কেন এমন হয় পর্ব – ১৩

#কেন এমন হয়

পর্ব – ১৩

গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে যে এত বড় দূর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই কথা কি এত সহজে ভুলা যায়?সেই মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় একসাথে রিয়া আর বাবুর চলে যাওয়াটা ছিল সবার জন্যই কষ্টের। ওদের কথা মনে করে এখনো অনেকের চোখের কোনে পানি চিকচিক করে উঠলো।

রিয়া আর বাবুর রূহের মাগফিরাত কামনা করে সবাই দোয়া করলো। নূরজাহান দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে অনেক কথা বললেন-কিভাবে হিয়া এবং আদনানের বিয়েটা হলো ,আহনাফের কথা চিন্তা করেই দুই পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা করা হলো।সবার শেষে সবাইকে ওদের জন্য দোয়া করতে বললেন ।
এর পর সবাই ওদের শুভেচ্ছা জানালো।সবার সাথে সবার অনেক আলোচনা হলো। বিল্ডিং এর সবাই আসলেও নিপাদের বাসা থেকে কেউ আসেনি।

মনু মিয়া বার বার বলছিল-
—আপনি কি কথা বলতে পারেন না?বললে সমস্যা কি, আপনার নাম কি,কয় তলায়,কার কাছে যাইবেন?এই সব না জেনে তো আপনাকে আমি ঢুকতে দিতে পারি না।
আশপাশের লোকজন জমা হলো কিছু।
সবাই যখন নিশ্চিত লোকটা হয়তো কথা বলতে পারে না।কেউ কেউ বলল,আহারে বেচারা বোবা-কালা মানুষ ,বোঝাতে পারছে না কোথায় যেতে চায়।
লোকটা হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো। মনে হল এতক্ষণ সে খুব মজা পেয়েছে মানুষের এসব বিষয়গুলো দেখে। সে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল-
—পঞ্চম তলায় যে মায়ারা থাকে তাদের বাসায় যাব। মনু মিয়া চিনতে পারল না। আবার লোকটা বলল –
—আরে চিনলে না ? মায়া হচ্ছে নিপার মা ।
—জী চিনতে পারছি।

মনু মিয়া ইন্টারকমে কল দিও পঞ্চম তলায়।
মায়া ভেবে পেল না কে হতে পারে , হয়তো গ্রাম থেকে কেউ এসেছে ।
ভিজিটর রেজিঃ খাতায় লোকটা সাইন করে উপরে উঠে যেতেই মনু মিয়ার মনে হলো লোকটা খুব চালাকি করে নিজের নামটা গোপন করেছে,সাইন দেখেও বুঝতে পারলো না কি নাম।
এই লোকের ভাবসাব দেখে মনু মিয়া শুধু যে অবাক হলো তাইনা, নিজেকে নির্বোধ মনে হতে থাকলো তার। তার ধারণা স্পষ্ট হলো আর যাই হোক লোকটা স্বাভাবিক না।
যাই হোক খালাম্মা তো বলেছে লোকটাকে যেতে দিতে।

দরজা খুলে মায়া চিনতে পারলো না। দাঁত বের করে বিশ্রী ভাবে হেসে যখন বলল-
—আমাকে চিনতে পারছ না মায়া?
—গলা শুনে মায়ার বুক কেঁপে উঠলো, অস্পষ্ট স্বরে মুখ দিয়ে বের হলো-
—নিরার বাবা?

বশির সোফায় বসে বসে পা নাচাতে নাচাতে বলতে শুরু করল-
—তোমার রান্নার হাত আগের মতোই আছে।পেট ভরে খেয়েছি, বখতিয়ারের মা আবার এত ভালো রাঁধতে পারে না।ও বখতিয়ারকে তো চিন না। আমার ছেলে বখতিয়ার। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির নামানুসারেই ছেলের নাম রেখেছি । দেখে নিও উনার মতোই আমাদের বখতিয়ার সাহসী হয়ে উঠবে।যাই হোক এখন আসল কথায় আসি।
এই বাসাটা চমৎকার হয়েছে।ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খুব সুখেই আছে তোমরা তাহলে।আর ঐ দিকে,আমার পরিবার নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।বাসা ভাড়াও দিতে পারি না। চিন্তা ভাবনা করলাম। এখানে তো দুই রুম পরেই থাকে । সামনের মাসে আমরা এখানে এসে উঠবো।
অনেক সময় ধরে মায়া কথা শুনে যাচ্ছে। বশির বিভিন্ন কথা বললেও সে তেমন কোন কথা বলেনি।
বুঝতে চাচ্ছিলো বশিরের হঠাৎ আগমনের কারন।
এই কথা শুনে,মায়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো দেখে বশিরের মুখ হা হয়ে গেল।
—তুমিও কি তোমার মেয়ের মত পাগল হয়ে গেলে নাকি? এভাবে হাসছ কেন?
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে মায়া বললেন-
—অনেকটা সেই রকমই।
—আমরা আসছি এক তারিখ তাহলে।
—এটা আমার বাসা, আমার বাবার ওয়ারিশ বিক্রি করে আমি এই ফ্ল্যাট কিনেছি।
—সেইটা তো জানি, কয়েকদিন আগেই শুনলাম এক জনের কাছে। তার পর মনে হলো তোমার জিনিস মানেই হলো আমার জিনিস।আমি শুধু শুধু কষ্ট করবো কেন? তুমি তো ছেলে জন্ম দিতে পারলে না, এখন শরিফার পেটের ছেলে হলেও বখতিয়ার আসলে তো তোমারই ছেলে। তোমার বয়স হয়েছে ,তুমি আরাম করে বসে থাকবে শরীফা তোমার সব কাজ করে দিবে।

মায়ার মুখ শক্ত হয়ে গেল-
—এই মুহূর্তে আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও। তুমি যা যা অন্যায় আমাদের সাথে করেছ,কিছুর হিসাব নেয়া হয়নি।
—আমি কোন অন্যায় করিনি কারো সাথে।এখন এক সাথে আমরা সবাই মিলেমিশে থাকবো।
—কত বড় নির্লজ্জ, আমার বাসায় আমার সামনে বৌকে নিয়ে থাকতে চাস,কত বড় নির্লজ্জ!
—এটা কেমন ব্যবহার!স্বামীকে তুই তুকারি কর?
—আমি বলছি এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও।
—এতক্ষণ ভালো ব্যবহার করলাম দেখে বেশি বার বেড়ে গেছস, এখনই উচিত শিক্ষা দিচ্ছি।
নিপা দরজা খুলে বের হয়ে রান্নাঘর থেকে সবজি কাটার ছুরি নিয়ে এসে বলল-
—মা বলছে কথা কানে যাচ্ছে না, এখনই বের না হলে যে কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো।আমাকে তো পাগল বল, জানই তো পাগল যে কোন কিছু করতে পারে।
এবার বশির একটু দমে গিয়ে দরজার কাছে এগোলো। দরজা খুলে বের হয়ে বলল-
—তোদের দেখে নিব।
একটু আগে যা ঘটে গেল , মায়ার মনে হচ্ছে অবাস্তব।কতটা নির্লজ্জ,কতটা নীচ হলে এমন কথা বলতে পারে! আজকেই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
—তুমি ঐ লোকটাকে আদর করে খাওয়াচ্ছিলে?
—টেবিলে খাবার দেয়া ছিল আমাদের জন্য, নিজেই সেগুলো খেয়েছে। রাক্ষসের মতো দুই জনের খাবার একাই খেয়েছে।
—এখন কি করবে মা?
—প্রথমে থানায় গিয়ে জি ডি করবো।পরে একজন ভালো উকিলের সাথে কথা বলতে হবে, কিভাবে একে খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স দেয়া যায় সেই ব্যপারে কথা বলতে হবে।
—সেই তো করছ মা তবে শুধু শুধু পানি ঘোলা করলে।
বশির আসার পর থেকেই নিপা দরজা আটকে বসে ছিল। বাইরের সবকিছু তার কানে আসছিল।মায়ার গায়ে হাত তুলতে উদ্ধত হলে নিপা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনি। সত্যিই তার ইচ্ছে করছিলো একটা কিছু করে ফেলতে লোকটাকে।
মায়া ভাবতে লাগলেন আসলেই তো, শুধু শুধু এতটা দিন ঐ লোকের সাথে সম্পর্কটা ঝুলিয়ে রেখেছেন, অনেক বার নিপু বললেও মায়া আমলে নেননি।আরো আগেই ফয়সালা হয়ে গেলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।

হিয়ার ইচ্ছে করছিল যে কোন জায়গায় লুকিয়ে পড়তে।সবার সামনে নিজেকে এক অদ্ভুত জন্তুর মতো লাগছে,সবার দৃষ্টি ওর উপরে। সবাই কত উপদেশ দিচ্ছে,কত সহমর্মিতা জানাচ্ছে।সে জানে এর মধ্যে অনেকেই আছে উপরে উপরে ভালো দেখাচ্ছে,এই বিয়েকে সাধুবাদ জানাচ্ছে কিন্তু আড়ালে তারাই অনেক খারাপ মন্তব্য করবে।হিয়ার এই এক বড় সমস্যা,আড়ালে কে কি বলল সেটা চিন্তা করে।সেটা চিন্তা করার কোন দরকার আছে?আড়ালে তো কত লোক কত কিছু বলে।কারো কারো কাজই,অন্যের পেছনে লাগা, আবার সামনে আসলে এরা খুব ভালো ব্যবহার করে।

অনেকে বলাবলি করলো নিপাদের বাসা থেকে কেউ এলো না।না জেনে অন্যের সম্পর্কে কত কিছু বলে ফেলা যায়!নিপাদের বাসায় কি ঘটে গেল সেটা সবার কল্পনার ও বাইরে।

সুষ্ঠুভাবে সব কিছু হয়ে গেল নূরজাহানের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আদনান মোটেও খুশি হয়নি।সে বলেই ফেলল-
—আম্মা আমাকে একবার বলার প্রয়োজন ও মনে করলেন না।
—না জানানোতে সমস্যা কি হইছে? রিয়া আর বাবুর জন্য দোয়া পড়ানোর দরকার ছিল আর বিল্ডিং এর সবাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি তোমাদের বিয়ের কথাটা।
—কেন জানিয়ে কি হবে?
—তোমার মোটা মাথায় তো কিছু ঢুকবে না। নিজের বৌকে অন্য মানুষ অপমান করে যাবে,তাতে তোমার কি?
—মানে কি?কে কাকে অপমান করলো?
—ঐ যে নিপা মেয়েটা হিয়ারে কত কি বইলা গেল,এমন কইরা আরো অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারে, তাই তোমাদের সবার কথা সবার জানা দরকার আছে। যাই কিছু করি, অনেক চিন্তা ভাবনা কইরাই করি।
আর একটা কথা আগামীকাল আমরা চইলা যাবো ব্যবস্থা কর।

হিয়া কে নিপা কথা শুনিয়েছে, এই সব কথা তো সে কিছুই জানে না।হিয়া কে জিজ্ঞেস করা দরকার।

সিমি কল করেছে-
—আপু আব্বার ঢাকায় একটা কাজ আছে,ঢাকায় তোমার বাসায় আসবে।
—কাক্কু আসবেন? সত্যি!কবে আসবেন? তুইও সাথে চলে আয়।
—আব্বা দুই/তিন দিনের মধ্যেই আসবেন।আমি আসবো?
—সমস্যা কি?
—আচ্ছা আম্মাকে বলে দেখি। আমার ও খুব আসতে ইচ্ছে করছে।তুমি একটু আম্মাকে বল না।
—আমি পরে চাচিকে কল করে বলবো।
—আচ্ছা আপু আরজু ভাই কি আরো মেসেজ দিয়েছে?
—হু, অনেকগুলো।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here