কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ০৮

||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ০৮||

পথটা ভুল জেনেও অনেকে সঠিক করার আকাঙ্খা নিয়ে সে পথে পা বাড়ায়। প্রাপ্তির খাতায় সাময়িক সুখ আর শত আঘাত লিখে যখন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না তখন আবার পুরনো অবস্থানে ফিরে আসতে চায় ঠিক পথে চলার আশায়৷ কিন্তু ততদিনে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে যা ফিরে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।

অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর এই নিয়ে চতুর্থ বারের মতো কনে দেখানো হয় প্রহেলিকে। পাত্রপক্ষ সবদিক পছন্দ করলেও মোটা হওয়ার কারণে বিয়ে পর্যন্ত কথা আর আগায় না। এতবার প্রত্যাখ্যানের পর বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় সে। নাহিয়ানের সাথে ব্রেকাপ হওয়ার পর এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে অনার্সে ইয়ার ড্রপ দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। এবার অনার্সটা শেষ করে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয়। স্বাস্থ্য কমানোর জন্য প্রথম প্রথম ডায়েট করতো কিন্তু পরবর্তীতে এসব বাদ দিয়ে কেবল সুস্থ থাকার জন্য কিছু শারিরীক ব্যায়াম করে। এই স্বাস্থ্য কমলেও তার কিছু যায় আসে না আর থাকলেও কিছু যায় আসে না। এভাবে তাকে দেখে কেউ বিয়ে করলে করুক, না করলে নেই।

কলিংবেলটা বিরতি টেনে বেজে যাচ্ছে। প্রহেলি এসে দরজা খুলতেই সামনে একজন ভদ্রলোককে দেখা যায়। চেহারাটা পরিচিত মনে হচ্ছে তবু চিনতে পারে না।

কৌতুহল ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চাই?”

“তুমি প্রহেলি না?”

ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”

“আমি মেহরাব। চিনতে পেরেছ?”

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রহেলি। তাকে চোখের সামনে জীবিত অবস্থায় দেখা যেন কল্পনা মনে হচ্ছে। এই মেহরাব যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সুইসাইড করেছিল। কিন্তু সে কীভাবে বেঁচে আছে এটাই ভাবাচ্ছে তাকে।

“ট্যাবলেট!”, প্রহেলি বেফাঁস বলে ফেলে।

মেহরাব শব্দ করে হেসে বলল, “হ্যাঁ তোমাদের সেই ট্যাবলেট। ভেতরে আসতে বলবা না?”

ভেতরে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসায় তাকে। সেদিনের ট্যাবলেট এখন আর ট্যাবলেটের মতো পিচ্চি নেই। দেখতে কেমন সাহেব সাহেব লাগছে তাকে। প্রহেলি তার সামনের সোফায় বসে পড়ে।

“তোমার মনে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন তাই না? পরিষ্কার করে দিচ্ছি সব। আসলে আমি সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছিলাম সত্যি কিন্তু সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। শরীরের বেশ কয়েকটি হাড়গোড় যদিও ভেঙে গিয়েছিল।”, বলেই আবার হেসে দেয় সে।

আরফা খাতুন আসতেই প্রহেলি তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি বাঁকা চোখে তাকিয়ে তাদের সাথে বসে পড়েন। মেহরাব মৃদু হেসে বলল, “আসলে আন্টি আমি আমার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছি। প্রহেলির কারণে আমি আমার দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। তাই তাকে আমার গুরুত্বপূর্ণ দিনটায় সবচাইতে কাছের বন্ধু হিসেবে সবকিছুতে তাকেই চাই।”

তার মেয়ে কীভাবে এই ছেলেকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে বুঝতে পারেন না আরফা খাতুন। তখন মেহরাব নিজেই বলে এসএসসি পরীক্ষার পেপার যখন রিচেক করানো হয় তখন তার ফেল এসেছিল। পরেরবার আর রিচেক করানোর কোনো মানেই ছিল না। কিন্তু প্রহেলি, পূজা মিলে সোহেল স্যারের সাহায্যে বোর্ড ফিস দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রিচেক করায় আর তখন তার রেজাল্ট পাস চলে আসে। এ+ পেয়ে পাস করে যায় সে। সেদিন যদি তারা এই সাহায্য না করতো তবে হয়তো আজ সে এই পজিশনে থাকতো না। মেহরাব আজ টেলিভিশনের একজন সংবাদ কর্মী। এটিএন নিউজের নিউজ রিপোর্টার সে। প্রহেলিকে এতদিন অনেক খুঁজেছিল সে কিন্তু কোথাও পায়নি৷ হঠাৎ করে যখন জানতে পারে সে এই শহরেই আছে তখন দেখা করতে চলে আসে৷ আর সুযোগে বিয়ের দাওয়াতটাও নিয়ে আসে। আজ প্রথম বারের মতো মেয়ের উপর গর্ভ হচ্ছে আরফা খাতুনের। চোখেমুখে মিশে আছে অপূর্ব এক হাসি। দাওয়াত গ্রহণ করেন তিনি৷ প্রহেলি যাবে বিয়েতে সাথে তিনিও যাবেন৷ বিয়ের কার্ড খুলে কনের নাম পড়ে আরেকবার চমকে উঠে প্রহেলি। মেহরাব আর কাউকে নয় তার ফুফাতো বোন এলিনাকে বিয়ে করছে! দুইদিন আগে তার ফুফু এসে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। একই কনভেনশন সেন্টারে কনে ও বরের একসাথে গায়ে হলুদ, বিয়ে ও রিসিপশনের অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে। যেকোনো একটাতে উপস্থিত থাকা মানে দুইটাতেই উপস্থিত থাকা। তাই প্রহেলিও আর মানা করে না৷

আজ মায়ের সাথে মেহরাবের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাবে প্রহেলি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নেয়। ৮০ কেজি থেকে ৬৫ কেজিতে নেমে এসেছে ওজন। অতোটাও মোটা লাগছে না তাকে। তবে গালটা একটু ফোলা ফোলা লাগছে। কিন্তু তবুও নিজের কাছেই নিজেকে আজ ভীষণ মায়াবী লাগছে। খুব পছন্দ করে একটা সাদা রঙের শাড়ি পরে নেয়। গায়ে হলুদে এটা খুব অদ্ভুত দেখাতে পারে কিন্তু কেন জানি আজ তার সাদা শাড়িটাই পরতে ইচ্ছে করছিল। মনের ইচ্ছেকে অনেকদিন পর প্রাধান্য দেয়। চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়েছে আবার কেটে কাঁধ পরিমাণ রাখতে চেয়েছিল। ছোট চুল তার পছন্দ। কিন্তু মায়ের বাঁধায় আর চুল কাটে না। হালকা করে সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে যেতেই নাহিয়ানের কথা মনে পড়ে যায়। স্মতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলে কড়া করে লিপস্টিক মেখে নেয়। ঠোঁটজোড়া খয়েরী রঙে রাঙা হয়ে আছে।

বিশাল বড়ো কনভেনশন হলকে লাল আর হলুদ ফুলে সাজানো। এমন এক বিয়ের স্বপ্ন কখনো প্রহেলিও দেখতো। এখন সব শখ মরে গেছে তার। বর-কনেকে দুই মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে স্টেজে একদল তরুণ-তরূণী গানের তালে নাচছে। ছেলেদের পরনে কড়া সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। বর কনের গায়ে হলুদ মাখানো হচ্ছে। মেহরাব প্রহেলিকে দেখে হাত তোলে ইশারা করে। একটা ছেলেকে ডেকে ফিসফিস করে বলে দেয় তার খাতির যত্নে যেন কোনো কমতি না হয়।

প্রহেলি যে চেয়ারে বসেছে সেই চেয়ারের পাশের চেয়ারে একটা চশমা পরা মেয়ে এসে বসে। একবার তার দিকে তাকিয়ে প্রহেলি আবার চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। মাকে বড়দের আড্ডায় দেখতে পায়। একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না।

পাশের মেয়েটা সহসা বলে উঠে, “আমাকেও চিনতে পারলি না?”

প্রহেলি তার দিকে ফিরে তাকায়। না, তার চিনতে আর সমস্যা হয় না। এটা তার সেই স্কুল জীবনের বান্ধবী পূজা। এতদিন পর তাকে দেখতে পেয়ে চোখে জল এসে যায়৷ পূজা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।

“কেমন আছিস রে?”

“এইতো যেমন ছিলাম।”

“শুনলাম ডাক্তার হয়ে গেছিস তুই!”

“এইতো হলাম বলে। তোর খবর বল। তুই তো অনেক সেক্সি হয়ে গেছিস।”

প্রহেলি একগাল হেসে বলল, “তুই এসব শব্দ কোত্থেকে শিখলি!”

“অনেক কিছুই শিখেছি তোদের সাথে থেকে তবে প্রয়োগ করিনি কখনো। এমন তো কথা নেই যা শিখেছি সব নিজের উপর প্রয়োগ করতে হবে। তবে আজ তোকে সত্যিই এই কথাটা বলতে মন চাইলো তাই বলে দিলাম।”

পূজার কথায় মুখটা মলিন হয়ে আসে। অপি আর ইলমার কথা শুনে যদি সেদিন সে প্রেম নামের অশ্লীলতা নিজের উপর প্রয়োগ না করতো তাহলে হয়তো আজ ভালো থাকতো। সত্যিই তো, জীবনে চলার পথে ভালো খারাপ সবার সাথেই চলতে হয়। নিজের ভালোটা নিজেকে বুঝে খারাপটা এড়িয়ে যেতে পারলেই জীবন সুন্দর। নাহলে সঙ্গ দোষে নিজেকেও দূষিত হতে হয়। নিজেকে দূষিত করে ফেলেছে প্রহেলি। এই দোষ জীবনেও ছাড়াতে পারবে না সে। এমন পাপ করেছে যা শতবার ধুইলেও যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে পূজা নাহিয়ানের কথা জিজ্ঞেস করে।

প্রহেলির মুখে সবকিছু শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটার ভয়ই ছিল আমার। কত করে বুঝিয়েছিলাম, তখন আমার কথা শুনলি না। যাক বাদ দে এসব। মানুষ মাত্রই ভুল। তবে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়াই হলো বড় কথা। তবেই এক ভুল মানুষ বারবার করে না।”

সবকথা নীরবে শুনে যায় সে। আসলেই সেদিন যদি পূজার কথা একবার শুনতো। একটু বোঝার চেষ্টা করতো! অপি এত প্রেম করে এতজনকে ঠকিয়েও কত সুখী। ইলমা যদিও তেমন ভুল করেনি তবুও সে আজ সুখী নয়। পূজা কারো সাথেও ছিল না পাছেও ছিল না সে তার ক্যারিয়ারে ফোকাস করায় আজ একজন সফল মানুষ হতে চলেছে। আর প্রহেলি মাঝ নদীতে বৈঠা ছাড়া নৌকার মতো ভাসছে। কোনো কূল ফিরে পাবে কী না কিছুই জানে না।

মেহরাবের পাশে শুভ্রত বসে আছে। প্রহেলি ভয় পাচ্ছে যদি নাহিয়ান এখানে আসে! বুকটা ধুকপুক করছে। যে মানুষটাকে সে গত দুই বছরে দেখেনি তাকে আর দেখতে চাচ্ছে না সে। সামনে আসলে আবার সব এলোমেলো হয়ে যাবে তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে। আর ভেঙে পড়তে চায় না।

এলিনার গায়ে হলুদ লাগাতেই সেও মজা করে তার গালে ও মাথায় একগাদা হলুদ মেখে দেয়। সামান্য বিরক্ত হলেও কিছু করার থাকে না তার। আদরের ছোট বোনের গায়ে হলুদ সে অনেক খুশি এই খুশিতে মন খারাপ করা যাবে না। পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশরুমে যায়। তাড়াহুড়োতে জেন্টস ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। আচমকা একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে মুখটা তুলে তাকায়।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here