কেন এমন হয় পর্ব – ১২

#কেন এমন হয়

পর্ব – ১২

নূরজাহান বের হয়েছেন বিল্ডিংয়ের সবার সঙ্গে দেখা করার জন্য ।একে একে সবার বাসায় যাবেন। আহনাফ আর শাপলা ও সাথে গিয়েছে। বারান্দায় একা একা বসে বিষণ্ণ বিকেল হিয়ার মনকে আরো বিষণ্ন করে তুলছে।

মোবাইল স্ক্রলিং করতে করতে এক সময় ফিল্টার মেসেজগুলো ওপেন করল,দেখেই চোখ এবং মন অবিশ্বাসে ছেয়ে গেল। এই কয় দিনে আরজুর অনেক মেসেজ জমা হয়েছে।
‘হিয়া কেমন আছ?’

‘কোন রিপ্লাই দিচ্ছ না কেন?’

‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।’

‘এখন আমরা কাছাকাছি থাকি, ইচ্ছে করলেই যে কোন সময় দেখা করতে পারি।’

‘জানালে না তো কিছু।’

‘তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ?’
‘আমাকে ভুলা কি ভাবে সম্ভব?’
‘মানুষের প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারে?’

‘তোমার সাথে দেখা করতে চাই।যেখানে বলবে সেখানেই দেখা করবো।’
‘জানিও’

হিয়া কি করবে বুঝতে পারছে না, আরজুর অনেকবার বেড়ে গেছে।মানা করার পর ও কিভাবে সাহস হয়? আরজুর এত সাহস?
হিয়া তারাতাড়ি সিমিকে ফোন দিল।সব শুনে সিমি বলল-
—আরজু ভাইয়ের এত সাহস সেটা তো জানা ছিল না।তুমি দেখ আর কি কি মেসেজ দেয়।
—তার সাথে আমার প্রেম ছিল মাখামাখি , বারবার এটা বোঝাতে চাচ্ছে কেন? কোনদিন তো মনের ভাব প্রকাশ করাই হয়নি।তাহলে?
—আপু শোন বেশি বাড়াবাড়ি করলে আদনান ভাইকে জানাও।
—এই সব কথা কিভাবে বলবো?কি মনে করে আবার?
—আরে না, আদনান ভাই কিছুই মনে করবে না,উনি খুবই ভালো মানুষ, বরং উনি জানলে একটা পারফেক্ট সলিউশন দিতে পারবেন।
কথা শেষ হয়নি তখনো,সিমির মা সায়মা এসে বললেন-
—কে ফোন দিসে?হিয়া?দে দে আমি কথা কই একটু।
—কেমন আছ মা?চাচির কথা ভুইলাই গেছ! তোমার মা ,মানে ভাবিও বলতেছিল খুব একটা ফোন কর না,ভাবি ভাবতেছে তুমি সবার উপরে মনে হয় রাগ কইরা আছ।
—না না চাচি কারো উপরে রাগ না,আসলে কথা বলতে ইচ্ছা করে না।
—মাগো যার কপালে যা লেখা আছে তাই হইবো,তুমি যদি মন খারাপ কর, আমাদের খুব অপরাধী মনে হয়।
এর পর সাধারণ কথাবার্তা বলে ফোন রেখে দিল।

নূরজাহান নিপাদের বাসায় ঢোকার আগে আহনাফ বলল-
—দাদু ,পঁচা আন্টিদের বাসায় যাবো না।
—দাদাভাই এই ভাবে কথা কইতে হয় না।
—দাদু তুমি আবার পঁচা করে কথা বলছ।কইতে বলতে হয় না,বলবে যে-বলতে হয় না।
— ঠিক আছে আর ভুল হবে না।
মায়ার সাথে কথা বলতে বলতে নিপার কথা জিজ্ঞেস করলেন নূরজাহান।
মায়া বললেন,নিপা ঘুমাচ্ছে।

সাজিয়াদের বাসায় যাওয়ার পর, কথার ঝুড়ি শেষই হতে চাচ্ছে না।
নিপার প্রসঙ্গ টেনে আনাতে অনেক কিছু খোলাসা হলো-
—খালাম্মা নিপা মেয়েটা একটু কেমন যেন!রিয়ার সাথে খুব খাতির ছিল।আমি যদি বলতাম একে সহ্য কর কিভাবে?রিয়া বলতো,’একজন মানুষ বাসায় আসে, কিভাবে মানা করি?আর সব মানুষ তো সমান না।’আমি বলতাম,’যে কোন সময় চলে আসে তোমার বাসায়, আদনান ভাই বাসায় আছে ,কি মনে করবে, কিছুই তোয়াক্কা করে না,এটা কেমন কথা?মানুষের প্রাইভেসি বলে তো একটা কথা আছে!’রিয়া হেসে উড়িয়ে দিত আমার কথা।
খালাম্মা আমি এই মেয়ের সাথে পাঁচ মিনিট এক নাগাড়ে কথা বললে বিরক্ত হয়ে যাই, জানিনা রিয়া ওকে কিভাবে সহ্য করতো!

সেদিনের ঘটনা শাপলা,সাদিয়াকে বলল।
তিন জনে আলোচনা চলল,হিয়ার সাথে এই সব ব্যবহারের মানে কি?একটা উত্তরই পাওয়া যায়,সেটা হলো,নিপা হয়তো আদনানকে পছন্দ করে।এই কারনেই কি শুধু মাত্র রিয়াদের বাসাতেই আনাগোনা ছিল?সবাই একমত ,এটাই আসল ঘটনা, আর এই কারনেই হিয়ার সাথে আদনানের বিয়ের কথা শুনে এমন করেছে।

সাজিয়া বললো-
—মাঝে মাঝেই উপরে ভাঙচুরের শব্দ পাই, রাগ উঠলে নিপা ঘরের জিনিসপত্র হাতের কাছে যা পায় তাই ভাঙচুর করে। নিপার মা এ সম্বন্ধে কখনো কিছু বলেন না, শুধু বলেন ,’রাগ বেশি তো মেয়েটার, কি যে করি? তোমাদের খুব সমস্যা হয়, কিছু মনে করো না মা।’মায়া আন্টির মুখের দিকে তাকালে খুব খারাপ লাগে, অসহায় মনে হয় তাঁকে।
—সন্তানের সমস্যায় বাবা-মা অনেক সময় খুব অসহায় হয়ে পরে,চোখে অন্ধকার দেখে। আমার মনে হয় কি মা,নিপারে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।
—এই কথা তো মুখ ফোটে বলা যায় না খালাম্মা,কি না কি মনে করে।
—সেইটাই তো।তবে হিয়ার সংসারে যেন কোন সমস্যা না করতে পারে এই ব্যপারে তোমারে খেয়াল রাখতে হইবো,এই কষ্টটা তোমারে করতে হইবো মা।
—কি যে বলেন খালাম্মা,এতে কষ্টের কি আছে?আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি যখন এসব জানতে পেরেছি তখন ব্যবস্থা একটা নিবোই।
—আর একটা কথা মা…কথাটা শেষ না করে নূরজাহান উসখুস করতে লাগলেন।
—খালাম্মা আপনি নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারেন।
—আদনান আর হিয়া দুইজনেরই এই বিয়েতে মত ছিল না, দুইজনেই তো তাগোর প্রিয় মানুষরে হাড়াইছে,।ভোলাটা এত সহজ না, কিন্তু কারো জন্য কষ্ট পুইশা রাইখা তো আর জীবন চলে না। এখন ওরা স্বামী-স্ত্রীর মতো না, বুঝতেই তো পারতেছ কি বলতে চাই।
—জী খালাম্মা বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ওদের একটু সময় ও দেওয়া উচিত। দুজনের বুঝা-পরা হোক আগে। সম্পর্ক ছিল একরকম এখন অন্য রকম।একটু সময় তো লাগবেই।
—সেইটা আমিও বুঝি গো মা, তুমি শুধু একটু মাঝে মাঝে হিয়াকে এটা সেটা বলে বুঝিও,সরাসরি কিছু বলার দরকার নাই। একটা মেয়েরে আল্লাহ যেই ক্ষমতা দিসেন,সেই ক্ষমতার বলেই হিয়া সব কিছু ঠিক কইরা ফেলতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
—সেইটাই খালাম্মা,সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না।
—দাদাভাই কোথায় তোমাদের খেলা শেষ হইলো ,চল বাসায় চল। সাজিয়া তোমার দুইজনকেও নিয়া যাই?
—না খালাম্মা এখন থাক, অনেকক্ষণ খেলা হয়েছে,একটু পরে ওদের পড়াতে বসাবো। পড়ার কথা শুনে রিদভী,অভির মন খারাপ হয়ে গেল।
—দেখলেন খালাম্মা , সারাদিন খেলা করলেও খেলা শেষ হয় না ওদের, পড়ার কথা শুনেই মন খারাপ হয়ে যায়!
—কি করবো বল,বাইরে গিয়া খেলার জায়গা পায় না,ঘরে বইসা বইসা খেলায় কি বাচ্চাদের মন ভরে?
—আচ্ছা তোমাদের মন খারাপ করতে হবে না,পড়া শেষ করে ঐ বাসায় গিয়ে আহনাফের সাথে খেলা করো।
—আচ্ছা আসলাম তাইলে।
—আচ্ছা খালাম্মা,এখান থেকে এখানে প্রতিদিন আসবেন, আমার খুব ভালো লাগে আপনার সাথে কথা বলতে ।
দরজার সামনে কথা শুনে হিয়া দরজা খুলে দিল। সাজিয়ার সাথে হাসি বিনিময় হলো।

নূরজাহান বাসায় ঢুকেই হিয়াকে বলল-
—শুনছ , তোমার ছেলে আমাকে কথা শিখায়, বলতে বলতে নূরজাহান হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগলেন।
তোমার শ্বশুর কই,ঘুমায়?এই লোকের আর ঘুম কমলো না।হাসতে হাসতে রুমে যেতে লাগলেন।
শাপলা বলল-
—ভাবি দেখছেন, খালাম্মা হাসলে কি সুন্দর লাগে! আমার জীবনে কয়েকবারই শুধু উনারে এইভাবে হাসতে দেখছি। ভাইজান দেখতে হইছ একবারে মায়ের মত কিন্তু স্বভাব পাইছে বাপের মত।

হিয়া শুধু হু হু করছিল ।ওর মাথায় ঘুরছিল, তোমার ছেলে-তোমার শ্বশুর এই কথাগুলো।যেই কথাগুলো হিয়ার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এবং অনভ্যস্ত।

আদনান অফিসের স্টাফ বাস দিয়েই অফিসে যাতায়াত করে। অনেকক্ষণ জ্যামে আটকে আছে বাস। বাসে অনেকে অনেক কিছু নিয়ে গল্পে মেতে আছে। আদনানের মাথায় ঘুরে ফিরে চিন্তা আসতে লাগলো- হিয়া রান্না ঘরে খুব ভয় পায় ,কি করলে ওর মন থেকে ভয় দুর হবে? তার বাসায় দূর্ঘটনা না ঘটলে, সিলিন্ডার গ্যারাজে রেখে নিচ থেকে পাইপের মাধ্যমে গ্যাস রান্নাঘরে সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা এত সহজে হতো না। যে কোন একটা কাজ করাতে গেলে ফ্লাট ওনার দের কয়েক দফা মিটিং করতে হয়, একেকজনের মত একেক রকম,সবাই একমত হওয়াও যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।এই কাজটাও শেষ পর্যন্ত হলো ,সবার টনক নড়লো , তার আপনজনের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কেন ? তার জীবনেই কেন ঘটলো এই দূর্ঘটনা?কেন জীবন দিতে হলো রিয়াকে-বাবুকে?

মনু মিয়া লোকটাকে চিনতে পারলো না।সে কিছুতেই লোকটাকে ঢুকতে দিবে না,কারণ লোকটা তার পরিচয় দিচ্ছে না। অদ্ভুত লোকটার ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল আর দাড়ি-গোফে মুখ ঢাকা।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

১১তম – পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1205570409957984/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here