কেন এমন হয় পর্ব – ১৪

#কেন এমন হয়

পর্ব – ১৪

আহনাফ ক্লাসে ঢুকার আগে হিয়াকে বার বার বলল-
—খামমনি তুমি কিন্তু আমাকে রেখে চলে যেও না। তুমি বসে থাকবে।
—ঠিক আছে বাবা আমি ওয়েটিং রুমে বসে থাকবো,তুমি ক্লাসে কোন দুষ্টমি করো না,ঠিক আছে?
—ঠিক আছে।
আহনাফের সাথে পড়ে অনেক বাচ্চার মায়েদের সাথে হিয়ার পরিচয় আছে। রিয়ার বাসায় যখন হিয়া আসতো, কখনো কখনো হিয়া আহনাফকে স্কুলে আনা নেয়া করতো।সেই ভাবেই পরিচয়।রিয়া তাদের ভাবি ডাকতো,সে জন্য হিয়াও ভাবি বলতো তাদের।
এখন সেই ভাবিরা রিয়াকে ঘিরে ধরলো, সমবেদনা জানাতে লাগলো।এক সময় কথা উঠলো,’পুরুষ মানুষ বিয়ে তো করবেই তখন ছেলেটার কি হবে?’
হিয়া আর আদনানের বিয়ের কথা তারা কেউ জানে না।হিয়া ও কোন ভাবে সেই কথা বলতে পারলো না,বলতে চেয়েও বলতে পারলো না,কেউ যেন গলা আটকে ধরে আছে।

এত এত কথার ভীড়ে গত রাতের ঘটনায় হারিয়ে গেল হিয়া-
—নূরজাহান কাপড় গোছানো শুরু করেছিলেন। আহনাফ সেটা দেখে জিজ্ঞেস করলো –
‘দাদু কাপড় গোছাও কেন?’
‘দাদাভাই কালকে আমরা বাড়িতে চলে যাবো?’
এই কথা শুনেই আহনাফের খুব মন খারাপ হলো। কিছুতেই দাদা-দাদুকে যেতে দিবে না।দাদা তাকে প্রতিদিন হাঁটতে নিয়ে যায়,খেলা করে,দাদু তাকে গল্প শোনায়। নূরজাহান ,আহনাফের মন খারাপ দেখে তাদের যাওয়া দুই দিন পিছালেন।

—এই হিয়া কি এত ভাবছ?একদম মন খারাপ করো না তো। মানুষ কি সারাজীবন বেঁচে থাকে? একদম মন খারাপ করে থেকো না বলছি।
পারুল ভাবি মানুষটা খুব ভালো।কথা বলে খুব সুন্দর করে।
—না না ভাবি মন খারাপ করছি না। ভাবছিলাম আহনাফের কথা।ওর দাদা-দাদু চলে যাবে শুনে কি মন খারাপ হলো,সে জন্য উনারা বললেন আরো দুই দিন থাকবেন কিন্তু তখন ও আহনাফ এমনটাই করবে।কি ভাবে যে বোঝাবো?
— হিয়া একটা কথা বলবো ভাবছিলাম তোমাকে।
—বলেন ভাবি।
—আমার পরিচিত একজন মেয়ে আছে।বিয়ে হয়েছিল, স্বামী ভালো না,ডিভোর্স হয়ে গেছে,তুমি যদি বল কথা বলতে পারি।
—কি কথা ভাবি?
—বিয়ের কথা?
—কার বিয়ে?
—আহনাফের বাবার বিয়ে।মেয়েটা খুব ভালো।
আহনাফকে আদর করবে।মেয়েটা আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়।আমি ভালো ভাবেই চিনি।

এই কথা শুনে হিয়ার খুব হাসি পাচ্ছিলো।অনেক চেষ্টা করেও হাসি চাপাতে পারলো না।
হিয়া কি বলবে ভাষাও খুঁজে পেলো না।জীবনে আর কত কিছু শুনতে হবে?
পারুল ভাবি অবাক হয়ে বলল-
—হাসছ কেন?
হাসি থামিয়ে যে নয়জন ভাবি বসেছিল, সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল-
—ভাবিরা আপনাদের কিছু কথা বলি।আহনাফের বাবা বিয়ে করেছে।

কোন পরিস্থিতিতে হিয়া আর আদনানের বিয়েটা হলো সবকিছু খুলে বলল হিয়া। এখানেও কয়েক জন ভালো হয়েছে বলল, কয়েকজন মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানালো,আর কয়েকজন চুপ করে থাকলো পেছনে প্রাণ খুলে গীবত করার জন্য।

সবাইকে নিজের বিয়ের কথা জানিয়ে অনেকটা হালকা লাগছিল।মনে মনে ভাবলো যে কোন পরিস্থিতি তো নিজেকেই সামলাতে হবে,ভয় বা লজ্জা পেলে চলবে না।

স্কুল ছুটির পর এক ভাবি একটু দুর থেকে হিয়াকে দেখিয়ে অন্য একজনকে বলল-
—পুরুষ মানুষ কেমন দেখ ,বৌ মরার কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলে।আর এই মেয়েটাই বা কেমন
নাচতে নাচতে বোন জামাইকে বিয়ে করে ফেলল!
হিয়া ঐ ভাবির কাছে গিয়ে বলল-
—ভাবি আপনার অবিবাহিত বোন আছে?
—না তো,আমিই সবার ছোট।
—তাহলে তো খুব চিন্তার কথা।আল্লাহ না করুন আপনার কিছু হয়ে গেলে , আপনার স্বামী কাকে না কাকে বিয়ে করে আনবে, আপনার দুই বাচ্চার অবস্থাটা তখন কি হবে? পুরুষ মানুষের বিশ্বাস আছে,বৌ থাকতেই বিয়ে করে ফেলে,মরলে তো কথাই নেই।
সেই মহিলা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল-
—আমাকে মরার অভিশাপ দিচ্ছ?
—আমি অভিশাপ কোথায় দিলাম। জীবন-মৃত্যুর কথা কে বলতে পারে? অনেকে এভাবে বলার আগে ,নিজেকে ঐ স্থানে বসিয়ে চিন্তা করবেন।আন্দাজে মামুষের সম্বন্ধে উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।যে সমস্যার ভেতর দিয়ে যায় শুধু সেই বোঝে তার কষ্ট।

এর মধ্যেই হিয়ার পক্ষ নিয়ে অনেকে কথা বলতে লাগল।অনেকে আবার বিপক্ষে।
হিয়া আর কথা না বাড়িয়ে আহনাফকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলো।আজ তার নিজেকে নিজের কাছেই অপরিচিত লাগছে।এভাবে কারো সাথে কথা বলতে পারবে তার ধারণার বাইরে ছিল।

আসলে মানুষ জানেই না তার নিজের কতটা ক্ষমতা।
পরিস্থিতিই মানুষকে তার নিজের ক্ষমতাটা ভালো করে চিনিয়ে দেয়, শুধু প্রয়োজন একটু সাহসের।

ভাত খাওয়ানোর সময় আহনাফ একটু খেয়েই বলল-
—খামমনি আমি আর খাবো না।
—আর দুই বার খাও বাবা,এর পর আর খেতে হবে না,প্লেটে তাকিয়ে দেখ অল্প একটু খেয়েছ।

নূরজাহান হঠাৎ এসে বললেন-
—কি গো হিয়া এত দিনেও মা ডাক টা শিখাইতে পারলা না?এইটা কেমন কথা?
হিয়া কোন উত্তর দিল না।সে এত দিনে একবার ও আহনাফ কে বলেনি মা বলে ডাকার জন্য।

আহনাফ যখন আধো আধো কথা বলতে শিখলো-তখন হিয়া বলতো ,’বাবা সোনা বল তো খালামনি’ এভাবে বলতে বলতে একদিন হিয়ার সাথে সাথে আহনাফ বলল-খামমনি খামমনি।এই কথা নিয়ে সবাই কি হাসাহাসি করছিল।এর পর থেকে খালামনি হয়ে গেল খামমনি।কত মধুর কত ভালোবাসাময় এই ডাক খামমনি।
যেটা আর কারো মুখ থেকে শোনা হবে না।এই ডাকটাও মুছে যাবে!

নূরজাহান আহনাফকে বললেন-
—দাদাভাই, আম্মু /মা/মামনি এইগুলার মধ্যে কোনটা তোমার ভালো লাগে?
—মামনি।
—তাহলে হিয়াকে এখন থাইকা মামনি ডাইকো।
—কেন?
—খালামনি তো মায়ের মতোই,তাকে মা ডাকা যায়।অনেক বাচ্চারা তো খালামনিকে ছোট মা বলে।ঠিক আছে।বলবে তো?
—আচ্ছা বলবো।

হিয়া রাগ হচ্ছিল, নূরজাহান মা ডাকা নিয়ে এত অস্থির হয়ে পরেছেন কেন? নূরজাহান ভাবছেন , অবিবাহিত মেয়ে , ভার্সিটিতে পড়ে কখন আবার কোন মতি হয়, অন্য কাউকে পছন্দ করে বসে, যত তারাতাড়ি সম্ভব আদনানের সাথে ভাবভালোবাসা হয়ে গেলে ভালো।
হিয়া খেয়াল করেছে আদনান অফিস থেকে আসলে নূরজাহান হিয়াকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আদনানের কাছাকাছি রাখতে চান,ব্যপারটা খুব হাস্যকর লাগে তার কাছে।

রাতে আহনাফ ঘুমিয়ে গেলে, বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে থাকা হিয়ার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আদনান এসে পাশের চেয়ারটাতে বসলো। সারাদিন কেমন কাটলো নানান কথা জিজ্ঞেস করতে করতে, নিপার ব্যপারটা জিজ্ঞেস করলো।হিয়া বলল-
—নিপার কথা বাদ দিন,আজ স্কুলের একটা মজার ঘটনা বলি আপনাকে। বলার আগেই হিয়া হাসতে শুরু করলো ।
আদনান কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল-
—তুমি হাসতে থাক, আমি গিয়ে ঘুমাই।
হিয়া আদনানের হাত ধরে হাসতে হাসতেই বলল-
—আরে বসেন,এখন আপনার জন্য আমার বিয়ের ঘটকালি ও করতে হবে!
—মানে কি?
—আহনাফের ক্লাসমেটের মা পারুল ভাবি আপনার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিল।মেয়ে তার আত্মীয় হয়, খুব ভালো, ভদ্র,শান্ত ,আহনাফ কে খুব আদর করবে।

শুনে আদনান একটুও হাসলো না,চোখ-মুখ শক্ত করে বলল-
—এর পর তুমি কি বললে?

আদনানের এমন আচরণে হিয়ার হাসি বন্ধ হয়ে গেল।সে মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বলল-
—আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছি সবাইকে।এটা শুনে একজন বলল,বোন মরে যেতেই আমি নাচতে নাচতে আপনাকে বিয়ে করে ফেলেছি।
—কি আশ্চর্য এ সব কি ভাবে বলতে পারে মানুষ? আহনাফকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দিব।ঐ স্কুলে আর যেতে হবে না।
—আপনি কয় জায়গায় যাওয়া বন্ধ করবেন,কত জনের মুখ বন্ধ করবেন?নিপা যে আচরণ করলো সে দিন!
আদনান বুঝতে পারলো হিয়া কাঁদছে।
আদনান হিয়ার মুখ তুলে বলল-
—প্রয়োজন হলে এই বাসা বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাবো।প্লিজ তুমি এভাবে কেঁদো না।আমি তো জানি তুমি রাজি ছিলে না। তুমি যদি অন্য কাউকে পছন্দ কর সেটাও আমাকে বলতে পার ।বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করার দরকার নেই।আমি সব ব্যবস্থা করবো।
এবার হিয়া রেগে গিয়ে বলল-
—আপনি কি সিনেমা পেয়েছেন?বিয়ে হলো,পরে তার স্বামী প্রেমিকের কাছে তুলে দিতে চায়। জীবনটা সিনেমা? আমার প্রেমিক আছে এই কথা আপনাকে কে বলল?
আদনান হিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে লাগলো।
হিয়া আদনানের স্পর্শে গভীর মমতা টের পেলো।প্রতিটা মেয়ে পুরুষের স্পর্শে বুঝতে পারে সেটা কি ধরনের স্পর্শ।যত দিন আদনানের কাছাকাছি হয়েছে হিয়া ,সব সময় বুঝেছে এক মমতাময় স্পর্শ,সেখানে কামুকতার কোন ছিটে ফোটা নেই।
হিয়ার মন আদনানের জন্য এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠলো।
আদনান আবার বলল-
—হিয়া তুমি কোন সংকোচ করো না।আমাকে বললে আমি কিছুই মনে করবো না। যে ভাবে সমস্যার সমাধান হয় সেই ব্যবস্থা করবো।গত রাতে দেখলাম কার মেসেজ দেখে তুমি খুব অস্থির হয়ে গেলে।
—আমাকে নজরদারিতে রাখছেন?
—ছিঃ ছিঃ এ সব কি বল? আমার ঘুম আসছিলো না। বুঝতে পারলাম তুমিও ঘুমাও নি। মোবাইল নিয়ে কার মেসেজ পড়ে অস্থির হয়ে উঠে গেলে। আমি ইচ্ছে করেই কিছু জিজ্ঞেস করিনি,যদি কিছু মনে কর।
—একটা ব্যপার নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে হবে।
—বল।
এর পর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আরজুর ব্যপারটা বলল হিয়া।
—আরজুর ব্যপারটা কিছুটা আমি জানি।
হিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—কিভাবে?
—রিয়া বলেছিল।
হিয়ার জীবনের সব কিছুই রিয়ার সাথে বলতো হিয়া,সেই হিসেবে আদনান তো জানতেই পারে।
—কিন্তু হিয়া তোমার, আরজুর প্রতি শুধুই ফিলিংস ছিল ,তাহলে এমন ঘনিষ্ঠতার কথা কেন বলছে কেন আরজু? নিশ্চয়ই কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে। তুমি কোন চিন্তা করো না,ব্যপারটা আমি দেখছি।এবার এই সব ফালতু চিন্তা রেখে ঘুমাতে চল।আরেকটা কথা হিয়া,নিপার ব্যপারটা পরিষ্কার করে বললে না তো।
—সেটা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।আরেক দিন বলবো।
—আচ্ছা ঠিক আছে।

নিপার খাওয়া- দাওয়া প্রায় বন্ধ। সারাদিন বিছানায় মরার মত পরে থাকে।মায়া এবার সমাজের চিন্তা বাদ দিয়ে মেয়েকে বাঁচানোর চিন্তা করতে লাগলেন।ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে হসপিটালে ভর্তি করার কথা চিন্তা করলেন। মেয়েটার দিকে তাকালে বুক ফেটে যায়।ওর জীবনের এই অবস্থার জন্য তিনি নিজেও কি দায়ী না? এমন একজন নেই যে তার পাশে দাঁড়াবে,একটু সাহস দিবে,একটু ভরসা করার জায়গা ও নেই তার।নিরাকে এই সব ব্যপার কিছুই বলেন না মায়া। দূরে বসে তাদের জন্য দুঃচিন্তা করার কি দরকার।নিরা অন্তত নিজের জীবনটা নিয়ে ভালো থাকুক।
মায়া দুচোখে যখন শুধুই অন্ধকার দেখছেন , তখন যেন আলোর ছোট্ট একটা কনা চোখে পরলো।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here