা-আব্বা থাকবেন।
—তোমার কাছে কোন কিছুর ফিরিস্তি জানতে চাই নাই, রুমে গিয়া ঘুমাও।
—আদনান উঠে বেড রুমে গেল। হিয়াকে বলল,নিচে কিছু বিছিয়ে দিতে। আহনাফ তখন ও ঘুমায়নি।ও বলল-
—বাবা আমার সাথে ঘুমাও।
হিয়া বলল-
—আপনি আহনাফের সাথে ঘুমান আমি নিচে শুয়ে পরবো।
—না খামমনি তুমিও আমার সাথে ঘুমাবে। তোমরা দুজন দুই পাশে আমি মাঝখানে ঘুমাবো।

শোয়ার পর হিয়ার ঘুম আসছে না, খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। আহনাফ ঘুমিয়ে গেলে হিয়া উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আজকের আকাশ একেবারে পরিষ্কার, তারাদের দেখতে খুব ভালো লাগছে। পায়ের আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আদনান আসছে।
—আহনাফ ঘুমিয়ে গেছে, এখন আমি নিচেই শুয়ে পরবো, তুমি গিয়ে ঘুমাও।আম্মার জন্য সোফায় ঘুমাতে পারছি না আর ছেলের জন্য নিচে।
যাও শুয়ে পর গিয়ে।
—আমার ঘুম আসছে না। এখানে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে ভালো লাগছে।
—আমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল তাই না?
—আপনি শুধু শুধু নিজেকে অপরাধী মনে করবেন না তো ,যা কিছু হয়েছে সেটাই আমাদের নিয়তি।
—ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু কর, ভালো লাগবে।
—যাবো।
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ থাকার পর ,হিয়া বলল-
—কফি খাবেন?
—তোমার এখনো এই অভ্যাস আছে? মাঝরাতে কফি খাওয়া?
—এখন রাতে খুব একটা কফি খাওয়া হয় না।
— তুমি যদি খাও আমার জন্য হাফ কাপ করতে পারো।
আদনানের এমনিতেই রাতে খুব একটা ঘুম হয় না, এখন কফি খেলে একেবারেই ঘুম চলে যাবে কিন্তু হিয়াকে মানা করলে কি মনে করবে,তাই খাবে বলল।

আদনান অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও হিয়ার দেখা নেই। খোঁজ নিতে রান্না ঘরে গিয়ে দেখে হিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
—হিয়া হিয়া বলে ডাকলেও ,হিয়া কোন উত্তর দিলো না,তাই আদনান কাঁধে হাত রেখে আবার বলল-
—হিয়া
এবার হিয়া কেঁপে উঠলো আর ফ্লোরে বসে পড়লো। আদনান ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো-
—কি হয়েছে,বল কি হয়েছে?
হিয়ার কাথে রাখা আদনানের হাতের উপর নিজের হাতটা দিয়ে চেপে ধরল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল-
—আপু কত না যন্ত্রনা পেয়ে মারা গেছে,ইস কি যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। আপু , আমার আপুর চেহারাটাও বোঝা যাচ্ছিল না।এই রান্না ঘরেই এই ঘটনা ঘটেছে আমি এখানে এসে এটা কিভাবে সহ্য করবো?

আদনানেরও সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।হিয়াকৈ টেনে উঠিয়ে বারান্দায় নিয়ে, চেয়ারে বসিয়ে দিল আদনান।
—গ্যাস সিলিন্ডার এখন তো নিচে গ্যারাজে থাকে,নিচ থেকে পাইপ দিয়ে লাইন করা হয়েছে ,উপরে গ্যাস আসার। তুমি ভয় পেয়ো না,শান্ত হও।
এত দিনে হিয়া একবারের জন্যও রান্নাঘরে ঢুকেনি, ইচ্ছে করেই যায়নি,শাপলাই সব কাজ করেছে।

এক সময় হিয়ার কান্না থামলো, তখন বুঝতে পারলো আদনান তার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কাছে।হিয়া প্রায় দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল।

একটা জোরে চিৎকারে মায়ার ঘুম ভেঙে গেল। বুঝতে পারছিলেন না চিৎকারটা কোথা থেকে আসছে।মা মা বলে জোড়ে ডেকে উঠলো নিপা।মায়া দৌড়ে গেলেন নিপার রুমে।মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললেন-
—মা আমার কি হয়েছে?এই যে আমি।
নিপা কাঁপছে আর বলছে-
—বাবা আমাকে কেন মারছে? আমি কি অন্যায় করেছি ?
—তুই স্বপ্ন দেখেছিস মা।তোর বাবা এখানে নেই, কেউ নেই এখানে।
—আমি লাইট জ্বালিয়ে দেই।
—দেখ কেউ নেই।স্বপ্ন দেখেছিস।এই নে পানি খা।
নিপা এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করলো।মায়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
—মানুষ অবাস্তবকে স্বপ্নে দেখে আর আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তবকে দেখি।বাবা নামক পশুটা আমাকে যেভাবে মারতো সেটা দেখে তুমি সহ্য করতে কিভাবে?
—সহ্য করতে পারতাম না,তাই দুরে দাঁড়িয়ে কাঁদতাম।
—তুমি কিংবা আপু কখনো আমাকে অন্যায়ভাবে শাসন করার জন্য কোন প্রতিবাদ করনি।আর এটা করেছ তোমাদের নিজেদের স্বার্থে।
মা তোমাকে এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না,তুমি যাও তো,চলে যাও এখান থেকে।
নিপা অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
মায়ার বুক হাহাকার করে উঠলো।
—আমার ভুল হয়েছে, অনেক বড় ভুল হয়েছে। অনেক আগেই তোর বাপের সাথে সম্পর্ক শেষ করে ফেলার দরকার ছিল। বুঝতে পারিনি।
ভয় পেয়েছি এই ঘুনেধরা সমাজকে। মানুষের কথাকে। আমাদের সমাজে একজন মেয়েকে এমনিতেই কত রকম সমস্যা আর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আর যদি হয় ডিভোর্সি তাহলে তো কথাই নেই।তাদের সমাজের বাইরের মানুষ মনে করা হয় , খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। মানুষের কথার অত্যাচার তো আছেই , কিছু পুরুষ শকুনের চোখ দিয়ে গিলে গিলে খায়।প্রতিটা পদক্ষেপে বিপদ,‌অপমান আর অত্যাচার সইতে হয়।
তোদের দুই বোনকে নিয়ে একলা পথ চলার সাহস পাইনি, আমার পরিবারের কারো সাপোর্টও পেতাম না ।
—তোমার এ সব কথা আমার কাছে অসহ্য লাগছে। যে কারণ তুমি দেখাচ্ছ, এসব কারণ অনেক মেয়েরা তোয়াক্কা করে না, এই যে এত অত্যাচার সহ্য করেছো, তবুও তো তোমার স্বামী থাকল না অন্য মহিলাকে বিয়ে করে চলে গেলো পাঁচ বছর আগে। আমার এখন মনে হয় ওই লোকটা আরো আগে চলে গেলো না কেন?
মা প্লিজ তুমি যাও তো , এখানে থাকলে আর একটা কথাও বলবে না।
মায়া মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন নিপা ঘুমিয়ে গেছে। এত কষ্ট করে ঔষধ খাওয়াতে হয়! না খেলে একদম ঘুমায় না।
ছোট বাচ্চার মত জড়িয়ে ধরলেন নিপাকে। তাঁর চোখে ঘুম আসছে না কিছুতেই।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

১০ম পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1204872040027821/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here