#কেন এমন হয়
পর্ব – ২
আদনান আর হিয়ার বিয়ের আলোচনা পাঁচ কান হতে সময় লাগলো না।সবার মতো আদনান আর হিয়ার কানেও উঠলো কথাটা।হিয়া সরাসরি ওর আম্মাকে মানা করে দিল।যেই বুড়ি দাদি প্রথমে কথাটা উঠিয়েছিল তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলো হিয়া । শান্ত মেয়েটা যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো।
আম্মার উপর রাগ দেখিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল হিয়ার।আপুর মৃত্যুর পর এমনিতেই আম্মা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে।যেই খাবারগুলো আপু পছন্দ করতো সেগুলো দেখলেই বলেন,’আমার রিয়া এইটা পছন্দ করতো।’রিয়ার বাইম মাছ খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হইলো না, শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হইলো না ‘এই কথা বলে প্রায় সময় কাঁদতে থাকেন।
আদনান এই প্রস্তাব শুনে বলল,’এটা কিভাবে হয়? দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা চিন্তাও করতে পারি না।’
এত দিন একটা সম্পর্কের জালে আটকে থেকে নতুন করে আরেকটা সম্পর্কের জালে জড়ানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।
তবে বিয়ের মতামতের ব্যপারটা আর দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না।
হিয়ার সঙ্গে আদনানের বিয়ের কথা চলতে লাগলো।সবাই একটা ব্যাপারেই জোর দিল,সৎ মা আহনাফকে আদড় করবে কিনা সেটার তো ঠিক নেই।হিয়া আপন খালা হয়ে তো আর অত্যাচার করবে না , বোনের ছেলেকে নিজের সন্তানের মত ভালবাসবে।
অফিস থেকে ছুটি বাড়িয়ে বাড়িয়ে এক সময় আর ছুটি বাড়ানোর রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেল আদনানের। আহনাফকে রেখেই ফিরতে হলো ঢাকায়। নিজের বাসায় ফেরার সাহস হলো না আদনানের, চাচার বাসায় উঠলো। যতক্ষণ ব্যস্ত থাকা হয় ততক্ষণই দুঃখ ভুলে থাকা যায় বাকি সময়টা দুর্বিষহ । মাঝে মাঝে মনে আসে হিয়াকে কি আসলেই বিয়ে করা ঠিক হবে? সবাই যেভাবে প্রতিদিন ফোন করে করে একই কথা বলে যাচ্ছে, কতদিন আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে? ছেলেকে রেখে এসে কিছুতেই মন টিকছে না আদনানের, বুকের ভিতরে চিনচিন করে।মনে মনে বলে ওঠে,’আমার বাবাটা।’
হিয়াকে সবাই বুঝিয়েও লাভ হচ্ছে না।ওর অন্য কাউকে পছন্দ কিনা সেটাও বলছে না । ঘুম, খাওয়া কিছুরই ঠিক নেই।আজ ও ঘুম আসছে না হিয়ার।জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকায়।আজ মনে হয় পূর্ণিমা, চারিদিক ঝলমল করছে আলোতে।জানালার পাশেই দোলনচাঁপা গাছ, ঘ্রাণে পুরো ঘর ভরে গেছে। এই সুন্দর ঘ্রাণ মনটাকে আরো বিষাক্ত করে তুলল। এই দোলনচাঁপার গাছের সাথে যে স্মৃতিটা জড়িয়ে আছে সেটা কিছুতেই হিয়া মনে করতে চায় না, তবুও বর্ষায় হঠাৎ করে বৃষ্টি চলে আসার মত করে সেই স্মৃতি মনে চলে আসে।
হিয়ার জীবনে প্রথম যখন মনে বসন্ত এসেছিল , সেই রঙে, চোখ রঙিন স্বপ্ন দেখতে লাগলো-একজন মানুষকে ঘিরে ,সেই মানুটাই ছিল আরজু।হিয়াদের প্রতিবেশি।একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখলো আরজু অনেকগুলো ফুলের গাছ নিয়ে যাচ্ছে,হয়তো নার্সারি থেকে এনেছে বাড়িতে লাগাবে বলে। হিয়া,একটা গাছ দিতে বললে আরজু, হিয়াকেই বলল যেটা পছন্দ সেটা নিতে।হিয়া সবগুলো থেকে বেছে এই দোলনচাঁপা টা নিয়েছিল ।আর কিছু না বলে আরজু হন হন করে চলে গেল।হিয়ার খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছিল তখন।এই ছেলে কখনও তাকে বুঝলো না, কত দেমাগ দেখায়।হিয়া যে আরজুকে পছন্দ করে ,সেটা কি আরজু বোঝে না!নাকি বুঝতে চায় না।হিয়াকে দেখলেই আরজু মাথা নিচু করে থাকে ,হিয়া যা বলে সেটারই উত্তর শুধু দেয়।এর পর সরে পড়তে চায়,যেন পালিয়ে বাঁচে।
সকালেই এই দোলনচাঁপা গাছটা উঠিয়ে ফেলে দিবে হিয়া।আরজু এখন অনেক দূর-দূরান্তের মানুষ,সে তো কখনো তার কাছেরই ছিলই না তবে দূরের মনে করছে কেন, তার স্মৃতি কেন হিয়ার চোখে পানি আনবে?
এই পৃথিবীর সবার উপর হিয়ার অভিমান হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি রিয়ার উপর। কেন সে এভাবে অসময়ে চলে গেল! জীবনে বিয়ে করবে না প্রতিজ্ঞা করা হিয়াকে কেন বিয়ে করতে হবে ,বোনের স্বামী-ভাগনের বাবাকে? বোনের স্বামী হিসেবে আদনান চমৎকার মানুষ,কোনদিকে অপছন্দ করার মত না কিন্তু কিভাবে সম্ভব তাকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেয়া।সবাই কত সহজে চিন্তা করছে । নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে কি বাঁচা যাবে,নাকি মনকেই মেরে ফেলতে হবে?দুই বছরে তো নিজেকে সামলে নিয়েছিল এখন আবার নতুন আরেক পরীক্ষা।এ সব চিন্তা করতে করতে চোখ বেয়ে শুধু পানিই ঝরে।
সকালে দোলনচাঁপা গাছগুলো উঠিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে চ্যাপটা করছিল, মনের যত রাগ যেন ঝরে পড়ছিল গাছটার উপর।ঠিক তখনই আরজু এলো , পেছনে তার বৌ।
আরজুকে দেখে রাগের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো,হন হন করে হেঁটে চলে গেল হিয়া।
হিয়ার মা হেনা এগিয়ে এলেন-
—কবে আসছ তোমরা?
—এই তো চাচী গতকাল।
— তোমরা থাকবা তো কিছু দিন?
আরজুর বৌ রোজি বলল-
—জ্বী চাচী,আমরা আছি এক সপ্তাহ।চাচী হিয়ার বিয়ের কথা হইতে ছিল, তার কি খবর?
—ও তো রাজি হইতেছে না।
আরজুর মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।কত কিছুই হতে পারতো।হয়নি,হতে দেয় নি।সে সব কিছুই হিয়া জানে না।হিয়া ওকে পছন্দ করে সেটা আরজু ভালভাবেই জানতো,সে নিজেও হিয়াকে ভালোবাসতো। একদিন হিয়ার ছোট চাচা আরজুকে ডেকে বললেন,’আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি, ঐদিন দেখলাম হিয়ার সাথে রাস্তায় হাইসা হাইসা কথা বলতেছস, চুল তো এমনি এমনি পাকে নাই সবই বুঝি, ওর থাইকা দূরে থাকবি। আমাগো বংশের একটা মান সম্মান আছে। তুই বুদ্ধিমান ছেলে আশাকরি বুঝতে পারছস।’
সেদিনের পর থেকে আরজু যতটা সম্ভব হিয়াকে এড়িয়ে যেতে শুরু করল। অর্থবিত্ত সবকিছু থেকেই আরজুরা,হিয়াদের সমান না। এইসব কথা আরজুর আব্বা জানতে পারলে উপায় থাকবে না,দুই পরিবারের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি হবে শুধু।মনের লুকানো কথা মনেই দাফন হয়ে গেল।
হিয়া এসবের কিছুই জানেনা। আরজুকেই ভুল বুঝলো হিয়া।আরজুকে ভুল বোঝলে সমস্যা নেই,সব সময়ের চাওয়া হিয়া যেন অনেক সুখী হয।
এখন হিয়ার আম্মার কথা শুনে আরজু জোরে বলে উঠলো-
—হিয়ার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে চাচী?
তখনই হিয়া কোত্থেকে ঝড়ের বেগে এসে বলল-
—আমার বিয়ে নিয়ে আপনাকে কে মাথা ঘামাতে বলেছে? আপনাকে মতামত দিতে কে বলেছে?
কথাটা বলেই আবার ঝড়ের বেগে চলে গেল।
সবাই বুঝতে পারলো না কি হলো। হেনা বললেন-
কিছু মনে কইরো না তোমরা?সব কিছু মিলাইয়া ওর মেজাজ এখন খুব খারাপ।
গ্রামে কারেন্ট বেশির ভাগ সময় থাকেই না। গ্রামে রাত এগারোটা মানে অনেক রাত, চারিদিক শুনশান নীরবতা, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।হিয়া আস্তে আস্তে পায়চারি করছে,যেন আম্মা টের না পান, পায়ের আওয়াজ পেলেই আম্মা ডেকে বলবেন ,’হিয়া এখনও ঘুমাস না।’ আম্মা-আব্বার রুমের সামনে যেতেই হিয়ার কানে এলো-
—আমাগো কোন্ পাপের শাস্তি আমরা পাইতেছি গো। আমার ফুলের মত মেয়ে ক্যামনে পুইড়া মরলো?আরেক মেয়েরে ওর মতের বিরুদ্ধে বিয়া দেওয়া মানেও তো নিজ হাতে মাইরা ফেলা তাই না। তুমি এই বিয়া বন্ধ কর রিয়ার বাপ।
—এই গুলা বইলো না।আর কাইন্দো না। রিয়ার মৃত্যু এমনে হইবো এইটাই আল্লাহর লিখন তোমার-আমার কি করার আছে?হিয়া না চাইলে আদনানের সাথে বিয়া হইবো না।তবে নানা ভাইটার জন্যে মন কান্দে,ওর বাপ অন্য কাউরে বিয়া করলে সৎ মায়ের কাছে কেমনে না কেমনে থাকে? আমাদের রিয়ার চিহ্ন।আদনানের মাতো ছেলে লাখে একটা। হিয়া না চাইলে তো কিছু করার নাই। নিজের সন্তানের সন্তানের সুখটাই আসল।
এই দুজন মানুষের কথোপকথন শুধু হিয়া একাই শুনলো না,নানা-নানুর মাঝখানে শুয়ে আহনাফ ও শুনলো ,নানু ভেবেছিল সে ঘুমিয়ে গেছে ,আসলে সে ঘুমায়নি।
এর পরে কান্না জড়ানো কণ্ঠে আম্মা কি বলতে লাগলেন হিয়া আর বুঝতে পারলো না। নিজের রুমে গিয়ে খাটে বসে পড়লো,আম্মা-আব্বার প্রতি তার যে ধারণা জন্মেছিল তা এক নিমেষে দূর হয়ে গেল।নিজেকেই খুব স্বার্থপর মনে হতে লাগল।
ছোট্ট আহনাফের ঘুম ভেঙ্গে গেল সকাল সকাল। দৌড়ে হিয়ার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লো, গলা জড়িয়ে ডাকতে লাগল-
—খামমণি উঠ উঠ।
—কি রে বাবু সোনা আজ এত সকালে ঘুম ভাঙ্গল কেন তোমার?কয়টা বাজে?
—তুমি বাবাকে কেন বিয়ে করবে না?
এই কথা শুনে হিয়া শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।
—এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?
—কাল রাতে নানা- নানু যখন কথা বলছিল আমি সব কিছু শুনেছি।
—বড়দের কথা শুনতে হয় না বাবু।
—নানু ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে গেছি।আমি তো ইচ্ছে করে শুনিনি,মা আকাশের তাঁরা হয়ে যাওয়ার পর আমার ঘুম আসতে চায় না। কয়েকদিন থেকে তুমিও তো ঘুম পাড়িয়ে দাও না।
এত আদুরে গলায় কথা বলে আহনাফ,ওর কথা শুনলে আদড় করতে ইচ্ছা করে। এখন এই সব কথা শুনে হিয়ার চোখ ফেটে পানি বের হতে লাগলো। আহনাফকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
আহনাফ, হিয়ার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল-
— খামমণি তুমি কাঁদছ কেন?
—এমনি কাঁদছি সোনামণি।
আহনাফ দৌড়ে গিয়ে তার নানুকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো।
—কি রে কান্দস ক্যান? তুই না চাইলে আদনানের সাথে তোর বিয়া দিমু না,মা আমার , এই রকম করিস না।
—আমি রাজি বিয়েতে।আহনাফের মা হতে রাজি আছি।
অস্ফুট স্বরে নিজেকেই বলল আবার , শুধু আহনাফের মা হতে রাজি।
হিয়ার আম্মা একটু অবাক হয়েই বললেন-
—এত তারাহুরার কি আছে, চিন্তা ভাবনা কইরা সিদ্ধান্ত নেওয়া ভাল।
—আম্মা অনেক চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিলাম।
চলবে…
ফাহমিদা লাইজু
১ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1198804647301227/