#কেন এমন হয়
পর্ব – ১৫
আরজু তারাতাড়ি করে বের হওয়ার আগে কনাকে বলল-
—আগামীকাল আমরা বাড়ি যাবো, লাগেজ গুছিয়ে রেখো।
—আমি যাবো না, আমার বান্ধবীর বাচ্চার জন্মদিন
আগেই বলে রেখেছে, ওখানে যেতে হবে।
—তাহলে শুক্রবার যাই চল।এমন তো না,কালকেই যেতে হবে?
—শুক্রবারেও আমার কাজ আছে।
আরজু কিছুক্ষণ কনার দিকে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল।
কনা আগে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনলে নেচে উঠতো এখন কোন আগ্রহ দেখায় না, বিভিন্ন কারণ দেখায় না যাওয়ার জন্য।
বেশ কিছু দিন থেকেই আরজু লক্ষ্য করছে কনা অন্যরকম ব্যবহার করছে ওর সাথে। কিছু হলেই ঠেস দিয়ে কথা বলে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
কনার বাবা-মা, বোনদের সাথে আবার ঠিকই স্বাভাবিক ব্যবহার করছে।আরজু বুঝতে পারছে না এই পরিবর্তনের কারণ।
আরজুর চাকরিটা কনার বাবা হারেস আলির জন্যই
হয়েছে।কনার সাথে বিয়ের আগেই চাকরি হয়েছে তার।কিভাবে হয়েছে সেটা আরজু জানতে চায়নি কখনো।
শ্বশুরের গাড়িতে করে অফিসে যাচ্ছে সে। শ্বশুর বাড়িতে থাকে।এই সব শর্ত সাপেক্ষেই আসলে বিয়েটা হয়েছিল।আরো কি কি শর্ত ছিল সে জানতে চায়নি,জানার ইচ্ছে ও হয়নি। এখন অবশ্য কনার কথায় সে সব শর্তের বিষয় বেরিয়ে আসছে।
আরজুর আব্বা যখন বলেছিলেন ,’বিয়ার পর তুই শ্বশুর বাড়িতেই থাকবি।হারেস আলির তিন মেয়ে কোন ছেলে নাই,তোরে উনার ছেলে বানাইয়া রাখবো।’
একটা কথাও আরজু সেদিন বলেনি। তার শুধুই মনে হচ্ছিল আব্বা কিভাবে এমন একটা সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে নিল। তার বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে সব সময় আম্মা-আব্বার অভিযোগ, অবাধ্য সন্তান হিসেবে।বড় ভাই নিজের পছন্দে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে।আব্বা-আম্মার কোন খবর নেয় না।এই একটা কারনেই সে নিজের নামটা অবাধ্যের খাতায় লিখাতে চায়নি। আরজুর ছোট তিন বোন,দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত আস্ত একটা বাংলা সিনেমা যেন।
সব বাবা-মাই সব সন্তানকে ভালোবাসে কিন্তু কখনো কখনো কোন এক সন্তানকে বলির পাঁঠা হতে হয়। আরজুর এখন নিজেকে বলির পাঁঠা মনে হয়।
এ সব কথা মনে করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস আরজুর বুক থেকে বেরিয়ে গেল। বিয়ের পর এক-দেড় বছর খুব ভালোই কেটেছে।
কনার বান্ধবীর বিয়েতে আরজুকে দেখে কনার যে আকর্ষণ জেগেছিল মনে সেই আকর্ষণের বন্যাতেই ভেসে বেড়াচ্ছিল দুজন।
কনাদের বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িতে আরজুর দম বন্ধ লাগে। বাড়ির সামনের সুন্দর সুন্দর ফুলের সুবাস ও তার নাকে লাগে না।কনার বাবা এই বাড়ি করেছেন কয়েক বছর হলো,এর আগে তারা নাকি বারোশ স্কয়ারফিটের একটা ফ্লাটে থাকতেন।এত বিত্ত বৈভবের দেখা কনার বাবা হারেস আলি হঠাৎ করে কিভাবে পেয়েছেন সেই রহস্য আরজু জানে না জানার প্রয়োজন ও বোধ করে না।
দুজনেই রেডি হচ্ছে দেখে নূরজাহান বললেন-
—আদনান তুই আজকে অফিসের গাড়িতে না গিয়া হিয়ার সাথে যা।এত দিন পরে মেয়েটা ভার্সিটিতে যাইতেছে, ওরে পৌঁছাইয়া দিয়া পরে তুই চইলা যাইস।
কথা বললে আম্মা শুনবেন না আরো কথা বাড়বে আর দেরি হবে।তাই এক সাথেই বেরিয়ে গেলো দুজন।
তারা শুধু দুইজন এই প্রথম পাশাপাশি রিকশায় বসে যাচ্ছে। আরেকদিন আহনাফ ছিল সাথে।আজ হিয়ার খুব সংকুচ হচ্ছিলো। আদনানের হঠাৎ মনে হলো কত সহজেই এক জনের জায়গা আরেকজন নিয়ে নিতে পারে।হিয়া তার স্ত্রী,আহনাফের মা এটাই এখন কঠিন সত্য।
হঠাৎ হিয়া বলল-
—আদনান ভাই..
সে আর কথা শেষ করতে পারেনা।
আদনান হেসে বলে-
—এখনো আদনান ভাই?
হিয়া ও হেসে ফেলল-
—অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। বলছিলাম কি, আপনার অফিসের সামনে আপনি নেমে গেলে,পরে আমি একা চলে যাবো। শুধু শুধু উল্টা যাওয়ার দরকার নেই।
—আম্মা শুনলে রাগ করবেন।
—উনি তো জানেন না,আমাকে দিয়ে আবার আপনাকে উল্টো আসতে হবে।কোন সমস্যা হবে না।
কিছু টাকা বের করে আদনান হিয়াকে দিল।
—লাগবে না, আমার কাছে আছে।
—রেখে দাও তো,কাজে লাগতে পারে।আর শোন ক্লাস কয়টা পর্যন্ত?কল দিলে ক্লাসে থাকলে ধরতে না পারলে পরে কল বেক করো। না হলে টেনশনে থাকবো।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
এটা সেটা আরো অনেক কিছু বলল আদনান।
—আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার অফিসের কাছে এসে পরেছি।
—আচ্ছা সাবধানে যেও।
নিপাকে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। বাবার বাড়ির গ্রাম থেকে একজন মহিলা সাহায্যকারী পেয়েছেন
মায়ার ভাবী যে এতটুকু উপকার করেছে ,সেটাই অনেক।
বার বার কাঁদছিল নিপা- বাসাতেই থাকতে চেয়েছিল সে।
মায়ার বুক ফেটে যাচ্ছিল।ওর ছোট বেলার কথাগুলো খুব মনে পরছে। দ্বিতীয়বার মেয়ে হয়েছে শুনে বশির হাসপাতালে ও যায়নি। সিস্টার যখন কোলে এনে দিল নিপাকে,দেখে মন জুড়িয়ে গিয়েছিল,কি সুন্দর ফুটফুটে ছিল।নিরা বারবার বোনকে দেখে আর বলে ,’বাবু ,মা ছোট বাবু,আমাকে দাও ,কিছুতেই শোনবে না কথা ,নিরাকে বেডে বসিয়ে নিরার কোলে দিতেই হলো নিপা কে।নিরা কি যে আদর করলো বোনকে। তখন মায়ার মা ছিলেন হাসপাতালে।আহ্ মা চলে গেছেন পর পারে।
নিরার কথা মনে হতেই মনে পড়লো আগামীকাল নিরার ডেলিভারির তারিখ।
মোবাইল নিয়ে কল করলেন নিরাকে।
ফোন রিসিভ করলো নিরার জামাই সালেহ।রাগে গজগজ করতে লাগল যেন-
—কেন ফোন করেছেন? গত কালই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে, সিজার করতে হবে। সিজার করতে এতগুলো টাকা লাগবে,হবে আবার মেয়ে।আব্বা খুব রাগারাগী করছে আর বলছে-‘কোন্ ফকিরের মেয়েকে বিয়ে করেছিস,কোন খরচ পত্র দিচ্ছে না।’
মায়া কঠিন গলায় বললেন-
—আমার পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব না।
—তাহলে আপনার মেয়েকে এসে নিয়ে যান।
—নিরু তোর কি হয়?তোর সাথে তো নিরুর বিয়েই দিতে চাইনি।বোকা মেয়েকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না।
—তুই তুকারি করছেন কেন?
—শোন, ভালো করে আমার কথা শোন,আমি এখন থানায় যাচ্ছি। তোদের নামে জি ডি করবো।যদি আমার মেয়ের কিছু হয়, তোদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলাবো।কি ভেবেছিস আমি একা মানুষ কিছুই করতে পারবো না?নিরু সুস্থ হলে ওর সাথে কথা বলবো ,ও যদি না চায় তোর মত ছোট লোকের সাথে সংসার করবে না, আমার কাছে নিয়ে আসবো।
সালেহের গলা দমে এলো।নরম গলায় বলল-
—এই সব কি বলছেন? আমার সরকারি চাকরি চলে যাবে,আব্বার মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে প্লিজ থানায় কমপ্লেইন করবেন না।
—যারা মেয়ে হবে শুনে খরচ দিতে পারবে না বলে,টাকা চায় তাদের আবার মান সম্মান কি?
সালেহ বুঝতে পারলো না এত দিন যেই নরম শাশুড়িকে দেখে এসেছে, হঠাৎ এমন গরম হলো কি করে?কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে,এই ধমকি শুধু ভয় দেখানোর জন্যই না।কাজেও প্রমাণ দেবেন তিনি।
এবার খুব নরম গলায় সালেহ বলল-
—আম্মা আমার ভুল হয়েছে,ক্ষমা করেন।দোয়া করেন কোন সমস্যা যেন না হয়।
—হু,বলে মায়া ফোন রেখে দিলেন।
এত দিন কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে নিরাকে। শ্বশুর বাড়িতে মেয়েরা অত্যাচারিত হয়,এর জন্য মেয়েদের মা-বাবা শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অতিরিক্ত সম্মান আর মাথায় তুলে যে রাখে, এটাও একটা কারন।মেয়ের সুখ হবে ভেবে কত কিছু করে তারা। তারা কেন বোঝে না যারা অসভ্য মানুষ তাদের কোন কিছু দিয়ে,কোন কিছু করে তাদের মন ভেজানো যায় না। মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছোটা।
না আর সহ্য করবেনা মায়া। নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি হতে দেবেন না।নিরাকে আর অত্যাচারিত হতে দেবে না।একটা কথা ভেবে পান না, তার নিজের জীবন, তার সন্তানদের জীবন এমন বিষাদময় কেন হলো?একটু সুখ,একটু ভালোবাসা পাবার যোগ্য কি ছিলেন না?
এইদিকে আবার উকিলের সাথে কথা বলতে হবে, বশিরের ব্যপারে। মায়ার পরিচিত একজন ,ভালো একজন উকিলের সন্ধান দিয়েছে।
উকিলের চেম্বারে অনেকক্ষণ সময় ধরে সহকারী একজন তার ঘটনাটা লিখলো এর পর নিয়ে গেল মুল ব্যক্তির কাছে। উকিল সাহেব সব কিছু পড়লেন এবং ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন করলেন,লিখাটার ভেতরেই কাটাকাটি, আঁকি বুকি করলেন।। অবশেষে মুখ তুলে মায়ার দিকে তাকিয়ে , সহকারীকে চলে যেতে ইশারা করলেন।
—যদি ভুল না হয়ে থাকে আপনি কি মায়া,আনন্দপুর হাই স্কুলের মায়া।
মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রায় তারই সমবয়সী লোকটার দিকে।
—আমি মায়া কিন্তু আপনি?
—চিনলে না তো? চেনার কথাও না।তোমার ক্লাসমেট ছিলাম, সবুজ।
মায়া ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতি খুঁজতেই সবুজকে খুঁজে পেলেন,এক চির চঞ্চল কিশোর এর শুকনা-পাতলা চেহারার সবুজকে।যার সঙ্গে এই পেঁকে যাওয়া চুল, দাঁড়ি আর ভূরি বের হয়ে যাওয়া সবুজের মিল খুঁজতে লাগলেন।
—সবুজ!
আহনাফ তার দাদুকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো-
—দাদু মামনি কখন আসবে?
নূরজাহান , আদনানকে কল করে জানালেন হিয়া ফোন ধরছে না। আহনাফ বারবার হিয়ার কথা বলছে।
হিয়া ক্যাম্পাস থেকে বের হতেই দেখে আদনান দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে মেহেনূর ও আছে।মেহেনূর হিয়ার হাতে জোরে চাপ দিল যেন বোঝাতে চাইলো,’কি রে তোর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছে না,দেখ নিতে চলে এসেছে।’ হঠাৎ হিয়ার খুব লজ্জা করতে লাগলো।
চলবে…
ফাহমিদা লাইজু
১৪তম-পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1207905756391116/