কেন এমন হয় পর্ব-৪

#কেন এমন হয়

পর্ব – ৪

কাছের আত্মীয়- স্বজন অনেকে উপস্থিত থাকলেও ,সবাই অনেক চুপচাপ,প্রয়োজনে কথা বললেও সেটা ছিল মিনমিনে আওয়াজ ,কাজী সাহেবের কথাগুলোই শুধু স্পস্ট শোনা যাচ্ছিল। বিয়ে একটা আনন্দময় আর খুশির ব্যপার হলেও এখন সবার মন দুঃখে পরিপূর্ণ।

আদনান আর রিয়ার যখন বিয়ে হয়েছিল,এই বাড়িটা ছিল উৎসবে মুখরিত। মানুষগুলোর সাথে সাথে যেন প্রকৃতি ও খিলখিলিয়ে হাসছিল।একটা বিয়েতে যত আনন্দ,যত নিয়ম-কানুন, সবই হয়েছিল।কতটা আনন্দ আর উত্তেজনা ছিল আদনান আর রিয়ার মনে। রিয়ার লাজুক সেই মুখটা মনে হতেই, আদনানের মনে হলো এখনো তার পাশে রিয়া বসে আছে।নিজের অবচেতন মনেই আদনান তার পাশে তাকালো,রিয়া নেই ,কোলে আহনাফ বসে আছে।এটাই এখন চরম বাস্তবতা । রিয়ার সঙ্গে বিয়ের দিন একটা বার ও কি মনে হয়েছে,আজকের দিনের মত দিন কখনো সামনে এসে দাঁড়াবে?

মফিজ কয়েকবার চেষ্টা করেও আদনানের কোল থেকে আহনাফকে নিতে পারেনি। কি হচ্ছে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে না পারলে ও খুব শান্ত ভাবে বসে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে।কোন কারণ ছাড়াই যে নানু কাঁদছে,তাই নানুকে তার খুবই বোকা মনে হচ্ছে।

হিয়ার চাচাতো বোন সিমি পান আনতে গেল নারকেল-সুপারি বাগানে। কিছু সুপারি গাছের গোড়ায় পান গাছ লাগানো আছে।পানগাছগুলো তর তর করে বেয়ে উপরে উঠে গেছে।সিমির মা বলে দিয়েছেন সাতটা তাজা পান, পান গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে।এ গুলো দিয়ে হিয়ার নজর কাটাবেন তিনি। তাঁর ধারণা রিয়ার উপর কারো বদ নজর পরে গিয়েছিল,তাই তো এত অল্প বয়সে এত বড় দূর্ঘটনা ঘটলো যে ওর জীবনটাই চলে গেল।তাই তো তিনি হিয়ার উপর বদ নজর আর বিপদ কাটানোর সর্বাত্মক চেষ্টায় ব্যস্ত।

সিমি বাগানে ঢুকে একটা নারিকেল গাছে আরজুকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—আরজু ভাই আপনি এখানে কি করেন?
—আরজু বিষন্ন ভাবে উত্তর দেয় –
—কিছু না।হিয়ার বিয়ে পড়ানো কি হয়ে গেছে?
এবার সিমি রেগে বলে-
—আপনার জন্য কি বিয়ে বসে থাকবে?কি ভেবেছিলেন আপনার জন্য বিরহে কাতর হয়ে হিয়া আপু সারা জীবন চির কুমারী হয়ে বসে থাকবে ? আর আপনি বৌ নিয়ে ফূর্তি করে বেড়াবেন তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে।
—আরজু করুন চোখে সিমির দিকে তাকায়। তার মানে সিমি সব কিছু জানে।আর কিছু না বলে আরজু চলে যায়। তার মনের অবস্থা নিজের কাছেই অচেনা লাগছে। নিজের বিয়ের সময়ও এমন অস্থিরতা ছিল মনে, বিয়েটা করতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। বড়লোক বাবার মেয়ের জন্য প্রস্তাব পেয়ে আরজুর মা-বাবা কিছুতেই দেরি করতে চান নি।প্রথমে মানা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়।
আজ আরজু কয়েকবার হিয়াদের বাড়ির সামনে,পাশে ঘোরাঘুরি করেছে,এর পর বাগানে ঢুকে কতক্ষণ ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল মনে করতে পারে না।ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি, সাহস তার অবশ্য কোন দিন ও ছিল না।
হিয়া এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলেনি,পানি কি শেষ হয়ে গেছে!হিয়ার মা, আত্নীয়-স্বজনরা কাঁদছে। এমনকি বাবার চোখেও পানি।হিয়া অবাক হলো , এখন বিদায় বেলা , কেন তার চোখে পানি আসছে না!

একবার পেছন ফিরে তাকালো হিয়া, তখন বুকটা হু হু করে ওঠলো।সূর্য অস্ত যাবে এখনই, কেন এই সন্ধ্যায় তার বিদায় হচ্ছে?আম্মা তো সবসময় বলতেন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হতে হয় না। ভাবতে ভাবতেই টুপ করে যেন সূর্যটা ডুবে গেল।

আদনানদের বাড়িতে হিয়া অনেক বার এসেছে,তবে আজকের আসাটা অন্যভাবে আসা হলো।আজ এই বাড়িটা, বাড়ির মানুষ সবাইকে যেন অচেনা লাগছে। প্রতিবেশীরা অনেকেই এসেছে নতুন বৌ দেখতে।হিয়া কে দেখতে নতুন বৌয়ের মত লাগছে না। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলছে। নূরজাহান এসে সবার মুখ বন্ধ করে দিলেন।হিয়াকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলেন, এখানে কাছের আত্মীয় স্বজন বসে আছে।

নূরজাহান আহনাফকে বললেন-
—দাদাভাই আজ থাইকা হিয়া হইলো তোমার নতুন মা।
আহনাফ অবাক হয়ে বলল-
—আমার মা তো আকাশে,এটা তো আমার খামমনি।খামমনি মা হয় কিভাবে?
—তোমার বাবার আর খালামনির বিয়ে হইছে তাই ও তোমার মা।
—না , আমার খামমনি।
রুমের ভেতরে নিরবতা নেমে এলো। সবাই কি বলবে কথা খুঁজে পেলো না। অবুঝ বাচ্চাটার মনে যে ধারণা তা হঠাৎ করে এভাবে বলে বোঝানো সম্ভব না। মাতৃস্নেহ পাওয়ার মাধ্যমেই ওর মনে হিয়ার প্রতি মায়ের অনুভূতি জেগে উঠবে।

সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে,চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।দরজা খুলে বারান্দায় এলো হিয়া, লম্বা টানা বারান্দার মাঝখানে বের হওয়ার গেইট , সেটায় এখন তালা দেয়া।বাইরে একটা লাইট জ্বলছে, বারান্দার একপাশে সেই আলো পোঁছে না।
হিয়া গ্রিলে ধরে দাঁড়িয়ে দূরে তাকালো, অন্ধকার এক জায়গায় চোখ রাখলো,ঐখানেই রিয়ার কবর, বাবুর কবর।এমন তো হবার কথা ছিল না, কেন হলো,কেন হয় মানুষের চিন্তার,প্রত্যাশার, স্বপ্নের বাইরের কিছু?
—এখনো ঘুমাও নি?
হিয়া চিন্তার মাঝে এত ডুবে ছিল যে,কথাটা শুনে চমকে তাকালো।
বুঝতে পেরে আদনান বলে উঠলো-
—সরি সরি তোমাকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য।
—এখনই ঘুমাবো।
উত্তরটা এত আস্তে ছিল যে,
আদনানের কান পর্যন্ত পোঁছালো না।সে দেখলো হিয়ার ঠোঁট দুটো শুধু নড়লো,সেই সাথে দু’চোখে পানির ধারা।
কি বলবে আদনান বুঝতে পারলো না।
হিয়া চলে গেলেও আদনান গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইল।মনে মনে অনুশোচনা হতে লাগল। নিজের অজান্তেই কি হিয়াকে এতবড় কষ্টে ফেলে দিল? তার নিজের কিছুতেই রাজি হওয়া উচিৎ হয়নি। ভুল হয়ে গেল, অনেক বড় ভুল।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

১ম পর্বের লিংক

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1198804647301227/

২য় পর্বের লিংক

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1199428647238827/

৩য় পর্বের লিংক

  1. https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1200056127176079/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here