||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ০৯||

||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ০৯||

সাদা টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট পরা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া সুবোধ চেহারার অপরিচিত এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে প্রহেলির সামনে। মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। ছেলেদের এমন ঝাকড়া চুল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। প্রহেলির কাছে এই ছেলেকে কিছুটা সেই কলেজ জীবনে দেখা দিয়ানের মতো লাগছে। ছেলেটা তার দিকে তখন থেকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৌজন্য মূলক একটা স্যরিও বলছে না। প্রহেলির হঠাৎ খেয়াল হয় মেয়েদের ওয়াশরুমে এই ছেলে কী করছে!

গর্জে উঠে বলল, “মেয়েদের ওয়াশরুমে ঢুকে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করতে চাচ্ছেন তাই না? আপনার মতো কিছু ছেলেরা এমনই হয়। যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুইচ্চামি করে বেড়ায়।”

জ্যাকেট ঠিক করতে করতে সে বলল, “এক্সকিউজ মি! আমি জেন্টস ওয়াশরুমেই আছি। আপনিই ভুলক্রমে…হয়তো ভুলক্রমেই এসেছেন।”

প্রহেলি ক্ষুদ্র চোখে তাকায় তার দিকে। ছেলেটা তার এলোমেলো দাঁতগুলো বের করে হাসছে! কার যেন ঠিক এমনই দাঁত দেখেছিল মনে করতে পারে না সে। এসব ভাবনা বাদ দিয়ে চট করে বাইরে গিয়ে দেখল আসলেই এটা জেন্টস ওয়াশরুম! চোখ বন্ধ করে রাগটা নিজের উপরই ঝাড়ে। ইচ্ছে করছে এখন নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলতে। এভাবে লজ্জায় পড়তে হলো তাকে। ছেলেটা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তারপর সোজা হেঁটে চলে যায়। তার এই অদ্ভুত হাসির অর্থ খুঁজে পায় না সে।

প্রহেলি মুখ থেকে হলুদ ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে বেরিয়ে আসে। সাজগোছ নষ্ট হয়ে গেছে। হলরুমে আসতেই দেখে অনেকে ওই ঝাকড়া চুলের ছেলের সাথে ছবি তুলছে। কেউ কেউ এসে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। প্রহেলি পূজার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কে রে এই ছেলে? এভাবে লোকজন তার সাথে ছবি তুলছে কেন?”

পূজা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ও মা! তুই তাকে চিনিস না?”

“না, কেন? সে কী কোনো সেলিব্রিটি?”

“সেলিব্রিটিই তো। নাম দিয়ান রহমান, জাতীয় দলের ক্রিকেট প্লেয়ার। তবে মেহরাবের হলুদে কীভাবে এলো সেটা জানি না। মেহরাবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। জানিস দিয়ান অনেক ভালো গানও গায়। চল না একটা সেল্ফি তুলে আসি।”

“তুই গেলে যা, গিয়ে সেল্ফি তুলে আয়। আমার এত শখ নেই।”

প্রহেলি এবার নিশ্চিত হয়ে নেয়, এই দিয়ানই সেই দিয়ান। যার সাথে তার চট্টগ্রামে দেখা হয়েছিল। পাড়ার মাঠে তাকে কত খেলতে দেখেছে অথচ টিভির পর্দায় কখনো দেখা হয়নি৷ মোবাইলের দিকে দৃষ্টি নামায় সে। দিয়ান রহমান লিখে গুগলে সার্চ করে। পূজা ততক্ষণে সেল্ফি তুলতে চলে গিয়েছে। দিয়ান আঁড়চোখে বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে। মোবাইল থেকে চোখ তুলতেই হাত-পা কাঁপতে লাগে প্রহেলির। তার সামনে নাহিয়ান একটা মেয়ের পিঠে হাত রেখে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলছে। সুন্দরী, আকর্ষণীয় শরীরের গঠন, অল্প বয়সী মেয়ে। হলুদাভ শাড়ি পরেছে। তার সামনে নিজেকে পান্তাভাত মনে হচ্ছে। অথচ সে নিজেও একসময় এমনই ছিল। সময়ের সাথে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়, নষ্ট হয় না তো কেবল মন। কিন্তু সেই মনের প্রাধান্য কেউ দেয় না, শরীরের প্রাধান্যই বেশি। হ্যান্ড ব্যাগের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রহেলি। চেয়ারে বসে একনাগাড়ে পা ঝাঁকাচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চিন্তায় গলা শুকিয়ে এসেছে তার। এখানে আর থাকতে পারছে না। মনে হচ্ছে এখান থেকে দূরে কোথাও চলে গেলে তবেই ভালো হবে। আরফা খাতুন সেই দূরে বসে গল্প করছেন। মায়ের কাছে যেতে হলে নাহিয়ানের সামনে দিয়ে যেতে হবে। কেন যে সে তার সামনে যেতে ভয় পাচ্ছে, নিজেও জানে না৷ হয়তো তার সাথের সুন্দরী মেয়ের সামনে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করতে লজ্জা লাগছে। তড়িঘড়ি করে কনভেনশন হল থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে আসে। একদম ডান প্রান্তে গাড়ির পাশে সিঁড়িতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ে। বুকভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাথার চুল দু’হাতে খামচে ধরে দাঁত চেপে কান্না করছে। চোখ বেয়ে জল পড়ছে অবিরাম অন্তহীন। মাথাটা হাঁটুর উপর রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।

“কেন নায়িহান! কেন! কেন এমন করলে আমার সাথে! আমার ভালোবাসার একটু দাম দিলে কী এমন হয়ে যেত তোমার! একদিন হয়তো তুমি বুঝবে কিন্তু সেদিন আমি অনেক দূরে চলে যাব। একদম তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”, বলেই সে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

নাহিয়ান অন্য সম্পর্কে কীভাবে জড়িয়ে গেল! তাদের এতশত স্মৃতি কীভাবে সে ভুলতে পারলো! কই সে তো কিছুই ভুলেনি। বিয়েটা কী আসলেই মিথ্যে ছিল তার কাছে! এসব ভাবনা তার মাথা ব্যথা শুরু করে দিয়েছে।

“কেক খাবেন? আপনার জন্য এক পিস কেক চুরি করে এনেছি।”

মুখ তুলে তাকায় প্রহেলি। চোখেমুখে অপূর্ব এক বিস্ময়! এই ছেলে তার জন্য কেন কেক এনেছে! তাও আবার চুরি করে! একজন জাতীয় দলের ক্রিকেটার, যার কাছে সকলে যায় আর সে কি-না তার কাছে এসেছে তাও কেক হাতে! প্রহেলির চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। গালদুটো জলে ভিজে একাকার।

দু’হাতে চোখ মুছে বলল, “আপনি! আপনি কেন এখানে এসেছেন? আমার পিছু নিয়েছেন?”

“ভুল বোঝা কী আপনার অভ্যাস?”

কথাটা বেশ গায়ে লাগে প্রহেলির। কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। দিয়ান চামচ দিয়ে একটু কেক বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই যে শুনুন, এদিকে নেন। মনে করুন এটা আমার দুঃখিতনামা।”

মনটা এমনিতেও খারাপ তার৷ এখন আবার এই ছেলে এসে ছ্যাঁচড়ামি করছে। এত অভিনয় এখন আর তার ভালো লাগে না। একজন তো এতটা বছর নিখুঁত অভিনয় করে জিতে গেল। আর কাউকে সে জিততে দেবে না। একজন সেলিব্রিটিকে কী এভাবে মানায়! তারা কী এমন হয়? কে জানে হলে হতেও পারে। তারাও তো আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই।

দিয়ান আবার বলল, “আপনি আমাকে হয়তো চেনেন না। কিন্তু আপনি, আপনি আমার অনেক বছরের চেনা। আর সেজন্যেই আমি এখানে বসে৷ একটু কেক খেয়েই দেখুন ভালো লাগবে।”

কেকের সাথে কিছু মিশিয়ে দিল না তো সেই ভয়টা পাচ্ছে এখন। এতবার জোর করার মানে কী! প্রহেলি তার দিকে এক পলক তাকায়। দিয়ান ক্ষীণ হেসে একটু কেক নিজের মুখে পুরে দেয়। তারপর আরেকটু কেক নিয়ে প্রহেলির মুখের সামনে ধরে। চকলেট কেক দেখে লোভ সামলাতে পারছে না সে৷ এদিকে বেশ ক্ষুধাও লেগেছে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে প্লেটের পুরো কেক সে একাই সাবাড় করে নেয়। ঠোঁটের আশেপাশে কেক লেগে আছে। এমন বাচ্চাদের মতো কেক খাওয়া দেখে হেসে দেয় দিয়ান। প্রহেলি জিভ দিয়ে ঠোঁটের আশেপাশের কেক চেটে খায়। দিয়ানের চোখের মণি স্থির নিষ্পলক তার উপর। কী এক তন্ময়তায় আছন্ন হয়ে আছে। সারামুখে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি ছড়িয়েছে। ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে চোখের নিচে লেপ্টে থাকা কাজল মুছে দিতে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য বা অনুমতি কোনোটাই তার নেই।

অপূর্ব শান্ত গলায় বলল, “আপনি অনেক সুন্দর! ঠিক যেন গোলাপি বর্ণের কোনো চন্দ্রমল্লিকা ফুল। ফুলের রাণী গোলাপ হলেও চন্দমল্লিকা আমার খুবই পছন্দ।”

চোখ উলটে তাকায় প্রহেলি। এমন অদ্ভুত কথা আজ অবধি কোনো ছেলে তাকে বলেনি৷ বলবেই বা কে! কোনো ছেলের সাথে মিশেইনি। তার পৃথিবী বলতে তো কেবল নাহিয়ান ছিল। নাহিয়ানের কারণে তাকে এতটা বছর মা ও ভাইয়ের নজর বন্দী থাকতে হয়েছে। যেখানে কোনো মেয়ে বন্ধুই হয়ে উঠেনি সেখানে ছেলে বন্ধু তো অনেক দূরের কথা। মনটা যেন আকাশের মতো হয়ে গেছে। এই কালো মেঘ এই ফকফকা পরিষ্কার।

“সত্যি করে বলুন তো, আপনি আমার পেছন পেছন কেন এসেছেন? কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”, প্রহেলি দৃঢ় কণ্ঠে বলল।

দিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজীবন মেয়েরা কী এই এক ভয় পেয়েই যাবে? তারা কী আর মন থেকে স্বাধীন হবে না? মুখেই কেবল তাদের স্বাধীনতার বাণী।”

“বলছিলাম যে, সমস্যা যতটা না আমার হবে তার থেকে দ্বিগুণ সমস্যা আপনার হবে। আগামীকাল টেলিভিশনের হেডলাইন এবং পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে আপনার ছবিসহ ছাপা হবে, ‘ক্রিকেটার দিয়ানকে দেখা গেল গাড়ির চিপায় অচেনা এক মেয়ের সাথে।’ তখন বিপদটা আপনারই হবে।”, বলেই মিহি কণ্ঠে হেসে দিল সে।

দিয়ান পরিমিত হেসে বলে, “আপনি আমায় নিয়ে বেশ ভাবছেন দেখা যাচ্ছে! এত চিন্তা! হোক না একটু গুঞ্জন। ক্ষতি কী যদি একটু বদনাম হয়ে চন্দ্রমল্লিকাকে পাওয়া যায়!”

চোখের মণিজোড়া বড় তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছে প্রহেলির। দিয়ানের চেহারায় কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। এত রহস্য রেখে কেন কথা বলছে ছেলেটা!

“কিসব আজগুবি কথাবার্তা! ক্রিকেটার নাকি কোনো কবি হ্যাঁ? এই ছেলে শোন, সেলিব্রিটি হয়ে গেছ মানে এই নয় যে যাচ্ছে তাই বলবে। তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট। তাই ভেবেচিন্তে কথা বলবে।”

হো হো শব্দে হেসে দিল সে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। মাথাটা একটুখানি হেলিয়ে বলল, “বাহ! আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন দেখছি! তা বয়সে ছোট হলেই ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয় এটা কোন ডিকশনারীতে লিখা আছে? বয়সে ছোট হলেও আমার জ্ঞান কিন্তু অনেক প্রখর। তাছাড়া আমি কোনো সেলিব্রিটি নই।”

প্রহেলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এর সাথে আর ক্যাচাল পাড়ার সময় কই তার! দ্রুত পা বাড়ায় হল রুমের দিকে। দিয়ান গলা ছেড়ে গান ধরে,

“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো?
এখন আর কেউ আটকাতে পারবেনা
সম্বন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পারো
মা কে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না…”

এত সাবলীল, গভীরতর, বলিষ্ঠ গানের সুর প্রহেলির কানে এসে মোহময় লাগছে। হৃদয় ঈষৎ স্পন্দিত করে। পা জোড়া ধীর গতিক হয়ে আসে৷ মন চাইছে মানুষটা আরো গান গেয়ে যাক আর সে নীরবে বসে শুনতে থাকুক। কাউকে মুগ্ধ করতে হলে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। সুন্দর কণ্ঠে গান গেয়েই তাকে মুগ্ধ করে নিজের ভক্ত করা যায়।

উপরে উঠার সিঁড়িতে আসতেই নাহিয়ানকে চোখের সামনে দেখতে পায়। সেই সুন্দরী মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here