কেন এমন হয় পর্ব-৩

কেন এমন হয়

পর্ব – ৩

আদনান ফোন রিসিভ করে হ্যালো বললেও, অপর প্রান্তের মানুষটি চুপ করে আছে। আদনান মোবাইল স্ক্রিনে আগেই দেখেছে হিয়ার কল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আদনান স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল-
—হিয়া কিছু বলবে?
—হু
আরো কিছুটা সময় কেটে গেল।
—কিছু বলতে চাইলে বলতে পার।
—আমি বিয়েতে রাজি,তবে শুধু মাত্র বাবুর মা হব, কোনদিন আমার উপর স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবেন না।যদি এই প্রস্তাবে রাজি থাকেন তবেই শুধু আমি রাজি।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে লাইন কেটে দিল হিয়া।
আদনান হিয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল, অনেকক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা আসলো মনে, ‘আমার সম্বন্ধে হিয়ার এই ধারণা।’
এখনই ফোন করে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন মনে করে,কল করলো একবার , রিং হলো কিন্তু রিসিভ করলো না হিয়া। আরো একবার কল দিতে যাবে তখনই আদনানের আম্মা নূরজাহান কল করলেন-
—আদনান তুই ছুটি নিয়া আয় , হিয়া রাজি হইছে আগামী মাসের পনের তারিখ বিয়ার দিন ঠিক করা হইছে।
—আমাকে না জিজ্ঞেস করে তারিখ ও ঠিক করে ফেলেছ আম্মা?
—ক্যান!তোর অনুমতি নেয়া লাগবো ক্যান?একজন রাজি হইছে এই বার তুই বুঝি বাগরা বাজাবি?বাচ্চাটার কথা চিন্তা আসে না,নিজেগো ফুটুংফাটং নিয়াই থাক।এক কাজ কর তোর ছেলে এইখানেই থাকুক,তুই ঢাকায় একলা একলা বইসা থাক।

আদনান বুঝতে পারলো আম্মা খুব রেগে গেছেন। এবার শুরু হবে একই কথা বার বার,সব শেষে কেঁদে কেঁদে পরিসমাপ্তি।
তাই আদনান তারাতাড়ি বলল-
—আম্মা কাল কথা বলি। অফিস থেকে ছুটি পাওয়া যাবে কিনা, জেনে তোমাকে জানাবো।

নূরজাহান ছেলের এই কথাকে সম্মতি ধরে নিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিলেন,যাক্ , সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।রিয়াকে এত মাখো মাখো পছন্দ না করলেও ,ওর জন্য মনটা কেমন করে ওঠে।আর নাতনি,যে কিনা জীবনের শুরুতেই ঝরে গেল!শেষ এসেছিল তিন মাস আগে ,সবার কোলে কোলেই রইলো, হাঁটতে শিখেনি সে,ছোট ছোট পা ফেলে বাড়িময় দৌড়াবে এটা দেখার ইচ্ছা পূরণ হলো না আর। এত বড় দূর্ঘটনায় মানুষিক আঘাত পাওয়া স্বাভাবিক কিন্তু সারা জীবন এই দুঃখকে আঁকরে ধরে রাখলে হবে নাকি? ছেলের এই সব আবেগ তিনি মা হয়ে কেন প্রশ্রয় দেবেন? একদিন আহনাফ বড় হয়ে যাবে,ওর আলাদা একটা জগত হবে,সেই জগতে সে ব্যস্ত হয়ে যাবে।তখন আদনান একা হয়ে পরবে , জীবনে একজন কথা বলার জন্য ও তো মানুষ দরকার হয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নূরজাহান এ সব‌ ভাবতে লাগলেন।

তাঁর ভাবনায় ছেদ পড়ল,কে যেন খুব আস্তে গেইট দিয়ে ঢুকে লেবুতলা দিয়ে দক্ষিণের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে। তিনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
—কে রে?
—আমি খালাম্মা, মফিজ।
—কি রে মফিজ,এত রাইতে আইলি? আবার চোরের মতো বাড়িত ঢুকস,ব্যপার কি?
—খালাম্মা বাজারে গেছিলাম,আইতে একটু দেরি হইয়া গেলো।
—এত রাইত পর্যন্ত বাজারে থাকস্! এত দিন বৌ বাপের বাড়ি পইড়া আছে ক্যান?সকালে গিয়া তোর বৌরে বাপের বাড়ি থাইকা নিয়া আসবি।

মফিজ আমতা আমতা করে বলতে লাগল-
—আমি তো শাপলারে আসতে বলতেছি,সে বলে আসবো না।
—আবার ঝগড়া-কাইজা করছস?দুই দিন পরে পরে তোদের এই ভাবসাব ভাল লাগে না।কাইল গিয়া নিয়া আসবি।বিয়া বাড়িত অনেক কাম আছে।
—ভাইজান কি রাজি হইছে? তাইলে তো খুশির খবর।
—আর একটা কথা,আমি যেন আর না শুনি বৌ রাগ কইরা বাপের বাড়ি গেছে।যাওয়ার সময় আমারে তো বলল,এমনেই বেড়াইতে যাইতাছে।এই যদি করস এই বাড়িততে বাইর হইয়া যাবি।ভাল কইরা কান খুইলা শুইনা রাখ এই সব তামশা এইখানে চলবো না।
—ঠিক আছে খালাম্মা।বলে মফিজ চলে গেল।

মফিজ শুয়ে আছে অনেকক্ষণ,বৌরে ছাড়া একলা, ঘরে তো ঘুম আসে না। এইবার শাপলার সাথে রাগটা বেশিই দেখিয়ে ফেলেছে।রাগে কষিয়ে চড় মেরেছিল গালে।টকটকা ফর্সা গালে আঙ্গুলের ছাপ পরে গিয়েছিল।এর পর আর একটা কথাও বলেনি বৌ টা। সামান্য ব্যপার নিয়ে এত রাগিয়ে দেয় শাপলা,মাথা ঠিক থাকে না।
নারিকেল গাছে উঠার সময় নতুন স্যান্ডোগেঞ্জিটা কেন খুলে নেয়নি মফিজ,কেন দাগ লাগালো, এই নিয়েই ঝগড়া শুরু হয়েছিল।
মনে মনে অনুতাপ হলেও এত দিন শাপলাকে আনতে যায়নি,নিজে ছোট হয়ে যাবে বলে,সে পুরুষ মানুষ না!
কিন্তু কাল তো যেতেই হবে। শাপলা না আসতে চাইলে কি করবে সে?ক্ষমা চাইবে?দেখা যাক,তখনেরটা তখন দেখা যাবে। যে ভাবেই হোক নিয়ে তো আসতেই হবে।না নিয়ে আসলে খালাম্মা রাগে তাকে বাড়ি থেকেই বের করে দিবে।এই বাড়িতে খালাম্মার কথাই শেষ কথা।খালাম্মা কে সে যেমন ভয় পায় তেমনি শ্রদ্ধা করে , ভালোবাসে।

এগারো বছর বয়স থেকেই এই বাড়িতে আছে মফিজ।মা-বাবা কোথায় আছে জানে না ,প্রথম প্রথম কিছু দিন মফিজের কাজের বেতন নিতে আসতো ওর মা, এই সূত্রে একটা সুতো বাঁধা ছিল ওর সাথে।পরে এক সময় সেটাও ছিঁড়ে যায়। এখন মফিজ মা-বাবার চেহারা ও মনে করতে পারে না।

খালাম্মা-খালু তার মা-বাবার চেয়েও বেশি। আদনানকে সে বড় ভাই মনে।আদনান , মফিজের চাইতে পাঁচ বছরের বড়। আদনান গ্রামে থাকলে সব কাজ ফেলে ওর পিছনে পিছনে থাকতে চায় মফিজ।হয়তো কিশোর বেলার সময়টায় ফিরে যেতে চায়। ছোট বেলায়, কিশোর বেলায় কেউ অবস্থা, অবস্থান এ সব বিচার করে না, আশেপাশের সবাই মিলে দল গঠন হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে অবস্থা, অবস্থান পাল্টে যায়,প্রয়োজনে অনেকে দূরে চলে যায় কিন্তু একসাথে সেই দূরন্তপনা ,কত মধুর স্মৃতি সবকিছু বার বার ফিরে আসে মনে।

ছোট বেলা থেকেই কাছের, দূরের সবাই মেয়েদের মনে বিভিন্নভাবে বিয়ের স্বপ্নের বীজ বপন করে দেয়।যখন হাঁটতে ও শেখে না তখন উড়না পড়িয়ে, বৌ সাজায়।এক সময় মেয়েরা বিয়ের সাজে নিজেকে দেখতে অপেক্ষা করতে থাকে। হিয়াও চাইতো লাল বেনারসী শাড়ি,গায়ে গয়না, হাত মেহেদির রঙে রাঙিয়ে ফুলে ফুলে সজ্জিত খাটে বসে বরের জন্য অপেক্ষা করতে।সেই স্বপ্নকে আরজু মেরে ফেলেছে।আর এখন যে বিয়ে নামক সন্ধিটা হবে এখানে বিয়ের সাজে সজ্জিত হবার প্রশ্নই উঠে না। কখনো কখনো কিছু মানুষের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়।

খুব নিরিবিলিভাবে বিয়েটা হয়ে গেলো, রিয়ার মৃত্যুর পাঁচ মাসের মাথায়। বধূ কিংবা বরের সাজে কেউ সজ্জিত হলো না, শুধু মাত্র একটা সম্পর্কের নাম দেয়ার লক্ষ্যেই একটা বৈধতা অর্জন।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here